জরায়ুমুখ ক্যান্সার (Cervical Cancer)

২০১৮ সালের International Agency for Research on Cancer (IARC)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নারী মারা যান সার্ভিক্যাল ক্যান্সার বা জরায়ুমুখ ক্যান্সারে। প্রতিবছরই এত মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিয়ে আমাদের অনেকেরই খুব একটা ধারণা নেই। অথচ একটু সচেতন থাকলে খুব সহজেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সার্ভিক্স হলো জরায়ুর নিচের দিকের অংশ, যা নারী দেহের যোনি এবং জরায়ুকে সংযুক্ত করে। যখন এই জায়গার কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে তখন ব্যাপারটি ক্যান্সারে রূপ নেয়। অনেক সময় ক্যান্সার সার্ভিক্স থেকে শুরু হয়ে পরবর্তীতে ফুসফুস, যকৃত, মূত্রথলি, যোনি, পায়ুপথেও ছড়িয়ে যেতে থাকে।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার কী

জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে, যার নাম “হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস”। আর এটি ছড়ায় ওই ভাইরাস আছে এমন কারো সাথে যৌনমিলন হলে। যৌনমিলনের সময় পুরুষের কাছ থেকে নারীদেহে এই ভাইরাস ঢুকে যায়। ভাইরাসটি ঢোকার সাথে সাথেই ক্যান্সার হয় না, ক্যান্সার হতে বেশ কয়েক বছরও লাগতে পারে। যখন নারীর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখনই এই ভাইরাসটি ক্যান্সার রোগের সৃষ্টি করে।


জরায়ু মুখের ক্যান্সারের মূল অসুবিধাটি হলো এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধুমাত্র ব্যথা দেখা দেয়। এর আগপর্যন্ত এর লক্ষণগুলোকে অনেকেই মাসিকের মেয়েলি সমস্যা বলে মনে করেন। ক্যান্সার যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে যায়, তখন রোগটা অনেক দূর ছড়িয়ে যায় প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যথা থাকে না দেখেই আমাদের দেশের নারীরা হাসপাতালে আসেন না। এমনকি যখন হয়, হওয়ার পরেও তারা অপেক্ষা করে। দেখা যায় দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব যাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় সে কাউকে বলছে না। স্বামীর সাথে মেলামেশায় রক্ত যাচ্ছে সেটিও সে বলছে না। ফলে যখন হাসপাতালে আসে তখন অনেকে দেরি হয়ে যায়।

অথচ এতদূর পর্যন্ত এটি গড়ানোরই কথা নয়। কারণ অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ুমুখের ক্যান্সার সবচাইতে সহজে নির্ণয় করা যায়।এমনকি হওয়ার আগেই খুব সহজ একটি পরীক্ষায় ধরা যায় ক্যান্সার হওয়ার আগের অবস্থা আছে কি না। এই পরীক্ষাকে বলে ভায়া টেস্ট। যৌন সম্পর্কে আছেন, এমন নারীরা ভায়া টেস্ট করিয়ে নিলেই জানতে পারবেন, তার জরায়ুমুখ ক্যান্সার হওয়ার আগের অবস্থায় অছে কি না।এছাড়া নিয়মিত ভায়া টেস্ট করালে ক্যান্সার হবার আগেই তা নির্ণয় করা সম্ভব–এমনকি যদি কারো জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয়–প্রাথমিক অবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা করলে তা ভালো হয়ে যায়।জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ, অর্থাৎ ভায়া টেস্ট করানোটা অত্যন্ত সহজ। কোনো ব্যথা লাগে না।  সময়ও লাগে মাত্র এক মিনিট। যেসব নারীর বয়স ৩০ থেকে ৬০-এর মধ্যে তাদের প্রতি ৫ বছর পরপর ভায়া টেস্ট

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের বড় কারণ বাল্যবিয়ে

বাল্যবিয়ে ও অল্প বয়সে মা হওয়া এবং ঘন ঘন সন্তান ধারণ করা জরায়ুমুখ ক্যান্সার সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। শুধু দেবহাটা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এ পরিস্থিতিতেই চলছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ মাস। চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সে বিয়ে হওয়া নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। জরায়ুর সংক্রমণ, জরায়ুতে টিউমার, রক্তস্বল্পতা, ফিস্টুলাসহ নানা সমস্যায় ভোগেন তাঁরা। তাঁদের সন্তানও কম ওজন, চোখের সমস্যা নিয়ে জন্মায়। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বাল্যবিয়ের পরিণতি হিসেবে নারীদের প্রতি সহিংসতা, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। বাল্যবিয়ের কারণে নারী শিক্ষার হারও কমে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই। ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। এর কারণ অর্থনৈতিক সংকট ও কিশোরীর নিরাপত্তাহীনতা। বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ সন্তানের মা হচ্ছেন। ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন অনেকে। এসব কারণে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা বাড়ছে।

রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. শেহরিন এফ সিদ্দিকা সমকালকে বলেন, 'জরায়ুমুখ ক্যান্সার নারীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ। সময় এসেছে এমন মৃত্যু প্রতিরোধের। এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণসচেতনতা সৃষ্টি ও স্ট্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা সবার কাছে নিয়ে যাওয়া। ৯ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা গেলে শত বছরের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হবে।'

দেশে ক্যান্সারে নারীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যান্সার দ্বিতীয় প্রধান কারণ। প্রতি বছর দেশে ১১ হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মারা যান এবং পাঁচ কোটিরও বেশি নারী এর ঝুঁকিতে আছে। ৯ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত সব সুস্থ নারীকে এর ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক পারভীন শাহীনা রহমান বলেন, আগে সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট ছিল। এখন ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপিও যোগ হয়েছে। তবে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসায় পরীক্ষার হার বাড়ছে না। একদম শেষ পর্যায়ে রোগীরা আসছেন। এর প্রধান কারণ অসচেতনতা।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে যা করবেন

জরায়ুমুখ ক্যানসার হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে, যার নাম প্যাপিলোমা ভাইরাস। সাধারণত এই ভাইরাসটি ছড়ায় ওই ভাইরাস আছে এমন কারও সাথে যৌন মিলনের ফলে। যৌন মিলনের সময় পুরুষদের কাছ থেকে নারীদের দেহে এই ভাইরাসটি ঢুকে যায়। তবে ভাইরাস শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার হয় না। ক্যানসার হতে বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে।একটু সচেতন থাকলেই খুব সহজে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে চলুন জেনে নেই -

জরায়ুমুখ ক্যানসার হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে, যার নাম প্যাপিলোমা ভাইরাস। সাধারণত এই ভাইরাসটি ছড়ায় ওই ভাইরাস আছে এমন কারও সাথে যৌন মিলনের ফলে। যৌন মিলনের সময় পুরুষদের কাছ থেকে নারীদের দেহে এই ভাইরাসটি ঢুকে যায়। তবে ভাইরাস শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসারহয় না। ক্যানসার হতে বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে।

আমাদের রোগবালাইয়ের বেশিরভাগই আমাদের জীবনযাত্রার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। তাই এত মারাত্মক একটি ক্যান্সার আপনার আশেপাশে আসার আগেই বরং সতর্ক হয়ে নিন। বিজ্ঞানীরাও ঔষধি প্রতিষেধকের চেয়ে জীবনযাত্রার প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দেন। কী করবেন তাহলে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারকে আপনার ত্রিসীমানার বাইরে রাখতে?

সুষম খাবার গ্রহণ করা ।ধূমপান না করা । ধূমপান থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা ।পানের সাথে জর্দা বা সাদা পাতা না খাওয়া।দাঁতের গোড়ায় গুল দিয়ে না রাখা ।সঙ্গমের সময় কনডম ব্যবহার করা। একাধিক সঙ্গীর সাথে সঙ্গম পরিহার করা ।নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করা ।জরায়ু একজন নারীর নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে এই অঙ্গটিই যদি ঝুঁকিতে পড়ে তার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই জীবনযাত্রার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরায়ুর যত্নের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

জরায়ুমুখের ক্যান্সার রোধে ৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে জরুরি

বিএসএমএমইউ ভিসি বলেন, জরায়ুমুখের ক্যান্সার চিকিৎসায় গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগ, অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ, ভাইরোলজি বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগ, অনকোলজি বিভাগ, রেডিওলজি বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে জরায়ুমুখের ক্যানসার যথা সময়ে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম আরো জোরদার করতে হবে।

জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকিরোধে মেয়েদের যাতে ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যেই বিবাহ হয়, সে দিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বাল্যবিবাহ যেমন জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ, দেরিতে বিয়েও তেমনি একটি কারণ। তবে দ্রুত চিহ্নিত করাই জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়।তিনি বলেন, বিএসএমএমইউয়ে জরায়ুমুখের ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এর সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হলে এই সেবা কার্যক্রম দেশব্যাপী জোরদার করতে হবে।

ডা. ফারজানা শারমিন তার ‘ইভালুয়েশন অব পোস্ট মেনোপজাল ব্লিডিং’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, নারীদের মাসিক বন্ধ হবার পরও রক্তক্ষরণ হলে তাকে পোস্ট মেনোপজাল ব্লিডিং বলে এবং এটা নারীর স্বাস্থ্যের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। সাধারণত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণের কারণটা স্বাভাবিক। কিন্তু ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটা জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য হয়ে থাকে।তিনি বলেন, প্রত্যেক নারীকে মাসিক বন্ধ হওয়ার পরও এ রকম রক্তক্ষরণ হলে ডাক্তারের পরামর্শ মতো পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসা নেওয়া উচিত। কারণ নারীদের জরায়ুর ক্যান্সার জটিলতা বা সমস্যা তৈরি করবার আগেই ধরা পড়লে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই যেসব নারীদের জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়বার আশঙ্কা রয়েছে, তাদেরকে মাসিক বন্ধ হওয়ার পরও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ও ফলোআপে থাকা উচিত।

পরে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. ফারহানা খাতুন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রবণতা কমলেও বাংলাদেশে নারীদের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ু ক্যান্সার দ্বিতীয় স্থানে আছে। গ্লোবোকন ২০২০ এর তথ্য মতে, প্রতিবছর ৮ হাজার ৬৮ জন নারীর জরায়ু ক্যান্সারে শনাক্ত হয় এবং ৫ হাজার ২১৪ জনের প্রতিবছর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে শুরু করে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন নারী জরায়ু ক্যান্সার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বাল্যবিবাহ, কম বয়সে বাচ্চা নেওয়া, ২ বা ৩ এর অধিক বাচ্চা নেওয়া, ধূমপান ইত্যাদি জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ডা. ফারহানা জানান, জরায়ু ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ হলো অনিয়মিত রক্তস্রাব, সহবাসে রক্ত যাওয়া, অতিরিক্ত সাদাস্রাব ও গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব যাওয়া ইত্যাদি। জরায়ুর ক্যান্সারে চিকিৎসা নির্ভর করে কোন পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত হয়েছে।তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং ৪র্থ পর্যায়ের জরায়ুর ক্যান্সার রেডিওথেরাপি মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে জরায়ুর ক্যান্সারের অপারেশন করার জন্য গাইনি অনকোলজি বিশেষজ্ঞ আরো প্রয়োজন এবং রেডিথেরাপির মেশিনও আরো বেশি দরকার। তাই আক্রান্ত হওয়ার আগেই এই রোগ ক্যান্সারে পূর্ববর্তী অবস্থায় শনাক্ত করতে পারলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব।

সবশেষে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. মনোয়ারা বেগম। জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও প্রতিকার বিষয়ে তিনি বলেন, জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যায়। ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষায় মাধ্যমে যেহেতু আমাদের দেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তাই জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে সচেতন করতে হবে। ভায়া পরীক্ষা করার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্ত করা যায় তা জানাতে হবে।মনোয়ারা বেগম বলেন, ভায়া ছাড়াও এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এই ক্যান্সার চিহ্নিত করা যায়। জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে সমস্ত মেয়েদের (৯-১৪ বছরের মধ্যে) এইচপিভি ভ্যাকসিন দিতে হবে এবং বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে হবে। ২ এর অধিক সন্তান নিতে নিষেধ করতে হবে। জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্তের জন্য এইচপিভি ভ্যাকসিন কার্যক্রম সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

জরায়ুমুখের পরীক্ষা করে ক্যান্সার থেকে দূরে থাকুন

নারী দেহের প্রজননতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম জরায়ু বা ইউটেরাস (Uterus)। জরায়ুর নিচের দিকের অংশকে জরায়ুমুখ বা সারভিকস্ (Cervix) বলে। নারীদেহে যেসব স্থানে ক্যান্সার হয়, তার মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার (Cervical Cancer) অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর ৬ হাজার মৃত্যুবরণ করে। নিয়মিত জরায়ুমুখ পরীক্ষা করলে প্রাথমিক অবস্থাতেই এ ক্যান্সারের পূর্বলক্ষণ ধরা পড়ে এবং এ ক্যান্সার থেকে শতভাগ মুক্তি পাওয়া যায়, এমনকি অপারেশন করে জরায়ু ফেলতেও হয় না। নারীদের জরায়ুমুখ পরীক্ষা করার পদ্ধতির নাম কলপোস্কপি।

কিভাবে কলপোস্কপি পরীক্ষা করা হয়

একজন নারীরোগ বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল বা তার ব্যক্তিগত চেম্বারে কলপোস্কপি পরীক্ষা করে থাকেন। কলপোস্কপ (Colposcope) নামের একটি বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ও যোনিপথ অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনো জায়গা অস্বাভাবিক মনে হলে, সেখান থেকে কিছু কোষ বা সেল নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। একে প্যাপ স্মেয়ার (Pap smear) বলে। প্রয়োজন হলে সন্দেহজনক স্থান থেকে যন্ত্রের সাহায্যে চিমটি দিয়ে কোষ কলা (Tissue) নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। একে বায়োপসি (Biopsy) বলা হয়। কলপোস্কপি পরীক্ষায় সাধারণত নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো ধরা পড়ে।

জরায়ুমুখ বা সারভিক্স-এর ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। যোনিপথে/যোনিমুখে ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জরায়ুমুখের প্রদাহ। যৌন রোগ।

কী কারণে কলপোস্কপি পরীক্ষার উপদেশ দেওয়া হয়

বিবাহিত নারী ।যাদের দীর্ঘদিন ধরে তলপেটে ব্যথা। দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব/অনিয়মিত রক্তস্রাব।  চিকিৎসক খালি চোখে দেখে জরায়ুমুখে কোনো সমস্যা আছে সন্দেহ করলে। জরায়ুমুখের প্রাথমিক পরীক্ষা যেমন ভায়া/প্যাপস স্মেয়ার-এর রিপোর্টে সন্দেহ হলে। এইচপিভি (HPV) বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টেস্ট পজিটিভ হলে। জরায়ুমুখে দীর্ঘদিন ইনফেকশন থাকলে। নিজের অথবা স্বামীর একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে।

কলপোস্কপি পরীক্ষার পূর্ব প্রস্তুতি

সাধারণত মাসিক চলাকালীন কলপোস্কপি পরীক্ষা করা হয় না। মাসিকের রাস্তায় কোনো ওষুধ ব্যবহার করলে তা ২-৩ দিন আগে বন্ধ করতে হয়। ২-৩ দিন স্বামী সহবাস হতে বিরত থাকতে হয়। বায়োপসি নেওয়ার প্রয়োজন হলে ইকোস্প্রিন (Ecosprin) জাতীয় ওষুধ ৭ দিন আগে বন্ধ করতে হয়। খালি পেট/ভরা পেট এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

কলপোস্কপি করতে কতক্ষণ সময় লাগে

কলপোস্কপি পরীক্ষা করতে ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে। তবে বায়োপসি নেওয়ার প্রয়োজন হলে আরেকটু বেশি সময় লাগতে পারে।

পরীক্ষায় কোনো ব্যথা বেদনা হয় কি

কলপোস্কপি কোনো কষ্টদায়ক পরীক্ষা নয়। কারো কারো সামান্য অস্বস্তি লাগতে পারে। তবে বায়োপসি নেওয়া হলে অল্প ব্যথা বা সামান্য রক্তক্ষরণ হতে পারে, যার জন্য কয়েকদিন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

পরীক্ষায় কোনো ঝুঁকি আছে কি

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলপোস্কপি পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষায় ব্যবহৃত সব ধরনের যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয়। তাই এই পরীক্ষায় কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই।

কলপোস্কপি পরীক্ষার পর করণীয়

কলপোস্কপি পরীক্ষার পর পরই বাসায় গিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যাওয়া যায়। বায়োপসি নেওয়া হলে দু-একদিন মাসিকের রাস্তায় ব্যথা, সামান্য রক্তস্রাব বা গাঢ় রঙের স্রাব যেতে পারে। এজন্য এক সপ্তাহের মতো স্বামী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হয়। চিকিৎসক কিছু ওষুধও দিতে পারেন।

কলপোস্কপি রিপোর্ট পেতে কত সময় লাগে

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই হাতে পাওয়া যায়। প্যাপ স্মেয়ার বা বায়োপসি পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক মানে কী

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক মানে নিচের সমস্যাগুলোর যে কোনো একটি ধরা পড়েছে-

জরায়ুমুখে প্রদাহ আছে। জরায়ুমুখে অস্বাভাবিক কোষ বা সেল পাওয়া গেছে। কোনো এক সময় এই কোষগুলো ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে, তাই আমরা এ অবস্থাকে ক্যান্সার-পূর্ববর্তী লক্ষণ বলে থাকি। যেগুলোকে রিপোর্টে CIN-I, CIN-II, CIN-III হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এগুলো ক্যান্সার নয়। এ কোষগুলো খুব সহজেই জরায়ুমুখ থেকে সরিয়ে ফেলে ক্যান্সার ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা যায়। খুব বিরল ক্ষেত্রে কলপোস্কপি পরীক্ষায় সরাসরি জরায়ুমুখ ক্যান্সার ধরা পড়তে পারে। তার মানে এই মহিলা সচেতনতার অভাবে কখনোই আগে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করাননি।

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক হলে করণীয়

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসক যথাযথ পরামর্শ দিবেন। কলপোস্কপি পরীক্ষায় যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যায় তা চিকিৎসা দিয়ে শতভাগ নিরাময় করা যায়।

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো মানে কী

কলপোস্কপি পরীক্ষার ভালো রিপোর্ট আপনার জরায়ুমুখের সুস্থতা নিশ্চিত করে। শুধু তাই নয়, ভালো রিপোর্ট মানে আপনার যোনিপথ ও যোনিমুখেও কোনো সমস্যা নেই।

কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো হলে আবার কবে পরীক্ষা করতে হবে

একবার কলপোস্কপি পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো এলে আগামী তিন বছরের মধ্যে আপনার জরায়ুমুখে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা নেই। কাজেই তিন বছর পর আবার পরীক্ষা করার উপদেশ দেওয়া হয়।অশিক্ষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশের নারীরা জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। নারীরা সংকোচের কারণে রোগের লক্ষণগুলো বেশিরভাগ সময় লুকিয়ে রাখেন। নিয়মিত জরায়ুমুখ পরীক্ষা করে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় বা রোগের পূর্বলক্ষণ সনাক্ত করা গেলে সামান্য চিকিৎসা দিয়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা যায়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসায় নিয়মিত পরীক্ষা যে কারণে জরুরি

জরায়ু ক্যান্সারকে বলা হয় 'নীরবঘাতক'। কারণ এই অসুখে আক্রান্ত হলেও অনেক নারী এর লক্ষণ বুঝতে পারেন না। আবার ভিন্ন লক্ষণ দেখা দিলেও অনেক সময় গুরুত্ব দেন না।নারীরা জরায়ুমুখ ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরেই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের স্থান।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী এই জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার নারী এর ফলে মারা যান।

আর ৯০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার বা আইএআরসি'র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে ৮ হাজার ২৬৮ জন নারীর শরীরে শনাক্ত হচ্ছে জরায়ুর ক্যান্সার। আর বছরে ৪ হাজার ৯৭১ জন নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন।হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১০০টিরও বেশি প্রজাতির এইচপিভি আছে।

এর মধ্যে দুই ধরনের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে এই ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পরপরই কিন্তু ক্যান্সার হয় না।গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, জীবাণু প্রবেশের পর ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হতে। তার মানে হলো এটি নির্ণয়ে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার কিন্তু খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। তবে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের মুল সমস্যা হল এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধুমাত্র ব্যথা দেখা দেয়।আর এই ক্যান্সারের লক্ষণগুলোকে অনেকেই পিরিয়ডের মেয়েলী সমস্যা বলে ভুল করে থাকেন। এমন ভুল যেন না হয়, সেজন্য লক্ষণগুলো মনে রাখা জরুরি।

জরায়ুমুখের ক্যান্সার হলে যে সমস্যা হয়


মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব যাওয়া, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি কয়েক রকম হতে পারে। যেমন: প্রতিমাসে নারীদের মাসিকের সময়কাল হঠাৎ বেড়ে যায়, বেশি পরিমাণে রক্ত যাওয়া শুরু হয়। মাসের মাঝখানে এ রকম রক্তক্ষরণ হয়। স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্বামী- স্ত্রীর মিলনের পর রক্তক্ষরণ হয় বা ব্যথা হয়। তবে রোগটি আরেকটু অগ্রসর হয়ে আশপাশের অঙ্গ-পতঙ্গ আক্রান্ত করে, তখন ধীরে ধীরে আরও কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন: তলপেটে ব্যথা, প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রক্ত যেতে পারে।

উপরের লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়া মাত্রই রোগীকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। পরামর্শ ও পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসায় ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ আশাবাদের জায়গা আছে। আমরা জানি, কোষের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে এক পর্যায়ে ক্যান্সার হয়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর পর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে পূর্ণাঙ্গ বা আগ্রাসী ক্যান্সারে রূপ নিতে।

এ জন্য লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই এ ক্যান্সার আমরা নির্ণয় করতে পারি। এখানে দুটো প্রধান পরীক্ষা রয়েছে। প্যাপটেস্ট, যাকে গোল্ডস্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়। আরেকটি হলো ভায়া টেস্টের মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। পরীক্ষা দুটি নিয়ে আতঙ্ক বা ভয়-ভীতির কিছু নেই। এটা কাঁটা-ছেড়া বা কষ্টদায়ক পরীক্ষা নয়। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যেভাবে নারী রোগীকে পরীক্ষা করেন, অনেকটা সে রকম।

চিকিৎসায় করণীয়


চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবাই মিলে বসে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি নাকি রেডিওথেরাপি। সাধারণত চারটি পর্যায়ে রোগের অবস্থাকে ভাগ করা হয়-  ১, ২, ৩ ও ৪। এর মধ্যে আবার এ, বি-এভাবে ভাগ করা হয়। স্টেজ বা পর্যায়-২ পর্যন্ত থাকে, তখন প্রধান চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া। পরে অন্যান্য চিকিৎসা লাগে সেগুলো করা। এ চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।দেরি হলে গেলে বা ওই পর্যায়টি পার হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার করা যায় না। রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পর, অনেক ক্ষেত্রে আবার অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া যায়। যত আগে ধরা পড়বে, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এ রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এসব বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

সংকোচের বিহ্বলতা কাটাতে হবে। আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় মাথায় রেখে প্রাণঘাতী এ রোগটি নিয়ে আলোচনা করাটাও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য। অনেকে ভিতরে ভিতরে রোগটি পুষতে থাকেন। লক্ষণ টের পেলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে গোপন রাখেন। শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসেন, কিন্তু করার কিছুই থাকে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

নারীদের প্রধান দুটি ক্যান্সারের স্থান অর্থাৎ স্তন ও জরায়ুর সুস্থতা নিয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। নারীদের বুঝতে হবে স্তন কিংবা জরায়ু একজন নারীর জন্য, একজন মায়ের জন্য লজ্জা বা সংকোচের বিষয় নয়। যে অঙ্গে মা তার সন্তান ধারণ করেন, সেই জরায়ু, কিংবা জন্মের পর যে অঙ্গ থেকে সন্তানকে পুষ্টি যোগান, সেই স্তন বরং একজন মায়ের জন্য অহংকারের বিষয়। এর সুস্থতা নিয়ে নারীকে কথা বলার সাহস যোগাতে হবে। প্রত্যেক পুরুষের দায়িত্ব জননীর, নিজের কিংবা তার সন্তানের জরায়ুর সুস্থতা নিশ্চিত করা। জননীর কাছে জন্মঋণ স্মরণ করে।

দেশে জরায়ুমুখ বছরে ১২ হাজার নারীর মৃত্যু

দেশে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সারের কারণে বছরে প্রায় ১২ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। এরমধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মারা যায় ৭ হাজার ও স্তন ক্যান্সারে মারা যায় ৫ হাজার। এই দুটি ক্যান্সারে বছরে আক্রান্ত হয় প্রায় ২১ হাজার।এরমধ্যে ১৩ হাজার নারী আক্রান্ত হয় জরায়ু ক্যান্সারে এবং ৮ হাজার আক্রান্ত হয় স্তন ক্যান্সারে। তাই স্তন ক্যান্সার ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিয়ে কোনো লজ্জা নয়। এ বিষয়ে বড় ধরনের জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এই দুই ক্যান্সার সম্পর্কে আগেভাগে জানতে ভায়া ও সিবিইসহ যত ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে তা মানুষকে জানাতে হবে।’

সেপ্টেম্বর থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের টিকা দেবে সরকার

শুরুতে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের দেওয়া হবে এই টিকা।জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যু ঠেকাতে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের নারীদের টিকা দেওয়া শুরু করছে সরকার।স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এতথ্য জানিয়েছেন।জাহিদ মালেক বলেন, “জরায়ুমুখের ক্যান্সার শনাক্তে সারাদেশেই স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম আছে। এটা আরও বেগবান করা আমাদের একটি চলমান প্রক্রিয়া।“এই রোগের একটি টিকা আছে এইচপিভি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেশের সব নারীদের জন্য এই টিকা কার্যক্রম শুরু করব। আমরা মনে করি, এতে জরায়ুমুখ ক্যান্সার অনেক কমে যাবে।”

বাংলাদেশে নারীরা স্তন ক্যান্সারের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ুমুখ ক্যান্সারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, মারা যান ৩ লাখের বেশি।আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ হাজার ২৬৮ জন নারীর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বছরে মারা যাচ্ছে ৪ হাজার ৯৭১ জন।জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে ১০ বছর বয়সের পর থেকেই টিকা নেওয়া যায়। এই টিকার তিনটি ডোজ নিতে হয়। প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং তার তিন মাস পর তৃতীয় ডোজ নিতে হয়।

বিনামূল্যের এই টিকা প্রাথমিকভাবে দেশের ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের দেওয়া হবে।দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্তন ক্যান্সার শনাক্তের যন্ত্রও দেওয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।তিনি বলেন, “আমাদের দেশে অনেকে ব্রেস্ট ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে এই রোগ শনাক্তের যন্ত্রের অপ্রতুলতা রয়েছে। এই রোগটা যেন দ্রুত শনাক্ত করা যায়, সেজন্য মেমোগ্রাফির যন্ত্রপাতি অন্তত প্রতি জেলায় দিতে পারি। পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া হবে।”

জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল হবে টিকায়

দেশে প্রতিবছর ৮ হাজার নারীর জরায়ুমুখের ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে। এই ক্যানসারে আক্রান্ত নতুন ও পুরোনো রোগী মিলিয়ে বছরে ৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। কিশোরী মেয়েদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধব্যবস্থা নিলে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষার (স্ক্রিনিং) মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত ও চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই নির্মূল করা সম্ভব জরায়ুমুখ ক্যানসার।

৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী। বাল্যবিবাহ এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। রোগটিকে আগেভাগে শনাক্তের জন্য দেশে ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড বা ভায়া পরীক্ষা চালু থাকলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ স্ক্রিনিং করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশে ভায়া পরীক্ষার মাধ্যমে ২০ শতাংশ স্ক্রিনিং করা সম্ভব হয়েছে। যত বেশি স্ক্রিনিং হবে, তত বেশ রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হবে। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম বলেন, জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—অতিরিক্ত সাদা স্রাব, রক্তমিশ্রিত স্রাব, সহবাসের পর রক্তস্রাব, অনিয়মিত মাসিক ও তলপেটে ব্যথা।  অন্তত এক ডোজ টিকা দিয়ে হলেও দেশব্যাপী জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম শুরু হোক।ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকেও বিনা মূল্যে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালুর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

জিএসবির সভাপতি ও ইলেক্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, টিকা দিলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশে সরকারিভাবে এই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নেই। গাজীপুরে পাইলট প্রকল্পে সারা দেশের মাত্র ১০ শতাংশ কিশোরীকে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়া গিয়েছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৯০ শতাংশ মেয়েকে টিকার আওতায় আনা দরকার।

ওজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা। তিনি জানান, জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলে ৯০-৭০-৯০ সংখ্যাটিকে অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা, ৭০ শতাংশকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ও ক্যানসার–পূর্ববর্তী চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়াটিকা চালুর বিষয়ে ওজিএসবির উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন ওজিএসবি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিজামুল হক বলেন, ক্যানসার শনাক্তের সাত–আট সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শেষ করতে হয়। যত দেরি হবে, তত চিকিৎসা ব্যর্থ হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) অ্যান্ড সার্ভিলেন্সের উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. তানভীর হোসেন জানান, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনসের (গ্যাভি) কাছ থেকে টিকা পেয়ে এ বছরের মধ্যে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের এইচপিভি টিকা দেওয়া চালু করার ব্যাপারে সরকার আশাবাদী।

দেশে জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্তে স্ক্রিনিং অবস্থার কথা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা। তিনি জানান, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪২ লাখ নারীকে (২০ শতাংশ) বিনা মূল্যে ভায়া পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতি ১০০ নারীকে পরীক্ষা করলে ৫ জনের ক্যানসার শনাক্ত হয়।বিএসএমএমইউর গাইনি অনকোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন বলেন, ভায়া পরীক্ষা ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ শনাক্তে ভুল ফল (ফলস পজিটিভ) দিতে পারে। তাই আধুনিক এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা চালু করা দরকার।

তবে এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভায়া পরীক্ষাই বেশি উপযোগী উল্লেখ করে বিএসএমএমইউর গাইনি অনকোলজি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগম বলেন, এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা আধুনিক হলেও ব্যয়বহুল।জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহানা পারভীন জানান, তাঁর হাসপাতালে জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের ৯০ শতাংশই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আসেন।

ক্যানসার শনাক্ত ও চিকিৎসায় কর্মকৌশল তৈরির জন্য দেশজুড়ে ক্যানসার নিবন্ধন করার ওপর জোর দেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. বেগম রোকেয়া আনোয়ার।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমা হক বলেন, গ্রামে বসেও একজন ক্যানসার রোগী যেন উন্নত চিকিৎসা পান, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।্ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ফারহানা লাইজু বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান এইচপিভি টিকাসহ নতুন নতুন ওষুধ বাজারে নিয়ে আসছে।

ভ্যাকসিন নিয়ে যা জানতে হবে

টার্গেট গ্রুপ—৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। কমপ্লিমেন্টারি গ্রুপ—২৬ বছর বয়স পর্যন্ত। এ ছাড়া সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ যে কেউ দিতে পারবে। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত দুই ডোজ দিতে হয়। ১৫ বছরের পরে তিন ডোজ লাগবে। প্রথম ডোজের ছয় মাস পর দ্বিতীয় ডোজ (অনূর্ধ্ব-১৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে) দিতে হয়। প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ, দ্বিতীয় ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ (১৫ বছর এবং তার ঊর্ধ্ব বয়সীদের ক্ষেত্রে) দিতে হয়। অল্প বয়সী মেয়ে যাদের সেক্সুয়াল এক্সপোজার হয়নি, তাদের স্ক্রিনিং দরকার নেই। যাদের এক্সপোজার হিস্ট্রি আছে, তাদের স্ক্রিনিং করে নেওয়া ভালো।

৮০% জরায়ুমুখ ক্যান্সার ভালো হয়

জননাঙ্গের সব রোগের মধ্যে সবচেয়ে জটিল জরায়ু মুখ ক্যান্সার। তবে এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য। সমাজে যদি এ সচেতনতা আসে তাহলে এ ক্যান্সার বহুলাংশে কমানো সম্ভব।জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। প্রতি বছর ৪ লাখ ৭০ হাজার নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এরমধ্যে ৫০% নারীই মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশেও এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ১২ হাজার ৫শ নারী। ঘন্টায় ১ জন করে মারা যান। তবে নারী দেহের ও যৌনাঙ্গের এই ক্যান্সারই সর্বাধিক সফলভাবে প্রতিরোধ যোগ্য। সচেতনতাই পারে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে। সাধারণত ২০ বছরের নিচে এ রোগ হয় না। আক্রান্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী হয়ে থাকেন।

এ থেকে বাঁচার জন্য প্রথমেই আচরণগত প্রতিরোধের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন: বাল্য বিবাহ রোধ, ধূমপান করা, পানের সঙ্গে জর্দা, সাদা পাতা, দাঁতের গোড়ায় গুল ইত্যাদি কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে বিধায় তা প্রতিরোধ করতে হবে। সুষম খাবার গ্রহণ, ফলমূল শাকসব্জি খাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুশৃঙ্খল জীবন যাপন ও সামাজিক অনুশাসন মান্য করা এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালণ করে।

দ্বিতীয়ত জরায়ুমুখে ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা নেওয়া যায়। বাজারে `গার্ডাসিল` ও ` সারভারিক্স` নামে ভ্যাক্সিন পাওয়া যায়। সাধারণত ১০ বছরের পর থেকেই এই টিকা নেওয়া যাবে। প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। আমেরিকার FDA অনুযায়ী ৯-২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়। গর্ভাবস্থায় এ টিকা প্রদানের অনুমোদন নেই। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর এ টিকা আর কোন কাজে আসে না।তৃতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো যথাযথ স্ক্রীনিং। ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী সহজে জরায়ুমুখ দেখতে এবং পরীক্ষা করতে পারেন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে জরায়ু মুখে অনেকদিন ধরে একটি ক্যান্সার পূর্ব অবস্থা বুঝা যায় কিংবা ভবিষ্যতে ক্যান্সারের আশংকা আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। Pap smear এবং via হলো এরকমই স্ক্রীনিং টেস্ট।

VIA আমাদের দেশে সব সরকারি বড় হাসপাতালে বিনামূল্যে সহজেই করা যায়। ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত নারীদের বছরে একবার এই পরীক্ষা করা উচিত। পরপর দুই বার নেগেটিভ হলে ৩ বা ৫ বছর পরপর দুইবার পরীক্ষা করাবেন।জরায়ু মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা রোগের ধাপ অনুযায়ী হয়ে থাকে। যদি কারো ক্যান্সার পূর্ব অবস্থা (CIN) থাকে তাহলে তা নিয়মিত স্ক্রীনিং করে জরায়ুমুখে সামান্য সেক দিয়ে অথবা LEEP এর মাধ্যমে সারানো যায়। বয়স্ক মহিলা হলে জরায়ু ফেলে দেওয়া যায়। যদি ক্যান্সার হয়ে যায় তাহলে ক্লিনিকাল স্টেজিং করা হয়। রোগীকে অজ্ঞান করে স্টেজিং করা হয়। এবং বায়োপসি নেওয়া হয়।

ক্যান্সার কতোটা ছড়িয়েছে তা দেখা হয় স্টেজিং এর মাধ্যমে। স্টেজ- ১ এবং স্টেজ- ২ কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন করা হয়। এই অপারেশনটি খুবই জটিল এবং নির্দিষ্ট হাসপাতালে হয়ে থাকে। স্টেজগুলোতে রেডিও থেরাপি অথবা কেমোথেরাপী দেওয়া যেতে পারে।জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ থেকে সর্বশেষ প্রকাশ করা প্রতিবেদন মতে, ২০০৫ সালে মোট ২ হাজার ২৭৫ জন নারী রোগীর মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ৫৬১ জন। তথ্য আছে, PAP SMEAR করে জরায়ুমুখ ক্যান্সার ৮০% এবং এর ফলে মৃত্যু ৭০% কমানো সম্ভব।

নিরাপদ যৌন মিলন, জরায়ুমুখ টিকা, VIA, PAP SMEAR এর মাধ্যমে যেমন এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায় তেমনি তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় হলে সফল চিকিৎসার মাধ্যমে বহুলাংশে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই সবার মধ্যে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা খুবই দরকার।

দ্রুত চিহ্নিত করাই জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়

সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারজানা শারমিন তার ‘ইভালুয়েশন অফ পোস্ট মেনোপজাল ব্লিডিং’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, নারীদের মাসিক বন্ধ হবার পরও রক্তক্ষরণ হলে তাকে পোস্ট মেনোপজাল ব্লিডিং বলে এবং এটা নারী স্বাস্থ্যের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। সাধারণত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণের কারণটা স্বাভাবিক কিন্তু ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটা জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য হয়ে থাকে।তাই প্রত্যেক নারীকে মাসিক বন্ধ হবার পরও এরকম রক্তক্ষরণ হলে ডাক্তারের পরামর্শ মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা নেয়া উচিত। কারণ নারীদের জরায়ুর ক্যান্সার জটিলতা বা সমস্যা তৈরি হবার আগেই ধরা পড়লে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই যেসব নারীদের জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাদেরকে মাসিক বন্ধ হবার পরও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ও ফলোআপে থাকা উচিত।

সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারহানা খাতুন বলেন, পৃথিবীব্যাপী জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রবণতা কমলেও বাংলাদেশে নারীদের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ু ক্যান্সার দ্বিতীয় স্থানে আছে। গ্লোবোকন ২০২০ এর তথ্য মতে, প্রতিবছর ৮ হাজার ৬৮ জন নারীর জরায়ু ক্যান্সার শনাক্ত হয় এবং প্রতিবছর ৫ হাজার ২১৪  জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে শুরু করে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন নারী জরায়ুর ক্যান্সার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বাল্যবিয়ে, কম বয়সে সন্তান নেওয়া, ২ বা ৩ এর অধিক সন্তান নেওয়া, ধূমপান ইত্যাদি জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

তিনি জানান, জরায়ু ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ হলো, অনিয়মিত রক্তস্রাব, সহবাসে রক্ত যাওয়া, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব যাওয়া ইত্যাদি। জরায়ুর ক্যান্সারে চিকিৎসা নির্ভর করে কোন পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত হলে অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং ৪র্থ পর্যায়ের জরায়ুর ক্যান্সার রেডিওথেরাপি মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়।

কনসালটেন্ট ডা. মনোয়ারা বেগম জরায়ু মুখ ক্যান্সার সনাক্তকরণ ও প্রতিকার বিষয়ে বলেন, জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যায়। এই ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য ৩০ বৎসরের ঊর্ধ্বে সবাইকে সচেতন করতে হবে এবং ভায়া পরীক্ষা করায় মাধ্যমে জরায়ু মুখ ক্যান্সার শনাক্ত করা যায় তা জানাতে হবে। ভায়া ছাড়াও এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এই ক্যান্সার চিহ্নিত করা যায়। জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে বালিকাদের (৯-১৪ বৎসরের মধ্যে) এইচপিভি ভ্যাকসিন দিতে হবে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে এবং দুই এর অধিক সন্তান নিতে নিষেধ করতে হবে।

প্রতিষেধকের কল্যাণে কমছে জরায়ুমুখের ক্যান্সার

রেখচিত্র সবচেয়ে বেশি নিম্নগামী জরায়ুমুখের ক্যান্সারে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার নজির কমেছে অর্ধেকের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিষেধকের ব্যবহারই সম্ভবত এই উন্নতির নেপথ্যে।কর্কট রোগ সার্বিক ভাবে থাবা চওড়া করছে দেশে। ব্যতিক্রম হাতেগোনা কয়েকটি ক্যান্সার। তার মধ্যে রেখচিত্র সবচেয়ে বেশি নিম্নগামী জরায়ুমুখের ক্যান্সারে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার নজির কমেছে অর্ধেকের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিষেধকের ব্যবহারই সম্ভবত এই উন্নতির নেপথ্যে। কিন্তু তাঁদের আক্ষেপ, একমাত্র জরায়ুমুখের ক্যান্সারকেই যে প্রতিষেধকের মাধ্যমে রোখা যায়, তা চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও টিকাকরণের হার প্রত্যাশিত নয়।

সিএনসিআইয়ের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) থেকেই জরায়ুমুখের ক্যান্সার হয়। অন্য কোনও কারণে হয় না। তাই এইচপিভি-কে যদি ঠেকানো যায়, তা হলে সম্পূর্ণ ভাবে জরায়ুমুখের ক্যান্সারকে রুখে দেওয়া সম্ভব।' তিনি জানান, এইচপিভি-র ১০০-রও বেশি ধরনের স্ট্রেন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মধ্যে ক্যান্সারের জন্ম দিতে সক্ষম টাইপ-১৬ ও ১৮। যে প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে মথুরাপুরে, তা আদতে এই দু'টি টাইপের মিশ্রনে তৈরি বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

যাদের এই প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাদের জরায়মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে।' জয়ন্ত জানান, সিএনসিআইয়ের তরফে মধুসূদন চকের পাশাপাশি ওই ব্লকের বলেরবাজার ও পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে স্থানীয়দের নিয়ে ক্যান্সার সচেতনতার শিবির করছেন অনেক দিন ধরে। গ্রহণযোগ্যতার কারণেই তাই ওই এলাকার কিশোরীদের বেছে নেওয়া হয়েছে প্রতিষেধকের জন্য।


তথ্যসুত্র

জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব’, News24.

প্রতিষেধকের কল্যাণে কমছে জরায়ুমুখের ক্যান্সার, Eisamaoy.

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের বড় কারণ বাল্যবিয়ে, Samakal.

জরায়ুমুখে ক্যান্সারের লক্ষণ, Kaler Kantho.

৮০% জরায়ুমুখ ক্যান্সার ভালো হয়, Ekushey Tv.

জরায়ুমুখের পরীক্ষা করে ক্যান্সার থেকে দূরে থাকুন, Jugantor.

জরায়ুমুখের ক্যান্সার রোধে ৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে জরুরি, Medivoicebd.

বছরে ১২ হাজার নারীর মৃত্যু, Ittefaq.

জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল হবে টিকায়, Prothom Alo.

জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে আপনি সচেতন তো?, Shajgoj.

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা, BBC.

জরায়ুমুখের ক্যান্সার কেন হয়, Doctor Tv.

জরায়ুমুখ ক্যানসার কী, The Daily Star.

সার্ভিক্যাল ক্যান্সার বা জরায়ুমুখ ক্যান্সার, Corona.