জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে টিকা / এইচপিভি ভ্যাকসিন (HPV Vaccine)

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে টিকা / এইচপিভি ভ্যাকসিন (HPV Vaccine)

সার্ভিকাল ক্যান্সার সাধারণত হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) এর সাথে যুক্ত, একটি সংক্রমণ যা যৌনভাবে যোনি, মৌখিক বা পায়ুদ্বার এক্সপোজার দ্বারা এবং ত্বক থেকে ত্বকের যোগাযোগের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে পারে। জরায়ুমুখের ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এটি শুধুমাত্র এইচপিভি ভ্যাকসিন পাওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যেতে পারে।এইচপিভি ভ্যাকসিন মানব প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। HPV সংক্রমণের ফলে জরায়ু, যোনি, ভালভা, লিঙ্গ, মলদ্বার এবং গলার ক্যান্সার হতে পারে। এর ফলে যৌনাঙ্গে আঁচিলও হতে পারে। এইচপিভি একটি সাধারণ ভাইরাস যা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বা যৌন যোগাযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। এইচপিভি ভ্যাকসিন 9 থেকে 26 বছর বয়সী লোকেদের জন্য নির্দেশিত।

এইচপিভি ভ্যাকসিনের বিভিন্ন প্রকার

HPV হল 200 টিরও বেশি ধরণের ভাইরাসের একটি পরিবার, যার মধ্যে প্রায় 40 টি যৌন সংক্রামিত। এর মধ্যে প্রায় 12টি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী তিনটি নিরাপদ এবং কার্যকর এইচপিভি ভ্যাকসিন রয়েছে:

Gardasil® 9: নয়টি HPV প্রকারের বিরুদ্ধে রক্ষা করে, যার মধ্যে উচ্চ-ঝুঁকির স্ট্রেন রয়েছে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এটি সার্ভিকাল ম্যালিগন্যান্সির 90% পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে পারে।

Cervarix® এবং Gardasil®: এই ভ্যাকসিনগুলি, যা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি স্ট্রেনকে লক্ষ্য করে এবং বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়, প্রায় 70% সার্ভিকাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে।

বাংলাদেশের নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসারের অবস্থান দ্বিতীয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার বিবেচনায় জরায়ুমুখ ক্যানসারের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে ক্যানসারজনিত মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এই জরায়ুমুখ ক্যানসারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর জরায়ুমুখ ক্যানসারে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে ৪,৯০০ জন মারা যান।এক্ষেত্রে এইচপিভি টিকা জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর টিকাগুলোর মধ্যে একটি। এইচপিভি দ্বারা সৃষ্ট ৯০ শতাংশের বেশি ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে এই টিকা।এইচপিভি ত্বক থেকে ত্বক বা যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর সংক্রমণ এতটাই সাধারণ যে, প্রায় সব নারীরই তাদের জীবনের কোনো না সময়ে অন্তত এক ধরনের এইচপিভি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সংক্রমণ দুই বছরের মধ্যে নিজ থেকে চলে যায়। কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়। যা পরবর্তীতে জরায়ুমুখ ক্যানসারের সৃষ্টি করে।

ঢাকায় ১৫ লাখেরও বেশি মেয়েকে এইচপিভি টিকা প্রদান করা হয়েছে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আজ বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট এবং রংপুর বিভাগে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকাদান ক্যাম্পেইনেরচূড়ান্ত পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করেছে। দ্যা ভ্যাকসিন এলায়েন্স (গ্যাভি), ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডাব্লিউএইচও)-এর সহায়তায় ১০-১৪ বছর বয়সী ৬২ লাখেরও বেশি মেয়ের জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এই টিকা প্রদানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।টিকাদান ক্যাম্পেইনের চূড়ান্ত পর্যায়ের এই কার্যক্রম সারা দেশ জুড়ে এক মাসব্যাপী চলবে। ক্যাম্পেইনের প্রথম পর্যায়ে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে,ঢাকায় ১৫ লাখেরও বেশি মেয়েকে এইচপিভি টিকা প্রদান করা হয়েছে।

২০২৪ সালে গ্যাভি-এর সহায়তায়, ৬২ লাখ টিকা সংগ্রহ করা হয়েছে

২০২৪ সালে গ্যাভি-এর সহায়তায়, ৬২ লাখ টিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে এই টিকা পাওয়া যাবে, তবে তারজন্য আগে থেকেই “ভ্যাস্কইপিআই (VaxEPI)” অ্যাপে বা এই ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে। সরকারি ছুটির দিন বাদে সকাল ৮:০০টা থেকে বিকেল ৩:৩০টা পর্যন্ত নিয়মিত এই টিকাদান কর্মসূচি চলবে।২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগ ব্যতীত ৭টি বিভাগের ৫১টি জেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইপিআই, শিক্ষা বিভাগ, বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় প্রশাসন, ১৬টি মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় একযোগে ১৮ দিনব্যাপী এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে। স্কুল পর্যায়ে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির কিশোরী ও স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরা এই টিকার আওতাভুক্ত। 

এ ভ্যাকসিনে কোন ধরণের ঝুঁকি বা বন্ধ্যাত্ব হওয়ার সম্ভাবনা নেই

৫ম-৯ম শ্রেণির ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩০ জন কিশোরী ও স্কুল বহির্ভূত কমিউনিটির ৭ হাজার ৫১৮ জন কিশোরীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে। ১৭ ডিজিটের জন্মনিবন্ধন দিয়ে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন এবং জন্মনিবন্ধন বিহীন কিশোরীদেরকে হোয়াইট লিস্টিংয়ের মাধ্যমে ক্যাম্পেইনের প্রথম ১০দিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র সমূহে টিকা দেওয়া হবে। পরবর্তীতে ৮ দিন স্থায়ী ও অস্থায়ী কেন্দ্রসমূহে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগে জাতীয় এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন সফল করতে সকল প্রস্তুতি রয়েছে। এ ভ্যাকসিনে কোন ধরণের ঝুঁকি বা বন্ধ্যাত্ব হওয়ার সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন বিষয়ে অপপ্রচার বা গুজব রোধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

সরকারের হাতে টিকার মজুত রয়েছে ৭৯ লাখ ৪৭৮ লাখ

এই ক্যাম্পেইনের আওতায় জেলার ১৭৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৬১৪টি কেন্দ্রে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী ৮৫ হাজার ১০৭ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ১৯০৪টি কেন্দ্রে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩ হাজার ৩৪৪ জন মোট ৮৮ হাজার ৪৫১ মেয়েকে এক ডোজ করে এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে। জেলায় স্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যা ৮ টিসহ মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৩০৭টি।স্কুলে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীরা বিনা মূল্যে পাবে এই টিকা। এক ডোজের টিকার ক্যাম্পেইন চলবে ১৮ দিন। এই ক্যাম্পেইনে ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৫৯ কিশোরীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য । এই মুহূর্তে সরকারের হাতে টিকার মজুত রয়েছে ৭৯ লাখ ৪৭৮ লাখ।ভ্যাকসিনটির নাম সার্ভিক্স (জিএসকে), যা বেলজিয়ামে তৈরি। প্রতি ভায়ালে ডোজ সংখ্যা ২টি। ভ্যাকসিনটি +২° সে. থেকে +৮° সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ সুপারিশ অনুযায়ী দেশের ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ অব এক্সপার্ট (নাইট্যাগ) কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার নারীর মৃত্যু হয়

জরায়ুমুখ ক্যান্সারে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার নারীর মৃত্যু হয়, তবে কেবল টিকাদানের মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যেতে পারে। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এই টিকা হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই টিকা নেওয়া মেয়েদের প্রায় ৯০ শতাংশের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে গেছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে টিকাদানের ক্ষেত্রে কিশোরদের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় গবেষণায় পশ্চিমা দেশগুলোর তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। তাই গবেষণায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বয়সসীমা ভিন্নও হতে পারে। দ্য অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এ বিষয়ে কিছু গবেষণা করেছে। তবে তা শুধু টিকার (ভ্যাকসিন) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে অল্প বয়সী গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন

জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে অল্প বয়সী গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন এবং এটি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জরায়ুমুখ ক্যানসার বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা প্রায়ই সংকোচ বোধ করি। ফলে আজকের গোলটেবিল আলোচনা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্মানিত প্রতিনিধির এখানে উপস্থিতির মাধ্যমে এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রমে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহায়তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অত্যন্ত আশার কথা হলো, শুধু একটি টিকার মাধ্যমেই এইচপিভি সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। এইচপিভি টিকা গ্রহণকে মূলধারায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত কিশোরীরাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই কিন্তু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত কিশোরীরাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই কিন্তু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই সংখ্যা কিন্তু বেশি না, মাত্র ৩%। আমাদের টার্গেটের ৬২ লাখের মধ্যে ১ লাখ ৮৬ হাজার মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত। সংখ্যায় অল্প হলেও এখানে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের যত কৌশল আছে, যাঁরা মাঠে আছেন, তাঁরা সব শক্তি দিয়ে জানাবেন টিকাটা নিতেই হবে।

দ্যা ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভির কর্মকর্তারা জানান, ব্যাপক পরিসরে এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন বাংলাদেশে সব মেয়ের সুস্বাস্থ্য ও বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং দেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে দারুণ সহায়ক হবে। জীবন রক্ষায় সাহায্যকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই টিকা তৈরিতে সহযোগিতা করতে পেরে গ্যাভি গর্বিত।জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) থেকে। আর এইচপিভি টিকার মাত্র একটি ডোজই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

তথ্যসুত্র

 ক্যানসারে মারা যান. Dhakatimes24.

জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে, Daily Messenger.

কিশোরীকে টিকা , Dhakapost.

কিশোরীকে এইচপিভি ভ্যাকসিন , BSS news.

জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে, Dainikshiksha.

সার্ভিকাল ক্যান্সার সাধারণত , Medicoverhospitals.

দ্য গ্লোভাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন, Prothomalo.

টিকাদান ক্যাম্পেইনের চূড়ান্ত, UNICEF.

Subscribe for Daily Newsletter