উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি (Corruption is the Main Obstacle to Development)
দুর্নীতি আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা। রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে শুরু করে পারিবারিক স্তর এমনকি ব্যক্তি জীবনে ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের কালো থাবায় সমাজজীবন আজ অতিষ্ঠ। প্রতিবছর দুর্নীতির কারণে খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবগুলো খাত থেকে ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর ফলে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের বিদেশের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়, এর পেছনের প্রধান কারণ হচ্ছে আইনের শাসন ও জবাবদিহির অভাব। দুর্নীতিবাজেরা জনগণের টাকা মেরে পকেট ভরলেও তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না এবং শাস্তিও পেতে হয় না। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত বিষয়টি বিবেচনায় এনে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।
আমরা যদি বাংলাদেশের অবস্থা পর্যালোচনা করি, তাহলে কী দেখতে পাই? বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করেছে, এটা যে কোনো মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে।বিশ্বে যে ১০টি দেশ উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪৪তম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৩০তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ নিকট-প্রতিবেশী অনেক দেশকে অতিক্রম করে গেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে আমাদের বড় অন্তরায় সীমাহীন দুর্নীতি
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা ১৯৬৮ সালের আগে দুর্নীতিকে কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে ধরতে রাজি হননি। প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল ১৯৬৮ সালে তার বিখ্যাত Asian Drama বইতে বলেছেন উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতিকে প্রতিহত করার কথা। তার এ বক্তব্য প্রথমে অর্থনীতির পণ্ডিতেরা মানতে রাজি হননি। পরে তারা কথাটির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে আমাদের বড় অন্তরায় সীমাহীন দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান দেয়। দুর্নীতির কারণে আমাদের সমাজে হলমার্ক, বিসমিল্লাহগ্রুপ তৈরি হয়; কয়েকটি ব্যাংক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়
দুর্নীতিগ্রস্ত লোক দেশের সব উন্নতির পথে বাধাস্বরূপ
সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থি। দুর্নীতি জাতির সব অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। কারণ, দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত। তিনি সব সময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে থাকেন। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের কল্যাণ, দেশের মঙ্গলের কথা তিনি চিন্তা করেন না। জাতীয় জীবনের উন্নতি, সমৃদ্ধির কথা ভাবতে তার বিবেক সায় দেয় না। এজন্য বিবেকবর্জিত, দুর্নীতিগ্রস্ত লোক দেশের সব উন্নতির পথে বাধাস্বরূপ, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বড় শত্রু।
উন্নয়ন ও অগ্রগতির বড় শত্রু দুর্নীতি
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)’ পরিচালিত দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। সম্প্রতি টিআই বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) ২০২০ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত রিপোর্টে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দুই ধাপ পিছিয়েছে। মোট ১৮০ দেশের তথ্য নিয়ে সংস্থাটি সিপিআই-২০২০ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র আফগানিস্তানই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, দেশটির স্কোর ৬৮। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।
২০১৯ সালে ছিল ১৪তম। সূচকে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এবারও বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। ১২তম অবস্থানে আরো রয়েছে উজবেকিস্তান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। টিআইবির মতে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের দুর্নীতির পেছনের অন্যতম একটি কারণ হলো, বাস্তবে উচ্চশ্রেণির দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার যথাযথ বাস্তবায়ন না করা। সূচক অনুযায়ী, সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। এরপরই রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশ দুটির স্কোর ৮৮। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত আফ্রিকান দেশ দক্ষিণ সুদান এবং সোমালিয়া। দেশ দুটির স্কোর ১২। উল্লেখ্য, টিআইর দুর্নীতির ধারণাসূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল তালিকার এক নম্বরে!
অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুর্নীতিই বড় অন্তরায়
দুর্নীতি সমাজ ও অর্থনীতির বড় অন্তরায়। দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে গিয়েছে। এই দুর্নীতি নির্মূল না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে। তাই আমাদের যেখানে যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যেন মানুষ দুর্নীতি করতে সাহস না পায়। এক জরিপে বেরিয়ে আসছে, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। ব্যবসার জন্য বিভিন্ন পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন করতে হয় ব্যবসায়ীদের। দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে ব্যবসার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদি সঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারে, তা হলে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা আমাদের কাজে লাগাতে হবে; কিন্তু দুর্নীতি আমাদের কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। দুর্নীতি দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। সেজন্য দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা হলেই আমাদের টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি।
দুর্নীতি দমনে মানসিকতার পরিবর্তন ও সদিচ্ছাই অপরিহার্য
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি সবকিছুর জন্যই নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিবেক, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জাগরণ দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করে। দুর্নীতি দমনে মানসিকতার পরিবর্তন ও সদিচ্ছাই অপরিহার্য। দুর্নীতি প্রতিরোধে কারিকুলামে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী বিষয় দুর্নীতি প্রতিরোধে সাহায্য করে। মহৎ মানুষের জীবন ও আদর্শই সাফল্যের বাতিঘর। শৈশব থেকে দুর্নীতির কুফল এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজের সুফলের ধারণা দিতে পরিবার ও বিদ্যালয়ের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনতে কর্তাব্যক্তির সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নৈতিকতামূলক শিক্ষা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে
দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে, যখন বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। দক্ষতা ও মানবিকতার বিকাশ, নৈতিকতা ও নিষ্ঠার অনুশীলন, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চর্চা প্রয়োজন। দুর্নীতি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড তদারকির আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে দুর্নীতিবাজরা বেরিয়ে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে, এই ভয়টা মানুষের মধ্যে গেঁড়ে দিতে পারলে সবাই ধীরে ধীরে দুর্নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এসব বিষয় নিয়ে সাধারণ জনগণ ও সরকারকে এখনই চিন্তাভাবনা করতে হবে। নৈতিকতামূলক শিক্ষা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে।
আইআরআই জরিপ বলছে, দেশের ৬৪ ভাগ মানুষের মতে, সঠিক পথেই এগোচ্ছে দেশ
আইআরআই জরিপ বলছে, দেশের ৬৪ ভাগ মানুষের মতে, সঠিক পথেই এগোচ্ছে দেশ। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে, আগামী বছর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নতি হবে। জরিপে উঠে আসা এসব তথ্যে বাংলাদেশের উন্নয়নে মানুষের আস্থার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। এ দেশের মানুষ যে আশাবাদী, এ জরিপের মধ্য দিয়ে সেটিরও প্রকাশ ঘটেছে বলা চলে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় যে কোনো দেশের উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা গুরুত্ব পাবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন চায়
বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন চায়, আর এজন্য তারা যেকোন মূল্যে শান্তি আর স্থিতিশীলতা চায়। তাই সহিংস ধরনের যে আন্দোলনের সংস্কৃতি আমাদের সরকারবিরোধীরা করছিল তা যে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, এই জরিপ তার আরেক প্রমাণ। তাই ৫১ শতাংশ মানুষের মত হল, তারা চায় বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এতে বোঝা যায়, জনগণের অর্ধেকের কিছু বেশি অংশ মনে করে, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা উচিত।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আসায় দেশের উন্নতি অগ্রগতি হয়েছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা যোগাযোগসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই। দেশ স্বাধীন হয়েছে সার্বিক দিক থেকে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের জন্য, দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, পেছনে ফেরার জন্য নয়। দুর্নীতির জন্য নয়।
দুর্নীতি অবশ্যই আমাদের উন্নতির প্রধান প্রতিবন্ধক
কোনো রাষ্ট্রে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব থাকে অর্থাৎ দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো কর্মকান্ডের জবাবদিহিতা করতে না হয়- তাহলে স্বাভাবিকভাবে সে রাষ্ট্রে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষ যেমন শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করবে তেমনি সেক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। দুর্নীতি অবশ্যই আমাদের উন্নতির প্রধান প্রতিবন্ধক। সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সরকারি অফিস আদালত বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হচ্ছে কিনা তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। তবে প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে দুর্নীতির সঙ্গে যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে দুর্নীতি দমন কঠিন হবে।
বিভিন্ন সেক্টরে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ
বিভিন্ন সেক্টরে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জনগণের ভোগান্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে বলে নির্বাচনি ইশতেহারে দাবি করা হয়েছে। সেইসঙ্গে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ চলমান থাকবে; প্রশাসনে দুর্নীতি নিরোধের জন্য ভূমি প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, আদালত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রে সূচিত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
বাস্তবতা হলো—সরকারের তরফে বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতির কথা ঘোষণা করা হলেও কোথাও দুর্নীতি কমেছে বা বন্ধ হয়েছে, সেটি বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা সরকারি অফিসগুলোয় ডিজিটাল সেবা চালুর পরেও নাগরিকদের ঠিকই সার্ভার ত্রুটিসহ নানা অজুহাতে অফিসে যেতে বাধ্য করা হয়। আর অফিসে যাওয়া মানে ঘুষ দিয়ে সেবা নেওয়া। তাহলে ডিজিটালাইজেশনের ফলে কোথায় দুর্নীতি কমলো, সেই প্রশ্নটি জনপরিসরে আছে।
একসঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানকে শত ভাগ দুর্নীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়—সেই সরকার যতই শক্তিশালী হোক। কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হয়, এরকম অন্তত একটি প্রতিষ্ঠানকেও কি শত ভাগ দুর্নীতি ও ঘুষমুক্ত করা সম্ভব নয়?
দুর্নীতি মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অপরাধগুলোর মধ্যে একটি
দুর্নীতি মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানব সভ্যতা বিকাশে এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনে দুর্নীতি প্রধান অন্তরায়। যে সকল দেশে সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে সেখানে দুর্নীতির ব্যাপকতা রয়েছে।
দুর্নীতি এমন এক অপরাধ, যা অন্যান্য অপরাধ দমনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অধিকাংশ অপরাধের অন্যতম উৎস হচ্ছে দুর্নীতি। কালের বিবর্তনে দুর্নীতির প্রকৃতি, রূপ, তীব্রতা ও প্রভাব ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এ বিবর্তনের মূলে রয়েছে সম্পদের উপর ব্যক্তির মালিকানা অর্জন এবং মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে অসঙ্গতি। জাগতিক সুখ এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাল্পনিক স্বপ্নে বিভোর কতিপয় মানুষের সীমাহীন লোভ দুর্নীতির অন্যতম কারণ। দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, দুর্নীতি কেবল গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি কি অনিবার্য?
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উন্নয়ন ও দুর্নীতি পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কাজেই একটি দেশের যখন দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে উত্তরণ ঘটে, তখন সে দেশে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিতে পারে।
দুর্নীতি অনেকটাই উন্নয়নের সহযাত্রী
দুর্নীতি অনেকটাই উন্নয়নের সহযাত্রী। অর্থাৎ তারা বলতে চান, একটি দেশ বা জনপদ যখন উন্নয়নের ধারায় ধাবিত হয় তখন সেখানে নানা পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে এবং প্রশ্নাতীত রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব। যে সরকার এটা করতে পারে সেই সরকারই আখেরে কামিয়াব হয়।
কোনো দেশই দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারেনি। এমন একটি দেশেরও উদাহরণ দেয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি একেবারেই নেই। উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি আছে তবে তা সীমিত বা সহনীয় পর্যায়ে।তাই দুর্নীতি সেসব দেশের প্রধান সমস্যা নয়। তবে একটি সমাজে কোনোভাবেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির বিস্তার সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দ্রুত উন্নয়ন এবং ব্যাপক দুর্নীতিও কাম্য হতে পারে না।অতি দরিদ্র কোনো দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হয় তখন সেখানে অবধারিতভাবে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এই সম্ভাব্য ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতি রোধ করতে পারাটাই একটি দেশের সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
আমাদের সমাজে দুর্নীতি একটা সামাজিক ক্যান্সারের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ক্যান্সার যেমন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুর দেশে পাঠিয়ে তারপর শান্ত হয়; দুর্নীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, জবাবদিহিতার অভাব, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট- এসব সামাজিক ক্ষত দেশটাকে তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে পঙ্গু না করে শান্ত হবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, সামাজিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, খুন, রাহাজানি, দেশি-বিদেশি কেলেঙ্কারি বিশ্বের মানুষকে বা সচেতন মহলকে দেশটি ও তার অর্থনীতি, রাজনীতি সংক্রান্ত যে বার্তা দেয় তা মোটেও সুখকর ও স্বস্তিদায়ক নয়। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণেও মানুষের মন থেকে, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে- দুর্নীতির ভাইরাস উৎপাটিত হচ্ছে না, চুরির প্রকোপ কমছে না।
তথ্যসুত্র
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের, BD News24.
দুর্নীতি অনেকটাই উন্নয়নের সহযাত্রী, Jugantor.
দুর্নীতি মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অপরাধগুলোর মধ্যে একটি, Dailyinqilab.
দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে, Bangla.The Dailystar.
উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক,, Jaijaidin.
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, Prothomalo.
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে , Jagonews24.
মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, Sharebiz.
দুর্নীতি নির্মূল না করতে পারলে , Dainikamadershomoy.
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি , Protidinersongbad.