বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (Bangladesh National Museum)

জাদুঘর শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে আসা, অর্থ মায়াজাল। উর্দুতে জাদুঘরকে বলা হয় আজবখানা। অতীতে জাদুঘর আজবখানা ছিল কি না জানা না গেলেও বর্তমানে এর অর্থ ব্যাপক। আর জাতীয় জাদুঘরের অর্থ তো আরো বিস্তৃত। জাতীয় জাদুঘর কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, কৃষ্টি, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে নিরাপদ পরিবেশে প্রদর্শনের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের প্রথম জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে।জাদুঘরে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বস্তুসমূহ সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয় এবং সেগুলি প্রদর্শ আধার বা ডিসপ্লে কেসের মধ্যে রেখে স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে জনসাধারণের সমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ বড় জাদুঘরই প্রধান প্রধান শহরগুলিতে অবস্থিত।
বর্তমান জাদুঘর ভবনটির নকশা
বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের পূর্ব নাম হলো ‘ঢাকা জাদুঘর’। ১৯১৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালের ১৭ই নভেম্বর সরকার জাতীয় জাদুঘরের নতুন ভবন উদ্বোধনের মাধ্যমে এটিকে একটি আধুনিক জাদুঘরের মর্যাদায় সমাসীন করেন। স্থপতি মোস্তফা কামাল বর্তমান জাদুঘর ভবনটির নকশা অঙ্কন করেন। এটি তিন তলাবিশিষ্ট। দ্বিতীয় তলায় বাংলাদেশ পরিচিতি, গ্রামীণ বাংলাদেশ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বাংলাদেশের শিলা ও খনিজ নিদর্শন, ফুলফল, লতাপাতাসহ বিভিন্ন জীবজন্তু, কাঠ ও মৃৎশিল্পের শিল্পকর্ম। এছাড়াও রয়েছে পাথরের ভাস্কর্য, লেখামালা, মুদ্রা, পদক, অলঙ্কার এবং হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম। তৃতীয় তলায় রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, কাচ ও চীনা মাটির শিল্পকর্মসহ বাংলাদেশের বাদ্যযন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, নকশি কাঁথা, বিভিন্ন চিত্রকথা ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যভিত্তিক চিত্র। এদেশের প্রাচীনকালের কৃষ্টি ও শিল্প সাহিত্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, পুরনো দিনের রাজা-বাদশাদের ব্যবহৃত পোশাক পরিচ্ছদ, তৈজসপত্র, রণসম্ভার এবং ভাস্কর্য ও চিত্রকলাসমূহ অত্যন্ত সুন্দরভাবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। নিচতলায় অফিস ও হল রুম রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর শুধু বাংলাদেশেরই নয় এটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ জাদুঘর ও সংগ্রহশালার মধ্যে অন্যতম। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে ৮.৬৩ একর জমির উপর একটি চারতলা ভবনে জাদুঘরটি অবস্থিত। এ জাদুঘরে ৪০ টির উপর প্রদর্শনী কক্ষ, তিনটি অডিটোরিয়াম, একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও দুটি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে,যেখানে ৪০ হাজারের ও বেশী বই রয়েছে । এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চারটি শাখা জাদুঘর। রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সংগ্রহশালা।
জাদুঘর স্থাপনার ইতিহাস
১৮৫৬ সালে প্রথম জাদুঘর স্থাপনার দাবী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।কিন্তু উনিশ শতকে জাদুঘর স্থাপনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ হয়নি।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় লর্ড কার্জনকে জাদুঘর স্থাপনার পুনরায় দাবী পেশ করা হয়।ঢাকাকে যখন বাংলা ও আসামের রাজধানী করা হয়,তখন আবার পত্রিকার মাধ্যমে দাবী উত্থাপন করা হয়।বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ১৯১২ সালের ২৫শে জুলাই নর্থব্রুক হলে তাকে নাগরিকসংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকগণ লর্ড কারমাইকেলকে এখানে একটি জাদুঘর স্থাপনের দাবি জানান। এ দাবির সপক্ষে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়ে লর্ড কারমাইকেল জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য ২,০০০ রুপি মঞ্জুর করেন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘর স্থাপনের সরকারি অনুমোদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় এবং ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই বছরের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ঢাকা জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ১৮ নভেম্বর বেঙ্গল গভর্নমেন্ট সাময়িক নির্বাহী কমিটি কর্তৃক প্রণীত খসড়া জাদুঘর নীতিমালা অনুমোদন করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর নিযুক্ত করা হয়। ড. এন. গুপ্তকে প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শন সংগ্রহ ও গ্যালারি উপস্থাপনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন জাদুঘরের মোট নিদর্শনের সংখ্যা ছিল ৩৭৯টি।
প্রথমে তৎকালীন সচিবালয়ের (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষ জাদুঘরের নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু জাদুঘরের নিদর্শন সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১৫ সালের জুলাই জাদুঘরটি নিমতলীতে অবস্থিত ঢাকার নায়েব নাজিমদের বারোদূয়ারি ভবনে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে এটি শাহবাগের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়।১৯১৪ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর প্রথম এক বছরে মোট ৪,৪৫৩ জন দর্শক জাদুঘর পরিদর্শন করেছিলেন।
১৯১২ সালে লর্ড কারমাইকেল ঢাকা সফরে এলে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর কাছে ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ঢাকাবাসীর এ দাবির প্রেক্ষিতে ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়। সেদিন লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন এবং বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) ঢাকা জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর প্রথমবারের মতো দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯১৫ সালে এ জাদুঘর নিমতলীর বারোদুয়ারিতে স্থানান্তর হয়। এরপর থেকে জাদুঘরে নিদর্শন সংগ্রহে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় এ জাদুঘরে নিদর্শন সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার। ১৯৬৬ সালে শাহবাগে ঢাকার কেন্দ্রীয় জাদুঘর নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। ঢাকা জাদুঘরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ১৯৭০ সালে ঢাকা মিউজিয়াম (বোর্ড অব ট্যাস্টিজ) অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়।
সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় জাদুঘর নির্মাণের প্রয়োজনটা আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শাহবাগের নবনির্মিত ভবনে জাতীয় জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা জাদুঘরের সংগৃহীত নিদর্শনগুলো জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয় তখন। একই সঙ্গে সারা দেশ থেকে নিদর্শন সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এভাবে নিদর্শনের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬ হাজারে।
প্রায় সাড়ে আট একর পরিমাণ জমির ওপর গড়ে ওঠা চারতলাবিশিষ্ট এ ভবনে নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য রয়েছে ৪৫টি গ্যালারি। দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় অবস্থিত এ গ্যালারিগুলোতে ৩০ হাজার নিদর্শন উপস্থাপিত আছে। বাকি নিদর্শনগুলো আছে গুদামজাত অবস্থায়। পালা করে এসব নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়।
জাতীয় জাদুঘরের নিদর্শন সমূহ
প্রশাসন ও সাংগঠনিক কাঠামো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় জাদুঘর পরিচালিত হয়।জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জাতীয় জাদুঘরে চারটি বিশেষায়িত কিউরেটোরিয়াল বিভাগ রয়েছে। সেগুলি হলো ১. প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, ২. ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগ, ৩. জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ এবং ৪. সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ। এছাড়াও রয়েছে আরো তিনটি সহযোগী বিভাগ। এগুলি হলো ১. সংরক্ষণ রসায়নাগার, ২. জনশিক্ষা বিভাগ ও ৩. প্রশাসন বিভাগ।
জাদুঘরের নিদর্শন ও গ্যালারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি বহুবিদ্যা সমন্বিত জাদুঘর। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত নিদর্শনাদি জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহভুক্ত মোট নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৮৬,০০০।
জাদুঘরের দ্বিতীয় তলাটি যেন পুরো বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে শুরু হওয়া এই তলাতে আরো দেখতে পাবেন বাংলাদেশের গাছপালা, প্রাণী, সুন্দরবন,ভূপ্রকৃতি, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, গাছপালা, ফলমূল, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীবজন্তুও এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।আরো আছে উপজাতীয়দের জীবনধারা,খনিজ শিলা,ভাস্কর্য, মুদ্রা এনং প্রাচীন যুগের নানাবিধ ভাস্কর্য।
ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগ
ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগ জাতীয় জাদুঘরের সবচেয়ে বড় বিভাগ। জাতীয় জাদুঘরের ৮৬ হাজার নিদর্শনের মধ্যে প্রায় ৬৮ হাজারই এ বিভাগের নিদর্শন। এ বিভাগের অধীনে রয়েছে ১১টি গ্যালারি, যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক দলিলপত্রের মাধ্যমে বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিভাগের নিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক হলো মুদ্রা। প্রাচীন ও মধ্যযুগ এবং ব্রিটিশ আমলের প্রায় ৫৩,০০০ মুদ্রা এ বিভাগে সংরক্ষিত রয়েছে। কুষাণ, গুপ্ত, ময়নামতি স্বর্ণমুদ্রা এবং সুলতানী ও মুগল আমলের স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা এ বিভাগের মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ বিভাগের অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর ভাস্কর্য, প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শনসমূহ,শিলালিপি ও তাম্রলিপি, মৃৎপাত্র, পান্ডুলিপি, ঐতিহাসিক দলিলপত্র, কৃতিসন্তানদের ব্যক্তিগত স্মৃতি নিদর্শন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও আলোকচিত্র।
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণীয় দিক হলো প্রাচীন যুগের হিন্দু-বৌদ্ধ ভাস্কর্য। অলংকরণ ও কারুকার্যে এসব ভাস্কর্য সারা পৃথিবীতে অনন্য। এছাড়াও প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভবনগাত্রের অলংকরণে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরণের পোড়ামাটির ফলক বিশেষ করে মহাস্থানগড়, ময়নামতী, পাহাড়পুর ও মধ্যযুগের মন্দির, মসজিদে ব্যবহূত অলংকৃত পোড়ামাটির ফলকগুলি এ বিভাগের গ্যালারীর অন্যতম সংগ্রহ।
তৃতীয় তলার ৩টি গ্যালারিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব গ্যালারিতে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র ও দলিলপত্র,শহীদ মিনারের ভাঙা অংশ,মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল,রক্তে ভেজা জামাকাপড়, ৭ই মার্চের ভাষণের বৃহৎ আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার, শরণার্থী শিবির ও গণহত্যার মর্মস্পর্শী আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র, অস্ত্র সমর্পণ ও দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্যাবলীর আলোকচিত্র, যা একটি সাহসী জাতির গৌরবময় ঐতিহাসিক উত্থানের সাক্ষ্য বহন করছে।
জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ
জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ জাতিতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে ১৬টি গ্যালারি, যেখানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিভাগের সংগ্রহে সংরক্ষিত নিদর্শনাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী ও সামাজিক পেশাজীবী মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি ও প্রথা সংশ্লিষ্ট নিদর্শনাদি, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত দ্রব্যসামগ্রী, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, নৌকা, হাতিয়ার, অস্ত্রশস্ত্র, দারুশিল্পকর্ম, কারুশিল্পকর্ম, ধাতব শিল্পকর্ম, চীনামাটির শিল্পকর্ম, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, সূচিশিল্পকর্ম, পরিধেয় বস্ত্র ও অলংকার সামগ্রী, নকশি কাঁথা, বাদ্যযন্ত্রসমূহ ইত্যাদি। কামার, কুমার, জেলে, কৃষক, গ্রাম্য হাট বাজার, জনজীবন ও আদিবাসী সংস্কৃতির উপর নির্মিত কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ডিওরামা এ বিভাগের গ্যালারির আকর্ষণীয় দিক। দৃষ্টিনন্দন দারুশিল্পকর্ম যেমন অলংকৃত ও কারুকার্য খচিত খাট, পালকি, কাঠের বেড়া, আসবাবপত্র ও ঢেঁকি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন জাদুঘর পরিদর্শনকারী দর্শকগণের আনন্দ ও কৌতুহলের উৎস। রুপার উন্নত তারজালিক শিল্পকর্ম এবং হাতির দাঁতের শীতলপাটি, সোনা-রূপার অলংকার সামগ্রী একটি উন্নত জাতির সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার বিবর্তন সব হরফের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ এ বিভাগে রয়েছে ৭টি গ্যালারি। জাতীয় জাদুঘরের আর্ট গ্যালারি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের বরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম দিয়ে এসব আর্ট গ্যালারি সাজানো হয়েছে। আর্ট গ্যালারির শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শিল্পকলা চর্চার পথিকৃৎ জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্ম দিয়ে। ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষের উপর জয়নুল আবেদীনের অাঁকা চিত্রকর্ম দুর্ভিক্ষের বাস্তবচিত্র সম্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেয়। এছাড়াও জেলে জীবন, বেদেদের জীবন, বিদ্রোহী, প্রকৃতি ও গ্রাম্য জনজীবনের উপর অাঁকা জয়নুল আবেদীনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দর্শকদের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। আর্ট গ্যালারির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিল্পী এস.এম সুলতান, কামরুল হাসান ও ভাস্কর নভেরার শিল্পকর্ম। বিশেষ করে এস.এম সুলতানের শিল্পকর্মে গ্রামীণ জনজীবন অত্যন্ত চমৎকার, নান্দনিক ও সুচারুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। আর্ট গ্যালারির শিল্পকর্মে সমকালীন বাংলার প্রকৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে।
বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি
জাতীয় জাদুঘরের চতুর্থ তলায় আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি। প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমীয়, সিন্ধু, গ্রিক, রোমান, পারস্য সভ্যতার কোনো নিদর্শন অবশ্য এখানে নেই। সে কারণে বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি পূর্ণতা লাভ করে নি। তবে রেনেসাঁ যুগ থেকে আধুনিক ইউরোপীয় বিখ্যাত শিল্পকর্মের মূল ও অনুকৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ববরেণ্য কৃতিসন্তানদের প্রতিকৃতি নিয়ে একটি বড় গ্যালারির আয়োজন করা হয়েছে, যা দর্শকদের বিশ্বমনীষীদের সম্পর্কে ধারণা দেয়।এছাড়াও রয়েছে বিদেশি সংস্কৃতিভিত্তিক কয়েকটি আকর্ষণীয় কর্নার। এসব কর্নারগুলির মধ্যে রয়েছে ইরানীয় কর্নার, সুইজারল্যান্ড কর্নার, কোরীয় কর্নার, চাইনিজ কর্নার ইত্যাদি। এসব কর্নারে ঐসব দেশের শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, বাদ্যযন্ত্র, চীনামাটির ও ধাতব শিল্পকর্ম এবং সর্বোপরি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে।সব ধরনের নিদর্শনের সঙ্গে রয়েছে আরবী ক্যলিগ্রাফি এবং ৭ কেজি ওজনের মুসলিম ধর্মের পবিত্র কোরআন শরিফ।
-জাতীয় জাদুঘর শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশি-বিদেশি গবেষকগণের আলোকচিত্র সরবরাহ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিক উপর মৌলিক গবেষণা কর্মে জাদুঘর সহায়তা করে।
সুযোগ -সুবিধা
ভবনটি পুরোটিই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামকক্ষ, নামাজের কক্ষ, বিনামূল্যে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট, শিশুদের জন্য খাবার ও টয়লেটের বিশেষ ব্যবস্থা প্রভৃতি।
জাদুঘর এর সময়সূচী
সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। শুক্রবার- বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে।(অক্টোবর থেকে মার্চ)শনিবার – বুধবারঃ সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকেল ৫.০০ টা পর্যন্ত। (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর)।শনিবার – বুধবারঃ সকাল ১০.৩০ থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত।
টিকেটের মূল্য
টিকেট এখন অনলাইনে নিতে হবে।প্রতিদিন ৫০০ জনকে টিকেট দেয়া হয়।টিকেটের মূল্য ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য ১০ টাকা, ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ২০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ৫০০ টাকা, তবে সার্কভুক্ত দেশ গুলোর জন্যে ৩০০ টাকা।
কিভাবে যাবেন
জাতীয় জাদুঘর শাহবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। আপনার এলাকা থেকে শাহবাগ রুটের যেকোনো বাসে চড়ে শাহবাগ গোল চত্বর কিংবা শাহবাগ পুলিশ বক্সের সামনে নামলেই দেখা মিলবে জাদুঘরের।
ঠিকানা
শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ। ফোন নম্বর- ৮৬১৯৩৯৬-৯৯, ৮৬১৯৪০০, ফ্যাক্স- ৮৮ ০২ ৮৬১৫৫৮৫, জিপিও বক্স নম্বর- ৩৫৫। ই-মেইল- [email protected] ওয়েবসাইট- http://www.bangladeshmuseum.gob.bd
সময়সূচী
গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) শনিবার-বুধ (সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) শনিবার-বুধ (সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৪.৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।) রমজান মাসে: শনিবার-বুধবার (সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।) বৃহস্পতিবার এই জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ।
টিকেট
বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য টিকেট ৭৫ টাকা। আর দেশী দর্শনার্থীদের জন্য এটি ১০ টাকা। ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য টিকেটের মূল্য ৫ টাকা। পহেলা বৈশাখ, ২৬ শে মার্চ ও ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ পায় এখানে।
স্থান
জাদুঘরটি শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে পিজি হাসপাতাল, রমনা পার্ক ও চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থিত।
কিভাবে যাওয়া যায়
ঢাকার গুলিস্তা, মতিঝিল, শাহাবাগ, গাবতলী, মিরপুর বা টঙ্গী থেকে শাহাবাগগামী যে কোন বাসযোগে জাতীয় জাদুঘরে আসা যায়।
জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত দেশের প্রধান জাদুঘর। এটি মার্চ ২০, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ৭ আগস্ট, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তারিখে এটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়া হয়।জাদুঘরটি শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে পিজি হাসপাতাল, রমনা পার্ক ও চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থিত। এখানে নৃতত্ব, চারুকলা, ইতিহাস, প্রকৃতি এবং আধুনিক ও বিশ্ব-সভ্যতা- ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা প্রদর্শনী রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি সংরক্ষণাগারও রয়েছে।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর "দ্য ঢাকা নিউজ" পত্রিকায় প্রথম এদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ তৎকালীন সচিবালয় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল)-এ দুই হাজার রুপি তহবিল নিয়ে জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু। বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে এই ঢাকা জাদুঘর উদ্বোধন করেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট ঢাকা জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ঢাকা জাদুঘরের প্রথম অস্থায়ী কিউরেটর বা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এন গুপ্ত। প্রথম কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালী। ব্রিটিশ সরকার এদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। শাহবাগ এলাকায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জন্য একটি অত্যাধুনিক বৃহদায়তন ভবনের উদ্বোধন করা হয় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর। আট একর জমির ওপর নির্মিত চারতলা ভবনটির তিনটি তলা জুড়ে রয়েছে ৪৩টি গ্যালারি।
সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে ৮.৬৩ একর জমির উপর একটি চারতলা ভবনে জাদুঘরটি অবস্থিত। এ জাদুঘরে ৪৪টি প্রদর্শনী কক্ষ, তিনটি অডিটোরিয়াম, একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও দুটি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চারটি শাখা জাদুঘর। এগুলি হলো সিলেটের ওসমানী জাদুঘর, ঢাকার আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর এবং ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৬ সালে দি ঢাকা নিউজ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু উনিশ শতকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয় নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। ঢাকাকে লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা অনুসারে গঠিত নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী করা হলে শিলং কেবিনেটের মুদ্রাসমূহ ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সুযোগে সরকারি মুদ্রা বিশারদ এইচ.ই স্টেপলটন ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের জন্য জনশিক্ষা পরিচালকের নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯০৯ সালে স্টেপলটনের প্রস্তাব সরকারি পর্যায়ে আলোচিত হলে গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার প্রস্তাবিত জাদুঘরের জন্য একটি স্থান নির্বাচনের নির্দেশ দেন। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের প্রচেষ্টা থেমে যায়। এই অবস্থায় ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকগণ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হন
প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন
ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন এইচ.ই স্টেপলটন, সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র, সৈয়দ আওলাদ হাসান, বি.কে দাস, খাজা মুহম্মদ ইউসুফ, হাকিম হাবিবুর রহমান, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, জে.টি র্যাঙ্কিন, এ.এইচ ক্লেটন, অধ্যাপক আর.বি রামসবোথাম ও সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুর। তবে ঢাকা জাদুঘরের উন্নয়নে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আগ্রহের ফলে ঢাকা জাদুঘর দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তিনি নিজে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য পরিচালনা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে নিদর্শন সংগ্রহ করে জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। নিদর্শনের শ্রেণিকরণ, ডকুমেন্টেশন, লেবেল তৈরি, প্রদর্শনী উপস্থাপনা এবং নিদর্শনের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা, সব ক্ষেত্রেই ভট্টশালীর অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৪৭ সালে ভট্টশালীর মৃত্যুর পর চারবছর জাদুঘরে কোনো কিউরেটর নিয়োগ দেওয়া হয় নি। ১৯৫১ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত জাদুঘর পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। এ সময় অবৈতনিক খন্ডকালীন কিউরেটর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ হাসান দানী, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, সিরাজুল হক, মফিজুল্লাহ কবীর প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাস গবেষক আহমদ হাসান দানী। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং প্রদর্শনী কক্ষের ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
১৯৬২ সালে এনামুল হককে ঢাকা জাদুঘরের সহকারি কিউরেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৯৬৫ সালে কিউরেটর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৬১ সালে দিনাজপুরের মহারাজার প্রাসাদ থেকে বহু নিদর্শন ঢাকা জাদুঘরে সংগ্রহ করা হয়। আবার বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯৬৩ সালে বলধা জাদুঘরের মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুর এবং হাকিম হাবিবুর রহমান ও তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত নিদর্শনাদি ঢাকা জাদুঘরে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। ফলে ঢাকা জাদুঘরের সংগ্রহভান্ডার ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়।
একটি প্রাদেশিক জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ
পাকিস্তান আমলেই শাহবাগে একটি প্রাদেশিক জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭০ সালে সরকার ঢাকা মিউজিয়াম বোর্ড অব ট্রাস্টিজ অধ্যাদেশ জারি করে ঢাকা জাদুঘরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে ১৮ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাতীয় জাদুঘর প্রকল্প পেশ করেন। ১৯৭৪ সালে জাতীয় জাদুঘর কমিশন গঠনের পর এ কমিশনের সুপারিশে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে অনুমোদিত হয়। ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং ওই বছরের ১৫ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠিত হয়।
সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন
প্রশাসন ও সাংগঠনিক কাঠামো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় জাদুঘর পরিচালিত হয় সরকার কর্তৃক গঠিত ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রযত্ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। সাধারণত দেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, পন্ডিত ও গবেষকগণের মধ্য থেকে জাদুঘরের প্রযত্ন বোর্ডের সদস্য নির্বাচন করা হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয় জাদুঘরের নির্বাহী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মহাপরিচালক। তিনি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হন। জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জাতীয় জাদুঘরে চারটি বিশেষায়িত কিউরেটোরিয়াল বিভাগ রয়েছে। সেগুলি হলো ১. প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, ২. ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগ, ৩. জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ এবং ৪. সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ। এছাড়াও রয়েছে আরো তিনটি সহযোগী বিভাগ। এগুলি হলো ১. সংরক্ষণ রসায়নাগার, ২. জনশিক্ষা বিভাগ ও ৩. প্রশাসন বিভাগ।
কিউরেটোরিয়াল বিভাগগুলি পেশাদার জাদুঘরবিদ দ্বারা পরিচালিত হয়, যাদের পদবি কিপার বা জাদুঘর রক্ষক। কিপারগণকে সহযোগিতা করেন উপ-কিপার ও সহকারী কিপারগণ। নিরাপত্তা, হিসাব ও প্রকৌশল শাখা নিয়ে নিয়ে গঠিত প্রশাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সচিব। তিনি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত এবং পদমর্যাদায় একজন উপ-সচিব। প্রশাসন বিভাগের প্রধান কাজ জাদুঘর পরিচালনায় কিউরেটোরিয়াল বিভাগগুলিকে সহযোগিতা করা। মহাপরিচালক কিউরেটোরিয়াল বিভাগ ও প্রশাসন বিভাগের মধ্যে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন।
জাদুঘর একটি বহুবিদ্যা সমন্বিত জাদুঘর
জাদুঘরের নিদর্শন ও গ্যালারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি বহুবিদ্যা সমন্বিত (multi-disciplinary) জাদুঘর। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত নিদর্শনাদি জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহভুক্ত মোট নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৮৬,০০০।
প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ সূচনালগ্ন থেকেই ঢাকা জাদুঘরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। বাংলাদেশে স্বতন্ত্র কোনো প্রাকৃতিক ইতিহাস (Natural History) জাদুঘর নেই। তাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার কাজটি এ বিভাগকেই পালন করতে হয়। বর্তমানে এ বিভাগের মোট ১০টি প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে বিভিন্ন নিদর্শন ও ডিওরামার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের গ্যালারিতে যেসব নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশের মানচিত্র, ভূপ্রকৃতি, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, গাছপালা, ফলমূল, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীবজন্তুও এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।
জাতির গৌরবময় ঐতিহাসিক উত্থানের সাক্ষ্য বহন করছে।
তৃতীয় তলার ৩টি গ্যালারিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব গ্যালারিতে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র ও দলিলপত্র, ৭ই মার্চের ভাষণের বৃহৎ আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার, শরণার্থী শিবির ও গণহত্যার মর্মস্পর্শী আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র, অস্ত্র সমর্পণ ও দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্যাবলীর আলোকচিত্র, যা একটি সাহসী জাতির গৌরবময় ঐতিহাসিক উত্থানের সাক্ষ্য বহন করছে।
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ এ বিভাগে রয়েছে ৭টি গ্যালারি, যেখানে দেশি-বিদেশি সমকালীন শিল্পকর্ম ও বিশ্ব সংস্কৃতির নিদর্শনাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের আর্ট গ্যালারি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের বরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম দিয়ে এসব আর্ট গ্যালারি সাজানো হয়েছে। আর্ট গ্যালারির শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শিল্পকলা চর্চার পথিকৃৎ জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্ম দিয়ে। ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষের উপর জয়নুল আবেদীনের অাঁকা চিত্রকর্ম দুর্ভিক্ষের বাস্তবচিত্র সম্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেয়। এছাড়াও জেলে জীবন, বেদেদের জীবন, বিদ্রোহী, প্রকৃতি ও গ্রাম্য জনজীবনের উপর অাঁকা জয়নুল আবেদীনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দর্শকদের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। আর্ট গ্যালারির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিল্পী এস.এম সুলতান, কামরুল হাসান ও ভাস্কর নভেরার শিল্পকর্ম। বিশেষ করে এস.এম সুলতানের শিল্পকর্মে গ্রামীণ জনজীবন অত্যন্ত চমৎকার, নান্দনিক ও সুচারুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। আর্ট গ্যালারির শিল্পকর্মে সমকালীন বাংলার প্রকৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে।
এছাড়াও জাদুঘরের চতুর্থ তলায় রয়েছে বিদেশি সংস্কৃতিভিত্তিক কয়েকটি আকর্ষণীয় কর্নার। এসব কর্নারগুলির মধ্যে রয়েছে ইরানীয় কর্নার, সুইজারল্যান্ড কর্নার, কোরীয় কর্নার, চাইনিজ কর্নার ইত্যাদি। এসব কর্নারে ঐসব দেশের শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, বাদ্যযন্ত্র, চীনামাটির ও ধাতব শিল্পকর্ম এবং সর্বোপরি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে।
সংরক্ষণ রসায়নাগার ১৯৭৫ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানে ঢাকা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি সংরক্ষণ রসায়নাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসময় দুজন সহকারী রসায়নবিদ নিয়োগ দিয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানির মাধ্যমে রসায়নাগার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সংরক্ষণ রসায়নাগারটিও জাতীয় জাদুঘরের বর্তমান ভবনে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে জাপান সরকরের অনুদানে সংরক্ষণ রসায়নাগারটি পুনরায় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়। নিদর্শনে মরিচা, প্যাটিনা ধরা, ব্রোঞ্জ ডিজিস, পোড়ামাটির ফলকের লবণাক্ততা, স্মৃতিস্তম্ভ, কাপড়, কাগজ, বাঁশ, বেত ও কাঠের সামগ্রীর উপর ছত্রাক ও কীটের আক্রমণ প্রভৃতি নিরাময় ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ রসায়নাগারটি কাজ করে থাকে। এ বিভাগ নিদর্শন সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিদর্শন সংরক্ষণ বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং বিশেষজ্ঞ বক্তৃতারও আয়োজন করে থাকে।
দেশের জনগণকে ঐতিহ্য সচেতন করে
জনশিক্ষা কার্যক্রম জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে একটি জনশিক্ষা বিভাগ, যা দেশের জনগণকে ঐতিহ্য সচেতন করে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকাশনা, ডিসপ্লে, ফটোগ্রাফি, শ্রুতিচিত্রণ, গ্রন্থাগার ও অডিটোরিয়াম শাখা নিয়ে জনশিক্ষা বিভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
শিক্ষাকর্মসূচির অংশ হিসেবে জাদুঘরে একটি স্কুলবাস ছিল। ৫২ সিটের এই বাসটিতে করে প্রতিদিন ঢাকা মহানগরীর কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জাদুঘরে আনা হত। কিন্তু বর্তমানে স্কুল বাসে ছাত্র আনা-নেওয়ার কার্যক্রমটি বন্ধ রয়েছে। তবে তারপরও ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত জাদুঘর পরিদর্শনে আসছেন। পাঁচজন প্রদর্শক প্রভাষক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রত্যেকটি নিদর্শন সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেন। বিদেশি দর্শনার্থীদের জাদুঘর পরিদর্শনেও শিক্ষা শাখা থেকে গাইড দেয়া হয়। শিক্ষা শাখা থেকে বুকলেট, ফোল্ডার প্রকাশ করা হয় এবং দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
ইতিহাস ও সংস্কৃতিক উপর মৌলিক গবেষণা কর্মে জাদুঘর সহায়তা করে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জাদুঘর দেখার সুযোগ করে দিতে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি বিশেষ ধরনের বাসে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী অর্থাৎ মিনি জাদুঘর চালু করেছিল। এই ভ্রাম্যমাণ মিনি জাদুঘরে ২৮টি ছোট ছোট গ্যালারিতে নির্বাচিত প্রাচীন মুদ্রা, প্রস্তর কুঠার, টেরাকোটা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন রাখা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ কর্মসূচিটিও বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে জাদুঘর বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, যেমন আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিশেষ প্রদর্শনী, শিশু-কিশোরদের সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। কখনও কখনও ডকুমেন্টারি ফিল্ম শো এবং বিশেষ দিবসের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্র ধারণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। আবার জাদুঘরের নিদর্শন ভিত্তিক গবেষণা, বুলেটিন, জার্নাল ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেও জাতীয় জাদুঘর শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশি-বিদেশি গবেষকগণের আলোকচিত্র সরবরাহ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিক উপর মৌলিক গবেষণা কর্মে জাদুঘর সহায়তা করে।
ইতিহাস জানতে ঘুরে আসুন জাতীয় জাদুঘর
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে ৮.৬৩ একর জমির উপর একটি চারতলা ভবনে জাদুঘরটি অবস্থিত। এ জাদুঘরে ৪৪টি প্রদর্শনী কক্ষ, তিনটি অডিটোরিয়াম, একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও দুটি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চারটি শাখা জাদুঘর। এগুলি হলো সিলেটের ওসমানী জাদুঘর, ঢাকার আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর এবং ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৬ সালে দি ঢাকা নিউজ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু উনিশ শতকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয় নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। ঢাকাকে লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা অনুসারে গঠিত নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী করা হলে শিলং কেবিনেটের মুদ্রাসমূহ ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সুযোগে সরকারি মুদ্রা বিশারদ এইচ.ই স্টেপলটন ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের জন্য জনশিক্ষা পরিচালকের নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯০৯ সালে স্টেপলটনের প্রস্তাব সরকারি পর্যায়ে আলোচিত হলে গর্ভনর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার প্রস্তাবিত জাদুঘরের জন্য একটি স্থান নির্বাচনের নির্দেশ দেন। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের প্রচেষ্টা থেমে যায়। এই অবস্থায় ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকগণ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হন।
বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ১৯১২ সালের ২৫শে জুলাই নর্থব্রুক হলে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকগণ এখানে একটি জাদুঘর স্থাপনের দাবি জানান। এ দাবির সপক্ষে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের আয়োজিত প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়ে লর্ড কারমাইকেল জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য ২,০০০ রুপি মঞ্জুর করেন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘর স্থাপনের সরকারি অনুমোদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় এবং ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল জেনারেল কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার নিকোলাস ডি বিটসন বেল কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। এই কমিটিকে জাদুঘরের খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সাময়িক নির্বাহী কমিটি গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ওই বছরের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ঢাকা জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ১৮ নভেম্বর বেঙ্গল গভর্নমেন্ট সাময়িক নির্বাহী কমিটি কর্তৃক প্রণীত খসড়া জাদুঘর নীতিমালা অনুমোদন করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এফ.সি ফ্রেঞ্চ দুই পরিষদেরই সভাপতি নিযুক্ত হন, স্টেপলটনকে নিয়োগ করা হয় সম্পাদক। ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর নিযুক্ত করা হয়। ড. এন. গুপ্তকে প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শন সংগ্রহ ও গ্যালারি উপস্থাপনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও একজন চাপরাশি, একজন বেয়ারা ও একজন দারোয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন জাদুঘরের মোট নিদর্শনের সংখ্যা ছিল ৩৭৯টি।
প্রথমে তৎকালীন সচিবালয়ের (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষ জাদুঘরের নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু জাদুঘরের নিদর্শন সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১৫ সালের জুলাই জাদুঘরটি নিমতলীতে অবস্থিত ঢাকার নায়েব নাজিমদের বারোদূয়ারি ভবনে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে এটি শাহবাগের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ সূচনালগ্ন থেকেই ঢাকা জাদুঘরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। বাংলাদেশে স্বতন্ত্র কোনো প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নেই। তাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার কাজটি এ বিভাগকেই পালন করতে হয়। বর্তমানে এ বিভাগের মোট ১০টি প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে বিভিন্ন নিদর্শন ও ডিওরামার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের গ্যালারিতে যেসব নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশের মানচিত্র, ভূপ্রকৃতি, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, গাছপালা, ফলমূল, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীবজন্তুও এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ বিভাগের অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর ভাস্কর্য, প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শনসমূহ, শিলালিপি ও তাম্রলিপি, মৃৎপাত্র, পান্ডুলিপি, ঐতিহাসিক দলিলপত্র, কৃতিসন্তানদের ব্যক্তিগত স্মৃতি নিদর্শন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও আলোকচিত্র।
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণীয় দিক হলো
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণীয় দিক হলো প্রাচীন যুগের হিন্দু-বৌদ্ধ ভাস্কর্য। অলংকরণ ও কারুকার্যে এসব ভাস্কর্য সারা পৃথিবীতে অনন্য। এছাড়াও প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভবনগাত্রের অলংকরণে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের পোড়ামাটির ফলক বিশেষ করে মহাস্থান, ময়নামতী, পাহাড়পুর ও মধ্যযুগের মন্দির, মসজিদে ব্যবহৃত অলংকৃত পোড়ামাটির ফলকগুলি এ বিভাগের গ্যালারির অন্যতম আকর্ষণীয় দৃশ্যপট।
এ বিভাগের গ্যালারিতে বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনও উপস্থাপন করা হয়েছে, যেগুলির মধ্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও টিপু সুলতানের তরবারি, সিরাজউদ্দৌলার কার্পেট, শেরশাহ ও ঈসা খাঁর কামান, আকবরের সময়ের নাকাড়া বা যুদ্ধের ঢাক ও বর্ম ইত্যাদি।
জাতীয় জাদুঘরের চতুর্থ তলায় আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি। প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমীয়, সিন্ধু, গ্রিক, রোমান, পারস্য সভ্যতার কোনো নিদর্শন অবশ্য এখানে নেই। সে কারণে বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি পূর্ণতা লাভ করে নি। তবে রেনেসাঁ যুগ থেকে আধুনিক ইউরোপীয় বিখ্যাত শিল্পকর্মের মূল ও অনুকৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ববরেণ্য কৃতিসন্তানদের প্রতিকৃতি নিয়ে একটি বড় গ্যালারির আয়োজন করা হয়েছে, যা দর্শকদের বিশ্বমনীষীদের সম্পর্কে ধারণা দেয়।
এছাড়াও জাদুঘরের চতুর্থ তলায় রয়েছে বিদেশি সংস্কৃতিভিত্তিক কয়েকটি আকর্ষণীয় কর্নার। এসব কর্নারগুলির মধ্যে রয়েছে ইরানীয় কর্নার, সুইজারল্যান্ড কর্নার, কোরীয় কর্নার, চাইনিজ কর্নার ইত্যাদি। এসব কর্নারে ঐসব দেশের শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, বাদ্যযন্ত্র, চীনামাটির ও ধাতব শিল্পকর্ম এবং সর্বোপরি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে।
তথ্যসুত্র
জাদুঘর স্থাপনার ইতিহাস, Irabotee.
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, Daily Sangram.
বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর, Sobnibo.
ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, Some Where In Blog.
বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা, Bangla Peindex.
দেশের প্রধান জাদুঘর।, Dhaka.Gov.bd.