শারীরিক ব্যায়ামের গুরুত্ব | The importance of physical exercise
এরকম বাক্য নিশ্চয়ই শুনেছেন, “ব্যবহার কর, নয়তো ক্ষয়ে যাবে” অথবা “ফেলে রাখলে, মরচে পড়ে”। এ কথাগুলো মানুষের শরীরের জন্য অনেক বেশি প্রযোজ্য। আপনি যদি আপনার শরীর ব্যবহার না করেন, তবে তার ক্ষয় হবেই। আপনার পেশি হয়ে পড়বে থলথলে, নিস্তেজ ও দুর্বল। আপনার শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন হার্ট, ফুসফুস, লিভার এগুলো ঠিকঠাক মত কাজ করবে না। আপনার শরীরের জয়েন্টগুলো হয়ে পরবে অনমনীয়। বলা হয়ে থাকে, নিষ্ক্রিয়তা বা শরীর কাজে না লাগানো অনেকটা ধূমপানের মতোই তীব্র ক্ষতিকর। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যাদের বয়স ৬০-এর ওপরে, তারা যদি সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাহলে বছরে যে টাকা তিনি চিকিৎসার জন্য ব্যয় করেন, তা অনেকাংশে কমে আসে।
কর্মদক্ষতার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো নিয়মিত শরীরচর্চা
শরীরচর্চা বলতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর গতিচলনকে বোঝায়। আমাদের শরীরের ক্রিয়া একটি মেশিনের মতো। মেশিনের যত্ন না নিলে তা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায়, তেমনি আমাদের শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে প্রয়োজন নিয়মিত শরীরচর্চা। শরীরের সুস্থতা ও কর্মদক্ষতার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো নিয়মিত শরীরচর্চা। শরীর ও মন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শরীর ভালো তো মন ভালো আর শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। কথায় বলে—‘সুস্থ মনই সুস্থ দেহ’। দেহের অসুস্থতা মনের ওপর প্রভাব ফেলে। জীবনের উন্নতি ও সফলতার প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম। অলস ব্যক্তি জীবনে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয় না। নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর ভালো ও মন প্রফুল্ল থাকে। এটা কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি উদ্দীপনা জোগায়। ব্যায়াম মাংসপেশিকে শক্ত এবং দেহকে কর্মঠ করে। উন্নত দেশের জনগণ শারীরিক ব্যায়ামের প্রতি খুব যত্নশীল এবং সচেতন। নিয়মিত শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
নিয়মিত ব্যায়ামের একাধিক উপকারিতা রয়েছে
নিয়মিত ব্যায়াম হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজে ভুগছেন, তারা যদি প্রতিদিন ব্যায়াম করেন, তাহলে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি তিন ভাগের এক ভাগ কমে যায়।নিয়মিত ব্যায়াম করলে মাংসপেশি, হাড় এবং অস্থিসন্ধি শক্ত হয়। মানবদেহে হাড়ের ডেনসিটি বেড়ে যায়; যা অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসসহ অস্থিসন্ধির বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়।নিয়মিত ব্যায়াম করলে অনেক ক্যালরি ক্ষয় হয়, যা স্বাস্থ্যসম্মত ওজন ধরে রাখে। ওজন ঠিক থাকলে অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা দূর করে। নিয়মিত ব্যায়াম করার পাশাপাশি আমাদের প্রতিদিনের খাওয়ার প্রতি যত্নশীল হতে হবে নিয়মিত ব্যায়াম ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এর মধ্যে স্তন ক্যান্সার, মলাশয় ক্যান্সার অন্যতম।গোটা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম দুই ধরনের ডায়াবেটিক বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। আপনি যদি ডায়াবেটিসের রোগী হন, তাহলে একটি ডায়েরি মেইনটেইন করুন।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রতিদিন আপনার সুগার লেভেল লিখে রাখুন। এভাবে নিয়মিত ব্যায়াম করলে দেখতে পাবেন আপনার রক্তের গ্লুকোজ লেভেলে কতটা পরিবর্তন এসেছে।প্রতিদিন ব্যায়াম করলে আমাদের শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে; যার ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এর ফলে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ করে।নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের চর্বি কমায় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণে সাহায্য করে।নিয়মিত ব্যায়াম করলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে, আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং হতাশা কমিয়ে দেয়। আমাদের নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা দূর করে। এ ছাড়া মাননিক চাপ, দুশ্চিন্তা দূর করে আমাদের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। সারাদিন অনেক কাজ করার পরও শরীর ও মন সজীব থাকে।
বয়সের তারতম্য এবং শারীরিক সুস্থতার ওপর ব্যায়ামের পরিমাণ নির্ভর করে
বয়সের তারতম্য এবং শারীরিক সুস্থতার ওপর ব্যায়ামের পরিমাণ নির্ভর করে। বয়সভেদে ব্যায়ামের ধরন বদলে গেলেও প্রয়োজনীয়তা কমে যায় না মোটেই। আদর্শ ওজন বজায় রাখতে, বিভিন্ন রোগের আক্রমণ ও জটিলতা থেকে দূরে থাকতে, এমনকি গর্ভাবস্থায়ও (চিকিৎসকের পরামর্শমতো) ব্যায়াম করতে হয় নানা রকম জটিলতা এড়াতে।
শিশু-কিশোর
শৈশবে শরীরের ওজন ঠিক রাখতে, শক্ত হাড় গঠনে, ঘুম ঠিক রাখতে ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে ব্যায়াম। শিশুদের দিনে অন্তত এক ঘণ্টা ব্যায়ামে কাটানো উচিত। শিশুদের টইটই করে দৌড়ে বেড়ানোতেই ব্যায়াম হয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলের মতো বিভিন্ন ধরনের দলগত খেলা; সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, কারাতে ইত্যাদি শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ব্যায়ামের চাহিদা মিটে যায়।
তরুণ আছেন যাঁরা
খেলাধুলা, সাঁতার কাটা, সাইক্লিং, দৌড়ঝাঁপ থেকে শুরু করে প্রায় সব রকমের শরীরচর্চায় ব্যস্ত থাকতে পারেন তরুণেরা। এ ক্ষেত্রে জিমের প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারেন। একই বয়সের হলেও শারীরিক উচ্চতা, ওজনের তারতম্যের কারণে একেকজনের ক্ষেত্রে ব্যায়ামের ধরন একেক রকম হতে পারে।
চাকরিজীবী যাঁরা
সকাল-সন্ধ্যা অফিস আর পারিবারিক জীবনের ব্যস্ততায় থাকেন যাঁরা, তাঁদের হয়তো নিয়মমাফিক ব্যায়াম করা হয়ে ওঠে না। তবু চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। অনেকে অফিসে চেয়ার-টেবিলে বসা চাকরি করেন, তাঁদের কাজের মধ্যেই ব্যায়াম করা উচিত। এক রুম থেকে আরেক রুমে হাঁটা, লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা, ফোনে কথা বলার সময় বসে না থেকে দাঁড়িয়ে বা একটু হেঁটে হেঁটে কথা বলা—এসবও ব্যায়াম। ঠায় বসে থাকার চেয়ে একটু ব্যায়াম তো হলো!
পড়ন্ত বয়সে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে শুরু করে। নিয়মিত কিছু ব্যায়াম সেই প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে অনেকটাই সুস্থ জীবন যাপন করতে সাহায্য করে। তবে এই বয়সে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখেই ভালো থাকা যায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি খুবই প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে, যেমন হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য, হাড়ের রোগ, ব্যাকপেইন, কোলেস্টেরল লেভেল কমাতে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে, মাংসপেশিকে শক্তিশালী করতে, অস্টিওপোরসিসের ঝুঁকি কমাতে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী হাঁটা, কিছুটা ফ্রি–হ্যান্ড, কার্ডিও টাইপ ব্যায়াম, এরোবিক্স ও ইয়োগা খুবই উপকারী।
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করা আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা সবার জন্য অপরিহার্য
আজ থেকে ২ হাজার ৫শ’ বছর আগে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিস বলে গেছেন মানুষের জন্য সেরা ওষুধ হল- হাঁটা। চিকিৎসা শাস্ত্রেই যে হাঁটা বা ব্যায়ামের উপকারিতা জানানো হয়েছে তা নয় এর ব্যাপকতা শরীর চর্চা, বাত ব্যথা, প্যারালাইসিসসহ আরও অনেক জায়গায় স্থান পেয়েছে। ব্যায়াম বলতে আমরা বুঝি শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম অথবা নিয়মিত এমন কিছু করা যার ফলে শরীর হয় প্রশান্ত এবং মানসিক অশান্তি হয় দূরীভূত। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করা আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা সবার জন্য অপরিহার্য। ব্যায়াম একজন মানুষের মানসিক এবং শারীরিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে কারণেই বলা হয়েছে ‘সুস্থ মন সুস্থ দেহ’। আমাদের শরীর অসার (মৃত) হওয়া অর্থ আমাদের মনেরও মৃত্যু ঘটা। সুতরাং শরীরকে সুস্থ রাখার পূর্বশর্ত নিয়মিত এবং পরিমিত ব্যায়াম করা।
ব্যায়াম আমাদের শরীরকে শারীরিক যোগ্যতা এবং স্বাস্থ্য সবলতা ঠিক রাখে। সুস্থ সতেজ রাখে। কেবলমাত্র তাই নয়, আমাদের শরীরের পুনঃগঠনের বিশেষ অবদান রাখে। ব্যায়াম আমাদের পেশিশক্তি বৃদ্ধি করে, ওজন কমানোয় সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম তারুণ্যকে ধরে রাখতে এবং বয়স ও বার্ধক্যের গতি কমিয়ে দেয়। ব্যায়াম হৃদপিণ্ডের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং হৃদযন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ব্যায়াম আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং অনেক রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
তথ্যসুত্র
আমাদের শরীরের ক্রিয়া. Ittefaq.
বয়সভেদে ব্যায়াম, Prothomalo.
কোন প্রকার রোগে ভোগেন নি, Shajgoj.
শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম , Samakal.