বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ (Hilsa Fish)

ইলিশ (বৈজ্ঞানিক নাম: Tenualosa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আগমন করে। বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয়। এ ছাড়াও ইলিশ ভারতের বিভিন্ন এলাকা যেমন পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ও আসামে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ।
বর্ষার বৃষ্টি এবার বেশ দেরি করে শুরু হয়েছে। জুনে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যখন বর্ষা বিদায় নেয়, এবার তখনই টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়তেও দেরি হয়েছে। দেশের অন্য যেকোনো মাছের চেয়ে ইলিশের দাম চড়া। এরপরও বর্ষায় ইলিশ কিনে খেতে চায় না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেশের জাতীয় মাছ হিসেবে স্বীকৃতি ছাড়াও এই মাছ নিয়ে এ দেশের মানুষের আবেগ-উৎসাহের শেষ নেই।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইলিশ কেন জাতীয় মাছ হলো—তা নিয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা সরকারি বা বেসরকারি নথি বা ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের সাগর-নদী, জলাশয় এবং মাছের আন্তসম্পর্কের ইতিহাস খুঁজতে গেলে উজান থেকে নেমে আসা ব্রহ্মপুত্র নদ আর গঙ্গার মতো বিশাল নদীর প্রসঙ্গ আসবে। ওই দুই অববাহিকা থেকে সৃষ্টি হওয়া হাজারো ছোট-বড় নদী বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার ভৌগোলিক কার্যকারণ উঠে আসবে। এসব জলাশয়ে ঘুরে বেড়ানো মাছের মধ্যে ইলিশের পাশাপাশি চিতল মাছের পেটি, পাঙাশ মাছের ঝোল আর রুই মাছের মাথা নিয়েও বাঙালির আবেগ আর ভোজন রসিকতার অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে।
ইলিশ যেভাবে জাতীয় মাছ হলো
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের জাতীয় মাছ হিসেবে ইলিশকে কেন নির্বাচন করা হলো, সে ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কথা বলা হয় ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে প্রশাসন ও গবেষণার দায়িত্বে থাকা দেশের শীর্ষস্থানীয় ও প্রবীণ মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। যাঁদের অনেকেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, ফল, ফুল, প্রাণীসহ নানা কিছু নির্বাচনের সময়ের সাক্ষী হয়ে আছেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই ইলিশকে জাতীয় মাছ করার একক কোনো কারণ বলতে পারেননি। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে দেশের নদ-নদীতে ইলিশ ছাড়াও রুই, কাতলা, বোয়াল, কই, চিংড়ি, পোয়া থেকে শুরু করে পুঁটি-ট্যাংরা মাছও জনপ্রিয় ছিল। ওই সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এসব ব্যক্তিরা একটি ব্যাপারে একই ধরনের মতামত দিয়েছেন, তা হচ্ছে এই সময়ে এসে ইলিশ নিয়ে যতটা মাতামাতি দেখা যায়, ষাট বা সত্তরের দশকে ততটা ছিল না। ইলিশ জনপ্রিয় ছিল বটে, তবে একই ধরনের জনপ্রিয় মাছ আরও ছিল।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনে কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছিল এত মাছ থাকতে ইলিশ কেন জাতীয় মাছ হলো। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মাছের তালিকায় ইলিশ যে প্রথম দিকে ছিল তা বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর খাবারের পাতে বেশির ভাগ সময় পুঁটি, ট্যাংরা, মলা ও পাবদা থাকত। কালেভদ্রে ইলিশ খেতেন।
তবে বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠ সহচর মনে করেন, শত শত বছর ধরে পদ্মার ইলিশের স্বাদ ছিল বিখ্যাত। দেখতে উজ্জ্বল আর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কোনো চাষাবাদ ছাড়াই এই মাছ সহজে ধরা যায়। এসব বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু ইলিশকে জাতীয় মাছ করতে পারেন।
ফরাসউদ্দিনের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুত ছিল নাজুক অবস্থায়। কৃষকের গোলায় জমা থাকা সামান্য ধান আর সবজি ছাড়া খাবারের পর্যাপ্ত জোগান ছিল না। ওই সময়ে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ইলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭২ সালে নদ-নদীগুলোতে ব্যাপক ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল। গ্রামের দরিদ্র মানুষ ওই ইলিশ ধরে খেতেন। তাই বঙ্গবন্ধু এই মাছকে জাতীয় মাছ নির্বাচন করেছিলেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবদুল ওহাবের বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জাতীয় মাছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখা হয় তা হলো, ওই মাছটি ওই দেশে বেশি পাওয়া যায় কি না। সেই অর্থে বিশ্বের মোট ইলিশের বেশির ভাগই বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে পাওয়া যেত। এখন এককভাবে বাংলাদেশে বিশ্বের ৮৫ শতাংশ ইলিশ পাওয়া যায়। এই বিষয়টি ইলিশকে জাতীয় মাছ করার পেছনে বড় যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে, যা পরবর্তী সময়ে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
ইলিশের জনপ্রিয়তার শুরু
১৯৮৩ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের উৎসবে প্রথমবারের মতো পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। আশির দশকের শুরুটা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ বিন্যাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দশক। তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ, প্রবাসী আয় ও দেশীয় শিল্পের বিকাশের সঙ্গে মধ্যবিত্তের পরিধিও তখন বাড়ছিল। একদিকে পিতৃপুরুষের ফেলে আসা গ্রামের স্মৃতি আর অন্যদিকে শহরে নতুন করে বাঙালি সংস্কৃতিকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চলছে ঢাকা শহরে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের সংস্কৃতির হাতছানিও তখন বাড়ছিল।
ঢাকা শহরকেন্দ্রিক এমন এক পালাবদলের সময়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে পয়লা বৈশাখ পালন উদীয়মান মধ্যবিত্তের পরিচিতি নির্মাণের উপলক্ষ হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালের এক ভোরে একদল তরুণ রমনা বটমূল এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের খোলা চত্বরে পান্তা-ইলিশের কয়েকটি অস্থায়ী দোকান দেন। মধ্যবিত্তের গ্রাম আর শহুরে সংস্কৃতিকে মেলানোর ওই অভিনব চর্চা এর পরের বছরগুলোতে ডালপালা মেলতে থাকে। উৎসবের ওই পান্তা-ইলিশের প্রচলন মধ্যবিত্তের রান্নাঘর আর বৈঠকখানায় স্থান পেতে শুরু করে।মধ্যবিত্ত যত বেশি ইলিশের দিকে ঝুঁকতে থাকে ইলিশের চাহিদা তত বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দেশজুড়ে তখন চলছে মধ্যবিত্তের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার চেষ্টাও।
শহুরে মধ্যবিত্তের বিকাশের সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক আছে। আশির দশকের শুরু থেকে এই ২০২২ সাল পর্যন্ত মধ্যবিত্তের বিকাশ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে তাদের আত্মপরিচয় নির্মাণের ভাঙাগড়া। আশি ও নব্বই দশকের শুরুতে মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক বনিয়াদ গড়ে দেয় পোশাক কারখানা, ছোট ও মাঝারি শিল্প আর উপকূলজুড়ে একসময় সাদা সোনা হিসেবে চিহ্নিত চিংড়ি চাষের বিস্তার। ৯০-এরপর নতুনভাবে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের ঘোরে বিভোর হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত মানুষ। শহরের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে, হাতে নগদ টাকা আসায় মধ্যবিত্তের ঘরে খাবার শীতল রাখার যন্ত্র রেফ্রিজারেটর শোভা বাড়াচ্ছে। বিশ্বায়নের নানা প্রভাবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশীয় সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ইলিশ মাছ খাওয়া, বাংলা পল্লিগীতিকে ফোক মিউজিক হিসেবে চর্চা করা, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস পালন হয়ে ওঠে বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের স্মারক।
তবে বাংলা অঞ্চল, যাকে আগে পূর্ব বাংলা বলা হতো—সেই সময়ের ঐতিহাসিক বই, লেখালেখি বা সাহিত্য-সংগীতে পয়লা বৈশাখে ইলিশ-পান্তা খাওয়া বা বছরের অন্যান্য সময়ে আয়োজন করে ইলিশ খাওয়ার চর্চা কিন্তু দেখা যায় না। বরং এই সময় অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে বাংলার কৃষকের ঘরে খোরাকির খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে যেত। অন্যদিকে বছরের ওই সময়টাতে ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম। তখন ইলিশ মাছ ধরাও বরং ওই সুস্বাদু মাছটির বংশবিস্তার বা সংখ্যা বাড়ানোর পথে মস্ত বড় বাধা।
তবে বাংলা অঞ্চল, যাকে আগে পূর্ব বাংলা বলা হতো—সেই সময়ের ঐতিহাসিক বই, লেখালেখি বা সাহিত্য-সংগীতে পয়লা বৈশাখে ইলিশ-পান্তা খাওয়া বা বছরের অন্যান্য সময়ে আয়োজন করে ইলিশ খাওয়ার চর্চা কিন্তু দেখা যায় না। বরং এই সময় অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে বাংলার কৃষকের ঘরে খোরাকির খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে যেত। অন্যদিকে বছরের ওই সময়টাতে ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম। তখন ইলিশ মাছ ধরাও বরং ওই সুস্বাদু মাছটির বংশবিস্তার বা সংখ্যা বাড়ানোর পথে মস্ত বড় বাধা।
দেশভাগের স্মৃতি ও বাঙালদের ইলিশ বন্দনা
তবে ইলিশ নিয়ে এই উৎসাহ-উন্মাদনা সেই ৫০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে আছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পর ৫০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ঘটি আর পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া বাঙালিদের বাঙাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কলকাতায় ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চলচ্চিত্রে ঘটিরা চিংড়ি আর বাঙালের ইলিশ নাম নিয়ে ঝগড়ায় মেতে ওঠা প্রতীকী অর্থেও একটি বড় সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। তা হচ্ছে, দেশভাগের সময় জন্মভূমি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া পূর্ববাংলার বাঙালিরা সঙ্গে করে ইলিশের স্মৃতিও নিয়ে যায়।
সাহিত্য ও কবিতায় ঠাঁই পায় ইলিশ
পদ্মা নদীর পাড়ে বড় হওয়া রাজশাহী, যশোর, খুলনা, বরিশাল, চাঁদপুর আর বিক্রমপুরের বাঙালদের ইলিশের স্মৃতি তাঁদের চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও কবিতায় ঠাঁই পায়।যে কারণে বুদ্ধদেব বসুর ইলিশকে ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ নামে চিহ্নিত করে কবিতা লেখা আর আনন্দবাজার পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ইলিশ নিয়ে হাহাকার করে একের পর এক লেখা ছাপা হয়। এসব লেখা সেই দেশভাগের স্মৃতিকে যেন উসকে দেওয়ার কথাই মনে করে দেয়। এখনো বর্ষায় পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলে ইলিশ বন্দনা করা হয়।
মধ্যবিত্তের অর্থনীতি ও ইলিশের বৃদ্ধি।
বর্তমানের ইলিশ
ইতিহাস থেকে এবার বর্তমানে ফেরা যাক। বর্তমানে এসে ২০০০ সালের পর সরকারের ইলিশ রক্ষায় নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। ৮০-এর দশক থেকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ইলিশ মাছ রক্ষায় সরকার একের পর এক উদ্যোগ নিতে থাকে। ইলিশের জন্য অভয়াশ্রম ঘোষণা ও জাটকা রক্ষার মতো উদ্যোগের সুফল আসতে শুরু করে ২০১০ সাল থেকে। দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্রুত বাড়তে থাকে। ওই সময়ে দেশে মানুষের আয় আর বিদ্যুৎ উৎপাদনও বাড়তে শুরু করে। ঢাকা ছাড়াও বড় শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ আর রেফ্রিজারেটর সমান তালে বাড়ে। দ্রুত পচনশীল এই মাছ সহজেই সংরক্ষিত রাখা যেত ওই রেফ্রিজারেটরে।
ইলিশের অবতরণ কেন্দ্র বা ঘাটগুলোতে বরফ কলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, ইলিশ সংরক্ষণে হিমাগার তৈরি হওয়ার মতো অবকাঠামোগুলো বেসরকারি খাতের মাধ্যমে দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে। একদিকে অবকাঠামোর বিস্তার, অন্যদিকে মানুষের আয় বেড়ে যাওয়া আর ভালো দাম পাওয়ায় ইলিশের পেছনে মৎস্যশিকারি ও ফড়িয়াদের বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। ফলে সমুদ্রে বড় জাহাজ ও নৌকায় করে ইলিশ ধরতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে ইলিশের উৎপাদন দুই লাখ টন থেকে প্রায় ছয় লাখ টনে পৌঁছায়। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের পাশাপাশি মফস্বলের মধ্যবিত্ত, এমনকি গ্রামীণ মধ্যবিত্তের পাতে ইলিশ স্থান পেতে থাকে। এভাবে ৭০-এর দশকের শুরুতে দেশের দরিদ্র মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ইলিশ এক সময় উচ্চবিত্তের মৎস্য বিলাসে পরিণত হয়। ২০১৫ সালের পর ইলিশের উৎপাদন বেড়ে, দামও কিছু কমে গিয়ে তা মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে চলে আসে। বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রতীক ও জাতীয়তাবাদী গর্বের উপাদান হয়ে ওঠা ইলিশ সত্যিকার অর্থে জাতীয় মাছ হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারে গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। কারণ, সরকার এই মাছ রক্ষায় অনেক অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ে মা মাছ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করেছে। আর মৎস্যশিকারিদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করছে। যে কারণে দেশে ইলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই মাছ এখনো দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আসেনি। কারণ, এই মাছ ধরা থেকে শুরু করে পুরো বিপণনব্যবস্থা একটি সামন্তচক্রের হাতে বন্দী। এ কারণে ইলিশের দাম কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। ওই চক্র ভাঙতে পারলে জাতীয় এই মাছ সবার ক্রয়সীমার মধ্যে আসবে।
যে কারণে ইলিশ খাবেন
হৃৎপিন্ডের জন্য: ইলিশ মাছে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। অন্য দিকে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। ফলে হৃৎপিন্ড থাকে সুস্থ। রক্ত সঞ্চালন সুবিধা: সামুদ্রিক মাছে থাকা ইপিএ ও ডিএইচএ ওমেগা-৩ তেল শরীরে ইকসিনয়েড হরমোন তৈরি রুখতে পারে। এই হরমোনের প্রভাবে রক্ত জমাট বেঁধে শিরা ফুলে যায়। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। বাতব্যথার উপশম: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। প্রতিদিনের ডায়েটে সামুদ্রিক মাছ থাকলে বাতের ব্যথা, গাঁট ফুলে গিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। চোখের স্বাস্থ্যে উপকারী: তেলযুক্ত মাছ খেলে চোখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চোখ উজ্জ্বল হয়। বয়সকালে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা মোকাবিলা করতে পারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। ইলিশ মাছের মধ্যে থাকা ভিটামিন এ রাতকানা রোগের মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে। প্রয়োজনীয় খনিজ মেলে ইলিশে: ইলিশ মাছে রয়েছে আয়োডিন, সেলেনিয়াম, জিংক, পটাশিয়াম। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড সুস্থ রাখে আয়োডিন, সেলেনিয়াম উৎসেচক ক্ষরণে সাহায্য করে, যা ক্যানসার মোকাবিলা করতে পারে। এ ছাড়া ভিটামিন এ ও ডির উত্কৃষ্ট উত্স ইলিশ মাছ। ফুসফুসের জন্য: বহু গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কার্যকর। শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোধ করতে পারে ইলিশ মাছ। যাঁরা নিয়মিত মাছ খান, তাঁদের ফুসফুস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। অবসাদ কাটাতে: ওমেগা-ত ফ্যাটি অ্যাসিড অবসাদের মোকাবিলা করতে পারে। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (এসএডি), পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন কাটাতে পারে ইলিশ মাছ। ত্বকের যত্নে: সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে ইলিশ খাওয়ার অভ্যাস। নিয়মিত মাছ খেলে অ্যাকজিমা, সিরোসিসের হাত থেকে রক্ষা পায় ত্বক। ইলিশ মাছে থাকা প্রোটিন কোলাজেনের অন্যতম উপাদান। এই কোলাজেন ত্বক টাইট ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে।পেটের যত্নে: ডায়েটে তেলযুক্ত মাছ থাকলে পেটের সমস্যা অনেক কম হয়। আলসার, কোলাইটিসের হাত থেকে রক্ষা করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড।
ব্রেন:মস্তিষ্কের ৬০ শতাংশই তৈরি ফ্যাট দিয়ে, যার অধিকাংশই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। যাঁরা নিয়মিত মাছ খান, তাঁদের মধ্যে বয়স বাড়ার পর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক কম দেখা যায়। শিশুদের মস্তিষ্কের গঠনেও সাহায্য করে ডিএইচএ। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) রোধ করতে পারে ইলিশ মাছ। স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, পড়াশোনায় মনোযোগী করে।
পুষ্টিগুণের রাজা ইলিশ
১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে আনুমানিক ৩১০ ক্যালরি, ২২ গ্রাম প্রোটিন ও ১৯ দশমিক ৫ গ্রাম ফ্যাট থাকে। একইসঙ্গে মাছের তেলে থাকে পলিআনস্যাচুরেটেড ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ইপিএ ও ডিএইচএ, যেগুলো হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যারিথেমিয়া, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিসসহ ব্রেন ডেভেলপমেন্ট ও ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকরী বলে কিছু গবেষণা নিবন্ধে দেখা গেছে।এ ছাড়াও, মানবদেহের জন্য প্রতিদিনের দরকারি ২৭ ভাগ ভিটামিন সি, ২ ভাগ আয়রন ও ২০৪ ভাগ ক্যালসিয়াম ইলিশ মাছ থেকে পাওয়া যায়।
ইলিশের অধিক পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হার্টের ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ ও উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনে। একইসঙ্গে রক্ত জমাট বাধাও প্রতিরোধ করে। ইলিশ মাছ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে।ইলিশে বিদ্যমান ভিটামিন এ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড চোখের জন্য উপকারী। ইলিশ রক্ত কোষের জন্যও বিশেষভাবে উপকারী। এপিএ ও ডিএইচএ নামক ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে বলেই ইলিশ মাছ দেহের রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ইলিশ মাছে আরও থাকে ভিটামিন এ, ডি ও ই। খুব কম খাবারের মধ্যেই ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ ও ভিটামিন ডি শিশুদের রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে।ইলিশে আয়োডিন, সোডিয়াম, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো প্রচুর পরিমাণ মিনারেল রয়েছে। আয়োডিন থাইরয়েড গ্ল্যান্ডকে সুরক্ষিত রাখে ও বিভিন্ন এনজাইম নির্গত হতে সহায়তা করে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।
ইলিশ থেকে প্রাপ্ত মিনারেল ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রন দেহ গঠনে ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে।ওমেগা-৩ আমাদের ত্বকের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এর প্রোটিন আমাদের ত্বকে কোলাজেন তৈরিতে সহায়তা করে। ফলে ত্বক থাকে সজীব ও প্রাণবন্ত।ইলিশ রান্না করা যায় অসংখ্য পদ্ধতিতে। ইলিশ রান্না করতে খুব কম তেল প্রয়োজন হয়, কেননা ইলিশের মধ্যেই অনেক তেল থাকে।
ইলিশ মাছের অপকারিতা
ইলিশ মাছের বিভিন্ন উপকারিতার সাথে দু-একটা অপকারিতাও রয়েছে। ইলিশের কারণে কারও কারও অ্যালার্জির প্রবলেম হতে পারে। যাঁদের অ্যালার্জির সম্ভাবনা থাকে, তাঁরা ইলিশ মাছ এড়িয়ে চলবেন। তবে যাঁদের অ্যালার্জির প্রবলেম নেই, গ্যাস হয় না, তাঁরা ইলিশ মাছ খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন। এতে আপনার স্বাস্থ্য উন্নত হবে। তাই চেষ্টা করবেন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ইলিশ মাছ রাখতে।
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ হয়ে যাচ্ছে?
ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঠিক এই কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে – এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ ভাল।মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ইলিশ কেন আর কীভাবে মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে?
ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে – আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।
কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না।ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলছিলেন, ইলিশের ‘অটোলিথে’ বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।তিনি বলছিলেন, “অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের ক্ষেত্রে মাথায় থাকে, কোনও কোনও মাছের ফ্যারিঞ্জিয়াল রিজিওনেও থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়
“আমরা এখন ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন যা থেকে স্পষ্ট অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা জলে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে – পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম – আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।”আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র।“গলদা চিংড়ি হরিদ্বারেও দেখা যায়, সেখান থেকে ডিম পাড়তে তারা চলে আসে সুন্দরবনের মোহনাও। এই জাতীয় মাছকে বলে ক্যাটাড্রোমাস। কিন্তু ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর।”
“কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারি জুড়ে বিছানো আছে চোদ্দ হাজারেরও বেশি জাল – তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়,” বলছিলেন বি কে মহাপাত্র।
বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়।এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও – জানাচ্ছেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।“গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি দুশো কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন … সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।”
তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশক-যুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যাচ্ছে।মিঠা জলের নদীতে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভাল, বলছিলেন ড: মহাপাত্র।তার কথায়, “মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে – কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভাল হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই!”ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্য বিজ্ঞানী আর খাদ্য-রসিকদের মধ্যে দু’রকম মত আছে।কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না – আর জেলেরা গঙ্গায় সেই ইলিশ পাচ্ছেন বছর জুড়েই!
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত ইলিশের ‘জীবন রহস্য’ কীভাবে এর উৎপাদন বাড়াবে
গত বছর ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব কর্তৃপক্ষ।
এবার এই মাছটির পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের কৃতিত্ব অর্জন করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। ২০১৫ সাল থেকে এই জিনোম সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেন তারা।এই সফলতা ইলিশ মাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার পাশাপাশি ভোক্তাদের কাছে ইলিশ আরও সহজলভ্য করে তুলতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
ইলিশ জিনোম সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি নামের এই গবেষণা দলটির সমন্বয়ক হিসেবে আছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ. সামছুল আলম।জেনম কি এবং এ সংক্রান্ত তথ্য কী কাজে লাগে। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,
“জিনোম হচ্ছে কোনও জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোমের মাধ্যমে। ““ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। আর এই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে। “
বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের মজুত কত, কোন ভৌগোলিক এলাকায় এর বিস্তৃতি কী পরিমাণে এসব বিষয়ে জানা যাবে বলে জানান ড. মোঃ. বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।
এছাড়া পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে।এই বিপুল চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো। আর সেজন্য ইলিশের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজননসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা।তাদের এই গবেষণা ইলিশের উৎপাদন বাড়িয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে বলে মনে করেন গবেষণা দলের আরেক সদস্য ড. মোঃ. বজলুর রহমান মোল্লা।
তিনি গবেষণার তিনটি গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন।
“প্রথমত ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে ইলিশের টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা যাবে। “
“এছাড়া ইলিশের জন্য দেশের কোথায় কোথায় ও কতটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা বা তুলে নেয়া প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা যাবে।”
“সেইসঙ্গে অন্য দেশের ইলিশ থেকে আমাদের ইলিশ বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্বতন্ত্র কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে”, বলে জানান ড. মোঃ. বজলুর রহমান মোল্লা।
লবন মাখা ইলিশের উপকারিতা কী?
মুলত ইলিশ মাছ দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মাছে লবন দেওয়া হয়।
লবন দেওয়ার উপকারিতাঃ-মাছ দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যায়। মাছে পোকামাকড় আক্রমন করেনা
লবন দেওয়ার অপকারিতা:
মাছে লবন দিলে মাছের স্বাদ কমে যায়।মাছে লবন দিলে লবনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় খাওয়ার সময় সমস্যা হয়
ইলিশ মাছে ডিম আছে কি না বুঝবেন যেভাবে
ইলিশ মাছ পছন্দ করেন না এমন বাঙালি মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বাদ ও সুবাসে অন্যান্য মাছ থেকে ইলিশ অনন্য ও সেরা। ডিমওয়ালা ও ডিম ছাড়া ইলিশের আলাদা আলাদা স্বাদ। তবে বাজারে গিয়ে অনেকেই চিনতে পারেন না কোন ইলিশে ডিম আছে কি নেই।
বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বর্ষাকালে ইলিশ মাছের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এসময় নদী কিংবা সাগরে বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। ইলিশ কিনতে গেলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান কমবেশি অনেকেই। কোনটি নদীর আর কোনটিই বা সমুদ্রের, কোন ইলিশে কোনটিতে ডিম আছে তা বুঝে উঠতে পারেন না অনেকেইআমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে, নদী আর সাগরের ইলিশের মধ্যে স্বাদে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যে ইলিশ আকারে যত বড়, তার স্বাদ ততই বেশি। আবার অনেকের মতে বর্ষাকালের ইলিশ বেশি সুস্বাদু হয়। ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিমপাড়ার আগ পর্যন্ত ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশি হয়।
সাধারণত ডিমওয়ালা ইলিশের স্বাদ তুলনামূলক কম। তবে আবার ডিম ভর্তি মাছের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। অনেকেই বাজার ঘুরে ডিম রয়েছে এমন ইলিশ খুঁজতে থাকেন। সাধারণত আগস্ট মাসের পর থেকে ডিম আছে এমন ইলিশ বেশি পাওয়া যায়। এটাই ইলিশের ডিমপাড়ার মৌসুম। যা একটানা অক্টোবর মাস পর্যন্ত থাকে। যদিও আজকাল সারাবছরই ইলিশ পাওয়া যায়।ডিম আছে এমন ইলিশের পেট কিছুটা মোটা অর্থাৎ উঁচু হয়ে থাকে, তবে আকৃতি অনেকটা চ্যাপ্টা হয়। এছাড়া ডিম ভর্তি ইলিশের পেট টিপলেই সেটি পায়ুর ছিদ্র দিয়ে ডিম বের হয়ে আসবে। এভাবে যাচাই করে সহজেই পছন্দমতো ইলিশ মাছ কিনতে পারেন।
ডিমভরা ইলিশ খাওয়া ভাল?
বর্ষার মরসুমে বাঙালির পাতে সেজে ওঠার সময় হয়েছে ইলিশ মাছের। ডিমভরা ইলিশের স্বাদ যেন কোনও মানুষেরই অপ্রিয় না। ইলিশ মাছের ডিম থায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।অনেকেই বাজারে গিয়ে ডিমভরা ইলিশের খোঁজ করেন। মাছে ডিম থাকলে তবেই কেনেন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইলিশ মাছের ডিম নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর। ডিমের নানা উপাদান শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে পারে।ইলিশের ডিমে থাকা ইপিএ, ডিএইচ ও ডিপিএ মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনে কাজে লাগে। ইলিশ মাছে ও ডিমে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এটি রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের লক্ষণ দূর করতে সাহায্য করে মাছের ডিমে থাকা ভিটামিন এ চোখের জন্য উপকারী। শিশুদের জন্যও এটি কার্যকরী। রক্ত পরিষ্কার করে রক্তাল্পতা কমাতে সাহায্য করে ইলিশ মাছের ডিম। মাছের ডিমে থাকে ভরপুর ভিটামিন ডি।
তবে মাছ আর ডিমের ক্ষেত্রে হিসাব একটু আলাদা। ডিমের ক্ষেত্রে যে ওই ইলিশ পদ্মা-মেঘনারই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নোনা জলের ইলিশের ডিম নাকি বেশি স্বাদ। মিষ্টি জলের মাছ বেশি সুস্বাদু। ব্যবসায়ীরা অন্তত এমনই দাবি করেন
ইলিশের ডিমে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে। রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
ইলিশ মাছের নাম শুনলে জিবে জল আসে না, এমন বাঙালি আছেন কি? শর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, দই ইলিশ, ইলিশের টক, ভাজা ইলিশ, ইলিশের ভর্তা, আরও কত কি! বাঙালির রান্নাঘরে ইলিশের পদের তো শেষ নেই। বাঙালির ইলিশপ্রেম যতটা খাঁটি, ইলিশের বাঙালিপ্রেমও কিন্তু ঠিক ততটাই। স্বাদে অনন্য ইলিশ পুষ্টিগুণেও ভরপুর।
তথ্যসুত্র
ইলিশ যেভাবে জাতীয় মাছ হলো, Prothom Alo.
একটি জনপ্রিয় মাছ।, Ntvbd.
ইলিশের বাঙালিপ্রেম, Prothom Alo.
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ, Theagronws.
ইলিশের ‘জীবন রহস্য’, Theagronews.
ইলিশ মাছের ডিম, Jagonews24.
ডিমভরা ইলিশ খাওয়া ভাল, Bengali.news18.