বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবন ব্যবস্থা (Life of People in Hills of Bangladesh)

বাংলাদেশের এক বিশাল অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো গঠিত। পুরো বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ এলাকা এখানে অবস্থিত। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো এখন এক সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে রামগড়, খাগড়াছড়ি, কাপ্তাই, বান্দরবান, চন্দ্রঘোনা, লামাসহ বিভিন্ন এলাকা রয়েছে। এসব এলাকাগুলোর অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। গত কয়েক দশক আগেও এসব এলাকার পাহাড়গুলো অনাবাদি অবস্থায় ছিল। ৮০-র দশকের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলগুলোকে আবাদের আওতায় আনা হয়।
চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা
আমাদের দেশে অনেক নৃগোষ্ঠী পাহাড়ে বসবাস করে। যারা মুলত পাহাড়ি নামে পরিচিত। আজ তাহলে তাদের জীবনযাপন নিয়ে জানা যাক। চাকমা বা চাঙমা বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। চাকমারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় চাঙমা শব্দই ব্যবহার করে থাকে। চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা। বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইংনেট জাতিগোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। এবং এরা প্রধানত থেরাবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বুদ্ধপুর্ণিমা ছাড়া তাদের অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব হচ্ছে বিজু ।বাংলাদেশের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে এদের সংখ্যা বেশি। তবে বান্দরবানেও সংখ্যায় চাকমাদের উপস্থিতি রয়েছে। চাকমা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে তথা ত্রিপুরা ও অরুণাচল মিজোরাম রাজ্যে বসবাস করছে। এছাড়া চাকমাদের বড় একটি অংশ অভিবাসন নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এদের প্রধান জীবিকা কৃষি কাজ। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল অংশে স্বাভাবিক সেচ পদ্ধতিতে মৌসুমী কৃষি কাজ, এবং পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন খাদ্যশস্য ও রবিশস্য উৎপাদন করে থাকে।
মারমা বাংলাদেশের একটি উপজাতি ও বৃহৎ জাতিসত্ত্বা
চাকমাদের ভাষার নামও চাঙমা। চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। চাকমারা ৪৬টি গোজা ও বিভিন্ন গুত্তি বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের সংখ্যা ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৭ জন। তবে বর্তমানে তা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। চাকমারা পূর্বে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার পাশাপাশি কিছু কিছু হরি ধর্মও চর্চা করত পরবর্তীতে সবাই মহাযান থেকে হীনযান বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে।মারমা বাংলাদেশের একটি উপজাতি ও বৃহৎ জাতিসত্ত্বা। তিন পার্বত্য জেলায় তাদের বসবাস দেখা গেলেও মূল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস বান্দরবানে। ‘মারমা’ শব্দটি ‘ম্রাইমা’ থেকে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা মিয়ানমার থেকে এসেছে বিধায় তাদের ‘ম্রাইমা’ নাম থেকে নিজেদের ‘মারমা’ নামে ভূষিত করে।মারমাদের বাড়ি “মাচাং” নামে পরিচিত। মাচাঙ গুলোর উচ্চতা ৬ থেকে ৭ ফুট হয়। তাদের ঘরগুলি হয় চারকোণা আকৃতির। ঘরের দেয়ালগুলি বাঁশ দ্বারা এবং ঘরের ছাদ কাঁচা ঘাস দিয়ে আবৃত থাকে। প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য মাচার নিচ থেকে একটি মই সংযুক্ত থাকে।
পার্বত্য বান্দরবানের সাথে মিয়ানমারের রয়েছে ১৫৫ কি.মি. সীমান্ত
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ১১০ কি.মি. সীমান্ত রয়েছে। পার্বত্য রাঙ্গামাটির ২৪০ কি.মি. সীমানা ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিভক্তি নির্দেশ করে এবং পার্বত্য বান্দরবানের সাথে মিয়ানমারের রয়েছে ১৫৫ কি.মি. সীমান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংঘবদ্ধ আকৃতি, প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘ্য কয়েকগুণ বেশি হওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলসমূহ বাংলাদেশের বৃহত্তর ভূ-ভাগের সাথে দুর্বলভাবে সংযুক্ত অভিক্ষেপিত ভূ-ভাগ হওয়া, এ ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতার দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার নাইখ্যংছড়ি থানার শেষ প্রান্ত (পূর্বাংশ) থেকে নিকটতম সমুদ্র উপকূল মাত্র ১৩-১৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত, যা পুরো পার্বত্য অঞ্চলটিকে বিশেষ ভূ-কৌশল গুরুত্ব দান করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩,১৪৮ বর্গ কি.মি. যা লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়। পার্বত্য রাঙ্গামাটির পশ্চিম প্রান্তের কাউখালী থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. দূরে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের অবস্থান এবং কাপ্তাই থেকে ৫০ কি.মি. দূরে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত জলরাশির গভীর সমুদ্রের শুরু।
উপকূলের আদিবাসী অর্থনীতি
কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর রাখাইন আদিবাসীরা সামুদ্রিক শুঁটকি ও নাপ্পি নামের একধরনের প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি উৎপাদন করেন। লবণ উৎপাদনেও জড়িত আছেন রাখাইন ও কিছু তঞ্চংগ্যা পরিবার। নাপ্পি ও সামুদ্রিক শুঁটকি জোগান দিয়ে চলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ, যার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশের বাইরে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে রপ্তানিও হয়। একক আয়তনে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন থেকে মৌয়াল ও বাওয়ালিদের পাশাপাশি সুন্দরবন অঞ্চলের মুন্ডা ও মাহাতোরাও মধু-মোম-গোলপাতা-গরান সংগ্রহ করেন। সমুদ্র উপকূলের আদিবাসীরা দেশের পর্যটন উন্নয়ন খাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে কক্সবাজার, পটুয়াখালী অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী উৎপাদনের ভেতর দিয়ে দেশের পর্যটন খাতে এনেছেন যুগান্তকারী সাফল্য। কারণ প্রতিটি পর্যটন অঞ্চলেই আদিবাসী হস্তশিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। পাশাপাশি পাহাড় ও উপকূলের আদিবাসী জনগণ দেশকে উপহার দিয়েছেন অবিস্মরণীয় তাঁতশিল্প।
সুন্দরবনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেইসবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক মধু আহরণ করা হয়
আজ পাহাড় কী উপকূলের আদিবাসী জনগণের উৎপাদিত এবং সংগৃহীত নানাকিছু ছড়িয়ে গেছে দেশের নানাপ্রান্তে। জাতীয় জীবনে এসবের গুরুত্ব ও চাহিদা সীমাহীন। এসব ফসল, উৎপাদন, তৈজস কী পাহাড়ি বস্তু আজ দেশজুড়ে একটা প্রাকৃতিক পণ্য গ্রহণের নাগরিক অভ্যাসও তৈরি করছে। সুন্দরবনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক মধু আহরণ ও সংগ্রহ করা হয়। আর এই মধুর এক ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে অকাঠামোগত বাজার। আবার এমনকিছু বস্তু আছে যা খুবই একেবারেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য; যা শুধুমাত্র পাহাড় নয়, বাংলাদেশওর পরিচয় মেলে ধরে। যেমন- বান্দরবানের পাহাড়ি ছড়ার পাথর থেকে ক্র্যকা নামের এক বুনো শ্যাওলা সংগৃহীত হয়, যা স্থানীয় আদিবাসীদের চাহিদা মিটিয়ে মশলা হিসেবে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও বিক্রি করা হয়।
পার্বত্য অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি
পাহাড়ে ব্যবসা বানিজ্য আর বাঙ্গালিদের সংস্কৃতি এখন পাহাড়িদের উপর ছোয়া লেগেছে।এদিক থেকে ওনেকটা উন্নয়ন লক্ষ্য হলেও ক্ষতির দিক ও কম নয়।ব্যবসা বানিজ্যর প্রভাবে পাহাড়িরা অদক্ষ হওয়াতে উৎপাদিত দ্রব্যর ন্যায্য মূল্য তারা পান না।খাগড়াছড়ি জেলার উত্তর সীমান্তে দুর্গম এলাকা নাড়াইছড়ি গ্রাম অবস্থিত। সেখানে প্রায় ১০-১৫ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু সেখানে দ্রব্য বিক্রি করারা মতো নেই একটা বাজার।ফলে জমিতে অধিক ফলন হলেও পাহাড়িদের অধিকাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। যেখানে বাজার নেই সেখানে উন্নতি নেই।৩০-৪০ কি.মি দূরে একদিন হেটে বাবুছড়া বাজারে উপর নির্ভর করতে হয় তাদের।শিক্ষা ক্ষেত্রে ৩-৪ টা প্রাইমারি স্কুল মাত্র। সেখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৭১ সাল হতে এখনো উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি।ফলে অধিকাংশ মেধাবি ছাত্র প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়ে হয়ে যায় নিরক্ষর। এদিক থেকেও তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়না।অধিকতর গড়ে উঠেছে বিজিবি ক্যাম্প, সাজেকে পর্যটন ইত্যাদি। এগুলো অনেকটা কাজে আসলেও তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিষয়টি গড়ে তোলা জরুরি ছিল।পার্বত্য অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। ফলে পাহাড়ি সমাজের বিবর্তনে আজ জীবনকাল আর সমাজ ব্যবস্থা পুরোটা বাঙ্গালিদের সাদৃশ্য। বর্তমান যুগের সাথে পাহাড়িরা তাল মেলাতে অনেক তরুন তরুনী আজ শহরে নানা শিল্পতে কাজ করতে বাধ্য।কারণ পাহাড়িদের পুরানো অর্থনীতি আজ ভেংগে পড়েছে। ফলে পাহাড়িদের অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা বাঙ্গালিদের সাথে সাথে পরিবর্তিত। আর সেই অর্থনৈতিক তো পুঁজিতান্ত্রিক।
বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে অনেক গুলো পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে
বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে অনেক গুলো পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে।কিন্তু এই শিল্প পাহাড়িদের জন্য অর্থনীতির মুক্তিতে তেমন ভূমিকা রাখছে না ।এসব পর্যটন শিল্প শুধুমাত্র দেশের শোভা প্রাপ্ত।নানা রং বেরংগের মানুষ আজ সাজেক ভ্যালিতে দেখা মেলে।কিন্তু এসব হাসি খুশির মাঝে লুকিয়ে আছে শত পাহাড়িদের কান্না।রাংগামাটিতে অধিকাংশ জমিতে আনারস,কাঠাল, কমলা ইত্যাদি ফলের উৎপাদন বাহার। কিন্তু সেসব ফল ফলাদির মালিকরা(পাহাড়ি) ব্যবসায়ী দের বিবেকের কাছে পরাজিত হতে হয়।প্রতি আনারস খুবই কম মূল্য হারে বিক্রি করতে হত তাদের।যদি পার্বত্য অঞ্চলে আজ কোথাও না কোথাও ফলের শিল্প কারখানা থাকতো তবে তাদের দূর্ভোগে পড়তে হতোনা।শহরে গ্রামে সমাজ ব্যবস্থা অনেক উন্নতি হত।তবুও থেমে নেই জীবিকার সংগ্রাম।এই অল্প পুঁজিতে তারা আজ অনেক সচেতন। ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে এই অল্প পুঁজিতে যথেষ্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা হওয়া উচিত ছিল।কারণ এদিক দিয়ে অনেক মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা মুক্তি পেত।পর্যটন না হয়ে হতে পারতো একটা শিক্ষা ক্ষেত্রে উচ্চ বিদ্যালয়। তবে অনেক পাহাড়ি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতো।পর্যটন শিল্পে পাহাড়িদের জুম চাষে উৎপন্নজাত দ্রব্য খুবই কম ব্যবহৃত। ফলে অধিকাংশ উৎপন্ন দ্রব্য নষ্ট হয়ে যায়।আর বাজারজাতকরণ হলেও জুম্মরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। আর অন্যদিকে চেংগী, মাইনী, কর্ণফুলী, কাচালং, রাইংখিয়ং নদী মিলে ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়।এতে ২,২৭,৪০০ একর জমি পানিতে ঢুবে যায়।ফলে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৮ হাজার পাহাড়ি পরিবার।
পার্বত্য অঞ্চলগুলো এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে
৮০-র দশকের পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে যেভাবে পাহাড়ে আবাদ শুরু হয় তাতে পার্বত্যাঞ্চল অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে আম চাষের পাশাপাশি কাঁঠাল, লিচু, মালটা, কমলা, সফেদা কাজুবাদাম ড্রাগন ফলসহ আদা, হলুদের চাষ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য ফলনের মধ্যে অত্যন্ত সুস্বাদু ফল কাজুবাদাম চাষের জন্য আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলো সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।এতে অনেক কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদামের পাশাপাশি দামি মসলা গোলমরিচ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে জনপ্রিয় পানীয় কফি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।পাহাড়ি অঞ্চলে অনেকেই আবার গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি বাণিজ্যিকভাবে লালন-পালন করে অনেকেই লাভবান হচ্ছেন। মোট কথা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি বাংলাদেশের অন্য ৬১টি জেলার চেয়ে ভিন্ন
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি বাংলাদেশের অন্য ৬১টি জেলার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ‘শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা সদস্যবৃন্দ নিরীহ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষায় তৎপর রয়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনী পাহাড়ে বসবাসরত লোকজনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। নানাবিধ ভৌত ও কাঠামোগত উন্নয়ন, সচেতনতামূলক কার্যধারা ও কল্যাণময় কার্যক্রমের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের হৃদয় ও মন জয় করে নিয়েছে।
চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম মাত্রই এক একটা আধুনিক শিক্ষা বঞ্চিত জনপদ
পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার সূচনা মূলতঃ মোঘল আমল পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনামলে এবং তাও ছিল প্রধানত সমাজের উঁচু শ্রেণী বিত্তবান, সম্পদশালী রাজ পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।এসব শিক্ষা সাধারণ মানুষের জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং এ আধুনিক শিক্ষা সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের উত্তরণ ঘটিয়েছিল।সাধারণ মানুষের ছেলে মেয়েদের পক্ষে এসব শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ মোটেই ছিলনা বলা যায়।কিয়ং এর শিক্ষা পাঠ শেষে কিংবা একটু বয়স বাড়লে এদের দূরবর্তী বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের প্রাইমারী বা মিডল এন্ট্রান্স স্কুলে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ থাকে না।মূলতঃ ভাষাগত পার্থক্য, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার তারতম্য ও ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ এদের পক্ষে খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠে।এছাড়া পশ্চাৎপদ ও দুর্গম প্রত্যন্ত এই পার্বত্য জনপদে প্রতিষ্ঠিত স্কুল গুলোর লেখাপড়ার মান এতই অবনতিশীল যে, যা রয়েছে তা দিয়ে প্রাইমারী স্কুলের চৌকাঠ পার হবারও এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনা।তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম মাত্রই এক একটা আধুনিক শিক্ষা বঞ্চিত জনপদ।এ সমস্ত কারণে দেশে একান্ত অপরিহার্য বাংলা ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষা এদের জন্য সুদূর পরাহত।তবুও এই অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক বিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়ে ছিলো একমাত্র সমতলবাসী বাঙালীদের সাথে ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষি পণ্য দ্রব্য ও লৌহজাত শিল্প আদান প্রদানের জন্য।এভাবে ধীরে ধীরে কালক্রমে একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণের জন্য উৎসাহী হতে দেখা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষী
সমগ্র এলাকায় আদিবাসী সমূহ পরস্পর থেকে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস ও বিশেষ কোন প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর শাসন ব্যবস্থা ছিল না বলে তাদের বিশেষ কোন ভাষা Lingua Franca এর রূপ ধারণ করেনি।তবুও এই অঞ্চলে যখন ব্রিটিশ আমলে শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে উঠে অর্থাৎ ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম Regulation প্রণয়ন করে তখন থেকে এখানে কিছু সংখ্যক মধ্যবিত্ত আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদেরকে ইংরেজী ও বাংলার মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের উদ্যোগী হতে দেখা যায়।ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের কাছে আধুনিক শিক্ষা বিস্তৃতি না হবার অন্যতম ও মূল কারণ শিক্ষার সুযোগ সুবিধার অভাব।কিছু সংখ্যক সৌভাগ্যবান আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠির ছেলে মেয়ের আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েও অধিকাংশ ছেলে মেয়ের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে বাড়ি থেকে বহুদূরে ভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়াশুনা এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।জাতীয় উন্নয়নের ধারা সর্বস্তরে শ্লোগান একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ এরাও বেঁচে থাকার জন্যে ছটফট করছে।
আগামী প্রজন্মকে কিভাবে নতুন সুখের আলো দেখাবে আদিবাসী সমাজ
আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশল, সম্বলিত জীবন যাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আগামী প্রজন্মকে কিভাবে নতুন সুখের আলো দেখাবে, বর্তমান প্রজন্মকে কিভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনের পথ দেখাবে, তারই সমস্যাসংকুল চিন্তায় চিন্তিত পর্বতমূখী আদিবাসী সমাজ।পথের নিশানা সে সমাজের হাতের নাগালে নেই, তবুও পরস্পরের প্রতি সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও সৎবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর সভ্য মানব সমাজ যেন তাদের বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে আসে।সচরাচর একটা জনগোষ্ঠী যেভাবে যে পর্যায়ে জাতিগত সুযোগ সুবিধার উপাদান গুলো অর্জন করে থাকে আনায়াসে ঠিক সে পর্যায়ে যাতে এসব পিছিয়ে পড়া আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীভূক্ত মানুষের জীবন যাপনের মান উৎকর্ষ সাধন ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ সম্পদ
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ সম্পদ সম্ভাবনার এক অপরিমেয় এবং বিপুল ভান্ডার ও সম্বাবনার প্রতিশ্রুত প্রান্তর, এতদসত্ত্বেও বাঙালী পাহাড়ীদের মধ্যে সুন্দর/মধুর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় সকল সম্ভাবনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে এমতাবস্থায় সম্পদ সম্ভাবনা এই এলাকার ভূগর্ভস্থ ও উপরিস্থ সকল সম্পদের সুসম উন্নয়ন ও বন্টনের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে যা প্রকারান্তে সমগ্র দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছে সে ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা ও যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হবে। পার্বত্য সংঘাত নিরসনে সরকার যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় এবং তাতে কোনো প্রকার শিথিলতা প্রদর্শন না করে সেজন্য সরকারকে চাপে রাখতে হবে। সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে যেসব বাঙালি অধিবাসী আছে, তাদের উচিত উপজাতি জনগণের সাথে প্রতিবেশী ও স্বদেশবাসী হিসেবে সদাচরণ করা এবং তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করা। উপজাতিরাও যে একই মাত্রায় বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের ওপর তাদেরও যে সমান অধিকার রয়েছে সেই মনোভাব সামাজিক সদাচরণের মাধ্যমে উপজাতি জনগোষ্ঠীর অন্তরে জাগ্রত করা উচিত, যাতে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এদেশে একাঙ্গীভূত অনুভব করে।
তথ্যসুত্র
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি , Dailyjanakantha.
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের, Weeklysonarbangnla.
সমাকীর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম, Jamaat-e-islam.
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ অংশ, Jumjournal.
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে, Dainikbangla.
পাহাড়িদের জীবন যাপনের, Ekushhotok.
বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, Aznewsbd.
উপকূলের আদিবাসী জনগণ, Sangbad.