পরিবেশ রক্ষায় বন (Forests to Protect the Environment)

আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সেরা জীব রূপে মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। বনাঞ্চল ও বনজাত গাছপালার দ্বারা ভূমণ্ডলের পরিবেশ ও মনোরম প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্যলীলার মধ্যে বৃক্ষরাজি অন্যতম জীব, যা ছাড়া প্রাণিকুলের জীবন-জীবিকার কোনো উপায় নেই। মানুষ না থাকলে গাছের কোনো অসুবিধা হতো না, কিন্তু বনরাজি না থাকলে দুনিয়ায় আদম সন্তানের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে পড়ত। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে এবং তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়নপ্রীতিকর সব ধরনের উদ্ভিদ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং এর দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি এবং সমুন্নত খেজুরগাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ।’ (সূরা কাফ, আয়াত: ৭-১১)
জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে ১৬টি সংরক্ষিত বায়ো ইকোলজিক্যাল জোন রয়েছে
দেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে। মোট ভূমির প্রায় ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বনাঞ্চল, যদিও পরিবেশ সংরক্ষণে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে বিদ্যমান বনাঞ্চলে প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি কম রয়েছে। পাহাড়, ম্যানগ্রোভ ও শালবন রক্ষণাবেক্ষণে বনবিভাগ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে, যা বিদ্যমান বনাঞ্চলের প্রায় ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, দেশে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে ১৬টি সংরক্ষিত বায়ো ইকোলজিক্যাল জোন রয়েছে, যেখানে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৫ হেক্টর বনভূমি রয়েছে।
বনবিভাগ কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণে বনজসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে
ওই সংরক্ষিত জোনের আওতায় আটটি জাতীয় পার্ক, সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং একটি গেইম রিজার্ভ এরিয়া রয়েছে। বনবিভাগের তত্ত্বাবধান ছাড়াও সামাজিক, পারিবারিক, চা ও রাবার বাগানে প্রায় ১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে।পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বনবিভাগের তত্ত্বাবধান ছাড়াও দেশে প্রায় অর্ধেক বনাঞ্চল রয়েছে। যদিও বনবিভাগ সংরক্ষিত এলাকায় বনায়নে ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে, তবুও বনজসম্পদ হ্রাসে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় বনবিভাগ কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণে বনজসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে।
আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে
গত এক শ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫০ থেকে ১ দশমিক ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে প্রকৃতি ও পরিবেশকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে। এজন্য বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলীয় এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের।
দেশের বন ও বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন
বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশএ উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশের বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষিভূমি সম্প্রসারণ, আবাসন প্রভৃতি নানা কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। ফলে দেশের বন ও বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন।
সব জেলাতেই সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে
বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বনভূমি, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল। সুন্দরবন বাদ দিলে বন বলতে যা অবশিষ্ট থাকে, তা খুবই নগণ্য। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের মতে, এর পরিমাণ মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ। ২০১০ সালের শ্রমিক জরিপে দেখা যায়, মোট বেসামরিক শ্রমিক ৫৭.১ মিলিয়ন এবং এর মধ্যে বিশাল একটি অংশ বনজ সম্পদ সৃষ্টি কিংবা বনজ সম্পদনির্ভর উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। এক সময় বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৮টি জেলায় কোনো বনায়ন কার্যক্রম ছিল না। এখন প্রায় সব জেলাতেই সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বনভূমি বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে
বনাঞ্চল একদিকে নিসর্গে শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে। বনভূমি বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। তা ছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে গাছ নিধন নয়, সৃজনই হোক সবার লক্ষ্য। একটি দেশের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়।
সামাজিক বনায়ন মূলত এমন এক প্রকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা
সামাজিক বনায়ন মূলত এমন এক প্রকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা, যেখানে জনগণ শস্য উৎপাদন ও গবাদিপশু পালনের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণের এক সমন্বিত কার্যক্রম করে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে নয় বরং মানুষের প্রচেষ্টায় কৃত্রিমভাবে এই বন তৈরি করা হয়। পারিভাষিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ১৮৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন উপনিবেশ স্থাপনকারী ব্রিটিশ শাসকরা প্রথম এদেশে কৃত্রিম বন তৈরি শুরু করে। পরে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের শালবন এলাকায় প্রচুর গাছের চারা রোপণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলার উপকূল এলাকায় নতুন উপকূলীয় বনায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়।
১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’ প্রণীত হয়
পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য ১৯৮৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এরপর ১৯৯২ সালে জাতীয় পরিবেশ নীতি এবং ১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’ প্রণীত হয়। পরিবেশ আইন বলতে সেই বিধিবদ্ধ আচরণ ব্যবস্থাকে বোঝায়, যার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবেশকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। পরিবেশকে কলুষমুক্ত করা যায় এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে
কোনো এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়লে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুসারে সরকার সেই এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এ যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার কথা বলা হয়েছে, যা পরিবেশ বিনষ্টকারী হিসেবে ১৯৮৩ সালে ‘মোট ভেহিকলস অধ্যাদেশ’-এ উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০০০ এবং ২০০২ সালে এই আইন সংশোধন করা হয় এবং আরও নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। এই আইনের আওতায় বেশ কিছু প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, যা পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
পরিবেশ রক্ষায় এই বিধিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারাবাহিকতায় পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ প্রণীত হয়েছে। এই বিধিমালায় পরিবেশগত মানমাত্রা নির্ধারণ, বর্জ্য নিঃসরণ ও নির্গমনের মানমাত্রা নির্ধারণ এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়নের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় এই বিধিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০০২ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়।আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশ-সংক্রান্ত প্রায় ১৮৫টি আইন রয়েছে। এর মধ্যে অ্যাক্ট, বিধি, নীতি, চুক্তি এবং অধ্যাদেশ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ২০টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে।
২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস পালন
বন সু-রক্ষায় ও জীব বৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস পালন করছে। বিশ্বব্যাপী শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পরিবেশ দূষণ শুরু হয়। বর্তমানে পরিবেশ দূষনে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হতে চলেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিন্তু আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন। বিশ্বের মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মিলিয়ন হেক্টর। মোট ভূমির ৭৮ ভাগ চাষাবাদের অনুপযোগী, ২২ ভাগ ভূমি চাষাবাদ যোগ্য। ২০০ বছর আগেও বিশ্বের ৪৭ ভাগ এলাকা বন ভূমিতে পরিবেষ্টিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ২৯ ভাগ এলাকা বনভূমি রয়েছে। পরিবেশের ভারাসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমান রয়েছে ১৭.৪ ভাগ। দেশের মোট আয়তন ১লাখ ৪৮ হাজারা ৩৯৩ বর্গ কি. মি.। এর মধ্যে বনাঞ্চল ২৩ হাজার ৯শ’ ৯৮ বর্গ কি. মি.। জনসংখ্যা চাহিদার তুলনায় বনভূমির পরিমাণ খুবই কম।
ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রয়োজনে পরিবেশ তথা বন ধ্বংস হবার মূল কারণ
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়ানো-ছিটানো যে অল্প বনভূমি রয়েছে তাও মানুষ নির্বিচারে কেটে সাবাড় করছে। দেশের মানুষের কাঠ ও জ্বালানি কাঠের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে বনভূমি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা পৃথিবী থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে পৃথিবী থেকে ১৯০ একর বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রয়োজনে পরিবেশ তথা বন ধ্বংস হবার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে ব্যাপক হারে বন উজাড়ের ফলে মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে
পৃথিবীর প্রায় ১০০টির বেশী দেশ মরুময়তার শিকার। ড্রাইলান্ডের ৭০ ভাগ ভূমি আজ বন হারিয়ে যাওয়ায় মরুময়তায় চলে যাচ্ছে। এর আয়তন প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন হেক্টর। এশিয়ার প্রায় মিলিয়ন হেক্টর জমি মরু বিস্তারের সম্মুখিন। অষ্ট্রেলিয়া সহ অন্যান্য দেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন বর্গ কি. মি. মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবছর এ মরুভূমির ৩-৪ কি. মি. করে বাড়ছে। ভারতের থর মরুভূমি প্রতি বছর প্রায় ১ কি. মি. বাড়ছে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর ১০ ভাগ বনও তৃণভূমি মরুময়তার শিকার হচ্ছে, আর ২৫ ভাগ হুমকির সম্মুখীন। প্রতি মিনিটে মরুভূমি গ্রাস করছে ৪৪ হেক্টর উর্বর জমি এবং ২০ হেক্টর বনভূমি বিরান হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে ব্যাপক হারে বন উজাড়ের ফলে মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল সহ এক তৃতীয়াংশ এলাকা বঙ্গপোসাগরের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে
পরিবেশ ও বন বিশেষজ্ঞদের ধারনা আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ হতে ৪.৫ সে. সি. বেড়ে যাবে। ফলে মেরু অঞ্চলের জমাট বাধা বরফ পুঞ্জ গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্রের পানি উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্র উপকুলীয় নিচু অঞ্চলগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা যদি ১ থেকে দেড় মিটার বৃদ্ধি যায় তবে বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল সহ এক তৃতীয়াংশ এলাকা বঙ্গপোসাগরের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। অপর দিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মরু অঞ্চল বৃদ্ধি পাবে। উর্বর জমির পরিমাণ কমে যাবে এবং দেখা দিবে খাদ্যাভাব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
প্রাণের অস্তিত্বের জন্যই সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের প্রয়োজন অপরিসীম
প্রাণের অস্তিত্বের জন্যই সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের প্রয়োজন অপরিসীম। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বনায়নের জুড়ি নেই। বনাঞ্চল একদিকে নিসর্গের শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। বনভূমি বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফল-ফসল ভালো হয়। তা ছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতেও প্রয়োজন ব্যাপক বনাঞ্চল
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতেও প্রয়োজন ব্যাপক বনাঞ্চল। যাদের অবস্থান এর বিপরীতে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের মূলোৎপাটনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। দেশের প্রায় সর্বত্র বনভূমি জবরদখলের খবর পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব জলাভূমি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ যেকোনো বনভূমি শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সম্প্রসারণও করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করা চাই। মহাবিপর্যয় ও দুর্যোগ থেকে পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায়, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রাখা। এদিকে নজর না দিলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে ওঠার আগে যেখানে সম্ভব বনাঞ্চল তৈরি করতে হবে। অন্যথায় প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। মোট কথা, প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছাচার থেকে মানুষকে বিরত থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে যাচ্ছেন
মানুষের টেকসই জীবনযাপনকে প্রাধান্য দিয়েই প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে লবণাক্ততার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নেও গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।পরিসংখ্যানগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক বনাঞ্চল বৃদ্ধিতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬০১ জন মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ওই প্রণোদনার আওতায় ৩৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৪ হাজার ৫২২ টাকা মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উদযাপনে ১০ মিলিয়ন গাছ লাগানোর লক্ষ্যে সমগ্র দেশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিতরণ করে যাচ্ছেন।
মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ কারণে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে দেশে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। এর ফলে বনাঞ্চলই বায়ুমণ্ডলে মানবসৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গাছের পাতা অণুজীবের উপস্থিতিতে মাটিতে পচে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা, টিলা ও মাটি কাটা রোধ ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধে মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে
চলমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা, টিলা ও মাটি কাটা রোধ ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধে মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এই তথ্য জানিয়েছেন।সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয়ে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ডিসি সাহেবদের অনেক দায়িত্ব। আমাদের টিলা কাটা, বন উজাড়, গাছ কাটা, মাটি কাটা, অবৈধ ইট ভাটা পলিথিন-প্লাস্টিক, বন্য প্রাণী-পাখি নিধন এগুলো পরিবেশের ক্ষতি করছে। এগুলো বন্ধে এবং পরিবেশ প্রতিবেশ সুরক্ষার জন্য আমাদের আইন অনুযায়ী তারা যাতে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করেন, সেজন্য আমরা তাদের বলেছি। তারা সহযোগিতা করবেন বলে আমাদের কথা দিয়েছেন। আমরাও তাদের সরকারি দায়িত্ব ও করণীয়গুলো জানিয়েছি।
জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি বা প্রস্তাব ছিল কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, তারা অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। অনেক জায়গায় আমাদের পরিবেশ অধিদফতরের অফিস নেই। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৫০ টিতে অফিস আছে, ১৪ টিতে এখনও হয়নি। তারা অফিস ও জনবল চেয়েছেন। এই ব্যাপারে আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, বাকি ১৪টি জেলায় আমরা পরিবেশের অফিস করব এবং জনবল নিয়োগ দেব।২০২৫ সালে সরকারি স্থাপনায় শতভাগ পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহার করা হবে। সে আলোকে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা ও বরাদ্দ বাড়বে।
তথ্যসুত্র
পরিবেশ অধিদফত. Banglanews24.
প্রয়োজনে বনভূমি ধ্বংস করছে, Jugantor.
বনায়নের প্রয়োজন অপরিসীম, Prothomalo.
জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, Patradoot.
পরিবেশের ভারসাম্য বজায়, Sharebiz.
বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণ, Protidinersangbad.