আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল (Arsenic-Free Drinking Water)

আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল (Arsenic-Free Drinking Water)

বাংলাদেশের পতাকায় লাল সবুজের অর্থ মানে রক্ত রঞ্জিত লাল এবং প্রকৃতির সবুজ। কিন্তু টিউবওয়েল এর ক্ষেত্রে লাল সবুজের অর্থ হচ্ছে বিষ ও বিশুদ্ধ। আর্সেনিক সম্পর্কে সকলেই পড়েছি। কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আসলে কতটুকু জানি! মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে সকলে এটাকে গুরুত্ব সহকারে দেখে না। কিছুদিন আগে শেষ হলো বাড়িবাড়ি গিয়ে টিউবওয়েল পরীক্ষার কাজ। আর্সেনিক একটি রাসায়নিক পদার্থ যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মানবদেহে আর্সেনিক বিষক্রিয়া হয়

আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মানবদেহে আর্সেনিক বিষক্রিয়া হয়। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো হলো জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, শরীরে অস্বাভাবিক ব্যথা, রক্ত আমাশয়, উদরাময়, ত্বকে কালো দাগ, হাত পায়ের তালু খসখসে হয়ে ফেটে যাওয়া, মুখের ভিতরে ঘা, পেটের সমস্যা, কিডনির সমস্যা, ফুসফুস সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে শরীরের ভিতর ও বাহিরে জটিল রোগ বাসা বাঁধতে পারে। এ পানি পান করলে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হতে পারে। যেমন, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি। এছাড়া আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে স্নায়ুবিক সমস্যা হতে পারে। যেমন, স্মৃতিভ্রম, মাথাব্যথা, অবসাদ, খিঁচুনি ইত্যাদি।

১০ হাজার নিরাপদ পানির উৎস সৃষ্টি করতে গভীর নলকূপ, আরও প্লান্ট, সিটকে প্লান্টসহ বিভিন্ন প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছে

গোপালগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলার ৭৫ ভাগ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও আয়রন থাকায় তা ব্যবহারের অনুপযোগী। নিরাপদ পানি সরবরাহে পাঁচ উপজেলায় ১০ হাজার নিরাপদ পানির উৎস সৃষ্টি করতে গভীর নলকূপ, আরও প্লান্ট, সিটকে প্লান্টসহ বিভিন্ন প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। আগামী তিন অর্থ বছরের মধ্যে বাকি পানির উৎস গুলো স্থাপন করে গোপালগঞ্জে আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হবে। 

মূলত ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় পানিতে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে ক্রমাগত

আর্সেনিক মূলত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখনই এই পানি ব্যবহারকারীর শরীরে নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে সেই উপসর্গগুলিকে রোগব্যাধির মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। ২০০৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশের ১৩৭ মিলিয়ন-এরও বেশি মানুষ, খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। কিন্তু এই বৈশ্বিক বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার ভূমি সেখানে বাংলাদেশের ভূমিকেও আর্সেনিক দূষণ গ্রাস করেছে। মূলত ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় পানিতে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে ক্রমাগত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানি দূষিত। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানিকে নিরাপদ পানি বলা যাবে না।

আর্সেনিক আক্রান্ত  হয়ে অসুস্থতার লক্ষণগুলো

আর্সেনিক আক্রান্ত  হয়ে অসুস্থতার লক্ষণগুলোর মধ্যে শরীরের চামড়ার উপর ছোট ছোট কালো দাগ এবং হাত ও পায়ের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া অন্যতম। কিছুদিন এভাবে থাকার পর কোনো কোনো রোগীর চামড়া ও প্রস্রাবের থলি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার কারো কারো লিভার ও ফুসফুসের ব্যাধিও দেখা দিতে পারে। ফুসফুসের অসুখে কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্টের ফলে অনেকে ভালোভাবে কাজকর্ম করতে পারে না। শরীরে দুর্বলতাও দেখা দেয়। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী পানীয় জলে আর্সেনিক মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের কম হলে সেটি নিরাপদ। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটি ১০ মাইক্রোগ্রামের কম হতে হবে (তথ্যসূত্র : বিবিএস)।

আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত

 স্থানীয় একাধিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে অন্তত দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর্সেনিককে  চিহ্নিত করেছে ‘মানব ইতিহাসের সব চাইতে বড় গণ বিষক্রিয়া’ হিসেবে। আগাছা ও কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ আর্সেনিক দূষণের একটি প্রধান উৎস হতে পারে বলেও মত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার। উচ্চ চাপযুক্ত স্প্রের ব্যবহার শুধু মাটি ও গাছপালার দূষণই ঘটায় না, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাতাস ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক ছিটানো পরিত্যক্ত তুলা ক্ষেত পোড়ালে  বায়ুদূষণ ঘটে। আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। পৃথিবীর ৫০টি দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে।

আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে

তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বাধিক দূষণ আক্রান্ত এলাকা হচ্ছে- ল্যাটিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া); দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার) ও দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তন)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আগে থেকে ওষুধ হিসেবে এর প্রচলন ছিল। কীটনাশকের যৌগ হিসেবে আর্সেনিকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যণীয়।

প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে আর্সেনিক বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য আপাতত প্রতিরোধক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযোগী

প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে আর্সেনিক বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য আপাতত প্রতিরোধক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযোগী। ব্যক্তি পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার না করা। নিকটে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ পাওয়া না গেলে পুকুর বা নদী হতে ১ কলসি পানিতে আধা চামচ ফিটকিরি মিশিয়ে ২-৩ ঘণ্টা রেখে দিয়ে, পরে উপর থেকে তলানিবিহীন পরিষ্কার পানি পান করতে হবে। বৃষ্টির পানি যেহেতু আর্সেনিকমুক্ত, তাই বৃষ্টি আরম্ভ হবার ৫ মিনিট পর সরাসরি পরিষ্কার পাত্রে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা পান করতে হবে।

আর্সেনিক মুক্ত করার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে ‘তিন কলসি পদ্ধতি’

স্থানীয়ভাবে আর্সেনিকমুক্ত পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে ‘তিন কলসি পদ্ধতি’। এজন্য তিনটি কলসি একটির উপর অপরটি রাখতে হয়। সবচেয়ে উপরের কলসিতে রাখতে হয় লোহার কণা ও মোটা দানার বালু; মাঝখানের কলসিতে রাখতে হয় কাঠ কয়লা ও মিহি দানার বালু এবং একেবারে নিচের কলসি থাকে খালি। আর্সেনিকযুক্ত পানি এনে ঢালতে হয় সর্বউপরের পাত্রে, তা ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ ও আর্সেনিকমুক্ত হয়ে জমা হয় সবচেয়ে নীচর কলসিতে। এ পদ্ধতিতে আর্সেনিকের মাত্রা অন্ততপক্ষে ৫০ পিপিবি (১ বিলিয়নে ৫০ শতাংশ)-এর নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। অবশ্য বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারি উদ্যোগে আর্সেনিক সমস্যায় কবলিত অঞ্চলে আনুমানিক ১৫০ মিটার গভীর  নলকূপ খনন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করছে। পাশাপাশি ভূউপরিস্থ পানি ব্যবাহারকে উৎসাহিত করছে।

মানুষকে সচেতন করতে পারলে আর্সেনিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলবে

তবে ঘনঘন বন্যা, ভূমিধ্বস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পানির উৎস দূষিত হয়। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশদূষণও বাংলাদেশে পানির গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে পারলে আর্সেনিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলবে। 

শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান

গবেষক ড. জিনি পেসোলা স্পষ্ট করে বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ ধূমপান। কিন্তু অধূমপায়ীরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।’ এছাড়া আমরা জানতে পেরেছি, আর্সেনিকে আক্রান্তের কারণে ক্যানসার সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও নিস্তেজ হয়ে যায়। আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই হাতে-পায়ে ফোস্কা এবং আঙুলের মাথায় পচন ধরে। এছাড়া অনেকেরই বুকে-পিঠে কিংবা জিহ্বা ও মাড়িতে ঘাঁয়ের সৃষ্টি হচ্ছে, যা পরে মারাত্মক ক্যানসারে রূপ নেয়। অনেকের আবার কিডনি, যকৃৎ বিকল হয়ে পড়ে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে এটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

নীরবে-নিভৃতে ঘাতক ব্যাধির প্রসার ঘটছে

শুধু যে নলকূপের পানি পান করে মানুষ আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের ৪৩টি জেলার মানুষ বোরো ধানের চালের ভাত খেয়েও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ধানের ভাত খাচ্ছে সমগ্র দেশের মানুষই, ফলে নীরবে-নিভৃতে ঘাতক ব্যাধির প্রসার ঘটছে। যেহেতু বোরো ধান চাষে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দেওয়া হয়, সেহেতু ঐ ফসল আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হয়।

আর্সেনিক আসলে কী?

আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এখনো জানেন না আর্সেনিক আসলে কী? তারা আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে (বিশেষ করে হাতের তালু, পায়ের তালু কিংবা শরীরে কালচে বাদামি রঙের দাগ নিয়ে) কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে মামুলি চর্মরোগ হয়েছে বলে জেনে আসেন। এতে করে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তারা যে মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এই আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে তাদের প্রস্রাবে ১০০ থেকে ১৮০ শতাংশ বেশি আর্সেনিক রয়েছে, যার ফলে মৃতু্য অবধারিত। এ থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই বলেও দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেই বললেই চলে

বিশেষজ্ঞরা আরো একটি ভয়ানক তথ্য জানিয়েছেন, ‘আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেই বললেই চলে।’ তবে তারা সামান্য আশার আলো দেখিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে দিলে সেই রোগী স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারেন, যা দেশের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য মোটেও সম্ভব নয়। এই হতাশাজনক সংবাদটি শোনার পর আমাদের করার কিছু নেই মনে করে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না।

এই মহামারি থেকে মুক্তি পেতে জনগণকে নিরাপদ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে

এই মহামারি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। জনগণকে নিরাপদ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে উৎসাহিত করতে হবে বৃষ্টির পানি পানে। তার সঙ্গে জানাতে হবে সহজ উপায়ে বৃষ্টির পানি ধারণ ও সংরক্ষণের অত্যাধুনিক কৌশল। জানাতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করে মাটির উপরিভাগের পানি বেশি ব্যবহার করতে হবে। তার সঙ্গে আরো জানাতে হবে, পানযোগ্য পানির উৎসের আশপাশে টয়লেট স্থাপন করা যাবে না। কারণ টয়লেটের বর্জে্য মাটির কম্পোজিশন ঘটে, যাতে পানি দূষণ ঘটায় দ্রুত। এর জন্য অবশ্য ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে এনজিও, পরিবেশবাদী সংগঠন ও আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন, তাহলে আক্রান্েতর সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

প্রকৃতিতে সাধারণত দুই প্রকার আর্সেনিক বিদ্যমান—জৈব ও অজৈব আর্সেনিক

বিজ্ঞান বলে, আর্সেনিক একধরনের ধূসর ধাতব পদার্থ। একে সহজে ভেঙে গুঁড়া করা যায়। প্রকৃতিতে সাধারণত দুই প্রকার আর্সেনিক বিদ্যমান—জৈব ও অজৈব আর্সেনিক।জৈব অপেক্ষা অজৈব আর্সেনিক বেশি ক্ষতিকর। পানিতে প্রধানত অজৈব আর্সেনিক বেশি পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোয় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পেয়েছে ২ থেকে ২.৫ পিপিএম, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতিমধ্যে এর প্রতিফলনও ঘটেছে ব্যাপক হারে; বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় রীতিমতো দুর্যোগ আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখন আর্সেনিক-ঝুঁকির সম্মুখীন

যদিও দেশের ৬১ জেলায় আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্তের খবর পাওয়া গেছে। তথাপিও উত্তরাঞ্চলের তুলনায় অন্য সব জেলা কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখন আর্সেনিক-ঝুঁকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ২৬৪ উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। বলে রাখা ভালো, ২৬৪ উপজেলায় আর্সেনিক এক দিনেই আক্রমণ করেনি। এটি ধীরে ধীরে মাটির নিচ দিয়ে ছড়িয়েছে; যা এখনো রীতিমতো ছড়াচ্ছে (উল্লেখ্য, আর্সেনিক মাটির নিচ দিয়ে দ্রুত ছড়াতে সক্ষম), যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ একটু পরেই বলব। তার আগে জেনে নিই গবেষণার আরেকটি ফলাফল।

নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. জিনি পেসোলা বাংলাদেশের ১২ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন

কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. জিনি পেসোলা তাঁর দলবল নিয়ে আর্সেনিক আক্রান্ত বাংলাদেশের ১২ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, আর্সেনিকের কারণে অধূমপায়ী ব্যক্তিরাও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, যা এর আগে জানা যায়নি। গবেষক ড. জিনি পেসোলা স্পষ্ট করে বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ ধূমপান। কিন্তু অধূমপায়ীরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।’ এ ছাড়া আমরা জানতে পেরেছি, আর্সেনিক আক্রান্তের ফলে ক্যানসার সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও নিস্তেজ হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই হাতে-পায়ে ফোসকা এবং আঙুলের মাথায় পচন ধরে। অনেকের বুকে-পিঠে কিংবা জিহ্বা, মাড়িতে ঘায়ের সৃষ্টি হয়, যা পরে মারাত্মক ক্যানসারে রূপ নেয়। অনেকের আবার কিডনি, যকৃৎ বিকল হয়ে পড়ে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে এটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

এক লিটার পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক থাকলে তা নিরাপদ

গত ২০ বছরে দেশে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। তবে এখনো দেশের ১৪ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।দেশের নলকূপে আর্সেনিকের মানমাত্রা নিয়ে করা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক লিটার পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক থাকলে তা নিরাপদ, সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মান এবং দেশীয় মানে পার্থক্য রয়েছে। ওই সমীক্ষা সরকার নির্ধারিত মান ধরে করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রা অনুযায়ী করলে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা আরও বাড়বে।

দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। তখন দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। এরপর ২০ বছরে কোনো সমীক্ষা হয়নি। ফলে দেশের কত সংখ্যক নলকূপে এখন সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে না।

২০১৯ সালে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর

২০১৯ সালে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। পার্বত্য জেলাগুলোসহ ১০টি জেলা ছাড়া বাকি ৫৪ জেলায় কমবেশি আর্সেনিকের প্রকোপ রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫৪ জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়েছে।প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৩ হাজার ২০০টি ইউনিয়নের নলকূপ পরীক্ষা করা হয়। ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮০টি নলকূপ পরীক্ষা করে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৮টি নলকূপে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়, শতাংশের হিসেবে যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। প্রকল্পের পরিচালক বিধান চন্দ্র দে প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ বছরে আর্সেনিক দূষণের পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে। অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমেছে। লোকজন আর্সেনিক বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।

সবচেয়ে কম আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ রয়েছে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর ও গাজীপুর জেলায়

সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি গোপালগঞ্জ জেলার ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। চাঁদপুরের ৫১ দশমিক ৩৫, কুমিল্লার ৪৪ দশমিক ৯১, সাতক্ষীরার ৪০ দশমিক ৮৫ এবং লক্ষ্মীপুরের ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ রয়েছে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর ও গাজীপুর জেলায়।

পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে

আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। যখন এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন মানবদেহে নানা রোগের উপসর্গ তৈরি করে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৬০ দশকে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামে। এরপর ১৯৯৩ সালে তা দশমিক শূন্য ১ মিলিগ্রামে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৬৩ সালের সেই মাত্রা আর পরিবর্তন করেনি। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সে পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

যাদের শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ধরা পড়ে, তাদের ‘আর্সেনিকোসিসে’ আক্রান্ত রোগী বলা হয়

যাদের শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ধরা পড়ে, তাদের ‘আর্সেনিকোসিসে’ আক্রান্ত রোগী বলা হয়। দেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বা তাদের চিকিৎসা–পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সেই হিসাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।


তথ্যসুত্র

মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা, Prothomalo.

বিষক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হয়, Ajkerpatrika.

আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই, Ittefaq.

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার, Ajkerkhobor.

আর্সেনিক সম্পর্কে সকলেই পড়েছি, Dailysangram.

আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ পানি , Ittefaq.

Subscribe for Daily Newsletter