দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশে (Inflation in Bangladesh)

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশে  (Inflation in Bangladesh)

নিত্যপণ্যের মূল্য অনেক দিন থেকেই ঊর্ধ্বমুখী। বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। ভোজ্যতেল, সবজি, চিনি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আলুসহ দৈনন্দিন জীবন ধারণের প্রায় সব ক’টি পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতিতে চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। এ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে না থাকা বা বাজার স্থিতিশীল না থাকার কারণ কেবল করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি নয়। এর পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি, অতি মুনাফাখোরি এবং কিছু ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কার্যকর। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলা প্রভৃতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা সরকার বিভিন্নভাবে দিয়ে গেলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। তারা যে পণ্য উৎপাদন করে তার মূল্য নির্ধারণ ও স্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যদি সহজ না হয়, সাবলীল ও আয়ত্তের মধ্যে না হয় তাহলে উন্নয়ন অর্থহীন।

তাই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া এখন লাগাম ছাড়া। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃশ্যমান অপারগতার কথা জনগণ মুখে বলতে না পারলেও তারা ক্ষোভ বুকে চেপে দমবদ্ধকর জীবন অতিবাহিত করছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। মেহনতী শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ 

বিভিন্ন পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যেসব কারণ বেরিয়ে এসেছে, তা হলো- ১. ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এসব ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে। ২. শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের দেয়া চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা। ৩. আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়। ৪. শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি বিরাট কারণ। ৫. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিভিন্ন সময় দায়ী করলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় খুব কমই।

অবৈধ ঘুষগ্রহণের কারণে দেশে কালোবাজারিদের উপদ্রব ক্রমেই বেড়েই চলছে। ফলে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য কমে না। অনুসন্ধানে এর নেপথ্যে আরো নানা কারণ বের করেছেন দেশি-বিদেশি বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলামের ভাষায় জানা একান্ত জরুরি। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন সব কালজয়ী কল্যাণধর্মী সুচিন্তিত নীতিমালা ও সুদূরপ্রসারী বাজার পরিকল্পনা রয়েছে; যা বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতি রোধ এবং সর্বোপরি বাজারের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীলতা দূর করা সম্ভব। তাই বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে ইসলামের ব্যবসায়িক নীতিমালা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

কালোবাজারি ও মজুতদারির ভয়াবহতা

কালোবাজারিরা বেশি লাভের আশায় দ্রবমূল্য মজুতদারি করায় সংকট সৃষ্টি হয়। হঠাৎ দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে দ্রব্যসংকট সৃষ্টি হয়। এতে কখনো কখনো দেখা দেয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। কোথাও আবার নাশকতা চালিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ থেকে নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের তো আয় বৃদ্ধি সম্ভব হয় না। এতে কালোবাজারিদের আয় বহুগুণে বেড়ে যায়, আর সর্বসাধারণের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই এসব কালোবাজারি দেশের আইনানুযায়ী যেমন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তেমনি ইসলামি আইনানুযায়ীও সে অভিশপ্ত। 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আমাদের করণীয়

দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে অতি দ্রুত আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই এখনই সরকারকে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে যে কাজটি করা দরকার বলে মনে হয় তা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান যেমন টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটানো দুষ্কৃতকারীদের মূলোত্পাটন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অবৈধভাবে অধিকহারে পণ্য মজুত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

এমনকি আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পচনশীল খাদ্যপণ্যের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে হবে। দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

অপচয় রোধ করার পাশাপাশি সরকার প্রধানের নির্দেশনা মোতাবেক এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উত্পাদনে সচেষ্ট হই, তবে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে আসবে, ঠিক তেমনি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক বিষয় আমাদের হাতে থাকে না বটে, কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্নগামী হতে বাধ্য

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বর্তমানে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে এই বিশাল লাইনের বার্তা, নিঃসন্দেহে দরিদ্র মানুষেরা স্বল্প আয়ে চলতে পারছেন না কিংবা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, সেটাই বুঝিয়ে দেয়। বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব দরিদ্র লোকের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, তাঁদের সরকারি সহায়তা দিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হচ্ছে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আরও বাড়ানো।

বর্তমানে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের মধ্য থেকে আগ্রহী এবং যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করে টিসিবি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল ব্যক্তিদের একটি সনদ প্রদান বা নিবন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন বেকারত্বের সমস্যা কমে যাবে, অন্যদিকে দ্রব্য সঠিক দামে ক্রেতারা ক্রয় করতে পারবেন। এ ছাড়া আমরা সচেতনতা এবং চেষ্টার মাধ্যমে পচনশীল খাদ্যপণ্য, যেমন আলু, মরিচ, বেগুন, পটোলসহ বিভিন্ন সবজি যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে পারি।

এক তথ্যমতে জানা গেছে, দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

টিসিবিকে ব্যবহার করে বা বাজার মনিটরিং জোরদার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে কিন্তু তাতে দীর্ঘমেয়াদি তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হলে প্রয়োজন একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা। ক্ষুদ্র আমদানিকারকের সক্রিয় করে দেশব্যাপী আমদানি অবারিত করার মাধ্যমে এবং সেসঙ্গে দেশের কৃষিপণ্য আধুনিক পদ্ধতিতে স্টোরেজ করার সুযোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল বাজার ব্যাবস্থার প্রবর্তন করলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তাই এই কৃষির সফলতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বিশ্বে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বেও এখন আর যে বছরের উৎপাদন সেই বছর ভোগ করা হয় না, বরং সুন্দর এবং মানসম্পন্ন স্টোরেজে রেখে দেয়া হয় আগামী বছর বিক্রির জন্য। ইরেডিয়েশন পদ্ধতি ব্যবহার করে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেমের প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই।

এই পদ্ধতিতে যেকোনো পচনশীল পণ্যসামগ্রী স্টোরেজ করে রাখলে তা স্বাদ ও মানে অটুট থাকে। উৎপাদন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত দামে স্টোরেজ কোম্পানি কিনে স্টোরে যত্ন করে রেখে দিবে এবং রাখার সময়ই নির্ধারিত থাকবে আগামী বছর উৎপাদনের সময় কী মূল্যে বিক্রি করা হবে। এভাবে চলতি বছর বিক্রি করা হবে গত বছরের উৎপাদিত পণ্য যা বিশেষ স্টোরেজ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এভাবে বিক্রি করে স্টোরেজ খালি করা হবে চলতি বছরের উৎপাদিত পণ্য পুনরায় স্টোরে রাখার জন্য।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। চাল, ডাল, তেল, গ্যাস, আটা, চিনি, মাছ, ডিম থেকে শুরু করে শাক-সবজি এমন কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই, যার দাম বাড়েনি বা বাড়ছে না। বাজারজুড়ে মিলছে শীতের সবজি। কিন্তু ভরা মৌসুমেও তার দাম আকাশ ছোঁয়া। সিম, মিষ্টি আলু ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর এই সময় ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি। চালের দামও ভরা মৌসুমে ঊর্ধ্বমুখী। সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলছে না। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। হতাশায় নিমজ্জিত খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও।

করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই, অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সঙ্কোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে অনেকের।নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি গরীব, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনকে রীতিমত দুর্বিসহ করে তুলছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি’ এবং বাস্তবতা

গত মাসে প্রকাশিত এক সংবাদ সূত্র অনুযায়ী, জার্মানিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভোক্তাদের৷ ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এটি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। বৈশ্বিক এই বাস্তবতার কথা বাণিজ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে গত বছর শেষ দিকে শোনা গিয়েছিল।

মনে রাখতে হবে উন্নয়নের মহাসড়কে আসীন বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাভোগ করছে। ১১ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের মধ্যে আছে। টেলিফোন সুবিধা আরও বেশি। ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি মিলবে। এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের অবস্থান অনেক উঁচুতে।

মূলত কৃষিপ্রধান দেশের কৃষক স্বল্পমূল্যে সার ক্রয় করতে সক্ষম হওয়ায় উৎপাদন খরচ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এজন্য খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নাগালের মধ্যে আছে। তাছাড়া টিসিবি’র ট্রাক সেল চলমান থাকবে। মনে রাখতে হবে, কৃষিখাতে বিশাল অংকের ভর্তুকি প্রদানে চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরে লাগবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকিতে লেগেছিল ০৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ভর্তুকি খাতে বাজেট মাত্র ০৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আরও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন। এতো বিশাল অংকের ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে এ বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।

অবশ্য এই ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, অন্যদিকে সারের দাম বাড়ালে কৃষকের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সার, সেচসহ কৃষি উপকরণে মোট ৮৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। বিএনপি’র শাসন আমলে (২০০৫-০৬ অর্থ বছরে) প্রায় ৩২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সার ব্যবহার হয় এবং ওই সময়ে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নৈতিকতার অবক্ষয়

মূল কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অনৈতিকতা এবং অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক মুনাফালাভের আকাঙ্ক্ষা। কিছু কিছু ব্যবসায়ীর নৈতিকতার অবক্ষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধহীনতা তাদের মুনাফা বৃদ্ধির এই আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। অথচ ইসলামে এইরূপ মজুতদারি নিষিদ্ধ। জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম পেশা হিসেবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবশ্যই উত্সাহিত করেছে। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারা-২৭৫)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য উত্সাহিত করেছেন। তবে তা আল্লাহর নির্দেশিত হালাল পন্থায় পরিচালিত হতে হবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি; শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ ও করণীয়

দেশে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের ভোগান্তি আজ চরমে। শ্রমজীবীরা আজ বড়ো অসহায়। ক্রয় ক্ষমতা শ্রমজীবীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। শ্রমজীবীদের কষ্ট কেবলই বাড়ছে। দেশে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী ছাড়া বেশিরভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। উপরন্তু অনেকের বিশেষ করে শ্রমজীবীদের আয় কমে গেছে। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

শ্রমজীবীদের অনেকের কর্ম নেই। অথচ এমন অবস্থাতেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এমন পরিস্থিতিতেও গত বেশ কয়েক মাস ধরে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অত্যন্ত চড়া। আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন, দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম কেবলই বাড়ছে যৌক্তিক কারণ ছাড়া। আগেই বলা হয়েছে এ অবস্থার জন্য যেমন দায়ী আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের অতি মুনাফা লোভ, তেমনি বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। মূল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ায় দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন সাধারণ শ্রমজীবী অসহায় মানুষ। শাসক শ্রেণির মাত্রাতিরিক্ত গোষ্ঠীপ্রীতি এ সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে মুক্তি চায় মানুষ

কমে যাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান। আমাদের শিল্প উৎপাদনের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমদানির দায় ডলারের মাধ্যমে বেশির ভাগ শোধ করতে হয়। সে জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে সব পণ্য আমদানি হয় তার বড় অংশ দেশে উৎপাদন করতে হবে। এতে আমদানির ওপর চাপ কমবে। ফলে রেমিট্যান্স ও রফতানি কম হলেও সঙ্কট প্রকট হবে না। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি ক্রমে কমে আসার সুযোগ তৈরি হবে।


তথ্যসুত্র

সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন , Daily Naya Diganta.

নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, Sramikkalyan.

অনৈতিক পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা , Ittefaq.

ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, Alokito Bangladesh.

দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, Bangla News24.

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি , News Bangla24.

দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি, Ittefaq.

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না, Prothom Alo.

Subscribe for Daily Newsletter