আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস (International Ozone Day)

বিশ্ব ওজোন দিবস আজ। ওজোন স্তরের ক্ষয় ও তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস পালন করা হয়।১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এ দিনটিই পালিত হয় বিশ্ব ওজোন দিবস বা আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে।
পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি ও হেনরি বাইসন ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন
১৯১৩ সালে ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি ও হেনরি বাইসন ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। এ স্তরের বৈশিষ্ট্য বের করেন ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ জিএমবি ডবসন। বায়ুমণ্ডলের এ ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সর্বপ্রথম ধরা পড়ে সত্তর দশকে। বর্তমানে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি ও অতিরিক্ত কার্বন ব্যবহারের কারণে এ ওজোন স্তর প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এ মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে
ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীতে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ পায়। ফলে ধীরে ধীরে মানুষসহ সব প্রাণীই আক্রান্ত হচ্ছে ত্বকের ক্যানসারসহ নানা কঠিন ও জটিল রোগে।তাই পৃথিবীর ওজোন স্তর সুরক্ষার নিশ্চিতে ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়।১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে গৃহীত এ প্রটোকল অনুযায়ী, সদস্যদেশগুলো ২০৪০ সালের মধ্যে ওজোন স্তর ধ্বংস করে এমন গ্যাস উৎপাদন, ব্যবহার সীমিত ও নিষিদ্ধ করতে সম্মত হয়।১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এ মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশ পালন করে আসছে দিবসটি।
৩৬ বছরে বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে
ওজোন স্তরের ক্ষয় রোধে ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ভিয়েনা কনভেনশন ও মন্ট্রিল প্রটোকল গ্রহণ করা হয় ‘মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিগত ৩৬ বছরে বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনী উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ১৯৮৭ সাল থেকে মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়িত হচ্ছে
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, অ্যারোসল, ফোম তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ ব্যবহৃত দ্রব্যগুলোর কারণে প্রতিনিয়ত অতি গুরুত্বপূর্ণ ওজোন স্তরে ক্ষয়সাধন হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তর সুরক্ষার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ১৯৮৭ সাল থেকে মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে বিগত ৩৬ বছরে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওজোন স্তর ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে এবং আশা করা যায় ওজোন স্তর ২০৬৬ সালের মধ্যে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। এছাড়া মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনী বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি-হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পৃথিবীর মাটি থেকে ঠিক উপরের প্রথম স্তরটি ট্রোপোস্ফিয়ার
তিনটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত একটি সক্রিয় গ্যাস হচ্ছে ওজোন। পৃথিবীতে বায়ুম-লের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। বায়ুম-লের এই স্তরসমূহ মানবজাতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর মাটি থেকে ঠিক উপরের প্রথম স্তরটি ট্রোপোস্ফিয়ার। তার উপরের স্তরে বা ভূস্তরের ৫০-৬০ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার।
পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৫-৩৫ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটিই ওজোন স্তর
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের একটু নিচের অংশ বা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৫-৩৫ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটিই ওজোন স্তর। প্রাকৃতিকভাবে ওজোন স্তরের এই সুরক্ষাকবচ আমাদের মাথার উপরে না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকতে পারত না। ওজোন স্তরের এই পর্দা ৯৭-৯৯ শতাংশ অতিবেগুনি রশ্মি শোষণে সক্ষম। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীর মাটি, পানি, আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করা যে কোনো প্রাণের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই রশ্মি যত বেশি পৃথিবীর ভূস্তরে পৌঁছবে ক্ষতিও তত বেশি হবে। মানুষের ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্যানসার হয় ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও এর প্রভাবে উদ্ভিদ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
৭০ এর দশকে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে
বিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত বিষুবরেখার কাছাকাছি ওজোনের পরিমাণ কম, আর মেরু এলাকায় বেশি। বসন্তকালে ওজোনস্তর বেশি পুরু, আবার শরতে কম। উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধের মাঝামাঝি থেকে উচ্চতর অক্ষাংশে বেশি পরিমাণে ওজোন গ্যাস থাকে। ওজোনের এ তারতম্য আবহাওয়ার পরিবর্তন ও সৌরশক্তির তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি ও অতিরিক্ত কার্বন ব্যবহারের কারণে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। ৭০ এর দশকে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে।আরও জানা যায়, ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সূর্য থেকে ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আসছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষসহ সব প্রাণী। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ত্বকের ক্যান্সারসহ নানা কঠিন ও জটিল রোগে। রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনারসহ এ রকম বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে নিঃসরিত সিএফসি বা ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের কারণে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গ্রিক ‘ওজোন’ শব্দের অর্থ গন্ধ পাওয়া বাস্তবেও ওজোন কড়া গন্ধযুক্ত হালকা নীল রঙের বিষাক্ত একটি গ্যাস।
পৃথিবীপৃষ্ঠে ওজোন গ্যাসকে একটি দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বায়ুমণ্ডলে ওজোন খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। গ্রিক ‘ওজোন’ শব্দের অর্থ গন্ধ পাওয়া। বাস্তবেও ওজোন কড়া গন্ধযুক্ত হালকা নীল রঙের বিষাক্ত একটি গ্যাস। ওজোন গ্যাস -১১২০ সে. তাপমাত্রায় তরলে রূপান্তরিত হয় এবং ওজোন ঘনীভূত হয় -২৫১.৪০ সে. তাপমাত্রায়। অক্সিজেনের সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে মিল থাকলেও ওজোন অক্সিজেনের চেয়ে বেশি সক্রিয় এবং শক্তিশালী জারক পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কাছের এলাকায় সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ এবং বজ্রসহ বৃষ্টির পর ওজোন গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে ওজোন গ্যাস আবিষ্কার করেন স্কোনবি। এরপর ফ্রান্সের পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯১৩ সালে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়, যা (সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি) পৃথিবীর জীবজগৎ ও প্রাণিজগতের জন্য হুমকিস্বরূপ। সর্বোপরি ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
ওজোন স্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আকাশে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের এপ্রিলের তাপপ্রবাহে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বিপদে পড়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলজুড়ে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৭⁰ সে.। এজন্য আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। বায়ুমণ্ডলে পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে শিল্পোন্নত (আমেরিকা, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত ইত্যাদি) দেশগুলো। ওজোন স্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আকাশে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে।
মানবসভ্যতার আধুনিকয়নের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে CFC গ্যাসের মত ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ওজন স্তরে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকায় এই স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করতে সক্ষম। কিন্তু মানবসভ্যতার আধুনিকয়নের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে CFC গ্যাসের মত ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার। যা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ওজোন স্তরকে। ফলস্বরূপ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অনায়াসেই পৃথিবীতে পৌছাচ্ছে এবং আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে উষ্ণতা। মানুষ, উদ্ভিদ, প্রাণী তথা সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য এই অতিবেগুনি রশ্মি মারাত্মক হুমকি স্বরুপ।
ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ব্যবহার সীমিত করনের লক্ষ্যে ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় মন্ট্রিল প্রটোকল গ্রহন করা হয় ১৯৮৭ সালের ১৬ ই সেপ্টেম্বর। বিশ্বের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এই মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। সৃষ্টিজগতের সংরক্ষণ এবং ওজোন স্তর ক্ষয় রোধে মন্ট্রিল প্রোটোকল মান্য করার বিকল্প নেই। ইতিমধ্যেই ওজোন স্তর যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ৩৬ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির যে প্রয়াস চলছে তা চলতে থাকলে ২০৬৬ সালের মধ্যে ওজন স্তরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সর্বস্তরের জনসাধারণের সোচ্চার ভুমিকা পালন করা অতীব জরুরি।
তথ্যসুত্র
জলবায়ুর পরিবর্তন , Prothomsangbad.
বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর, Bonikbarta.
বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর, R TV Online.
ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস, Dailyjanakantha.
মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন , Banglatribune.
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি, Jugantor.