রক্তদান কর্মসূচি (Blood Donation Program)

প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ১৪ জুন ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। যেসব রক্তযোদ্ধারা অসংখ্য, অগণিত মুমূর্ষু রোগীকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেন তাদের দানের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্যে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালন করা হয়। এ দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের জনগণকে প্রাণঘাতী রক্তবাহিত রোগ এইডস, হেপাটাইটিস-বি ও হেপাটাইটিস-সিসহ অন্যান্য রোগ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অবগত করা। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’ এ স্লোগান নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।

১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

বর্তমানের প্রচলিত রক্তের গ্রুপের (এ, বি, এবি, ও) আবিষ্কারক বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডইস্টেনার জন্মদিন ১৪ জুন ১৮৬৮। তার স্মরণে ২০০৪ সাল থেকে ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বে ১০৭ কোটি ব্যাগ রক্ত সংগৃহিত হয়। এর মধ্যে ৩১ শতাংশ স্বেচ্ছা রক্তদাতা আর ৫৯ শতাংশ আত্মীয় রক্তদাতা। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছা রক্তদানের হার প্রতি এক হাজারে ৪০ জন আর উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি এক হাজারে চার জনেরও কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর দুই শতাংশ লোকও যদি বছরে একবার রক্তদান করে তাহলে আমাদের দেশে রক্তের অভাব থাকবে না

রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য

জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসে মানুষ। রক্তদান মানব জগতের সবচেয়ে বড় ও নিঃস্বার্থ উপহার। স্বেচ্ছায় রক্তদান বাঁচাতে পারে অনেকের প্রাণ। প্রতিবছর ১৪ জুনের এ দিনটি বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন, তাদেরসহ সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। 

রক্তদান কোনো দুঃসাহসিক কাজ নয়

রক্তদান কোনো দুঃসাহসিক কাজ নয়। সুস্থ-সবল মানুষ, যাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি এবং যাদের শারীরিক ওজন ৪৫ কেজির বেশি, তারা প্রতি চার মাস পরপর এক ব্যাগ রক্ত অনায়াসেই দান করতে পারেন। মানবদেহে সাধারণত ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। দান করা এক ব্যাগে থাকে ৩৫০ থেকে ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত। দান করা রক্তের প্লাজমার (রক্তরস) অভাব পূরণ হয়ে যায় বেশি বেশি পানি পানের মাধ্যমে। অন্যদিকে, রক্তের প্রধান উপাদান লোহিত কণিকা ১২০ দিন পরপর মানুষের শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ, কেউ রক্ত দিক বা না দিক পুরনো লোহিত কণিকাগুলো মরে গিয়ে ১২০ দিন পরপর মানুষের শরীরে নতুন লোহিত কণিকা জন্ম নেয়।

রক্তদানের জন্য প্রয়োজন শুধু একটু সাহস ও সদিচ্ছা

রক্তদানের জন্য প্রয়োজন শুধু একটু সাহস ও সদিচ্ছা। রক্তদান করলে রক্তদাতার শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না এবং রক্তদানের জন্য আলাদা কোনো খাবার খাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। তবে রক্তদানের পর পানিজাতীয় খাবার খাওয়া ভালো। মনে রাখবেন, আপনার-আমার এক ব্যাগ রক্ত বাঁচাতে পারে একটি মুমূর্ষু রোগীর জীবন। তাই জীবন বাঁচাতে আসুন, আমরা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হই এবং অন্যকেও উৎসাহিত করি। আমাদের দেশে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন ‘সন্ধানী’ বাংলাদেশে প্রথম ব্যাপকভাবে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির কাজ শুরু করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাঁধন’, ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ এবং আরো অনেক সংস্থা স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রোগীকে প্রয়োজনীয় নিরাপদ রক্ত সরবরাহ করে আসছে। ইদানীং আবার ইন্টারনেট এবং ফেসবুকের মাধ্যমেও রক্তদাতা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে রক্তদানের ক্ষেত্রে রক্তদাতার এইচআইভি, হেপাটাইটিস-‘বি’ এবং প্রয়োজনে আরো কিছু পরীক্ষাসহ ক্রস ম্যাচিং করা বাধ্যতামূলক।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চার লাখ রক্তদাতা আছেন

রক্তদানের বিষয়ে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করা, তাদের উদ্বুদ্ধ করা ও রক্তদানের অমূলক ভীতি দূর করার উদ্দেশ্যে এবার অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এডাস্ট) সমকাল সুহৃদ সমাবেশ ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নানা আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয়েছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান, বাঁচাবে জীবন’ প্রতিপাদ্যে ১৪ জুন এডাস্ট ক্যাম্পাসে আলোচনা, সচেতনতা ও রক্তদানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করেন সুহৃদরা। তরুণ শিক্ষার্থীদের রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো, রক্তদান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া ও রক্তদান নিয়ে ভীতি দূর করা ছিল কর্মসূচির উদ্দেশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তারাও এতে অংশগ্রহণ করেন ও রক্তদান করেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চার লাখ রক্তদাতা আছেন। তাঁরা দিনে ৪৫০ থেকে ৫৫০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেন। কোয়ান্টামের স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির সমন্বয়ক শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর তাঁদের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার ব্যাগ রক্তের চাহিদা ছিল। যার মধ্যে ৯৫ হাজার ব্যাগ সরবরাহ করতে পেরেছেন

মানবিকতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি

মানবিকতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই সেবার গুরুত্বের শেষ নেই। কারণ আমাদের দেশে বছরে রক্তের চাহিদা থাকে প্রায় ৮-১০ লাখ ইউনিট। এই অবস্থায় কারো স্বেচ্ছায় রক্তদানের বিষয়টি অতি তুচ্ছ নয়, বরং তা বীরত্বের পরিচায়ক। তাই কারো প্রাণের স্পন্দন টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে আমাদের সবারই উচিত স্বেচ্ছায় রক্ত দান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা।

বাংলাদেশে ১৪ জনে ১ জন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত

বাংলাদেশে প্রতিবছর রোগীদের সার্জারি চিকিৎসা সেবার জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়। যারা রক্ত সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত তাদেরও নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে প্রয়োজন হয় রক্তের। যেমন বাংলাদেশে ১৪ জনে ১ জন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ১০ হাজার শিশু।এসব থ্যালাসেমিয়া রোগীর পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অপারেশন, অগ্নিদগ্ধ বা দুর্ঘটনাজনিত রোগীর ক্ষেত্রেও রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়।

পৃথিবীতে এখনো কৃত্রিম রক্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি

পৃথিবীতে এখনো কৃত্রিম রক্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আর এ কারণেই মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে শুধুই স্বেচ্ছায় দান করা এক ব্যাগ রক্তের ওপর।নির্দিষ্ট সময় পর পর রক্তদানের অভ্যাসে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে না বরং তা শরীরকে আরও সুস্থ করে তোলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্ত দান করলে শরীরের অস্থিমজ্জা নতুন রক্তকণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়।রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকার প্রাণশক্তি বাড়িয়ে তোলে ও নতুন কণিকা তৈরির হার বৃদ্ধি করে। নিয়মিত রক্তদানকারীর হৃদ্‌রোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়।

পূর্ণবয়স্ক ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তি রক্ত দিতে সক্ষম

তবে একজন পূর্ণবয়স্ক ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তি রক্ত দিতে সক্ষম বলে মনে করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডা. সিরাজুল ইসলাম। যদিও অনেক চিকিৎসক মনে করেন ৬০ বছর পর্যন্ত এ কাজে শামিল হওয়া যায়।নারী ৪৫ এবং পুরুষ ৪৮ কেজি ওজনের বেশি হলেই তিনি রক্তদানের মতো মহৎ উদ্যোগে শামিল হতে পারবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তদানের সময় রক্তদাতার তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইটের নিচে এবং নাড়ির গতি ৭০ থেকে ৯০ এর মধ্যে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকতে হবে।পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসিলিটারে ১৫ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ গ্রাম হওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে।

৪ মাস অন্তর অন্তর ৩ বার রক্তদানে রক্ত প্রাকৃতিকভাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়

বছরে ৪ মাস অন্তর অন্তর ৩ বার রক্তদানে রক্ত প্রাকৃতিকভাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়, যা নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোনো রোগ আছে কি না, তাও বিনা খরচে জানা যায় এই মহৎ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে।

স্বেচ্ছারক্তদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি

বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় রক্তের চাহিদা একেবারেই নগণ্য হলেও এখনো আমরা স্বেচ্ছারক্তদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে যেহেতু রক্তই দিতে হয়; সেহেতু ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে স্বেচ্ছারক্তদাতা বৃদ্ধিই রক্তের এ চাহিদা মেটাতে পারে। তাই আসুন স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজে সুরক্ষিত ও বিপদমুক্ত থাকি এবং অন্যের জীবন প্রদীপকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি।

একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে কার্যক্রম চালায় বাঁধন। আজ ২৪ অক্টোবর ২৫ বছর পূর্ণ হলো সংগঠনটির। ১৯৯৭ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে একদল শিক্ষার্থী সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৯ লাখ ৭৭ হাজার ব্যাগ রক্তের যোগান দিয়ে সহযোগিতা করেছে বলে জানিয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সবচেয়ে বড় এ সংগঠনটি।  'একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন' স্লোগানে শিক্ষার্থীদের পরিচালিত এ সংগঠনটি গত ২৫ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদানকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছে বলে জানান বাঁধনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি'র প্রবেশমুখে বাঁধনের অফিসে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম পরিচালা করেন একদল বাঁধনকর্মী।

বাঁধন ২৫ বছরে ১০ লাখ মানুষকে রক্ত দিয়েছে

বাঁধন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে যাত্রা শুরু করে ২৫ বছর ধরে 'বাঁধন' এখন দেশের ৫৩টি জেলার ১৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মোট ৭৬টি ইউনিটের মাধ্যমে আজ মানবিক কাজের বার্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।শিক্ষার্থী রক্তদাতাদের অন্যতম বড় সংগঠন বাঁধন। এর সভাপতি মো. নাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধন ২৫ বছরে ১০ লাখ মানুষকে রক্ত দিয়েছে। আর ২১ লাখ মানুষকে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়েছে। বছরে ৭৫ হাজার ব্যাগ রক্তের চাহিদা পায় বাঁধন। যার ৯০ শতাংশ তারা পূরণ করতে পারে।

রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী

‘রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত বোন ম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এ ঘাটতি পূরণ করে। আর বছরে তিনবার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে দেয়।’প্রয়োজনের সময় এক ব্যাগ রক্ত জীবন-মরণের সেতু হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষকে উৎসাহিত করতে আমাদের এই কর্মসূচি।’‘আমার এক ব্যাগ রক্ত একজন মৃত্যু পথযাত্রীর জীবন বাঁচিয়ে দেবে, এটি ভাবতেই আমার খুব ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা থেকেই আমার রক্ত দান করা

দেশে রক্তের যে চাহিদা, তা পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পেশাদারদের চেয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংখ্যা এখন বেশি।বেসরকারি রক্তদাতা সংগঠনগুলো বলছে, দেশে রক্তের যে চাহিদা, তা পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের যে সংখ্যা, তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তাই স্বেচ্ছায় রক্তদানে আরও বেশি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন সন্ধানী

দেশের সবচেয়ে পুরোনো স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন সন্ধানী। তাদের হিসাবে, দেশে বছরে ছয় লাখ ব্যাগের মতো রক্তের চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে ১২ শতাংশ পূরণ করছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। প্রায় ৬০ শতাংশের মতো আসে পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে। বাকিটা স্বজন, বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেওয়া হয়। রক্তদাতাদের বেশির ভাগ তরুণ ও শিক্ষার্থী।

দেশে এখন স্বেচ্ছায় রক্তদানের পরিমাণ বেশি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আতাউল করিম বলছেন, দেশে এখন স্বেচ্ছায় রক্তদানের পরিমাণ বেশি। দেশে পেশাদার রক্তদাতা বা টাকার বিনিময়ে রক্ত দেওয়া কমে গেছে।রক্তের অভাবে কেউ মারা গেছে, এখন আর তা শোনা যায় না। এখন রক্তের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিভেদ করা হচ্ছে। আগুনে দগ্ধ রোগীর জন্য এক রকম, আবার ডেঙ্গু রোগীর জন্য আরেক রকম রক্তের উপকরণের প্রয়োজন হয়। এটি এগিয়ে নিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে

দেশে সরকারিভাবে ব্লাড ব্যাংক আছে ২০৬ এবং বেসরকারি ১৭২টি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন হয়। এর বিপরীতে চাহিদা ১০ লাখ। দেশে সরকারিভাবে ব্লাড ব্যাংক আছে ২০৬ এবং বেসরকারি ১৭২টি।

এবার আসুন জেনে নিই রক্তদান সম্পর্কিত কিছু তথ্য

সুস্থ-সবল মানুষ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, তারা রক্তদান করতে পারেন যাদের ওজন ৪৫ কেজির বেশি, তারা অনায়াসেই রক্তদান করতে পারেন। যিনি চার মাসের মধ্যে রক্তদান করেননি, তিনি রক্তদান করতে পারেন।২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনো সময় রক্তদান করা যায়।ভরা পেটে খাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিট পর রক্ত দেওয়া ভালো।খালি পেটে রক্তদান না করে হালকা খাবার খেয়ে রক্ত দেওয়া ভালো।

নিয়মিত রক্তদান করলে হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, রক্তদান করা শরীরের জন্য ভালো। তাদের মতে, রক্ত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ে অবস্থিত বোন্ম্যারৌ বা অস্থিমজ্জা নতুনভাবে রক্ত তৈরি করতে উদ্দীপ্ত হয় এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকায় শরীর তাজা হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বছরে তিনবার রক্তদান করেছে, তাদের শরীরের লোহিত রক্তকণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা অনেক বেড়ে গেছে; এবং নিয়মিত রক্তদান করলে হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া রক্তদানের মাধ্যমে রক্তদাতা বিনা মূল্যে জানতে পারে, তার শরীরে কোনো রোগ আছে কিনা। মোট কথা, রক্তদানে কোনো ক্ষতি নেই। বরং যিনি রক্তদান করেন, তিনি শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তি নিয়ে আনন্দে বেঁচে থাকেন। তাই আসুন, নিজে রক্ত দেই এবং অন্যকে রক্ত দিতে উৎসাহিত করি।

প্রতিবছর অনেক রোগী রক্তের অভাবে মারা যায়

আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে এখনো প্রয়োজনের তুলনায় রক্তের সরবরাহ অনেক কম। এনো প্রতিবছর অনেক রোগী রক্তের অভাবে মারা যায়। এর কারণ রক্ত দান সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও অমূলক কুসংস্কার। কেউ যদি স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন এতে যেমন একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন যেমন বাঁচে, তেমনি রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার মধ্যে গড়ে উঠে সম্পর্কের সেতু বন্ধন।এসব তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে জাগ্রত ব্লাড ডোনার্স ক্লাব প্রতিদিন সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর জন্য ৪০ থেকে ৫০ ব্যাগ নিরাপদ রক্ত সরাসরি সরবরাহ করে থাকে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে রক্ত দানে উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। রক্তের সীমাহীন চাহিদা পূরণে রক্তদান কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য মানুষ আগ্রহী হলেও রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণ উল্লেখযোগ্য নয়।

মানুষ সামাজিক জীব। সে হিসেবে মানুষের একে অপরের প্রতি রয়েছে কিছু সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। আর এর মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান অন্যতম। রক্তদান একটি মহৎ মানবিক কাজ। আপনার রক্তের মাধ্যমে আরেকজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে এর মতো মহৎ মানবিক কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা হতে পারে না। রক্ত মানবদেহের অপরিহার্য ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পূর্ণমাত্রায় রক্ত থাকলে মানবদেহ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া দেখা দিলেই শরীর অকেজো ও দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রাণশক্তিতে পড়ে ভাটা। এই অপরিহার্য উপাদানটি কল-কারখানায় তৈরি হয় না, তৈরি হয় না বড় বড় ল্যাব ও গবেষণাগারে। বিজ্ঞানীদের নিরসল চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো রক্তের বিকল্প দ্বিতীয় কোনো উপাদান তৈরি করা সম্ভব হয়নি, নিকট ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে এমনটাও আশা করা যায় না। মানুষের রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বলা হয় ‘করিলে রক্তদান, বাঁচিবে একটি প্রাণ’, ‘আপনার রক্ত দিন, একটি জীবন বাঁচান’, ‘সময় তুমি হার মেনেছ রক্তদানের কাছে, দশটি মিনিট করলে খরচ একটি জীবন বাঁচে।’


তথ্যসুত্র

মানুষ সামাজিক জীব, Ajkerkhobor.

রক্তের সরবরাহ অনেক কম, Dhakapost.

সুস্থ-সবল মানুষ, Protidinersangbad.

জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান, Prothomalo.

রক্তের পাঁচটি পরীক্ষা, NTV Bd.

দ্রুত ২ ব্যাগ রক্তের, The Daily Star.

বাংলাদেশে প্রতিবছর রোগীদের , Shomoy News.

রক্তদান সম্পর্কে সঠিক ধারণা, Shamakal.