শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস (Martyred Intellectuals Day)

বুদ্ধিজীবীদের বলা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারাই একটি জাতি, দেশ বা সমাজের পথ প্রদর্শক। কিন্তু কারা এই বুদ্ধিজীবী? সহজ কথায় বললে, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত তারাই বুদ্ধিজীবী।বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার মানুষ বলতে বোঝায়- লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, নাটক-চলচ্চিত্রকর্মী প্রভৃতি পেশার মানুষকে। তবে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই হতে হয় জ্ঞানী-গুণী, বিচক্ষণ, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন।
বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষ’’ গ্রন্থ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীর অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাধিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারী বেসরকারী কর্মচারী, চলচ্ছিত্র ও নাটক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবি ও সংস্কৃতি সেবী’’।
তবে সাধারণ ভাবে বুদ্ধিজীবী বলতে ব্যক্তির পেশা, শিক্ষা, এবং জীবনাদর্শর মাধ্যমে যারা সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। এদের মধ্যে লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, দার্শনিক, সাংস্কৃতিককর্মী, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বুদ্ধিজীবীর আওতাভুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল বদর বাহিনীর হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে এটি নির্মিত হয়। ১৯৭২ সালের ২২শে ডিসেম্বর এই সৌধের ফলক উন্মোচন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এটির স্থপতি ছিলেন মোস্তফা হারুন কুদ্দুস হিলি।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। কেবল এই তারিখে নয়, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর আগে মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা মুহূর্তেও ঘাতক বাহিনী অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা তালিকা করে জাতির বরেণ্য সন্তানদের হত্যার জন্য ঘাতক বাহিনী আলবদর-আলশামসকে লেলিয়ে দেয়। পরাজয়ের আগমুহূর্তে তারা চূড়ান্ত আঘাত হানে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ।
১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ঘটে এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। তারা বেছে বেছে অসংখ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের হত্যা করে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে এক শ্রেণির দালাল এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার এই নীলনকশা প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। পাকবাহিনীর অস্ত্র সহায়তা নিয়ে তাদেরই ছত্রচ্ছায়ায় আধাসামরিক বাহিনী আলবদরের ক্যাডাররা এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী।
সাংবাদিকদের সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), সৈয়দ নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীনসহ শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মেহেরুন্নেসা, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহাসহ আরও অনেককে হত্যা করে পাক বাহিনী।
একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তারা শহীদ হন এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে।
একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দুটি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।
পাকিস্তানি দুঃশাসনের দিনগুলোয় আমাদের লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন। এসব কারণেই তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের জিঘাংসার শিকার হয়েছেন। এত কম সময়ে এত বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিধনের উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া আর কখনো ঘটেনি।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এটি জাতির জন্য স্বস্তিকর। কিন্তু দুটি কারণে এই বিচার অসমাপ্ত রয়ে গেছে। প্রথমত, সব বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়নি। আবার যেসব হত্যার বিচার হয়েছে, দণ্ডিত সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষ করে আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তিপ্রাপ্ত আলবদর কমান্ডার চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুঝে গিয়েছিল এ যুদ্ধে তারা কখনোই সফল হতে পারবে না। আর যুদ্ধ শেষে দেশের বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে স্বাধীনতাবিরোধী বিশ্বাসঘাতকরা কখনোই এ দেশের মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করে ফেলতে পাক-হানাদার ও তাদের এ দেশীয় অনুচর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে দেশের শত শত শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কবি-সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ ফেলে রাখা হয়।শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ড. ফজলে রাব্বী, নাজিমুদ্দিন আহমেদ, শহীদ সাবের, সেলিনা পারভিন, আনোয়ার পাশা, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, ড. আবুল কালাম আজাদসহ অনেকে। অনেকের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং অনেকের লাশ পাওয়াও যায়নি।
প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে পালন করা হয় ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার রায়ের বাজারে নির্মাণ করা হয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাত। ‘পূর্ব বাংলা' নামে পাকিস্তানের প্রদেশটি মাত্র স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। ঠিক সে সময় ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরের চিহ্নিত জ্ঞানী ও গুনী মানুষদের বাড়ির দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করে জানতে চাওয়া হয় "ভেতরে কেউ আছেন?" ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসেন নাম জানা-অজানা অনেকেই। সশস্ত্র পাকিস্তানি হায়েনারা একে একে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায় ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
সেদিন হায়েনাদের সাথে বেরিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তারা আর ঘরে ফেরেনি। সবকটি জানালা খুলে রেখেও হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য স্বজনদের ফেরার অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। তবে তারা আসবেন কিভাবে? তারা যে এ মাটির চির মমতা অঙ্গে মেখে অনিচ্ছাকৃত চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর বধ্যভূমির মতো চিহ্নিত কসাইখানায়।
স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছর দেশ ও জাতি ১৪ ডিসেম্বর হারিয়ে যাওয়া বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন রায়েরবাজার বধ্যভূমি তথা শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এদিন সকাল থেকে নিহতের স্বজনসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অঙ্গ সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের মানুষ শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে দেশের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দিবস থাকলেও বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোন তালিকা নেই।
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ প্রথমে ১৯৭২ সালে শুরু হলেও, সে তালিকা কখনো সরকারি নথি বা গেজেটভুক্ত হয়নি। এখন যে ১২২২ জনের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটি গেজেটভুক্ত করা হবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য চলতি বছরের ১৯শে নভেম্বর একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির একজন সদস্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেছেন, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল।
এরপর ডাক মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ডাকটিকেট বের করা হয়েছে। এরপর আরো নতুন নাম যুক্ত করে বাংলা একাডেমীর একটা গবেষণা আছে। এই সব মিলিয়ে সরকারিভাবে যাদের সম্মাননা বা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।""এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। আমরা ঠিক করেছি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাতে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা যায়। এক বছরের মধ্যে সেটা শেষ করবো বলে আমরা আশা করছি," বলছেন শাহরিয়ার কবির।
শাহরিয়ার কবির বলেছেন, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে প্রথমবারের মত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের মধ্যে কতজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। যাদের নাম জানা যায়, তাদের মধ্যেও শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাই বেশি।
১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা করেছিল তৎকালীন সরকার। পরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর ডাকটিকেট প্রকাশ করে।সরকারের তৈরি করা শহীদ বুদ্ধিজীবীর নতুন তালিকা এই দুইটি হিসাবের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে বাংলা একাডেমী প্রণীত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গবেষণা গ্রন্থেও আরো বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় তাদের বিচার এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি ।চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছে। তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আল-বদর বাহিনী আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল-বদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে।
হত্যাকারীরা বুদ্ধিজীবীদের গেস্টাপো কায়দায় ধরে নিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে কোন বিশেষ ক্যাম্পে বা বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শহরে জারিকৃত কারফিউয়ের সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ওপর চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন যে নির্যাতনকে হার মানায় মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হয়েছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
জানা যায় , ঢাকা শহরের দু’টি বধ্যভূমির মধ্যে একটি ছিল মোহাম্মদপুরের কাছে রায়ের বাজারের জলাভূমি, অপরটি ছিল মিরপুরে। যুদ্বের পরে এ দুটি বধ্যভূমির ডোবা, নালা, ইটের পাঁজার মধ্যে অসংখ্য মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব মৃতদেহের অধিকাংশের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল , হাত পেছন দিক থেকে বাঁধা। এসব মৃতদেহের মাথায় ও পিঠে বুলেটের চিহ্ন ছিল। আর সারা দেহে ছিল বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন।
২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পনের পূর্বে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে পুণঃমুদ্রিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত “শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত তথ্যকোষে” শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিঁখোজ।
লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ”বাংলাদেশ” নামক প্রামান্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ই ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নীচে চাপা পড়ে ছিল। লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিষ্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক সনাক্ত করা হয় সেদিনই। সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ সনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরো বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেঁজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিলনা। এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গ্রেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
উনসত্তরের গণঅভ্যুথানের সময়ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলের বড় অংশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বুদ্ধিজীবীদের উপর আক্রোশের প্রধান কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবিরোধী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পনা করেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কারণ বুদ্ধিজীবীরা এদেশের প্রায় সকল পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানিদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা। ২৫ মার্চ থেকে ডিসেম্বরে আত্ম সমর্পনের আগ পর্যন্ত বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার,শিক্ষক, গবেষক ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তারা মনে করেছিল যুদ্ধে জেতার পরও এই জাতি যেন আর মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘‘রেইপ অব বাংলাদেশ’’ গ্রন্থে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রতি বছরের বুদ্ধিজীবী দিবস বাঙালির মনে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে যায়। বুদ্ধিজীবীরা যেমন তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য, কল্যাণের জন্য সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, দেখো তোমাদের জন্য, দেশের জন্য আমরা আমাদের সবটুকু উৎসর্গ করে গেলাম। আগামী দিনে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তুমিও আমাদের মত কর তৈরি হও। বুদ্ধিজীবী দিবসের বড় শিক্ষা এটাই
তথ্যসুত্র:
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, Prothom Alo.
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা, BBC.
মোহাম্মদপুরে রায়েরবাজার বদ্ধভূমি, Life TV 24.
বুদ্ধিজীবী-শহীদ বুদ্ধিজীবী, Bangla News 24.
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পটভূমি, Azhar BD Academy.
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঠাঁই হৃদয়ে, Barta 24.
মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনকশা, BSS News.
বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য, Channelionline.
বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচি, Dhaka Post.