শিশু নির্য়াতন (Child Abuse)


শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে

সম্প্রতি একের পর এক বীভৎস কায়দায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন থাকার পরও শিশুদের প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বাসা বাড়িতে সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব নির্মম আচরণের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে আমাদের সমাজে। ফলে স্কুলে শিশুদের ওপর দৈহিক নির্যাতন করলেও নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এই শাস্তির কারণে অনেক শিশু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে এমন নজিরও রয়েছে অনেক। এই আচরণের পেছনে কাজ করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এজন্য আমাদের সামাজিক ও প্রচলিত নেতিবাচক আচরণগুলোকে পাল্টাতে হবে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবেও পদক্ষেপ নিতে হবে।

বড়দের নিষ্ঠুরতার কাছে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। সেই নিষ্ঠুরতা অনেক সময় বাবা-মার কাছ থেকেও আসে, বাইরের মানুষ থেকেও আসে। সব থেকে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে সুরক্ষা। শিশুরা নিরাপদ নয়। শিশুর নিরাপত্তা খুব জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে বাস করার নিরাপত্তা। স্কুলে আসা-যাওয়ার নিরাপত্তা। খেলাধুলা-বিনোদনের নিরাপত্তা। মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার নিরাপত্তা। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করার নিরাপত্তা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। সেজন্য শিশুরা নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হলেও তার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।

পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ২০২১ সালে ১৮৩টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭টিতে। তবে এই এক বছরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪১৯টি। যা ২০২১ সালের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এছাড়া এই এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশু নিয়ে সংবাদ প্রকাশও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ, যা সংখ্যা ১৯৬টি।এমজেএফের শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২’ শিরোনামে করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো-যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৪, অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫টি শিশু। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩০১, যা আগের বছরের তুলনায় ৯৪ শতাংশ কম

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে ৩১১টি শিশু অন্যান্য দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এই বছরে ৫৬০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের বছরের (২০২১) তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৯৮টি শিশু, যা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৯৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার, ৩০ শিশু অপহরণ, ৬৮ শিশু নির্যাতন, ৩৩ শিশু নিখোঁজ ও ৯টি শিশুর বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে ৪৪টি শিশুর আত্মহত্যা করার খবর এসেছে সংবাদপত্রগুলোতে।বাবা-মার কাছে সন্তান সবসময় আদরের, ভালোবাসার। কিন্তু অনেকসময় সন্তানদের লালন পালনের ক্ষেত্রে বাবা মা শিশুদের মারধর করেন, যা একদমই উচিত নয়। শারীরিক নির্যাতনের ফলে শিশুদের মানসিক ক্ষতি হয়। আমাদের দেশে পজেটিভ প্যারেন্টিং নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই, এমনকি প্যারেন্টিং এর ব্যাপারেও নেই। আমরা আমাদের শিশুকে কীভাবে লালন পালন করব তা অবশ্যই জানতে হবে। নিয়মিত শারীরিক আঘাত ও বকাঝকা ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে।

শিশু নির্যাতন রোধে আপনার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে নিজে আগে জানা যে, কী উপায়ে আপনার শিশুকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারবেন। একইসঙ্গে আপনার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে শিশু নির্যাতন সম্পর্কে এবং সঙ্গে তাদেরকেও বোঝাতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো। তবে যদি শিশুর মধ্যে নির্যাতিত হওয়ার কোনো লক্ষণ পেয়ে থাকেন, তবে দেরি না করে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিন। যত দ্রুত আপনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন, আপনার সন্তানের জন্য ততই তা মঙ্গলজনক হবে। ছোট শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। ছোট শিশুরা প্রতিহত করতে পারে না, ভয়ে ঘটনা গোপন করে। ফলে তারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে গণমাধ্যম অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

আগস্টে ২৭৩ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার

চলতি বছরের আগস্ট মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৭৩ জন নারী ও কন্যা শিশু। এর মধ্যে ১৩৫টি শিশু। ধর্ষণ, হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ অথবা আত্মহত্যার প্ররোচনার মতো ৩৫ ধরনের নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। সারা দেশে ৪৩ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছেদেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। নারী নির্যাতনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ধর্ষণের ঘটনা। চলতি বছরের আগস্ট মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৬১ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন। ধর্ষণ এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৫১ জন।

আগস্টে আত্মহত্যা করেছেন ২৮ জন। তাঁদের মধ্যে ১৩টি শিশু এবং ১৫ জন নারী। নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২২ জন। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। তাঁদের মধ্যে ৮টি কন্যাশিশু, ১৫ জন নারী। আগস্ট মাসে সারা দেশে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। একই কারণে নির্যাতিত হয়েছেন ৮ জন। ১৭ জন কন্যাসহ অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছে একটি শিশু।

শিশু নির্যাতন ও আমাদের ভেঙে পড়া সামাজিক রীতি

কাগজে-কলমে এ দেশের ক্ষমতাহীনদের নিরাপত্তায় আইন রয়েছে। কিন্তু আমাদের আইনি ব্যবস্থা এতটাই জটিল, নানা স্তরে বিভক্ত, দুর্বহ, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল যে, দরিদ্ররা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আইনের সহায়তা নেওয়ার চেয়ে তা মেনে নেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন।নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার স্থানীয় পৌরসভা মেয়রের বিরুদ্ধে ৭ ও ১১ বছর বয়সী ২ শিশুকে নির্যাতন, মারধর ও হাত বেঁধে ২ কিলোমিটার পথ হাঁটানোর অভিযোগ উঠেছে। মেয়রের দাবি, ওই ২ শিশু একটি পরিত্যক্ত কারখানা থেকে কিছু পুরনো যন্ত্রপাতির জং ধরা নাট-বল্টু 'চুরির চেষ্টা করছিল'। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় বেশ কিছুদিন ধরেই কারখানাটি উন্মুক্ত পড়ে আছে। ওই ২ শিশু সেখানে খেলতে গিয়ে কয়েকটি নাট-বল্টু হাতে তুলে নেয়। তারা হয়তো সেগুলো নিয়ে খেলতে চেয়েছিল। মেয়র দূর থেকে ঘটনাটি দেখতে পেয়ে রেগে যান এবং ওই শিশুদের মারধর ও নির্যাতন করেন।

এটা হঠাৎ রেগে গিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনা নয়। তিনি সেখানে তার ক্ষমতার প্রদর্শন করেছেন। ওই ২ শিশুকে তিনি হাত বেঁধে স্থানীয় বাজারে সবার সামনে ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘুরিয়েছেন। সেই সময় ওই শিশুদের অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা মেয়রের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চান। শেষ পর্যন্ত ওই শিশুদের ক্ষমা করা হয়, কিন্তু তার আগে তাদের মাথার চুল কেটে দিয়ে জনসমক্ষে চূড়ান্তভাবে অপমান করা হয়। এই শাস্তির কারণ হলো, তাদের ছোট চুল দেখে যেন মানুষ তাদের চোর হিসেবে চিনতে পারে এবং বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রূপ ও মৌখিক হয়রানির সুযোগ থাকে, যেন তাদের শাস্তিকে আরও দীর্ঘায়িত করা যায়।প্রথমত, এটি সামাজিক শ্রেণি ও অবস্থানের বিষয়। আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি— ৭ ও ১১ বছর বয়সী ওই ২ শিশু যদি ওই মেয়রের মতো একই সামাজিক অবস্থান, সম্পদ অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী কোনো পরিবারের সন্তান হতো, তাহলে তিনি কখনোই তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারতেন না।

দ্বিতীয় কারণটিও ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মেয়র নিশ্চিত ছিলেন, ওই ২ শিশুর অভিভাবক বা পরিবারের সদস্য পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কারণ, সেখানেও হয়তো মেয়রের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তা ছাড়া, তাদের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থার সঙ্গে কোনো ধরনের 'যোগাযোগ' নেই, যারা মেয়রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে।২০১৯ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের কাছ থেকে সহিংস শাস্তি ও আগ্রাসী ব্যবহারের শিকার হয়
২০২২ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের পথশিশুদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত এবং ২১ শতাংশ শিশু মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ জানিয়েছে, ১০ বছর বয়স থেকে তারা মাদক গ্রহণ করছে।

বেড়েছে শিশু নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যা

দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে মোট ৮০৪ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১০৯ শিশু। মোট ২২৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই সময় ১০৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ সময় ২৭ জন ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সংস্থা দুটি জাতীয় গণমাধ্যম ও নিজেদের কিছু সোর্সের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে।

এক বছরে শিশু নির্যাতন বেড়েছে ৫ শতাংশ। গত ছয় মাসে ২৪৬ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। এ সময় আত্মহত্যা করেছে ৪৫ শিশু। বিভিন্ন সময়ে মোট ৮৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে চার শিশুর। মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন মতে, গত ছয় মাসে ২০টি বাল্যবিবাহ ঘটে। ১৪টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়। মহিলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। মহিলা পরিষদ বলছে, গত ছয় মাসে মোট ৭৩২ জন কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়। ছয় বছর বয়সের মোট ২১ জন শিশুকে এ সময় ধর্ষণ করা হয়। আসকের ছয় মাসের শিশু অধিকার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ সময় ২৭ জন ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়। এক জন ছেলে শিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়।

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, মাদ্রাসায় ও দুর্যোগের সময়গুলোতে ছেলে শিশুর বলাৎকার বেশি ঘটে। ১৯৯৬ সালে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতি ১০ জনে ৭ জন মেয়ে শিশু ও প্রতি ১০ জনে ৫ জন ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতন সাধারণ মানুষ মেয়ে শিশুর মতো মনে করে না। তারা চেপে যায় প্রকাশ করে না। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সমন্বয়ক সাফিয়া সামি বলেন, ছেলে শিশু বলাৎকার আগেও হতো, কিন্তু মানুষ প্রকাশ করত না। এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে, তবে সংখ্যায় অনেক কম। এসব ঘটনা প্রকাশ প্রতিকার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন সাফিয়া।বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, গত ছয় মাসে ছয় বছরের মধ্যে ২১ জন শিশু এবং  ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৩২ জন শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর হত্যা হরা হয় ৯ জন শিশুকে। এ সম্পর্কিত কারণে আরো চার শিশুকে হত্যা করা হয়।

শিশুসুরক্ষার আইন আছে প্রয়োগ নেই

ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এভাবে শিশু অপরাধীদের বিচার হয়। আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসনের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, শিশুদের জন্য আলাদা কোনো আসন বা এজলাসও নেই। লালসালু ঘেরা আদালতকক্ষে দাগি আসামিদের সঙ্গে একই এজলাসে বিচার চলছে শিশু আসামিদের।
২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপ-বিধি (১) এর সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ করিয়া আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করিবে।’

শিশু আইনের ১৯ (৪)ধারায় বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু-আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালতকক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করিতে পারিবেন না। গ্রেফতার করিবার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না।’দাপ্তরিক ইউনিফরম পরে কোনো শিশুকে আদালতে না আনার কথা থাকলেও আইনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে একদিকে শিশু আইনের বিধানকে অমান্য করা হচ্ছে, অপরদিকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।

শিশুশ্রম করালে জরিমানার বিধান থাকলেও বাস্তবায়ন নেই

কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করলে জরিমানার বিধান থাকলেও এর বাস্তবায়ন খুবই কম। নিয়োগকর্তারা কম পারিশ্রমিকে অধিক লাভের আশায় শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করছেন। শিশুরাও আর্থিক সচ্ছলতার আশায় শেষ করছে তাদের সোনালি শৈশব-কৈশোর। শ্রম আইনের ২৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করে অথবা এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করিয়া কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরি করিবার অনুমতি দেন তাহলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ শ্রম আইনের ২৮৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুর পিতা-মাতা বা অভিভাবক বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশু সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদন করিলে তিনি এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’

বাড়ছে শিশুশ্রম, লাগাম টানতে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার সার্ভে ২০২২ এর প্রতিবেদন বলছে, মাজেদুল ও রিপনের মতো দেশে এখন শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর। এ সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। ১০ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৬ হাজার ৫৫৮ জন। তবে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন। ২০১৩ সালের জরিপে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। এক্ষেত্রে শিশুশ্রম বেড়েছে ৭৭ হাজার ২০৩ জন।ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ মিলিয়নে।

বিগত চার বছরের তুলনায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ লাখ। এই উদ্বেগজনিত হারে শিশুশ্রম বৃদ্ধির জন্য মূলত দরিদ্রতাকেই দায়ী মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো নতুন নয়। আইন করেই বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে শিশুশ্রম। তারপরও কমছে না।বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরদের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার চুক্তি করতে পারবেন না। তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, ৯০ দশকে যত সংখ্যক শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো তা এখন অনেকটা কমে গেছে। এজন্য যথাযথ আইন প্রণয়নসহ বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা শিশুশ্রমে নিয়োজিত করে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুরা কেন শ্রমে যায় সেটাও দেখতে হবে। আইনে যে জরিমানা বা শাস্তির বিধান রয়েছে তা কম। আইনের সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠোর করতে হবে

সাবেক বিশেষ পিপি ও আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে তো অনেক আইনই আছে, বাস্তবায়ন কয়টা হয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আইনে তা আছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। শিশুশ্রম নিরোধ করতে হলে আইনের বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। আইন আরও শক্তিশালী করতে হবে। আইনে জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে।মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি জাগো নিউজকে বলেন, শিশু অপরাধীদের জন্য আলাদা আইন হলেও আদালত হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শিশুদের বিচার হচ্ছে। যেখানে ধর্ষণ মামলার আসামিদের বিচার হয়। একই এজলাসে থাকায় ধর্ষণ মামলার আসামির বিচার তারা শোনে। এতে তাদের মানসিক ক্ষতি হয়।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, যারা শিশুদের দিয়ে শ্রম করায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগটা অনেক কম। আইন করার পরও যদি তা প্রয়োগ না করা হয় তাহলে আইনের কোনো মূল্যায়ন থাকে না। শাস্তি নিশ্চিত করা হলে শিশুশ্রম অনেকটা কমে আসবে।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও গ্রাম ও শহরে সমানতালে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ সরকার নানানভাবে শিশুশ্রম বন্ধের চেষ্টা করলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ই পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং যারা শিশুদের ব্যবহার করে তারাও অল্প খরচে তাদের কাজে খাটাতে পারছে। এজন্য কাজে লাগাচ্ছে।

১০ বছর পেরোনোর আগেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশু

এ বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) প্রকাশিত ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন অ্যান্ড ইটস অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস ইন আরবান এরিয়া অব ঢাকা, বাংলাদেশ’ (‘ঢাকা শহরে শিশুর প্রতি সহিংসতা ও সম্পর্কিত কারণ’) শিরোনামের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে এমন সব অভিজ্ঞতার ছবি। গবেষণায় দেখা যায়, ৮৮ শতাংশ শিশু কমপক্ষে একবার এবং ৫৫ শতাংশ শিশু একাধিকবার শারীরিক (মারধর, চড়, লাথি, চুলটানা, কানমলা, হাত মোচড়ানো), মানসিক (বকাঝকা, চিৎকার, গালি, অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা, অপমান) এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে

বিইউএইচএসের প্রতিবেদনটি স্থান পেয়েছিল মে মাসে আইসিডিডিআরবি আয়োজিত ‘জাতীয় সম্মেলন ২০২৩’-এর সেরা তিন উপস্থাপনার তালিকায়। গবেষণাটি হয় ২০১৯ সালে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুরের দুটি ওয়ার্ডে। অংশ নেয় ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪০১ শিশু। অধিকাংশই স্কুলশিক্ষার্থী, বসবাস পরিবারের সঙ্গে। বেশির ভাগের বাবাই কাজ করেন, মায়েরা থাকেন বাড়িতে। ১০ বছর বয়সের আগেই এর অধিকাংশ শিশুর নির্যাতনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।

নির্যাতন: শারীরিক, মানসিক, যৌন

বিইউএইচএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গবেষণায় অংশ নেওয়া শিশুদের মধ্যে খেলার মাঠে প্রায় ৬৫ শতাংশ শারীরিক, ৩২ শতাংশ মানসিক ও প্রায় ৩ শতাংশ যৌন; পরিবারে প্রায় ৫৮ শতাংশ শারীরিক ও ৪২ শতাংশ মানসিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৬ শতাংশ শারীরিক ও ৪২ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছে ১ শতাংশেরও কম শিশু।

পরিবারের সদস্যরাই শিশুদের নির্যাতন করে বেশি—৩৯ শতাংশ। এর পরপর শিক্ষক, আগন্তুক, বন্ধু ও প্রতিবেশীরা যথাক্রমে ১৭ এবং প্রায় ১৫, ১৩ ও ৫ শতাংশ করে। এদের বাইরে সহপাঠী, স্বজন ও নিয়োগকর্তাদের হাতেও তারা কমবেশি নির্যাতিত হয়। সঙ্গী ও সেবাদানকারীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় যথাক্রমে ৫৫ ও ৩৯ শতাংশ শিশু।গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া বিইউএইচএসের প্রজনন ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বেগম রওশন আরা প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণাটি তাঁরা করেছিলেন শিশু নির্যাতন রোধে সচেতনতা গড়ে তুলতে। কারণ, নির্যাতন শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। নির্যাতনে বেড়ে ওঠা শিশুর ভবিষ্যতে নির্যাতক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

খেলার মাঠ শিশুবান্ধব নয়

বিইউএইচএসের প্রতিবেদন অনুসারে, খেলার মাঠে আগন্তুক ও বন্ধুদের হাতে শারীরিক নির্যাতনের হার ৬৫ শতাংশ।

যৌন নির্যাতন নিয়ে কেউ বলে না

সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে শিশু নির্যাতনের বিষয়ে সহায়তা চেয়ে কল এসেছিল ৮ হাজার ২১টি। একই বিষয়ে কল এসেছিল ২০২০ সালে ৫ হাজার ২৭৫ এবং ২০২১ সালে ৬ হাজার ৩৮৮টি। নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোনো শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ, ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন করে এবং এতে শিশুর অহেতুক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও মানসিক বিকৃতি হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

দরিদ্র শিশুদের সুরক্ষায় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফ পরিচালিত চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট মো. এমরান খান বলেন, শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সমাজকর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি পদক্ষেপ কম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, নিজেদের অভিযোগ জানানোর জন্য পথ খোলা রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ বা পথে শিশুদের জন্য বিনা মূল্যের টেলিফোন বুথ রাখতে পারলে ভালো হতো।

নীরবতা ভাঙা জরুরি

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো নির্যাতনই শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। মারধর আর বকাঝকার মধ্যে বড় হওয়া শিশু ভয়ে কিছুই প্রকাশ করতে চাইবে না। যৌন নির্যাতনের কথা সে গোপন করবে। ফলে প্রতিকারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।এতে শিশুর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে। শিশুর প্রতি ঘরে-বাইরে যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রতিরোধ করতে এ বিষয়ে নীরবতা ভাঙা দরকার। অনেকে মনে করেন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে তবে সেটা যৌন নির্যাতন। আসলে যেকোনো মন্দ স্পর্শই যৌন নির্যাতন।

শিশুর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে’

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নারী ও শিশুর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রকল্প, আইন ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী, জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে।তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধন ২০২০ আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করায় দ্রুত অপরাধী শনাক্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে। আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ছিল ৪৫টি, সরকার ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০৬টি করেছে। বহুমুখী এসব কার্যক্রমের ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন কমেছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি এবং সাতটি বিভাগ এবং ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য মনঃসামাজিক কাউন্সেলিং প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং আটটি রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ন্যাশনাল হটলাইন ১০৯ থেকে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়।তিনি বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৪টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ৪৭টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে।

নারী-শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের আহ্বান

নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম।নারী নির্যাতনের সংখ্যা, ধরন ও তীব্রতা বেড়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সরকারি উদ্যোগ আরো কমে গেছে। সরকারি বেসরকারি তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন মাসে গড়ে ৩৫০টি মামলা বেড়েছে। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, প্রতারণা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের আরেকটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। আর অন্যদিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের বাজেট  গত ছয় বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম। এ সময়ে বাজেট কমেছে ৬৩ শতাংশ।বিচারহীনতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয় অপরাধ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণের মামলায় ৯৭ শতাংশেরই কোনো সাজা হয় না। ফলে অপরাধী আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অর্থ ও ক্ষক্ষতার বলয়ে থাকলে খুন-ধর্ষণ যেকোনো অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, এই হচ্ছে বাস্তবতা।  মুনিয়া হত্যা, তনু হত্যার বিচার না হওয়া সেটাই প্রমাণ করে।

শিশু নির্যাতন বেড়েছে

শ্রমে নিযুক্ত সব শিশু কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। গত বছর শিশু নির্যাতন ২০২১ সালের তুলনায় বেড়েছে। শিশু হত্যার ঘটনাও গত বছর বেড়েছে। এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এ সময় গৃহশ্রমকে শিশুশ্রমের তালিকাভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, গৃহশ্রমে নিযুক্ত বেশিরভাগই শিশু এবং তারা অধিক হারে নির্যাতনের শিকার।

সমকালসহ আটটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকার বিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা করে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। 'বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২২ :সংবাদপত্রের পাতা থেকে' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে ৩১১ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এবং অন্য ৪২ শিশুকে হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। ২০২১ সালে হত্যার শিকার হয়েছিল ১৮৩ শিশু। গত বছর ৬৮ শিশু ভয়াবহ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২১ সালে ভয়াবহ নির্যাতনের ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনকারীদের মধ্যে আছেন গৃহকর্তা, বাবা-মা, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, স্থা নীয় চেয়ারম্যান, চাকরিদাতা, প্রতিবেশী এবং সৎমা।

সংবাদ সম্মেলনে শিশু পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করেন এমজেএফের কো-অর্ডিনেটর রাফেজা শাহীন। তিনি জানান, বাল্যবিয়ের হার ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৯৪ শতাংশ কমেছে। ২০২১ সালে দেশের ২৩টি জেলায় ৪১ হাজার ৯৫টি বাল্যবিয়ের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালে বাল্যবিয়ের সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ২ হাজার ৩০১টি। করোনার সময় অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে স্কুল বন্ধ থাকায় ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেলেও ২০২২ সালে তা কমেছেপ্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-এর তুলনায় ২০২২ সালে শিশু ধর্ষণের হার কমেছে ৩১.৫ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৬০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ৯৮ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১২ শিশু। ২০২১ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮১৮।


খবর বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। একইভাবে পারিবারিক কারণেই বাল্যবিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারের পরিচিত লোকদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়াও প্রতিবেশীদের হাতে শিশুদের একটি বড় অংশ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তিন-চার বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুরা অধিক হারে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বেশির ভাগ শিশুকে খেলার সময় লোভ দেখিয়ে পরিচিতরা ধর্ষণ করেছে। মূলত কম বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার বেশি হচ্ছে। কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বন্ধুদের দ্বারা, কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে যাওয়ার পথে ও পরিবারের ভেতরে।২০২২ সালে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে পানিতে ডুবে ৪০৫ শিশু মারা গিয়েছিল, ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ হাজার ১৫২। এর মধ্যে ৫২০ মেয়ে শিশু ও ৬৩২ ছেলে শিশু।

যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে কমলেও, ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার হার বেড়েছে। ২০২২ সালে মোট ৯৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশু ২০। ২০২১ সালে ছিল ৬ জন। বিভিন্ন কারণে গত বছর আত্মহত্যা করেছে ৪৪ শিশু। এদের মধ্যে ২৭ মেয়ে ও ১৩ ছেলে। ২০২১ সালে আত্মহত্যা করা শিশুর সংখ্যা ছিল ৭৮। এদের মধ্যে ছেলে শিশু ৫৭ ও মেয়ে শিশু ২১। মূলত পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, পরিবারের ওপর রাগ, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, উত্ত্যক্ত হওয়ায়, ধর্ষণের শিকার হওয়ায় বা ধর্ষণচেষ্টা করায়, ধর্ষণের বা শ্নীলতাহানির বিচার না পাওয়ায় এবং সাইবার ক্রাইম বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

শিশু নির্যাতন বাড়ছে কেন

শিশুর প্রতি ব্যতিক্রমধর্মী সহিংস ঘটনা সংখ্যায় কম হলেও তার বহিঃপ্রকাশ মানুষের মনকে নাড়া ও অপরাধ-ভীতি তৈরি করে; যার ফলে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এবং এটি একটি দেশের মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।পারিবারিকভাবে শিশুর প্রতি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, পরীক্ষা ও ফলাফলকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের অধিক গুরুত্ব প্রদান।অর্জনকেন্দ্রিক এ প্রবণতা শহরাঞ্চলে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা তাদের শৈশবকে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত করছে। বিভিন্ন ধরনের অনুশাসনের (যেমন পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি) চর্চা থেকেও কিছু শিশু সহিংসতার শিকার হচ্ছে।সন্তানের ওপর অভিভাবকের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে অনেক সময় মা-বাবা শিশুদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক নির্যাতন করছেন। অভিভাবকের এরূপ আচরণের কারণে অনেক শিশু আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে।

অনেক সময় কোমলমতি শিশুদের একাকী স্কুল ও কোচিং সেন্টারে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এছাড়াও অভিভাবকরা বিশ্বাস করে শিশুদের শিক্ষকের বাসায় পড়তে পাঠাচ্ছেন।কিন্তু বাড়িতে বা অন্য কোনো স্থানে মেয়ে শিশুর একাকী অবস্থান তাকে অনিরাপদ করে তুলছে। সামাজিক অনুশাসন বিচ্যুত কিছু মানুষ নির্জন পরিবেশে স্কুল, কোচিং সেন্টার, যানবাহনসহ অন্যান্য স্থানে ধর্ষণ করছে।কখনও কখনও শিশুরা নিজ বাড়িতেও গৃহশিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া মাদ্রাসাভিত্তিক এতিমখানার অসহায় বাচ্চাদের ওপর অনেক সময় শিক্ষকরা লেখাপড়ার জন্য নিষ্ঠুর আচরণ করছেন, যাদেরকে একাডেমিক স্লেভও বলা হয়।বিশেষ করে, প্রবাসীর স্ত্রী’রা কখনও কখনও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের সন্তানকেও হত্যা করে ফেলছেন। অর্থাৎ নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে বা যথাযথ সামাজিকীকরণের অভাবে পরকীয়ার বলি হচ্ছে শিশুরাও।

শহরের নিম্নআয়ের বিশেষত বস্তির মানুষ একই কক্ষে পরিবারের অনেককে নিয়ে বসবাস করায় নিজ স্ত্রীর সঙ্গে জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ কম পাচ্ছেন। ফলে এ শ্রেণীর মানুষরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শিশু ধর্ষণেও দ্বিধা করছে না।বর্তমানে বিয়ের প্রবণতা কমে গিয়ে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড নামক নতুন পশ্চিমা সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে বিয়ের আগে অনেকেই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে ভ্রƒণ ও নবজাতক হত্যা করছে।মোটিভেটেড ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা ঘটনাকালীন অনেকটাই অবচেতন মনে থাকে, যেখানে সে তার দ্বারা সংঘটিত কার্যটির ভয়াবহতা ও ভবিষ্যৎ ফলাফল অনুধাবনে ব্যর্থ হয়।তাছাড়া পর্নোগ্রাফি দেখেও যুবসমাজ বিচ্যুত হচ্ছে। কিছু মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে বহুগামিতা বা শিশুর প্রতি যৌন উত্তেজনা অনুভব করার বিষয় থাকলেও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধের অভাবে নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে।

মা-বাবা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য কর্মস্থলে বা বাইরে থাকার কারণে শিশুরা প্রতিবেশী দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষ বিশেষত গার্মেন্টস কর্মীদের বাচ্চারা বাসায় একাকী বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।অনেক সময় বাচ্চার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক বাবা-মা শিশুকে শ্রমে নিয়োগ করছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে শত্রুতার জের ধরেও শিশুরা নির্মমতার শিকার হচ্ছে।আবার প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজের শিশু সন্তানকে হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনাও ঘটছে, যা সমাজে কাক্সিক্ষত নয় এবং প্রচলিত মূল্যবোধের পরিপন্থী।শিশুদের শারীরিক শক্তি কম এবং প্রতিরোধে যথেষ্ট সক্ষম না থাকায় অপরাধীরা তাদের উপযুক্ত টার্গেট হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

বিআইএসআরের এক গবেষণা (২০১৩) মতে, যেখানে অপরাধী এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে ভিকটিম দ্বারা চ্যালেঞ্জ বা প্রত্যাখ্যান, প্রতিরোধ এবং পরর্তী সময়ে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ দেখে, সেখানে এ ধরনের অপরাধ করে থাকে।শিশুরা বুদ্ধিতে অপরিণত থাকায়, অনেক সময় নির্যাতনকারীর সামনেই ঘটনাটি জানিয়ে দেয়ার কথা বলে। ফলে শিশুরা ধর্ষণ বা বলাৎকারের ঘটনাটি বলে দিতে পারে- এই সন্দেহ বা প্রমাণ লুকানোর জন্য নির্যাতনকারী শিশুটিকে হত্যাই করে ফেলে।

শিশুর প্রতি সহিংসতা কমানোর জন্য যা করা দরকার

নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কখনও শিশুদের একাকী না রাখা;  স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কর্মজীবী হলে শিশু সন্তানকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে বা বিকল্প ব্যবস্থায় রাখা;  গৃহকর্মীকে নিয়মিতভাবে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার মাসিক পরিদর্শনে রাখা; সম্ভাব্য অপরাধী ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিকটিমকেন্দ্রিক প্রচারণা চালানো; জনসাধারণকে অপরাধ প্রতিরোধে দায়িত্বশীল ও সমাজ স্বীকৃত উপায়ে যৌন চাহিদা মেটানো; এবং  অপরাধীর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

বিগত বছরের তুলনায় শিশু নির্যাতন বেড়েছে দ্বিগুণ

সিএমপি’র ১৬ থানা এলাকায় শিশু নির্যাতন বেড়েছে। ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে দ্বিগুণ।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বার্ষিক প্রতিবেদনে শিশু নির্যাতনের এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার ১৮ থানায় শিশু নির্যাতনের মামলা বাড়ছে।২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সিএমপির ১৬ থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনা মামলা হয়েছে ১৪৩টি।  ২০২১ সালে মামলা হয়েছিল ৬৬টি। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলার ১৮ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৩২৩টি। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু নির্যাতনের মামলা বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও)।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল দ্রুত বিচার করতে পারেন, সেজন্য জনবল বাড়াতে হবে। আইন প্রয়োগে নজরদারি রাখতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা বন্ধে যে আইন রয়েছে, তা মূলত প্রতিরোধমূলক। সেটিও ঠিকঠাক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এজন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

শিশু নির্যাতন : সালিস-মীমাংসায় পার পাচ্ছেন অপরাধীরা

তিন বছর ধরে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা কমছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও আইনজীবীরা বলছেন, নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও অনেক সময় তা মামলা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে সালিস করে অভিযোগ মীমাংসা করে দেওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ও সমাজপতিদের চাপ উপেক্ষা করে মামলা করা হলেও বিচার শুরুর আগেই বেশির ভাগ আসামি মুক্তি পাচ্ছে।রায়ের পর সাজা পাচ্ছে অল্প কয়েকজন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ৩.৬৬ শতাংশ।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারে বিলম্ব, জামিনে মুুক্তি পেয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারকে অপরাধীর হুমকি, সালিসে মীমাংসা করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াসহ রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দায়ী, যার কারণে মামলা না করে মীমাংসার পথে হাঁটছে ভুক্তভোগীরা। আর শাস্তি না হওয়ায় আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে অপরাধীরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা দেশে ১২ হাজার ২৬৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা করা হয়। ২০২১ সালে ১৫ হাজার ৭৮৩টি এবং ২০২০ সালে ১৫ হাজার ৯৪৬টি মামলা করা হয়। অর্থাৎ তিন বছর ধরে মামলার সংখ্যা কমছে।গত বছরের জুলাই মাসে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে খুলনায় গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়।গত বছরের নভেম্বরে দেশের ছয়টি বিভাগের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ৩৮৫টি মামলা নিয়ে ব্র্যাক একটি জরিপ করে। মামলাগুলোয় আসামি ছিল ৯৮৪ জন। এর মধ্যে ৪৭৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু হয়। অভিযোগ থেকে মুক্তি পায় ৫০৫ জন। বিচারে ৩৬ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। বেকসুর খালাস পায় ৪৪৩ জন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ৩.৬৬ শতাংশ। ৩৮৫টি মামলার মধ্যে ২৯৮টি মামলাই প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। খালাস পায় মামলাগুলোর আসামিরা।

আইন ও আয়নায় শিশু অধিকার

বাংলাদেশে আইনে শিশুদের অধিকার অনেক৷ তাদের অধিকার লঙ্ঘন হলে শাস্তির কথাও বলা আছে আইনে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূল৷ এখনো শিশুদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন হয়, শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়৷সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে একটি শিশু সহায়তা সেল আছে, যার নাম্বার ১০৯৮৷ টোল-ফ্রি এই নাম্বারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ফোন করে তাদের সমস্যা বা অভিযোগ জানাতে পারে৷ তারা আইনিসহ সব ধরনের সহায়তা করে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, তারা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাত লাখ ৮৩ হাজার ৮৪৫টি কল গ্রহণ করেছেন৷ তার মধ্যে ৯ হাজার ৮৭২ টি শিশু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার, আট হাজার ৩৪৭ টি পরিবারিক সমস্যা সমাধান, ১১ হাজার ২১৩ জন গৃহহীন ও সহায়সম্বলহীন হারিয়ে যাওয়া শিশুর নিরাপদ আবাস বা পরিবারে স্থানান্তর, ২০ হাজার ১৩৮ জন শিশুকে আইনি সহায়তা, ৫৩ হাজার ৪৫৩ জন শিশুকে স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ প্রদান, ১৯ হাজার ২১৭ জন শিশুকে বিদ্যালয়ে পড়াশুনার ব্যাপারে, স্কুল শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সহায়তা, ৬৬৮ জনকে মাদক ও অন্যান্য নেশার ব্যবহার ও ক্ষতি সম্পর্কে পরামর্শ ও নিরাময় সেন্টারে রেফার এবং দুই হাজার ৯৯৭ জন শিশুর বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন৷

সেলের ম্যানেজার মোহাইমেন চৌধুরী বলেন, ‘‘শিশুদের অভিযোগগুলো ১৯৮টি ভাগে ভাগ করা যায়৷ আমাদের কাউন্সেলিংয়ের টিম আছে৷ মোবাইল টিম আছে৷ সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে৷ আমরা প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সবার সহায়তা নিই৷ ফোন পাওয়ার পর তার তথ্য নিয়ে তাতে সহায়তা করি৷ এটা ফলোআপের মধ্যে রাখা হয়৷ আর শুধু শিশু নয়, তার সমস্যা নিয়ে অভিভাবক, প্রতিবেশী এমনকি পথচারি পর্যন্ত সবাই আমাদের সহায়তা চাইতে পারেন৷ আমরা শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী তাদের সহায়তা করি৷’’

নারী নির্যাতন বাড়লেও সরকারি পদক্ষেপ কম

অর্থনৈতিক সংকটে সামাজিক চাপের মুখে পারিবারিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়েছে। ওই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে এখন নারী নির্যাতন কমেছে বলে সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ।

বাস্তবে ও ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে নির্যাতন বাড়ছে

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ।ধারণত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা গুরুতর হলে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৯টি পত্রিকা ও কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩ হাজার ১৮৪টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশই ধর্ষণের খবর।

অনলাইনেও নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপক বেড়েছে। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভুয়া আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেলিং, মুঠোফোনে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন ৮ হাজার ৭১৫ নারী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬৬১টি অভিযোগ এলেও গত নভেম্বরে এসেছে ৮২৬ অভিযোগ।পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তারা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী নির্যাতন বাড়ছে। নিজেদের পরিচয় গোপন করে অপরাধীরা অনলাইন মাধ্যমে সহজেই নারীদের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করে।

নির্যাতন প্রতিরোধে কমেছে বাজেট

পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনি কাঠামোয় লিঙ্গবৈষম্য নারী নির্যাতন বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন নারী আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা। গত জুলাইয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার অসমতাবিষয়ক ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। অথচ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪৮তম।লিঙ্গবৈষম্য ও নারী নির্যাতন বাড়লেও অর্থনৈতিক সংকটে কাটছাঁটে পড়েছে নারীবিষয়ক প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো। ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম’ প্রকল্পটিকে সরকার ‘ফ্ল্যাগশিপ’ (অতিগুরুত্বপূর্ণ) বলে থাকে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ১১টি মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত সেবা দেয়। গত ছয় বছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) এই প্রকল্পে সবচেয়ে কম ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

নির্যাতন কমেছে বলার সুযোগ নেই

ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন মামলা কিছুটা কমলেও তা সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন কমার চিত্র প্রকাশ করে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান।প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটে সামাজিক চাপের মুখে পারিবারিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়েছে। ওই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে এখন নারী নির্যাতন কমেছে বলে সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। কারণ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি ও বিশিষ্ট নাগরিক—দুই পর্যায় থেকেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।

নারী ও শিশু নির্যাতন: মামলা বেশি বিচার কম

নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে আইনের দারস্ত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হওয়ায় সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। বিষয়টি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় থেকে ধর্ষণ নির্যাতন সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে হচ্ছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বিদ্যমান আইন সংশোধন করার দাবি উঠে। নারী নির্যাতন তথা নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনও পাস হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা এর সুফল পাচ্ছেন না। বরং উল্টো কেন মামলা করা হচ্ছে এ নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি ও মারধরের শিকার হতে হচ্ছে।

শিশু নির্যাতনের বিধানসমূহ

শিশুদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫’ প্রণয়ন করেন, যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত।কোনো অভিযোগকারী যদি পুলিশের কাছে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন, তাহলে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন—এই মর্মে হলফনামা সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকে (প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ট্রাইব্যুনালও থাকতে পারে)। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত বা পরিচিত।

কখন এই আইনের ১১ (গ) ধারার অধীন মামলা দায়ের করা যায় :বৈবাহিক জীবনে পারস্পরিক মনোমালিন্যের জের ধরে ঘটে যাওয়া শারীরিক নির্যাতনের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই সবাই ১১(গ) ধারা, যৌতুকের জন্য সাধারণ আঘাত মামলা করতে চান। শারীরিক নির্যাতন বা মারামারি ঘটলেই তার জন্য ১১(গ)-তে ঢালাওভাবে মামলা করা যাবে না। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ঘটলে কেবল তখনই ১১(গ)-তে মামলা করা যায়। বিবাহিত জীবনে অন্য কোনো কারণে (যেমন:পরকীয়া আসক্ত হয়ে, ঝগড়া ইত্যাদি) মনোমালিন্য থেকে শারীরিক আঘাতে সাধারণ বা গুরুতর আঘাত করলে তার জন্য দণ্ডবিধির অধীন মামলা হতে পারে, তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০-এর অধীনে মামলা চলবে না।

বিএলসি (২০২০) ৮৫৭ :তালাকের পরে অর্থাৎ পূর্বে সংগঠিত অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্ক চলমান অবস্হায় সংঘটিত অপরাধের জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ (গ) ধারার অধীনে মামলা করতে পারবেন। তালাক হয়ে যাওয়া বা দাম্পত্য সম্পর্ক আর না থাকাতে মামলা করার অধিকার শেষ হয়ে যায় না। ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর মামলা চলবে কি না, তা বিচার চলাকালীন সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। [মো. তৌয়ব আলী মোল্লা বনাম সুলতান এবং গং ২২ বিএলটি ৮৮]মামলা আপস করা যাবে কি না : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ সালের পর ১১(গ) ধারা যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম ঘটানো অপরাধ এখন আপসযোগ্য। যৌতুকের দাবিতে সাধারণ জখম ঘটনানোর অপরাধে মামলা চলাকালীন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে এবং তারা বর্তমানে একত্রে বসবাস ও দাম্পত্য জীবন বলবৎ রেখেছেন মর্মে আদালতে আপসমূলে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

রায় ঘোষণার পরও আপস করা যাবে কি না : মামলার বর্তমান অবস্হা অনুযায়ী যদি মামলা শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তি দণ্ডিত হন, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৬১-এ অনুযায়ী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আপসের অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিয়ে দণ্ডিত দরখাস্তকারীর দণ্ড বাতিল এবং সাজা মওকুফ করতে পারবেন। [সাইফুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র ২৫ বিএলসি (২০২০) ৭৫৮]আপিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশ রায় বা আরোপিত দণ্ড দ্বারা সংক্ষুব্ধ পক্ষের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করার সময় ৬০ দিন। সংক্ষুব্ধ পক্ষ যদি উল্লিখিত সময় পার করে ফেলে, তাহলে তামাদি আইন, ১৯০৮-এর ধারা ৫-এর অধীনে বিলম্ব মওকুফ পাবে না। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি বিশেষ আইন।

গ্রামেও বেড়েছে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন, নেপথ্যে কী?

শিশু নির্যাতনেরকথা এত দিন শহরে বেশি দেখা গেলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও। গত এক বছরে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে শতাধিক শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। এটা বলা কঠিন, কোথায় কী হচ্ছে? গ্রাম আর শহর বলেন, প্রত্যেকটা ঘটনাই আলাদা। মন্দ লোক গ্রামে থাকতে পারে, শহরেও থাকতে পারে। তবে বলতে পারেন গ্রামে আগে একটু কম ছিল। আমরা নোটিশ করতাম না, অগোচরে হতো। তবে এখন মামলা হচ্ছে

শিশু ধর্ষণের ঘটনা আগেও হতো, বর্তমানেও হচ্ছে। তবে গ্রামাঞ্চলের ঘটনা আগে প্রকাশ পেত না। এখন প্রযুক্তির কারণে প্রকাশ হচ্ছে। আগে এসব ঘটনা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যেত। গ্রামের মানুষ এখনও পাশাপাশি থাকে। তারা একে অপরের পরিচিত। এজন্য লোকলজ্জার কারণে তারা মামলায় যেতে চান না। তাছাড়া সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যে এখনও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কাজ করে

শিশুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয়

বাচ্চার আরও ভালো করতে গিয়ে মা-বাবা... হয়তো বাচ্চাটা ক্লাসে নবম ও দশম হয়, আমার বাচ্চাটাকে ফার্স্ট হতে হবে। সেজন্য কম্পেয়ার ও ক্রিটিসাইস, দুটো শব্দ বলছি আমি। কম্পেয়ার বা তুলনা করে অন্য বাচ্চাদের সাথে এবং ক্রিটিসাইজ বা সমালোচনা করে। এতে মানসিকভাবে বাচ্চাটা খুব বেশি ভেঙে পড়ে। তাকে ওর মতো হতে হবে, তাকে আরও ভালো করতে হবে। অনেক বাবা-মা মারধর করে। সেটা কিন্তু ফিজিক্যাল অ্যাবিউস হয়ে যাচ্ছে এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। দেখা যায়, যারা ক্রমিকভাবে এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হয়, তারা একসময় ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়। যখন পেশেন্ট হিসেবে আসে ডক্টরের কাছে, পাস্ট হিস্ট্রি নিলে দেখা যায় এবং বাচ্চারাও ইদানীং অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশনে ভুগছে। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত চাহিদা, তোমাকে ফাস্ট হতে হবে পড়ালেখায়। এসব প্রভাব পড়ে।

শিশুদের পড়াশোনা করাটাও জরুরি, সে ক্ষেত্রে বাবা-মা থেকে কিছুটা ইনফ্লুয়েন্সও প্রয়োজন। সেটি আসলে কীভাবে নিশ্চিত করবেন, না কি এটি চাপের পর্যায়ে পড়ে যাবে; এই যে মধ্যস্থতার জায়গা, সেটি কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সঞ্চালকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. নাদিয়া আফরিন বলেন, বাচ্চাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা কমাতে হবে। সবাই তো ফার্স্ট-সেকেন্ড হবে না। সে অন্য কোন বিষয়ে ভালো, সেটা আমাদের তুলে ধরতে হবে। যেমন সে খেলাধুলায় ভালো বা গানে হয়তো ভালো করছে। তবে হ্যাঁ, বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সে যদি একেবারেই লেখাপড়া না করে, তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। মারধর করলে হয় কি, একটা সময় সেই মারের আর গুরুত্ব থাকে না। বাচ্চা মনে করে মারুক, আমি পড়ব না। বাচ্চারা যখন ডাক্তারের কাছে আসে, বাবা-মা অভিযোগ করে খুব জেদি, কথা শোনে না, ইরিটেটেড বাচ্চা, খুব রাগ। এ জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আসে। তখন বাচ্চার সাথে কথা বললে বোঝা যায়। আরেকটি জিনিস যেটা করা হয়, ছোট ভাইবোন বা বড়দের সাথে তুলনা করা হয়। এই কম্পেয়ার জিনিসটা বাচ্চারা নিতে পারে না।

শিশুর নিরাপত্তা ও অধিকার: প্রয়োজন আলাদা মন্ত্রণালয়

শৈশবে বেড়ে উঠার উপর নির্ভর করে আগামী। সুন্দর সেই আগামীর জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তাও। শিশু যতো সুন্দর পরিবেশে বড় হবে, তার ভবিষ্যৎ ততোই সৌন্দর্য ও সুভাস ছড়াবে। তিক্ত হলেও সত্য, দেশের অনেক শিশুই বেড়ে উঠছে অনিরাপদ পরিবেশে। বঞ্চিত হচ্ছে অধিকার থেকেও। বিষয়টি সমাজের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের বাধা বলেও মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।শিশুদের শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদন ও ক্রীড়ার মতো মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন এবং মানসিক বিকাশে সুযোগ তৈরি, ছিন্নমুল শিশুদের পুর্নবাসন, শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সব শিশুর সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভক্ত করে ‘শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


তথ্যসুত্র


শিশু নির্যাতন বাড়ছে কেন, Jugantor.

শিশু নির্যাতনের বিধানসমূহ, Ittefaq.

শিশুর নিরাপত্তা ও অধিকার, Jago News24.

মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় কী, NTV BD.

গ্রামেও বেড়েছে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন, Dhaka Post.

নারী ও শিশু নির্যাতন, Monob Kantha.

শিশু নির্যাতন দমন আইন, Prothom Alo.

আইন ও আয়নায় শিশু অধিকার, DW.

সালিস-মীমাংসায় পার পাচ্ছেন অপরাধীরা, Kaler Kantha.

শিশু নির্যাতন বেড়েছে দ্বিগুণ, Bangla News24.

শিশু নির্যাতন বেড়েছে, Samakal.

শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ, Rising BD.

শিশুর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, Bangla Tribune.

নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশু, Prothom Alo.

শিশুসুরক্ষার আইন আছে প্রয়োগ নেই, Jago News24.

শিশু নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যা, Ittefaq.

শিশু নির্যাতন, The Daily Star.

শিশু নির্যাতনের শিকার, Prothom Alo.

শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, Jago News24.