যৌতুক (Dowry)

যৌতুক (Dowry)

যৌতুক সংজ্ঞা

যৌতুক বা পণ হল কন্যার বিবাহে পিতামাতার সম্পত্তির হস্তান্তর প্রক্রিয়া। 'যু' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন 'যুত' শব্দের অর্থ যুক্ত; বুৎপত্তিগত অর্থ হলো, পাত্র-পাত্রীর যুক্ত হওয়ার সময়ে অর্থাৎ বিয়ের সময় পাত্রীর জন্য যা কিছু মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হয়, তা যৌতুক।

সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় কিংবা বিয়ের আগে-পরে পাত্র বা বরপক্ষ কর্তৃক কনে পক্ষের কাছে কৃত দাবি-দাওয়াকে বুঝায়। অর্থাৎ পাত্রপক্ষ কনেপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে যে সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আদায় করে তা-ই যৌতুক। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, স্বামীপক্ষের দ্বারা বিয়ের পণ হিসাবে বিয়ে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বিয়ে স্থির থাকার শর্তে অর্থ, বিলাস সামগ্রী বা অন্যবিধ দাবিকে যৌতুক বলা হয়েছে।

যৌতুক কি?

সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় কিংবা বিয়ের আগে-পরে পাত্র বা বর পক্ষ কর্তৃক কনে পক্ষের কাছে কৃত দাবি-দাওয়াকে বুঝায়। অর্থাত্ পাত্র পক্ষ কনে পক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে যে সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আদায় করে তাই যৌতুক৷ ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে স্বামী পক্ষের দ্বারা বিয়ের পণ হিসাবে বিয়ে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বিয়ে স্থির থাকার শর্তে অর্থ, বিলাস সামগ্রী বা অন্যবিধ দাবিকে যৌতুক বলা হয়েছে।

বিবাহের এই পবিত্র বন্ধনকে কলঙ্কিত করছে যৌতুক প্রথা। এই যৌতুক প্রথা সমাজে এখন এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, যৌতুক ছাড়া বিয়ের কল্পনা করাও যেন বৃথা। সমাজ এটাকে ভীষণভাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু কেন? মেয়ের জন্মলগ্ন থেকেই গরিব বাবা–মাকে যৌতুক নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়। নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘যৌতুক প্রথা’।

যৌতুক এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যাধিবহু কবীরা গুনাহর সমষ্টি। যৌতুক প্রথার মাধ্যমে একজন পুরুষ স্ত্রীকে নয় বরং টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, যা নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মীয় এবং আইনগত দিক থেকে অবৈধ এই কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুকের বলি হয়ে দেশে প্রতি বছর অনেক নারী প্রাণ হারিয়েছেন।

সম‌য়ের পথ প‌রিক্রমায় দুষ্টক্ষ‌তের মতই বাসা বেঁ‌ধে‌ছে যৌতুক প্রথা অামা‌দের অন্ত‌রে ও সমা‌জে। অামা‌দের শরী‌রে যেমন অসংখ্য রো‌গের প্রাদুর্ভাব ঘ‌টে তেম‌নি অামা‌দের সমাজেও র‌য়ে‌ছে অজস্র রো‌গের বিস্তার ও বিচরণ। তার ম‌ধ্যে অন্যতম হ‌চ্ছে যৌতুক রোগ। সংক্রামক ব্যা‌ধির মতই যৌতুক রোগ বি‌ভিন্ন জা‌তি ও সমা‌জের র‌ন্দ্রে র‌ন্দ্রে প্র‌বেশ ক‌রে গোটা সমাজ ব্যবস্থা‌কে ভয়ংকর বিভী‌ষিকার দি‌কে ঠে‌লে দি‌চ্ছে।

যৌতুক নামক প্রথা, রোগ, বা বিষবৃক্ষ‌কে সমাজ থে‌কে সমূ‌লে উৎপাটন কর‌তে হ‌লে যৌতু‌কের কারণ, উৎপ‌ত্তি ও বিকাশ সম্ব‌ন্ধে জ্ঞান থাকা অাবশ্যক। যৌবন‌কে তুচ্ছ জ্ঞান করাই হ‌চ্ছে যৌতুক রোগ।‌ বি‌য়ের সময় কণ্যাপ‌ক্ষের অ‌ভিভাবক ই‌চ্ছে বা অ‌নিচ্ছায় পাত্র পক্ষ‌কে যে অর্থ সম্পদ, অলংকার, অাসবাবপত্র দি‌য়ে থা‌কে তা‌কে যৌতুক ব‌লে। অার এ উপঢৌকণ প্রদা‌নের রেওয়াজ‌কে বলা হয় যৌতুক প্রথা।অাবার দেখা যায়, পাত্র‌কে চাকুরীর নিশ্চয়তা দি‌য়ে কিংবা বি‌দে‌শে পাঠা‌নোর প্র‌তিশ্রু‌তি দি‌য়ে কণ্যা‌কে পাত্রস্থ করা হয়। সেটাও যৌতু‌কের অাওতাভুক্ত।

কখ‌নো দেখা যায় পাত্র‌কে প্র‌তি‌ষ্ঠিত হওয়ার উ‌দ্দে‌শ্যে কণ্যা প‌ক্ষের অ‌ভিভাবক পাত্র‌কে লেখাপড়া শেখা‌নোর যাবতীয় দা‌য়িত্ব গ্রহণ ক‌রেন বি‌নিম‌য়ে মে‌য়ে‌কে পা‌ত্রের নিকট বিবাহ বন্ধ‌নে অাবদ্ধ করান। বাস্ত‌বিক প‌ক্ষে সেটাও যৌতুক হি‌সে‌বে গণ্য হয়। কখ‌নো বা মে‌য়ের বাবা জামাই‌কে শ্বশুড় বাড়ী যাতাযা‌তের জন্য গাড়ী কি‌নে দেন অথবা মে‌য়ের সুখ শা‌ন্তি নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধা‌নের জন্য বা‌ড়ি বা‌নি‌য়ে দেন সেটাও একরকম যৌতুক হি‌সে‌বে ধরা হয়।

যৌতুক কি সামাজিক ব্যাধি না কি একটা প্রথা?

এটা অবশ্যই সামাজিক ব্যাধি৷ আমাদের সমাজে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলায়নি৷ বিয়েতে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত আছে৷ বাংলাদেশে কিন্তু যৌতুকবিরোধী আইন আছে৷ অথচ যারা যৌতুক দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তারা কিন্তু এই আইনের তোয়াক্কা করছে না৷ তবে আইনের ফাঁক-ফোকর রয়েছে৷ এই যৌতুকটা একটা মেয়ের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক৷ এর কারণেই মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে৷ মেয়ের বয়স যত বেশি হবে, তার জন্য নাকি তত বেশি যৌতুক দিতে হবে৷

উচ্চবিত্ত পরিবারেও নানা কৌশলে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে৷

আমাদের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ এর সিংহ ভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে৷ এটা পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে উঠে এসেছে৷ বিয়ের ১০ বছর পরও যৌতুকের কারণে মেয়েদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তার পরিবারের উপর চাপ দেয়া হচ্ছে৷ এটা বন্ধ করা না গেলে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধ বা মেয়েদের সম্মানজনক একটা অবস্থায় কখনও নিয়ে যাওয়া যাবে না৷ দেশে যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং হত্যা চলছেই৷

যৌতুক প্রথা শহরে না গ্রামে বেশি?

আমরা বলব গ্রামে বা শহরে সব জায়গাতেই এটা চলছে৷ গ্রামেরটা দৃশ্যমান৷ সেখানে বলাই হয় যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না৷ বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে৷ কিন্তু শহরে নানান ‘ফরম্যাটে' যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে৷ এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক – নানা কায়দায় এটা চালাচ্ছে৷ যারা দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তাদের আমরা সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারছি না৷ আমরা যদি তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে না পারি তাহলে যৌতুক প্রথা বন্ধ করতে পারব না।

বাল্যবিবাহ যৌতুকের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত?

খুবই সম্পর্কিত৷ এখানে দারিদ্র একটা কারণ৷ বলা হয়, কম বয়সে বিয়ে হলে কম যৌতুক দেয়া যায়৷ এ কারণে গ্রামের বাবা-মায়েরা মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন৷

পুরুষদের মধ্যে যৌতুকের আকাঙ্খা কেন তৈরি হয়?

আমাদের সমাজে ছেলেরা একটা ভিন্ন ধরনের মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে৷ যৌতুক নেয়াটা তারা এক ধরনের অধিকারের বলে ধরে নিছে৷

এটা কি তাহলে পারিবারিক প্রথার মধ্যে ঢুকে গেছে?

শুধু পারিবারিক বা সামাজিক প্রথা নয়, এটা মানসিক চিন্তার মধ্যেও এটা ঢুকে গেছে৷ যৌতুক নেয়াটা একটা ছেলের জন্য কতটা অসম্মানজনক, সেটা আজকের ছেলেদের আমাদের বোঝাতে হবে৷

শাশুড়ি কিংবা ননদ যৌতুকে জড়িত হন কেন? তাঁরাও তো নারী?

এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ঢুকে গেছে৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহক ছেলে এবং মেয়ে৷ এর শিকারও হচ্ছে ছেলে-মেয়ে সবাই৷ ফলে নির্যাতিত মেয়ের পাশে এই শাশুড়ি বা ননদ দাড়াঁচ্ছেন না৷ অনেক সময় তাঁরাও নির্যাতনকারীর ভূমিকায় চলে আসছেন৷

শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরাও তো যৌতুক দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন৷ তাহলে আমাদের শিক্ষায় কোনো গলদ আছে কি?

আমি বলব অবশ্যই শিক্ষায় গলদ রয়েছে৷ একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর প্রতি সম্মান দেখানোর শিক্ষা – এই বিষয়গুলো আমাদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে৷ এটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি৷ তবে এবার এটাকে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷

যৌতুকের জন্য প্রাণ নিয়ে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে না কমছে?

আমরা কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না৷  নানানভাবে এই প্রবণতা বেড়েই চলছে৷ আমরা দেখছি শুধু প্রাণ কেড়ে নেয়া নয়, একজন নারীর চোখ তুলে নিচ্ছে বা নানাভাবে তাঁর উপর নির্যাতনও করা হচ্ছে৷ আর এ ধরনের নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে৷

যাঁরা যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার তাঁরা যদি মামলা করেন, তাহলে তাঁদের কতভাগ নিজেদের পক্ষে রায় পান? আর এই ভাগ যদি কম হয়, তাহলে তার কারণ কী?

আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চয় আপনাদেরও একটা ধারণা আছে! আর দ্বিতীয় কথা হলো, এটা কিন্তু নারী বান্ধব না৷ এই বিচার ব্যবস্থা থেকে নারীরা যে ন্যায় বিচার পাবে, তার সম্ভাবনা সবক্ষেত্রেই কম৷ যৌতুকের মামলার ক্ষেত্রে তো আমরা দেখিই যে, এটা ঠিকমতো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেক ব্যতয় ঘটে৷

তাহলে কি আদালতে নারী ‘পাবলিক প্রসিকিউটার' বা সরকারি প্রতিনিধি জরুরি হয়ে পড়ছে?

নিশ্চয় প্রয়োজন৷ আমরা দেখছি যে, বিচার ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে৷ আমরা বলছি, যিনি ‘পাবলিক প্রসিকিউটার' বনা পিপি রয়েছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা যেন নারীবান্ধব হয়৷ নারীর প্রতি তাঁর একটা সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি যেন থাকে৷ তাছাড়া আইনেও পরিবর্তন আনতে হবে৷ আমরা চেষ্টা করছি৷ সরকারেরও একটা ‘পজেটিভ' দৃষ্টিভঙ্গি আছে৷ দেখা যায় কী হয়!

যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের শাস্তি:

যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ এর ধারা ৩ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে অথবা প্রদান বা গ্রহণে প্ররোচনা দেয়, তাহলে সে ৫ বছর পর্যন্ত এবং একবছরের কম নয় এমন কারাদন্ডে বা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে অর্থাৎ যৌতুক দেয়া বা নেয়া দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তেমনিভাবে যদি কেউ যৌতুক নেয়া বা দেয়ার জন্য উৎসাহ বা প্ররোচনা দেয় তাহলে সে ব্যক্তিও একই ধরণের শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে।

যৌতুক দাবি করার জন্য শাস্তি:

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ক্ষেত্রমতে বর বা কনের পিতা-মাতা বা অভিভাবকের কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন যৌতুক দাবি করে, তাহলে সে ৫ বছর মেয়াদ পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য এবং একবছর মেয়াদের কম নয়, কারাদন্ডে বা জরিমানায় বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবেন। অর্থাৎ যদি কোন একপক্ষ যৌতুক দাবি করে এবং তা প্রমাণিত হয় তবে অপরাধীর দন্ড হবে। এই দাবি মৌখিক বা লিখিতভাবে হতে পারে।

মিথ্যা মামলা দায়ের শাস্তি:

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করার মতো কারণ না থাকা সত্ত্বেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যৌতুকের কুফল:

অনেক কনেপক্ষ মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে বরপক্ষকে নানা ধরণের উপধৌকন প্রদান করে থাকলেও অনেক পরিবার তা প্রদানে ব্যর্থ হয়।এই দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে বেশিরভাগ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা স্বচ্ছল না। যার ফলে বিবাহের পর যদি কোন স্ত্রী কিংবা তার পরিবার  তার বাবার বাড়ি থেকে প্রদত্ত যৌতুক এর উপধৌকন প্রদানে ব্যর্থ হয়।যার কারণে একজন মেয়ের উপর চলে ছেলে পক্ষ থেকে নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। মাঝে মাঝে কনে পক্ষ যদি কোনোভাবে যৌতুক প্রদানে ব্যর্থ হয় তাহলে তখন নির্যাতনের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়ে উঠে যে একজন কনেকে স্বেচ্ছায় কিংবা প্ররোচনায় মৃত্যুবরণ কিংবা আত্নহত্যার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

Taken from Light The Mind

একক কোন কার‌ণে যৌতুক প্রথার উদ্ভব ঘ‌টে‌নি। এর জন্য বহু‌বিধ কারণ‌কে দায়ী করা যায়। যেমনঃ-

১। অাই‌নের চো‌খে নারী পুরুষ সমান মর্যদার অ‌ধিকারী হ‌লেও নারী‌কে নিম্ন সামা‌জিক মর্যাদার কার‌ণে সমা‌জে যৌতুক প্রথার বিস্তার ঘ‌টে‌ছে।

২। দা‌রিদ্রতার নিষ্ঠুর ছোবল হ‌তে মু‌ক্তির একটা মাধ্যম হি‌সে‌বে যৌতু‌কের বিকাশ ঘ‌টে‌ছে।

৩। অ‌তি‌রিক্ত সম্পদ লা‌ভের মান‌সিকতা হ‌তে যৌতু‌কের সূত্রপাত হ‌য়ে‌ছে।

৪। কণ্যার দৈ‌হিক খুঁত, অ‌ধিক বয়স, সৌন্দ‌র্য্যের বা রু‌পের অভাব প্রভৃ‌তি কার‌ণে কণ্যাপক্ষ যৌতুক দি‌য়ে বি‌য়ে‌তে রা‌জি হন।

৫। প্রকৃত শিক্ষার অা‌লো‌ক বিব‌র্জিত মান‌সিকতা যৌতু‌কের জন্য দায়ী।

৬। পা‌ত্রের বাবার ব্যবসা‌য়িক ম‌নোভাবও যৌতু‌কের প্রসা‌রে সহায়তা ক‌রে।

৭। কণ্যা সন্তা‌নের প্র‌তি পিতা মাতার অত্য‌ধিক স্নে‌হের কার‌ণে মে‌য়ের সু‌খের জন্য জামাই‌কে অর্থ সম্পদ প্রদান ক‌রে যৌতুক বৃ‌দ্ধি‌তে সহায়তা ক‌রে।

৮। কণ্যার চে‌য়ে বর বে‌শি উপযুক্ত হ‌লে মে‌য়ের অ‌ভিভাবক মোটা অং‌কের যৌতুক প্রদান ক‌রে মে‌য়ে‌কে পাত্রস্থ ক‌রে বিধায় যৌতু‌কের প্রসার ঘ‌টে।

যৌতুকের প্রতিকার:

যৌতুক প্রথার শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত। এই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার জন্য, একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের জন্য, যৌতুকের অভিশাপ থেকে সমাজ, দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। যৌতুকবিষয়ক প্রচলিত আইন ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

যৌতুকের বিরুদ্ধে আমাদের লেখা, বক্তৃতা ও আচার-আচরণে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। যৌতুকের কুফল, ভয়াবহ গ্লানি এবং অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সর্বস্তরের নারী-পুরুষকে অবহিত করতে হবে। পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায়

রোগ শনাক্ত না হলে যেমন নিরাময় করা কঠিন। অধিকার কি না জানলে যেমন অধিকার সচেতন হওয়া যায় না। নিজেকে না জানলে যেমন জগৎ জানা হয়ে ওঠে না, তেমনি কোনটি অপরাধ, কোনটি কুসংস্কার সেটি না জানলে সংস্কারমুক্ত হওয়া দুরুহ। গভীর ঘুমে নিমগ্ন ব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলা সহজ। কিন্তু যে বা যারা জেগে ঘুমের ভান করেন, তাদের জাগিয়ে তোলা বড্ড কঠিন। প্রচ্ছন্ন এ যৌতুকের বিষয়ে আমাদের সমাজ জেগে জেগে ঘুমুচ্ছে। প্রচ্ছন্ন এই কুসংস্কার যৌতুক নির্মূলে আজ আমাদের এক যুগপুরুষের বড় প্রয়োজন। ‘যুগ জামানা পাল্টে দিতে চাই না অনেকজন।

যৌতুক এক‌টি সামা‌জিক ব্যা‌ধি, এ‌টি মানবতা বি‌রোধী কুপ্রথা। এই স্বীকৃত মনুষ্য কুপ্রথা নির্মু‌লে অামরা নিম্ন লি‌খিত ব্যবস্থা গ্রহণ কর‌তে পা‌রি।‌যেমনঃ-

ক। সরকারী ও বে-সরকারীভা‌বে সম‌ন্বিত উ‌দ্যোগ গ‌ড়ে তুল‌তে পা‌রি।

খ। ১৯৮০ সা‌লের যৌতুক বি‌রোধী অাই‌নের প্র‌য়োগ ঘটা‌তে হ‌বে। প্র‌য়োজ‌নে নতুন অাইন পাস ও বাস্তবায়ন কর‌তে হ‌বে।

গ। অ‌ভিভাবক‌দের স‌চেতন হ‌তে হ‌বে।

ঘ। শি‌ক্ষিত যুব সমাজ‌কে এ‌গি‌য়ে অাস‌তে হ‌বে।

‌ঙ। পেপার প‌ত্রিকায় যৌতুক বি‌রোধী প্র‌তি‌বেদন ছাপা‌তে হ‌বে।

চ। সমাজ থে‌কে অ‌শিক্ষা, কু‌শিক্ষা ও অজ্ঞনতা দূর ক‌রে শিক্ষার অা‌লো ছড়া‌তে হ‌বে।

ছ। অর্থ-সম্প‌দের প্র‌তি তীব্র লোভ প‌রিহার কর‌তে হ‌বে।

জ। পাঠ্যপুস্ত‌কে যৌতুক বিষয়ক প্রবন্ধ অন্তভুক্ত কর‌তে হ‌বে।

ঝ। মাদ্রাসা, মস‌জিদ তথা ধর্মীয় প্র‌তিষ্ঠান গু‌লো‌তে হুজুর ইমাম‌দের যৌতু‌কের কুফল তু‌লে ধর‌তে হ‌বে।

ঞ। ‌যৌতুক দেওয়া নেওয়া সামা‌জিক অপরাধ সেটা জনগণ‌কে অব‌হিত কর‌তে হ‌বে।

ট। হীন যৌতুক প্রথা ব‌ন্ধের জ‌ন্যে সভা-‌সে‌মিনার, ্য কর‌তে হ‌বে।

ঠ। মান‌বিক মূল্য‌বোধ ও দৃ‌ষ্টি ভ‌ঙ্গির প‌রিবর্তন কর‌তে হ‌বে।

ড। নারী শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থা‌নের ব্যবস্থা কর‌তে হ‌বে।

ঢ। মি‌ডিয়া ও গণমাধ্য‌মের দা‌য়িত্ব স‌চেতনতা বাড়া‌তে হ‌বে।

ণ। সক‌লের সাহায্য স‌হযোগিতা অার ঐ‌ক্যের একই প্লাটফর্ম তৈ‌রি কর‌তে হ‌বে।

সামাজিক একটি সমস্যা যৌতুকের কারণে সবচেয়ে বেশি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে ৩৯২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ সংখ্যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১৯২ জনকে। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ জন। ২০১৪ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০৭ জন।

যৌতুক আদায় করতে স্বামীরা নানা উপায় অবলম্বন করছেন। কেউ স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করছেন, কেউবা করছেন মানসিক নির্যাতন। আর না পেলেই তাঁকে মেরে ফেলা হচ্ছে। রংপুরের পীরগাছায় গৃহবধূ তহমিনা খাতুনের (৩২) গায়ে জ্বলন্ত কুপি ছুড়ে মারেন স্বামী ও শাশুড়ি। এতে তাঁর গায়ে আগুন ধরে শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে যায়। বিয়ের ১৩ বছর পর এই ঘটনা ঘটে। এর আগে তাঁকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। চড়-থাপ্পড়ে একটি কানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু দুই মেয়ের কথা ভেবে সংসার করে যাচ্ছেন তিনি। (সূত্র: ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ প্রথম আলো)

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শুধু যৌতুকের কারণে ১ হাজার ২৪৩ জন নারীকে স্বামী ও তাঁর স্বজনেরা হত্যা করেছে। একই সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩৪ জন নারী।

বিশিষ্টজনদের মতে, সরকার যৌতুক নিরোধের আইন করলেও যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, একটা স্বাভাবিক রীতি হিসেবে এখনো পরিচিত। যৌতুক যেন একটি সামাজিক ‘স্ট্যাটাস’। বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেকে ‘কী’ দিল, এটা একটা অন্যতম আলোচনার বিষয়। আর ধনী-গরিবনির্বিশেষেই হচ্ছে। একটি পোশাক কারখানার কর্মীর বিয়েতেও যেমন যৌতুক দিতে হয়, তেমনি একজন চিকিৎসক পাত্রীকেও দিতে হচ্ছে। আর মেয়ের অভিভাবকেরা ‘সুপাত্র’ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে মেনেও নিচ্ছেন। এই সুযোগে ছেলেপক্ষ যত বেশি যৌতুক আদায় করতে পারে, ততই লাভ।


তথসুত্র

‘যৌতুক সামাজিক ব্যাধি, যারা নিচ্ছে তারা অপরাধী', DW.

প্রসঙ্গ যৌতুক: সংজ্ঞা, শাস্তি, প্রতিকার ও অন্যান্য, Lawyers Club Bangladesh.

যৌতুক প্রথা, Protom Alo.

যৌতুক প্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি ও অভিশাপ, Our Islam 24.

যৌতুক নিয়ে উক্তি, Grathor.

প্রচ্ছন্ন যৌতুক প্রথা, Daily Nayadi Ganta.

Subscribe for Daily Newsletter