বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক (Agriculture and Farmers of Bangladesh)

বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক (Agriculture and Farmers of Bangladesh)

পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থাপনার জোরে কৃষকের রক্ত পানি করা ঘামশ্রমে উৎপাদিত পণ্যই সিন্ডিকেট চক্রের সর্বোচ্চ মুনাফার ক্ষেত্র। করপোরেট শোষণব্যবস্থা একদিকে জমির উর্বরতা শক্তি নিশ্চিহ্ন করছে, অন্যদিকে বৈষম্য-বঞ্চনাজর্জরিত কৃষক শুধু নিঃস্বই হচ্ছে। এসবই সত্যি এবং তা বড়ই হতাশাজনক।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষকই অনভিজ্ঞ

অতিরিক্ত প্রতিটি জিনিসই অকল্যাণকর। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষকই অনভিজ্ঞ। ফলে এ রাসায়নিক সার তারা মনগড়াভাবে ব্যবহার করে জমির স্বাস্থ্য আরো নষ্ট করে তুলছে। তাদের ধারণা, সার বেশি দিলেই ফলন বেশি পাওয়া যায়। ভ্রান্ত ধারণাবশে ক্ষতি করছে মাটির সুস্বাস্থ্য, পাশাপাশি বিরূপ প্রভাব ফেলছে পরিবেশের ওপরও। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর সেজন্যই সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় আমাদের দেশে মৃত্তিকা সম্পদের উন্নয়ন ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হাতে নিয়েছে মৃত্তিকা গবেষণা ও গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের মতো প্রকল্প। এ গবেষণায় মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে কৃষকদের দিচ্ছে সার সুপারিশমালা। এটা অত্যন্ত সীমিত আকারে হলেও এর পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার।

অর্থনীতির যে ২১টি খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে

বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের ২১টি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক কিছু সুবিধা পেলেও অধিকাংশই বহুকষ্টে অর্জন করে নিয়েছে, যেখানে অমিত সম্ভাবনাময় কৃষি ও কৃষক সমাজই সামনে থেকে দিয়েছে নেতৃত্ব। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চীন-ভারতকেও পেছনে ফেলে বাংলাদেশ প্রথমে অবস্থান নিয়েছে। বড় দাগে অর্থনীতির যে ২১টি খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে তার মধ্যে প্রায় সবই কৃষিখাতের অন্তর্ভুক্ত।

সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির হিস্যা ছিল ১১.২২ শতাংশ (আইএমএফের মতে ১৩.০৭ শতাংশ)। অপরদিকে শিল্প ও সেবাখাতের হিস্যা যথাক্রমে ৩৩.৯২ শতাংশ ও ৫১.০৪ শতাংশ। কিন্তু কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছে মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ শতাংশ।

নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০-এ

জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) বলছে, জনসংখ্যা ও আয়তনে বিশ্বে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অনেক দেশ অপেক্ষা বহুগুণ ছোট হলেও প্রাথমিক কৃষিপণ্য (শুধু ফসল) উৎপাদনে ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ এখন ১৪তম অবস্থান নিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য ছিল ৩ হাজার ৬১১ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার সমান। এফএওর মতে, খাদ্যশস্য, ধান, গম, সবজি, মাছ, আলু, আম, পাট, গরু-ছাগল ও মৎস্য উৎপাদনে এখন বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে। নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০-এ।

যে কারণে মধ্যবিত্ত কৃষক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক একদম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাতায় নাম লেখাচ্ছেন

সরকার কৃষিতে উন্নয়নের কথা বলে বারবার বীজ, তেল, কারেন্ট বিলসহ সব কিছুর দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি করেছে। সেই সঙ্গে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে ধান মাড়াই করার ব্যয় বৃদ্ধিতে। ১ বিঘা জমির ধান কেটে বাড়ি নিয়ে এসে তা মাড়াই করতে অঞ্চলভেদে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে ধান উৎপাদনে অনেক কৃষক অনীহা দেখাচ্ছেন, যা দেশের জন্য শুভ সংবাদ নয়। ধান রোপণ থেকে শুরু করে মাড়াই করা পর্যন্ত যে খরচ হয়, সেই ধান বিক্রি করে কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। যে কারণে মধ্যবিত্ত কৃষক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক একদম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। যার প্রমাণ ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় চলে গেছে। করোনার কারণে ৫৬ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে।

কৃষিতে ৪১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়

এ দেশের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কৃষিতে ৪১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কৃষি বাংলাদেশের ১৬ দশমিক ৫ কোটি মানুষের শুধু খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করে না, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের জোগানও দেয়। 

১ লিটার পানির দাম ২৫ টাকা অথচ ১ কেজি ধানের দাম মাত্র ১২ টাকা। কৃষি উপাদান যেমন- উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের মজুরি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে; সে তুলনায় কৃষিপণ্য বিশেষত ধানের দাম নিতান্তই কৃষকদের সঙ্গে ঠাট্টার শামিল।এক কেজি গরুর গোশত কিনতে কৃষককে এক মণ অর্থাৎ ৪০ কেজি ধান বিক্রি করতে হয়। মনের ক্ষোভে কয়েকজন কৃষক নিজেরাই নিজেদের ফসলের মাঠে আগুন দিয়েছেন।

কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব?

একবার চিন্তা করে দেখুন তো, যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত; সেখানে কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব?যারা ১৮ কোটি মানুষের অন্ন জোগায়, তাদের পেটেই থাকে ক্ষুধা। এ অবস্থা প্রতিবছর ঘটতে থাকলে ফসল ফলানোর ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে কী করে? যারা আজ উচ্চশিক্ষিত সমাজে এসির বাতাসে বাসমতি চাল আর বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে, তারা কখনও কি ভেবে থাকে- এগুলো কোথা থেকে আসছে এবং কারা জোগাচ্ছে?

প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি এপ্রিল, ১৯৯৯-এ গৃহীত হয়েছিল

প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি এপ্রিল, ১৯৯৯-এ গৃহীত হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য উদ্ভূত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। কৃষি সম্পদ হ্রাস, ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে কৃষিকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষভাবে সক্ষম করে তোলা প্রয়োজন। বর্তমান কৃষি-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান কৃষিনীতিকে যুগোপযোগী করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৩-এর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে- টেকসই ও লাভজনক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফসলের উন্নত জাত ও চাষাবাদ প্রযুক্তির টেকসই উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক

কৃষকের দুর্দশার এ এক করুণ চিত্র। মফস্বলের একটি বাজারে কৃষক বেগুন বিক্রি করছে ১৫-২০ টাকা কেজি। ঢাকার মানুষ সে বেগুন কিনছে ৬০-৭০ টাকা কেজি। সরকারি হিসেবে সেল খোন্দে প্রতিমণ ধান উত্পাদনে খরচ হয়েছে ৬৭৩ টাকা। কৃষক বািক্র করেছে ৪৫০-৫০০ টাকায়। উত্পাদন খরচ উঠা তো দূরের কথা, গরু-বাছুর বিক্রি এমনকি জমি বন্ধক রেখেও কৃষক সামাল দিতে পারে না তার দুরবস্থা। সবাই জানে, বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা হয় বিভিন্ন দোকান থেকে সার তেল-বীজ বাকিতে নিয়ে জমি চাষ করে। অথবা দাদন নিয়ে আবাদ করে তাদের জমি। ফলে প্রচলিত বাজার দামের চেয়ে বেশি দামে এ সব কৃষি উপকরণ কিনতে বাধ্য হয় আমাদের কৃষক।

অ-কৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশ সরকারের অভিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসরত জনগোষ্ঠী ৫০ ভাগের নীচে নামিয়ে আনা। এ ছাড়া দেশে একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক কাঠামো বজায় রাখার জন্য প্রণীত ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১)’-তে জনগোষ্ঠির দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি, পল্লী অঞ্চলের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি, কৃষি উন্নয়ন এবং গ্রামীণ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট অ-কৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মোট দেশীয় উৎপাদনের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে কৃষি খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি একইভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ভোক্তাদের সাথে কৃষকের সরবরাহ চেইন সংযোগের মাধ্যমে কৃষিতে জিডিপি’র উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। এর ফলে দেশে দারিদ্রতা হ্্রাসের পাশাপাশি জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।

এ কীটনাশক এতটাই খারাপ যা শুধু পোকার ওপরই কার্যকর নয়, সেটা মানবদেহ ছাড়াও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে

কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে কৃষকদের শস্য উৎপাদন ক্ষমতা এবং জনগণের চাহিদার মধ্যকার ব্যবধানিরাপদ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি সম্প্রসারণে আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্ট চলছে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশের কৃষক অনভিজ্ঞ এবং বেশির ভাগই অশিক্ষিত। ফলে একবার তাদের মাথায় কোনো কিছু প্রবেশ করলে সেখান থেকে বের করে আনা অত্যন্ত কঠিন। কৃষি বিভাগ তাদের পরামর্শ দিলেও বাড়ি যেতে যেতে তারা ভুলে যায়। একসময় কৃষি বিভাগ পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিতো কৃষকদের। কীটনাশক ব্যবহার করে পোকার আক্রমণ থেকে বহুলাংশে রক্ষা পায় কৃষকের ফসল ও সবজি। ফলে তারা সব খাদ্যেই কীটনাশক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এখান থেকে তাদের বের করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে কৃষি বিভাগের পক্ষে। এ কীটনাশক এতটাই খারাপ যা শুধু পোকার ওপরই কার্যকর নয়, সেটা মানবদেহ ছাড়াও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিরাপদ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু এ প্রকল্পের সফলতা খুবই কম। এ প্রকল্পের সফলতা আনতে হলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে হবে। নিরাপদ ফসল উৎপাদনকারী কৃষককে তাদের মাধ্যমে সনদ দিতে হবে। নিরাপদ ফসল বা কীটনাশকবিহীন ফসল পেলে ক্রেতাসাধারণ দাম বেশি দিয়ে কিনতে আগ্রহী হবেন। ফলে বিষমুক্ত ফসলের চেয়ে বিষযুক্ত ফসলের বাজারমূল্য কম হবে। এ কারণে বিষযুক্ত ফসল বিক্রি কম হবে। ফলে সনদবিহীন কৃষক কৃষি সনদ ও বাজারমূল্য বেশি পাওয়ার জন্য বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে পড়বেন।

সব কৃষককে প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পভুক্ত করা সম্ভব নয়

এ জন্য প্রতিটি বাজারে একটি করে বিষমুক্ত ফসল বাজারজাতের জন্য দোকান থাকতে হবে। এত কিছুর পরও প্রতিটি প্রকল্পের একটি খারাপ দিক রয়েছে তাদের প্রচারণার অভাবে। মাঠপর্যায়ে এসব কার্যক্রম প্রকাশিত হলে প্রকল্প সম্পর্কে অন্য কৃষক সম্যক অবগত হতেন। সব কৃষককে প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পভুক্ত করা সম্ভব নয়। তাই যারা প্রকল্পভুক্ত কৃষক নন, তারা এ প্রচার থেকে উপকৃত হতে পারবেন।ন দূর করা এবং তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন দক্ষ কৃষি শ্রমিক ও শিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত মানব সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। জাতীয় কৃষি নীতির সঠিক বাস্তবায়ন ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বেগবান করবে, যার ফলশ্রুতিতে সময়ের পরিবর্তনে সামগ্রিকভাবে কৃষি একটি গতিশীল খাতে পরিণত হবে যা দেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায়। জাতীয় কৃষি নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষি ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদ সকলে তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল অবদান রাখলে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হবে।

খাদ্য নিরাপত্তার প্রথম এবং প্রধান শর্তই হচ্ছে খাদ্য জোগানের সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকা

রাস্তাঘাট, মিল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০,৩০০ হেক্টর জমি। আবাদি জমিতে বাড়ছে পুকুর ও ডেইরি খামার। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে নিবিড়ভাবে চাষ করা হচ্ছে ধান আর ধান। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ধানের সঙ্গে আনুপাতিক হারে অন্যান্য ফসলের (ডাল, তেল, শাকসবজি, ফলমূল) চাষ আশানুরূপ বাড়েনি। খাদ্য নিরাপত্তার প্রথম এবং প্রধান শর্তই হচ্ছে খাদ্য জোগানের সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকা অর্থাৎ নিশ্চিত আয়ের সংস্থান থাকা, যার দ্বারা সবাই চাহিদা ও পছন্দ মতো নিরাপদ এবং প্রয়োজনীয় আমিষসহ পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে বছরে ৮০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। সংরক্ষণের অভাবে উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন ডেনমার্ক, হল্যান্ড, ব্রাজিলের জনগণ প্রধান খাদ্য হিসেবে আলু খেয়ে থাকে। আমরা ১০০ গ্রাম চালের পরিবর্তে আলুসহ অন্যান্য সবজি ও ফল খাদ্যতালিকায় প্রতিস্থাপন করতে পারলে চালের ওপর অনেকাংশে চাপ কমবে। আর এজন্য প্রয়োজন  সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিকতা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন।

লাভজনক ও বাণিজ্যিকীকরণের অগ্রযাত্রায় কৃষি

লাভজনক ও বাণিজ্যিকীকরণের অগ্রযাত্রায় কৃষি। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন (৪৩২.১১ লাখ মেট্রিক টন) এর লক্ষ্যমাত্রা (৪১৫.৭৪ লাখ মেট্রিক টন) ছাড়িয়ে গেছে। দেশ আজ চালে উদ্বৃত্ত; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪৬ লাখ মে: টন। নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।  সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। এবছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম। আম উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

অর্থকরি ফসল চাষ ও বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে মন্ত্রণালয় কাজ করছে

ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সহায়তা অব্যাহত আছে। এছাড়াও কাজু বাদাম, কফি ইত্যাদি অর্থকরি ফসল চাষ ও বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস করার লক্ষ্যে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সারের মূল্য ৪ দফা  কমিয়ে প্রতি কেজি টিএসপি ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ টাকা, এমওপি ৭০ টাকা থেকে ১৫ টাকা, ডিএপি ৯০ টাকা থেকে ২৫ টাকায় নির্ধারণ করেছিলো। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষক পর্যায়ে ডিএপি সারের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে; কৃষকদের  জন্য এটা ছিল গত বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেরা উপহার।।

 বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে এ পর্যন্ত ৯৬০ কোটি ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৪ জন কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।

ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’ প্রবর্তনের ধারা জোরদার করা হয়েছে

ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’ প্রবর্তনের ধারা জোরদার করা হয়েছে। দেশে মোট ৪ শ ৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার ১৬ হাজার ১ শ ২৩, ইউটিউব, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন-৩ হাজার ৩শ ৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, কমিউনিটি রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বীজতুলা বিক্রয়ে ই-সেবা, পোকা দমনে পরিবেশবান্ধব ইয়েলো স্টিকি ট্র্যাপ ব্যবহার, নগর কৃষি,  ডিজিটাল কৃষি ক্যালেন্ডার বাছাই করে দেশব্যাপী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যকরি ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করেছে

সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৯৯, ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাতীয় কৃষিনীতি প্রণয়ন করেছে।  জাতীয় কৃষি স¤প্রসারণ নীতি ২০১৯ চূড়ান্তকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রসেচ নীতিমালা, জৈব কৃষিনীতি প্রণয়নসহ কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যকরি ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করেছে। কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নীতিমালা ২০১৯ প্রণীত হয়েছে, যার মাধ্যমে কৃষিতে অবদানের জন্য ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সংহত/স¤প্রসারিত হবে।   

নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে

ফসল উৎপাদেন পাশাপাশি সরকার নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষকরা কিভাবে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করে লাভবান হতে পারবে এ ব্যাপারে ব্যপক প্রচারণা দরকার। সেই সাথে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষক নিরাপদ উপায়ে যেসব ফসল উৎপাদন করবেন সেগুলো প্রয়োজনে আলাদা বাজারের ব্যবস্থা করে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

প্রয়োজনে কৃষক পর্যায় থেকে নিরাপদ কৃষি পণ্য সুপারসপ, রেস্টুরেন্ট, বড় বাজার বা বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করে দিলে কৃষক লাভবান হবে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের পণ্য অতি দ্রুত বিক্রির ঝোক বেশি থাকে। এই ঝোকটাকেই কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে দুজনেরই পকেট কাটছে। এমন অবস্থায় কৃষকদের এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে কৃষকদের সর্ব প্রথম ব্যবসায়ী মনোভাব তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক প্রান্তিক কৃষককেই ব্যবসায়ী হতে হবে। প্রত্যেকটি ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয়ের হিসাব ও আয় নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে কৃষকরা সচেতন হবেন। আর কৃষকরা সচেতন হলেই মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন।

প্রত্যেকটি কৃষককে হতে হবে এক একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

প্রত্যেকটি কৃষককে হতে হবে এক একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নিজের উৎপাদিত ফসল যতদিন তার কাছে ব্যবসায়ী মূলধন হবে ততদিন কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে না। তরমুজ নিয়ে কেন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে? তরমুজ যে কৃষক উৎপাদন করতে পারলো সেই কৃষকই বাজারে ভালো দাম পেতে পারে। ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে দুজনেরই লাভ। একজন ব্যবসায়ী কখনোই চায় না যে তার ব্যবসায় লস হোক। কিভাবে কোন পদ্ধতিতে বিক্রি করলে পণ্যটিতে বেশি লাভ হয় সেটি ঐ ব্যবসায়ী নিজেই খুঁজে বের করবেন। তেমনি কৃষকরা যদি বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে ফসল উৎপাদন করে তাহলে তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে কোনো বাধা থাকবে না। এতে ধ্বংস হবে বাজার সিন্ডিকেট, টেকসই হবে দেশের কৃষি, সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। সেই সাথে কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আর এই সবকিছু মিলিয়ে কৃষি পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, বাজারজাতকরণের ওপর কৃষকদের আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। 


তথ্যসুত্র


কৃষি ঈর্ষণীয় সাফল্য, Banglanews24,

দেশজ উৎপাদন , Dainikjamalpur.

আমাদের কৃষক, Ittefaq.

মৃত্তিকা গবেষকরা, Bonikbarta.

সমম্বিত রূপ হল কৃষিখাত, Ajkalerkhobor.

এক করুণ চিত্র, Ittefaq.

উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি , Jaijaidinbd.

ফসলের মাঠে আগুন, Jugantor.

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার , Protidinersangbad.

কৃষি খাত সঞ্জীবনী , Dailyjanakantha.

Subscribe for Daily Newsletter