নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ (Illiteracy)
নিরক্ষরতা বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। কেননা নিরক্ষরতার কুফল আর্থসামাজিক জীবনে মারাত্মক ক্ষতিকর। নিরক্ষরতা নিজে যেমন একটি সমস্যা তেমনি অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাছাড়া নিরক্ষর ব্যক্তিরা উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে তারা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।
মানুষের পাঁচটি মৌল-মানবিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম
মানুষের পাঁচটি মৌল-মানবিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম যা মানুষকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। অন্যদিকে নিরক্ষরতা মানুষের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। শিক্ষাহীন জীবন নির্বোধ-অচৈতন্য প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এককথায় নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ।
দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা
ভাষাভিত্তিক পরিসংখ্যানিক ওয়েবসাইট এথনোলগ ডটকম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পৃথিবীতে বর্তমানে আনুমানিক সাত হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা এক হাজারের কম। এ ছাড়া মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লেখ্য রূপ। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো মৌখিকভাবেই চর্চিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রিক গবেষণার তথ্যানুযায়ী প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা।
ইউনেসকোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করা হয়
১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৬৫ সালের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেসকোর উদ্যোগে তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইউনেসকোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করা হয় এবং এটি ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হয়। প্রতিবছর দিবসটি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দেশের সাক্ষরতা ও বয়স্ক শিক্ষার অবস্থা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকে। এর লক্ষ্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা।
আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা
আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হলো অক্ষরপরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয় পড়ে, সেটা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, তাহলে তাকে সাক্ষর বলে। ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ কমিটি সাক্ষরতার সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে: ‘একজন ব্যক্তির পাঠের ক্ষমতা অক্ষরপরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পাঠের বিষয়ের বোধগম্যতা ও লিখে নিজের মনের ভাব প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’ সাক্ষরতা শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়: ব্যবহারিক সাক্ষরতা ও আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা বলতে বোঝায় লেখা, পড়া ও গণিতের সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা আর আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা হলো স্কুল-কলেজে পড়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায়।
১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসটি উদযাপিত হয়
১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি উদযাপিত হয়। দিবসটির লক্ষ্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা। জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্র এ দিবসটি উদযাপন করে থাকে। নিরক্ষরমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সর্বপ্রথম সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার মূল কাজটি সরকারের। দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যবস্থা নেওয়া যায় দুভাবে : এক. ১৪ বছর পর্যন্ত সব শিশুর অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করা। দুই. সমাজের বয়স্ক নিরক্ষর মানুষের মাঝে অক্ষরজ্ঞান প্রদানের জন্য সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা।
১৯৬১ উনেসকোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন বিশ্বের ৮০টি দেশের শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন
১৯৬১ উনেসকোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন সালের ডিসেম্বর মাসে পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের ৮ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেসকোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বের ৮০টি দেশের শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন।ওই সম্মেলনে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৬৬ সালে ইউনেসকো দিবসটি প্রথম উদ্যাপন করল। তবে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকে।
সাক্ষরতা শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য এটি একটি হাতিয়ার
টেকসই উন্নয়নের মূলকথা ‘সাক্ষরতা ও দক্ষতার উন্নয়ন’ (Literacy and skills development) হচ্ছে ২০১৮ সালের বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসের স্লোগান। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে সাক্ষরতাকে গ্রহণ করা হয়। কারণ দারিদ্র্য হ্রাস, শিশুমৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য এটি একটি হাতিয়ার। যে মা-বাবা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন তাঁদের সন্তানদের যেকোনো মূল্যে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন, আর এই প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে আরো শিক্ষিত করার ধারার মধ্যে অবস্থান করে।
১৯৯১ সালে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়
আমাদের দেশে সাক্ষরতা বৃদ্ধির প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয় ১৯১৮ সালে নৈশবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর ১৯৩৪ সালে খান বাহাদুর আহসানউল্লা, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। ১৯৬০ সালের ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় সফলভাবে পরিচালিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। এতে শত শত দরিদ্র মানুষ অন্তর্ভুক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যুরো অব নন-ফরমাল এডুকেশন’। ১৯৯১ সালে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে বই সরবরাহ করা হচ্ছে আর মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি তো আছেই। আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে ছয় থেকে ১০ বছরের ছেলে-মেয়েদের জন্য বিনা মূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সাক্ষরতার হার নির্ধারণে আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছি, সেটি সাক্ষরতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না
এগুলো সাক্ষরতা বৃদ্ধি তথা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ধনাত্মক ফ্যাক্টর। কিন্তু এটিও তো ঠিক যে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরও অনেক শিক্ষার্থী দেখে দেখে বাংলা পড়তে পারে না, ইংরেজি তো দূরের কথা। এটিকে কোন ধরনের সাক্ষরতা বলব? সাক্ষরতার হার নির্ধারণে আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছি, সেটি সাক্ষরতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। ১৯৮৫ সালে লেসোথোতে ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যায়ন, যা আমাদের দেশেও প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে সাক্ষরতার হার দেখানো হয়েছিল ৬০ শতাংশ, অথচ সাক্ষরতার পরিবর্তিত সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে মূল্যায়ন ও যাচাই করা হলে সাক্ষরতার হার ৪৬ শতাংশে নেমে এসেছিল। এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ। কারণ আমরা দাবি করছি আমাদের সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এটির ভিত্তি কী? এখানে কী কী শর্ত ধরা হয়েছে, বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন।
এ সময় দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘সমন্বিত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম (ইনফেপ)’ নামে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও বিভিন্ন আদমশুমারি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে এই হার দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশে। এরপর ১৯৯১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৫.৩ শতাংশ। এ সময় দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘সমন্বিত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম (ইনফেপ)’ নামে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২০০১ সালে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭.৯ শতাংশ। ২০০৩ সালে সরকারিভাবে সাক্ষরতার হার বেড়ে হয় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৮.৯ শতাংশ। বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। আর ২০১০ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৫৯.৮২ শতাংশ। বর্তমানে আমরা দাবি করছি ৭২ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টার ফলে এই হার হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, তার পরও গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি দিয়ে দেখা উচিত এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে দেশে একজন মানুষও নিরক্ষর না থাকে।
বিদ্যালয় থেকে শিশুর ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার জন্য নানাবিধ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে
ইশতেহার-২০০৮ এর ’মানব উন্নয়ন’ শিরোনামে ১০.১ দফায় এবং ভিশন ২০২১ এর ৮ দফায় বর্তমান সরকার সবার জন্য শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যালয় গমনোপযোগী শতভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ এবং ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, শিক্ষানীতি ২০১০ এবং বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির আলোকে ২০১১ সালে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার বিষয়টি ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি দেশের সকল রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করা হয়েছে। ফলে সাক্ষরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা আতিক্রম করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। বিদ্যালয় থেকে শিশুর ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার জন্য নানাবিধ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি অনেকাংশে প্রতিপালন করা সম্ভব হয়েছে।
দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ
এমনিতর অবস্থায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে সাক্ষরতার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য গতানুগতিক পদ্ধতি ও কৌশলের পাশাপাশি নতুন পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে গ্রহণ, Public-Private Partnership-PPP-র আওতায় সাক্ষরতা কর্মসূচিকে নিয়ে আসা, নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্পোরেট জগতকে উত্সাহিত করা, প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়ন কৌশল বাদ দিয়ে কার্যক্রম ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচিতে স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা এবং বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্রতিজনে একজন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করা’ কর্মসূচি বাধ্যতামূলক করা— এসব পদক্ষেপ গ্রহণ এবং গণশিক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সাক্ষরতার আলো ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব
দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ এখনো নিরক্ষরতার অভিশাপ বহন করে চলেছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ এখনো নিরক্ষরতার অভিশাপ বহন করে চলেছে। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, প্রকৃত সাক্ষরতার হার ৫৭ শতাংশ। বছরে সাক্ষরতার হার বাড়ছে ১ শতাংশ কিংবা তারও কম। এই ধারা চলতে থাকলে দেশ নিরক্ষরতামুক্ত হতে আরও ৩০ বছর লেগে যাবে। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি কম হওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সাক্ষরতার হার বাড়াতে তিনি গত আট মাসে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে।
বর্তমানে কেউ শুধু নাম লিখতে পারলেই সাক্ষর হিসাবে গণ্য হবে না
বাংলাদেশে "সাক্ষরতা" শব্দের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে। শুরুতে স্ব অক্ষরের সঙ্গে অর্থাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণমালা প্রয়োজন তা জানলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। ১৯৪০-এর দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। ষাটের দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হিসাব-নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই সাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃত হয়। বর্তমানে কেউ শুধু নাম লিখতে পারলেই সাক্ষর হিসাবে গণ্য হবে না।
বর্তমানে সাক্ষর হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ৬টি শর্ত মানতে হয়
বর্তমানে সাক্ষর হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ৬টি শর্ত মানতে হয়- ১. ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, ২. সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে, ৩. দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে, ৪. ব্যক্তিত্ব রক্ষা করে অপরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং অন্যের মতামত কে গুরুত্ব দিবে, ৫. নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে এবং ৬. যেকোন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন ও যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে।
নিরক্ষর ব্যক্তিরা সবসময় হীনম্মন্যতায় ভোগে
বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। প্রতি চারজন মানুষের একজন নিরক্ষর। তাই এ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে, যেন সমাজের একজন মানুষও নিরক্ষর না থাকে। নিরক্ষর ব্যক্তিরা সবসময় হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাদের চিন্তাশক্তির বিকাশ হয় না। তারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
নিরক্ষর মানুষ রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত অধিকারগুলোর সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে না, কারণ অধিকার সম্পর্কে তারা অসচেতন। দারিদ্র্য নিরক্ষর মানুষের নিত্যসঙ্গী। তারা নিজের নাম সাক্ষর করতে অক্ষম হওয়ায় বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। এ যুগেও তাদের সাক্ষরের স্থানে হাতের টিপ দিতে হয়। ফলে অফিস-আদালতে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি একজন নিরক্ষর লোককেও অক্ষরজ্ঞান দিতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে নিরক্ষরমুক্ত হবে আমাদের সোনার বাংলা।
নিরক্ষর মানুষদের অক্ষর-জ্ঞান প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব
সরকারের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যারা শিক্ষিত তারা প্রায়ই ভুলে যাই নিরক্ষর মানুষদের অক্ষর-জ্ঞান প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ গড়তে শিক্ষিত সমাজকে কিছু কর্মসূচি পালন করতে হবে। যেমন- প্রত্যেক শিক্ষিত কর্তৃক কমপক্ষে একজন নিরক্ষরকে অক্ষর-জ্ঞান প্রদান। পথশিশু ও নিরক্ষরদের মাঝে খাতা-কলম, বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা। বয়স্কদের মাঝে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। নিরক্ষরদের অক্ষর-জ্ঞান প্রদানের জন্য শিক্ষিত সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা। পোস্টারিং ও দেয়াল লিখন। অনগ্রসর এলাকায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।
দারিদ্র্য নিরক্ষর মানুষের নিত্যসঙ্গী
নিরক্ষর মানুষ রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত অধিকারগুলোর সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে না, কারণ অধিকার সম্পর্কে তারা অসচেতন। দারিদ্র্য নিরক্ষর মানুষের নিত্যসঙ্গী। যারা নিজের নাম স্বাক্ষর করতে অক্ষম, বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। এই যুগে এসে স্বাক্ষরের স্থানে হাতের টিপসই দিতে হয়। যার ফলে অফিস-আদালতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি একজন নিরক্ষর লোককেও অক্ষর জ্ঞান দিতে পারি তাহলে ধীরে ধীরে নিরক্ষরমুক্ত হবে আমাদের সোনার বাংলা। তাই ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আমরা শিক্ষিত প্রত্যেকেই একটি কর্মসূচি গ্রহণ করি। একজন হলেও নিরক্ষরতা নামক অভিশাপ থেকে মুক্ত করব।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য যাই থাক না কেন এখনো আমাদের দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ রয়েছে নিরক্ষর। তাদের কাছে দৈনিক পত্রিকার সংবাদ বা সম্পাদকীয়ের কোনো মানে দাঁড়ায় না। তারা নিজেদের সন্তানদেরও লেখাপড়া শেখাতে পারে না। নিরক্ষরতা ব্যক্তিজীবনের জন্য যেমন অভিশাপ তেমনি সমাজ ও দেশের জন্যও অভিশাপ।
সাক্ষরতা দিবস সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘটা করে তা পালন করে। কিন্তু এরপর আর কোনো উদ্যোগ থাকে না
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এমন একটি অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যাপারেই সবাইকে সচেতন করে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এ দিবসটি এলেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘটা করে তা পালন করে। কিন্তু এরপর আর কোনো উদ্যোগ থাকে না। তা না হলে ছয় বছর ধরে এ-সংক্রান্ত প্রকল্পটি ঝুলে থাকে কী করে? নিরক্ষর মানুষের মধ্যে যেমন প্রাচীনরা রয়েছেন, তেমনই শিশু-কিশোররাও রয়েছে। এসব শিশু-কিশোর আগামীর ভবিষ্যৎ। ফলে শুধু প্রকল্প নয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্যকে সফল করতে হলে প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষকে নিরক্ষরতার অন্ধকারে রেখে দেশের উন্নয়নও যে সম্ভব নয় সে কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। একা সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এর জন্য সরকার ও জনগণের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন এবং এ সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
তথ্যসুত্র
নিরক্ষরতা মানুষের জীবন , Ajkerpatrika.
নিরক্ষরতামুক্ত করার ঘোষণা, Prothomalo.
সাক্ষরতা প্রসারের জন্য, Ittefaq.
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, Protidinersangbad.
নিরক্ষরতা একটা অভিশাপ, Bhorerkagoj.
সাক্ষরতা সম্পর্কে সচেতনতা, Cvoice24.
সাক্ষরতা ও দক্ষতার উন্নয়ন, Kalerkantho.
অন্যতম সামাজিক সমস্যা, Banglalekok.
নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যবস্থা , Jugantor.