বাংলাদেশের বন্যা (Flood in Bangladesh)

বাংলাদেশের বন্যা (Flood in Bangladesh)

বন্যা সাধারণত মৌসুমী ঋতুতে হয়ে থাকে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর)। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা (১৮%) বন্যায় প্লাবিত হয়। অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে। অর্থ্যাৎ দেখা যায়, প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়ে থাকে।

কারণ বাংলাদেশ অনেক নদীর দেশ, ব্রহ্মপুত্র নদের ব-দ্বীপ এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত অনেক শাখা নদীতে অবস্থিত হওয়ার কারণে এটি বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ।বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস বাংলাদেশে বর্ষা ঋতু। এই সময়ে প্রধান নদী ও উপনদীগুলো হিমালয়ের বরফগলা ও বৃষ্টিতে পানির উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং বন্যায় প্লাবিত হয়। কিন্তু চলতি বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত ২১ টি জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী। তৃতীয়বারের মতো বাড়ছে পানি। বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগস্টের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ রকমের বন্যা হয়েছে বেশ কয়েকবার

‘৮৭ সালের বন্যা

১৯৮৭ জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৪০% এরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ার নিচের অঞ্চল, খুলনার উত্তরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।

‘৮৮ সালের বন্যা

‘৮৮ সালের বন্যা। Taken from ADST

১৯৮৮-র বন্যা ছিলো বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায়। বেশ কয়েকটি স্থানে এই বন্যা ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। এটি ছিলো এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়-ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বব্যাপী গণ-মাধ্যমেও সেই সময় এই দুর্যোগটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়। বন্যার মূল কারণ ছিলো সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত। এবং একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়। এই বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গ কিমি (সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক) এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

‘৯৮ সালের বন্যা

১৯৯৮ সালের বন্যা হয় আগস্ট মাসে। এতে ৬৮ শতাংশ এলাকার ১ লাখ ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। বন্যার ব্যাপ্তি অনুযায়ী এটি ১৯৮৮ সালের বন্যার সাথে তুলনীয়। ব্যাপক বৃষ্টিপাত, একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ ঘটার ফলে ও ব্যাক ওয়াটার এ্যাফেক্টের কারণে এই বন্যা ঘটে।

‘০৪ সালের বন্যা

২০০৪ সালে বন্যা হয় জুলাই মাসে। এতে বাংলাদেশের ৩৮ শতাংশ এলাকার ৫৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়।

‘০৭ সালের বন্যা

২০০৭ সালের বন্যাকে মহাবন্যা বলা হয়। ২০০৭ সালের বন্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এতে দেশের ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। যার মোট আয়তন ৬২ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়

১৭ সালের বন্যা

বাংলাদেশে এলাকাভেদে ২০১৭ সালের বন্যা ‘ভয়াবহ’ এবং ‘অতি ভয়াবহ’ পর্যায়ের ছিল। তবে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের তুলনায় ২০১৭ সালের বন্যাকে সারা দেশের জন্য ভয়াবহ বলা যাবে না। তবে পানিপ্রবাহ ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় বন্যাকে এলাকাভিত্তিক হিসাবে ভয়াবহ থেকে অতি ভয়াবহ বলা যায়। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এসব জেলায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতিও হয় অনেক। বন্যার পানির তোড়ে সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ ও রেললাইন বিধ্বস্ত হয়। একই মাত্রার বন্যা হয় এবার ভারত, নেপাল ও ভুটানে।

বন্যা পরবর্তী দৃশ্যও করুণ। নানা প্রকার ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়। পেটের পীড়া, আমাশা, সর্দি, জ্বর, কাশি ইত্যাদি হয়। বন্যার সময় তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। নদীর তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বন্যা। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাঙ্খিত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ও এর ক্ষয়-ক্ষতির সীমা যাতে ছাড়িয়ে না যায় তা লক্ষ্য করা আমাদের জরুরী।


বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন-

(১) মৌসুমি বন্যা: এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

(২) আকস্মিক বন্যা: আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয় আকস্মিক বন্যা। এতে করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় এবং মানুষ ও পশুপাখি চরম দুর্ভোগে পড়ে।

(৩) জোয়ার সৃষ্ট বন্যা: সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ২ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে। এই বন্যা জানমালের তেমন ক্ষতি হয় না।


এছাড়াও আমরা বন্যাকে আরো চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি।

(১) সাধারণ বন্যা: যা প্রতিবছরই আমাদের দেশে সংঘটিত হয়।

(২) তীব্র বন্যা: কয়েক বছর পর পর সংঘটিত হয়।

(৩) মারাত্মক বন্যা: গড়ে প্রতি ৫ বছর অন্তর হয়।

(৪) প্রলয়ংকরী বন্যা: গড়ে প্রতি ১০ বছর অন্তর হয়ে থাকে।

বন্যার কারণ: বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে বন্যা সংঘটিত হয়। বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী কারণগুলি হচ্ছে-

(১) অতিবর্ষণ বন্যার অন্যতম একটি কারণ। পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টি বহুল এলাকা চেরাপুঞ্জি মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। তাই এ অঞ্চলে অধিক বৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা দেখা দেয়।

(২) সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থানের কারণে বন্যা দেখা দেয়। যার উপর দিয়ে এদেশের প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। নদীগুলি তাদের শাখা-প্রশাখা এবং উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যাস নিষ্কাশন জালিকা গড়ে তুলেছে। ফলে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে।

(৩) ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বন্যা দেখা দেয়। এদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এ প্রধান তিনটি নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬-৭ মিটার উঁচু। ফলে বর্ষাকালে যখন তিনটি নদীর বিশাল অববাহিকায় পানি এক সঙ্গে এসে পড়ে তখন বাংলাদেশে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে তা থেকে বন্যার সৃষ্টি হয়।

(৪) দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে এদেশে বেশী বন্যা দেখা দেয়।

(৫) দেশের প্রায় নিম্নাঞ্চল ভরাটের ফলে নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে তা থেকে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়।

(৬) হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন বন্যার আরেকটি কারণ। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বতমালা হিমালয় আমাদের দেশে অবস্থিত। গ্রীষ্মকালে তাপে বরফ গলে কোটি কোটি কিউসেক পানি গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়।

(৭) প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তারের কারণে বন্যা দেখা দেয়।

(৮) গাছপালা কেটে অরণ্য নিধন করা হচ্ছে। গাছপালার শিকড়ে বাধা পেয়ে অনেক বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে চলে যায়। কিন্তু গাছপালাও বনাঞ্চল উজাড় করার


খুলনা জেলায় নদীর বাঁধ। Taken from Flickr

বন্যার প্রতিকার: বন্যার প্রতিকার কিভাবে করা যাবে তা নিয়ে হয়তো আমরা অনেকে চিন্তা করি না। আমরা বন্যা সমস্যার প্রতিকার গুলো জেনে নিই:

(১) বন্যা সর্ম্পকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

(২) ত্রাণ সামগ্রী মজবুত রাখতে হবে।

(৩) প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বহুতল আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।

(৪) উজান এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে বর্ষাকালে নদীর উদ্বৃত্ত পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

(৫) নদীর উপচানো পানি প্রতিরোধে সারাদেশে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

(৬) বর্তমানে যেসব বেড়িবাঁধ আছে সেগুলো উচু করতে হবে।

(৭) পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিস্তৃত করে দিতে হবে।

(৮) রাস্তাঘাটের মাঝে মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ কালভার্টসহ পানি সরবরাহ পথের সৃষ্টি করতে হবে।

(৯) ভরাট নদী-নালা সংস্কারের মাধ্যমে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

(১০) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

(১১) আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা গ্রহণের মাধ্যমে বৃহৎ নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

(১২) নদীর পাড়সহ সারাদেশে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় বন্যা আমাদের জীবনে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে ।


তথ্যসুত্র:

বাংলাদেশে বন্যা, Wikipedia.

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ যত বন্যা, Bangla Insider.

বাংলাদেশের বন্যার কারণ ও প্রতিকার | শব্দনীড়, Shobdonir.

Subscribe for Daily Newsletter