মহিয়সী বেগম রোকেয়া (Mahiyashi Begum Rokeya)


৯ ডিসেম্বর ‘বেগম রোকেয়া দিবস’। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রামের জহিরউদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের ও রাহাতুন্নেসা চৌধুরানীর ঘরে ১৮৮০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন

মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। রংপুরের পায়রাবন্দের জমিদার সাবের পরিবারে ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। তার পিতা জহির মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাহেব উর্দুভাষী ছিলেন। তার দু’সন্তান খলিলুর রহমান আবু জায়গাম সাবের ও আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সাবের ও কন্যা করিমুন্নেসা খাতুন ও হোময়রা খাতুন রোকেয়া। পিতা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দু’পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, কন্যাদের জন্য গৃহে আরবি, ফার্সি ও উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। বেগম রোকেয়া পিতার দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে বড় ভাই খলিল সাবেরের কাছে ইংরেজি এবং বড় বোন করিমুন্নেসার নিকট বাংলা শিক্ষা লাভ করেন।

বেগম রোকেয়া রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানাধীন পায়রাবন্দ গ্রামে এক রক্ষণশীল ও সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জহির উদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের ও মা রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরাণী তাঁর ছেলেদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করেন। তখনকার দিনে মুসলমান সমাজে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার সুযোগ ছিল না। তাই তাঁরাও সাহসী হয়ে মেয়েদের জন্য পারিবারিক শিক্ষার বাইরে অন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করেননি।

শিক্ষার সুযোগ বলতে ছিল শুধু কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা ও উর্দু শিক্ষা

জহিরউদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের একজন উচ্চ শিক্ষিত হয়েও মুসলিম সমাজের রীতি অনুযায়ী মেয়েদের শিক্ষার দ্বার রূদ্ধ করে রেখেছিলেন।বেগম রোকেয়ার দুই ভাই আবুল আসাদ ইবরাহীম সাবের এবং খলিলুর রহমান আবু জাইগাম সাবের ও দুই বোন করিমুন্নেসাএবং হুমায়রা।রোকেয়ার পরিবারে পর্দা প্রথার এতই কড়াকড়ি ছিল যে, আত্মীয় পুরুষ তো দূরের কথা বহিরাগত নারীদের সামনেও মেয়েদের পর্দা করতে হতো। নারী শিক্ষার সুযোগ বলতে ছিল শুধু কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা ও উর্দু শিক্ষা।   বাংলা বর্ণপরিচয় ছিল নিষিদ্ধ।বড় ভাই ইবরাহীম সাবের ১৮৮৫ সালে বি,এ পাশ করেন। তিনিই বোন রোকেয়া ও করিমুন্নেসাকে পরিবারের সবার অগোচরে মোমের আলোয় লেখাপড়া শেখান।

রোকেয়া ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ গল্প লিখে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন

সেই থেকে অযৌক্তিক ও নির্মম সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে রোকেয়ার মনে জন্ম নেয় প্রচণ্ড বিদ্রোহ।১৮৯৬ সালে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেট খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। তিনি রোকেয়ার বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন,লেখালেখিতে উৎসাহ, স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সঞ্চয় ও  নারীশিক্ষার প্রসারে সহযোগিতা প্রদান করেন।রোকেয়া ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ গল্প লিখে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। ১৯০৫ সালে তিনি ইংরেজিতে ‘সুলতানা’স ড্রিম’ (সুলতানার স্বপ্ন) লেখেন। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন। ১৯০৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে  বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়।

নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নাই

বিয়ের মাত্র ১৩ বছর পরে ১৯০৯ সালে তার স্বামী মারা যায়। এতে অবদমিত না হয়ে ‘নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নাই এবং সমাজের কোনো আশা নাই’ এ মূল মন্ত্রে বিশ্বাসী থেকে সমাজের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে নিগৃহীত নারীসমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান।সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটি ১৯১১ সালে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে স্কুলটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পরিচালিত।

বেগম রোকেয়া ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন

স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও নিগৃহীত নারীসমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য বেগম রোকেয়া ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।পাশাপাশি সমাজের অনাচারের বিরুদ্ধে তার লেখনী চালিয়ে যান। কেবলমাত্র নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের ‘অগ্রদূতই ছিলেন না, তার সামগ্রিক চিন্তা চেতনা ছিল আন্তর্জাতিক মানের।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল, সংগঠন এবং সাহিত্য সাধনা নিয়ে সময় অতিবাহিত করেন।১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া ইন্তেকাল করেন। রোকেয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন রেখে প্রতিবছর এই দিনটি রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

বেগম রোকেয়ার বিবাহিত জীবনমাত্র ১৩ বছরের

১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের এক উচ্চশিক্ষিত, উদারমনস্ক পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হলে রোকেয়া সেখানেই চলে যান। রোকেয়ার মতো সৈয়দ সাখাওয়াতও চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি, নারী সমাজে শিক্ষা বিস্তার তথা নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি। বেগম রোকেয়ার বিবাহিত জীবনমাত্র ১৩ বছরের। সাখাওয়াত হোসেনের অকাল মৃত্যু হয় ১৯০৯ সালে। অকালেই তাঁদের দুটো কন্যা সন্তানেরও মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর সঞ্চিত টাকা থেকে স্ত্রী রোকেয়ার জন্য দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখে যান। স^ামীর মৃত্যুর পর ভাগলপুরের বাড়িতেই রোকেয়া মাত্র ৫/৬ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তী পর্যায়ে হাইস্কুলে পরিণত হয়। স^ামীর স্মৃতি ও উদ্দেশ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এ নামকরণ করা হয়। কিন্তু নানা কারণে একাকী তাঁর পক্ষে ভাগলপুরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে রোকেয়া কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন

ইতিহাসবিচ্ছিন্নতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও অনেকটা আড়ষ্ট করেছে

স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকা-ে ব্যস্ত রাখেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উনিশ শতকের শুরুতে শুধু নারীকে সমাজের অচলায়তনের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নামেননি, বরং তার কর্মতৎপরতায় ছিল এমন এক জ্যোতি যার চর্চা বর্তমান সময়েও যে কোনো সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়।কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের সংস্কৃতিচর্চা, নারীবাদচর্চা ও রাজনীতিচর্চা এমন গণ্ডিবদ্ধতায় পড়ে আছে যে, তা আমাদের চিন্তার জগতে একটি বন্ধ্যত্ব তৈরি করে ফেলেছে। ইতিহাসবিচ্ছিন্নতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও অনেকটা আড়ষ্ট করেছে।

এ যন্ত্রযুগে আমরা ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চাকে উপেক্ষা করছি বেশি

আমরা বস্তুগত লাভালাভের হিসাবে এতটাই আটকে পড়েছি যে বুঝতে চাই না ফল্গুধারার গোপন ও নীরব জলসিঞ্চন উর্বর আর সজীব রাখতে পারে ভূমি। এ যন্ত্রযুগে আমরা ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চাকে উপেক্ষা করছি বেশি।নীতিশিক্ষা বিষয়ক সাহিত্য, মহান মানুষদের জীবনধারা-জাতীয় লেখাগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই থেকে প্রায় উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ছেলেবেলায় রোকেয়াকে জানার সুযোগ যতটা ছিল, এখন তেমনটা দেখি না ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতির যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল তেমনি সমৃদ্ধ ছিল এর ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। আজ ঐতিহ্যের সত্য ও সৌন্দর্যকে ধারণ না করে যদি ভুঁইফোড় ধনীর আচরণ করি, তবে তা আমাদের শুধু বিষণ্ণই করবে না এক ধরনের মূর্খতারও প্রকাশ ঘটাবে

জাতীয় হালকা বিবেচনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম জুড়ে দেয়া সত্য এবং ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর

আমাদের এগিয়ে চলার পথে রোকেয়াচর্চা এ সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সঠিক রোকেয়া সাখাওয়াতই উপস্থাপিত হওয়া উচিত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে। ‘প্রচলিত হয়ে গেছে’ জাতীয় হালকা বিবেচনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম জুড়ে দেয়া সত্য এবং ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর। রোকেয়া তো আমাদের মতো সামান্য কেউ নন। তাই এই অসামান্য মহীয়সীর নামের সামনে থেকে ‘বেগম’ মুক্ত করা এখন ইতিহাসেরই দাবি।

বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন আজও নারী জীবনে এক অবিসংবাদী, প্রেরণাদায়ী সত্তা

১৯১৬ সালে তিনি নারীদের সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম নামে নারী সমিতি গঠন করেন। তাঁর সমিতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। সমাজের উঁচু তলার, লেডি ফারুকি, লেডি অবলা বসু যেমন এ সংগঠনের সদস্য ছিলেন তেমনি সমাজের অবহেলিত অশিক্ষিত নারীরাও ছিলেন। তাই শতাব্দী পার হয়েও বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন আজও নারী জীবনে এক অবিসংবাদী, প্রেরণাদায়ী সত্তা। তাঁর জীবনদর্শনে কোনও মোড়ক ছিল না, ছিল না কোনও লোক প্রদর্শনকারী উপাধি। তাঁর জীবনাদর্শ ছিল একান্ত সহজাত, আন্তরিক। কথায় ও কাজে তাঁর কোন ফারাক ছিল না। তাঁর চিন্তা, মন ও জীবনযাপন ছিল এক সূত্রে গ্রন্থিবদ্ধ। সেজন্যই বেগম রোকেয়ার জীবনাদর্শন সর্বকালে বরেণ্য- কালোত্তীর্ণ তিনি।

মৃত্যুতেও আপন সৃষ্টির মাঝেই বেগম রোকেয়া অমলিন

বাংলার নারীজাগরণের প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা বেগম রোকেয়ার জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ঊষালগ্নে। ৮ ডিসেম্বর রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি নিমগ্ন ছিলেন লেখাপড়ায়। সেzলাকে হেলায় জয় করেছিলেন রোকেয়া। মৃত্যুতেও আপন সৃষ্টির মাঝেই তিনি অমলিন। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ১১ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন এক শোকবার্তায় তাঁকে pioneer of higher education among Muslim girls in this province বলে আখ্যায়িত করেন।

বেগম রোকেয়া ছিলেন নিজের চেষ্টায় গড়ে ওঠা একজন উচ্চশিক্ষিত আদর্শবাদী মানুষ

ফলে বেগম রোকেয়ার জীবনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। তাঁর দুই ভাই কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তেন এবং বোন করিমুন্নেছা পিতৃহীন সন্তানদের শিক্ষার জন্য কলকাতায় অবস্থান করতেন। রোকেয়া তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছে ইংরেজি শেখেন। রোকেয়াকে অনুপ্রেরণা জোগাতেন তাঁর বড় বোন করিমুন্নেছা। এভাবেই বাংলার অসংখ্য মুসলিম নারী যখন সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারকে মেনে নিয়ে কঠোর পর্দার আড়ালে ঘরের চার দেয়ালকেই আপন ভুবন মনে করেছে, তখন সংগোপনে জ্ঞান সাধনায় মগ্ন ছিলেন বেগম রোকেয়া। ভাইবোনের অনুপ্রেরণা ও নিজের চেষ্টায় রোকেয়া ক্রমে উর্দু, ফারসি, বাংলা ও ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ষোলো বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন নিজের চেষ্টায় গড়ে ওঠা একজন উচ্চশিক্ষিত আদর্শবাদী মানুষ।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-  "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন বেগম রোকেয়া

নারী-পুরুষ সমান অংশগ্রহণ এবং অধিকার সমান ভাগাভাগি করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। "ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ করে শিক্ষায় সমাজকে সচেতন করতে অসামান্য অবদান রেখেছেন বেগম রোকেয়া। তিনি মনে করতেন নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজন নয় বরং সহযোগিতা প্রয়োজন। তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন জমিদার। তার মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়।

রোকেয়ার প্রকৃত নাম ছিল রোকেয়া খাতুন

রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম নেয়া রোকেয়ার প্রকৃত নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। বৈবাহিকসূত্রে নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু তাকে বেগম রোকেয়া নামেই ডাকা হয়। তার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। রোকেয়ার বড় দু’ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করেন তারা আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। তারাই রোকেয়াকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।

সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায় বেগম রোকেয়া

১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। ইতোপূর্বে তাদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়।

একমাত্র ধর্মই আমাদিগকে বরাবর রক্ষা করিয়া আসিতেছে

বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ বেগম রোকেয়ার অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার ‘রোকেয়া জীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তৎকালীন সমাজে স্কুলের কাজ করতে গিয়ে বেগম রোকেয়াকে নানা প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘স্কুলের বিরুদ্ধে কত দিকে কত প্রকার ষড়যন্ত্র চলিতেছে তাহা একমাত্র আল্লাহ জানেন। একমাত্র ধর্মই আমাদিগকে বরাবর রক্ষা করিয়া আসিতেছে।’ অন্যত্র স্কুলের ১৮ বছর পূর্তিতে তিনি বলেন, “.... আমরা তোমারই উপাসনা করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি- কুরআন শরিফের এই বচনটিই আমি জীবনের পরতে পরতে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিলাম।’

গভীর আন্তরিকতাভরা আবেদন, তাহা বুকের মধ্যে অনুভব করা যায়- মুখে বলা যায় না!

এই পুণ্যশীলা মহীয়সী মহিলার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের অন্য এক পুরাতন ছাত্রী তার বহু যত্ন ও সাধনায় গঠিত এক আদর্শ বালিকা রওশন আরা বলেন, ‘মনে পড়ে, তার আদেশ মতো দৈনিক ক্লাস আরম্ভের আগে বিস্তীর্ণ হলে আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইতাম। তিনি একটি দোয়া পড়িতেন, আমরা সকলে তার সঙ্গে যোগ দিতাম। ওই দোয়াটি তিনি যখন পড়িতেন, তখন মনে হইত যেন তিনি হৃদয় দিয়া আমাদের সেদিনের সাফল্যের জন্য খোদাকে ডাকিতেন। সে যে কি গভীর আন্তরিকতাভরা আবেদন, তাহা বুকের মধ্যে অনুভব করা যায়- মুখে বলা যায় না!

প্রগতিশীল রোকেয়া নারী স্বাধিকার ও সম অধিকারের  প্রবক্তা ছিলেন

১৯০৯ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করলে  বেগম রোকেয়া বৈধব্য জীবন বেছে নেন এবং ভাগলপুরের ভিটামাটি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। সমাজসেবামূলক কাজে ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রগতিশীল রোকেয়া নারী স্বাধিকার ও সম অধিকারের  প্রবক্তা ছিলেন। বাংলার মুসলিম নারী সমাজের অগ্রগতি সাধনের জন্য ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে  একটি মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির কার্যক্রম সম্পর্কে সূফি মোতাহার হোসেন তার ‘বেগম রোকেয়া’ গ্রন্থে  বলেছেন, ‘জাতিগঠনমূলক কাজের জন্য আঞ্জুমান নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। আঞ্জুমান অজস্র বিধবা নারীকে অর্থ-সহায়তা করেছে।চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার থেকে বহু অসহায় বধূকে রক্ষা করেছে। বয়ঃপ্রাপ্ত দরিদ্র কুমারীকে সৎপাত্রস্থ করেছে। অভাবগ্রস্থ মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণে নানাভাবে সাহায্য করেছে।’

২৩ বছরের বৈধব্য জীবনে তার এই সব প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তার শিক্ষা বিস্তার প্রচেষ্টা, নিরলস সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে পুরুষশাসিত কুপমণ্ডূক সমাজের গণ্ডি থেকে অবগুণ্ঠনবতি ও অবরুদ্ধ মুসলিম নারীকে মুক্ত করতে যে মহতি প্রয়াস তিনি করেন, যা তার অসাধারণ প্রতিভা ও সমাজ সচেতনতারই পরিচায়ক।


তথ্যসুত্র

কুসংস্কার আর গোঁড়ামি, Ittefaq.

চিন্তাবিদ ও ধার্মিক , Daily Naya Diganta.

নারীর অধিকার আদায় , Kurigrambarta.

বেগম রোকেয়ার লক্ষ্য, Prothomalo.

নির্মম সামাজিক প্রথার , Bangla News24.

 সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি , Daily Inqilab.

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন,, Jugantor.