আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day)

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day)


ব্যবহারিক অর্থে মায়ের মুখের ভাষাকেই মাতৃভাষা বলা হয়। সন্তান জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা শুনে শুনে রপ্ত করে তাই-ই তখন তার মাতৃভাষা হয়ে যায়। একটি দেশ বা বৃহৎ এলাকায় অনেকগুলো ভাষা প্রচলিত থাকে। এর মধ্যে থেকে অধিকাংশ লোক যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাই ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাতৃভাষা। বাংলা ভাষা হলো বাঙালির ভাষা। এই ভাষায় প্রতিটি বাঙালি একে অপরের সাথে সাচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। তাই বাংলা আমাদের মুখের বুলি, বাংলা আমাদের অহংকার। কবি অতুলপ্রসাদ সেন তার কবিতায় বলেন,

"মোদের গরব, মোদের আশা

আ মরি বাংলা ভাষা।"

মাতৃভাষার গুরুত্ব

মাতৃভাষা হলো মানুষের মনের ভাব আকাঙ্খা প্রকাশের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ কথা ও মনের ভাব প্রকাশ করতে সবচেয়ে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে উন্নতি সাধনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু মাতৃভাষার চেয়ে মধুর কোনো ভাষা হতে পারে না। কবির ভাষায়,


"নানান দেশের নানান ভাষা,

বিনা স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা।"

মাতৃভাষার মর্যাদার লড়াই

বাঙালি জাতি বীরের জাতি। বাঙালিরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য অনেকবার অনেক কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে। তেমনি বাঙালিরা নিজের দেশের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে রাজপথে ঢেলে দিয়েছিল তাদের বুকের তাজা রক্ত। অনেক মায়ের বুক হয়েছিল খালি, বাংলার দামাল ছেলের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। তবু তারা থেমে থাকেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেই তবে দম নিয়েছে। বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা মাতৃভাষার জন্য নিজেদের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর দিতীয়টি নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি ভাঙালি জাতিসত্তার শেকড়ের অনুপ্রেরণর দিন। এই দিনটি ঐতিহ্যের পরিচয়কে দৃঢ় করেছে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করেছে। এ ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর কাব্যগন্থ্য ‘গীতাঞ্জলী’ রচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ১৯১৩ সালে। এ ভাষার অসাধারণ প্রজ্ঞাবান মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঙ্গের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব পরিমণ্ডলে।

মাতৃভাষা অর্থ মায়ের ভাষামানুষ জন্মসূত্রে ভাষা লাভ করে না। মানুষকে তা আয়ত্ত করতে হয়। শিশু মায়ের কাছ থেকে প্রথম যে ভাষা শেখে, তাই তার মাতৃভাষা। আরও সহজভাবে বলা যায়, জন্মের পর একটি শিশু তার মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা আয়ত্ত করে তাকে মাতৃভাষা বলে। আর এটি হলাে একটি জাতির স্বদেশি ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রতিটি জাতি, গােষ্ঠী তার স্বীয় ভাব আদান-প্রদান করে থাকে।

বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃত এবং ২০১০ সালে জাতিসঙ্গের সাধারণ পরিষদ ‘এখন’ থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে’ প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আর এভাবেই বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলমান।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক  সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের হাত ধরে। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা-না উর্দু ?’ এই  পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে ভাববিনিময়, অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা  করার পক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাব আগ্রাহ্য হলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।

এর পরম্পরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।  সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত  নেয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত  ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালিত হয়।

২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতারা ও জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে।

২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘Students Role in nation building’ শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদানকালে ক্যাটাগেরিক্যালি বাংলা  ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং  সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই  পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে।’

জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তনস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাড়িয়ে ‘‘নো নো’’ বলে প্রতিবাদ করে। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্বে পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের ভাষণের মাধ্যমে। এদিন পল্টন ময়দানের এক জনসভায় জিন্নাহর কথাই পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’।

নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতার প্রতিবাদে সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্র-নেত্রীরা আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্দান্ত নেয়। পরে তারা মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের দিকে অগ্রসর হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের

পরদিন ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়’। এই পরিষদ তার সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি  হরতালের, সমাবেশ ও মিছিলের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।

২০ ফেরুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়।

২১ ফেব্রুয়ারি  পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী  সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। বেলা ২টার দিকে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হকসহ অন্যান্য নেতারা দাবি আদায়ে অনড়  থাকে।

ছাত্ররা ছোট ছোট দলে মিছিল নিয়ে ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্য করে। এমনকি ছাত্রীরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। পুলিশ বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসরমাণ মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়।

গুলিতে আব্দুল জব্বার  রফিক উদ্দিন আহমেদ ও আবুল বরকত নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে।  উপায়ন্তর না দেখে ২২ ফেব্রুয়ারি  নুরুল আমিন সরকার  তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং  প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

১৯৫৪ সালের ৭ মে  যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি  ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে  রাষ্ট্রভাষা  হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।

১৯৫৬ সালের স্বীকৃতি

১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয়  সংসদ বাংলা এবং  উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাস করে। ওই বছরের ৩ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর হয় এবং  ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার সাফল্য অর্জিত হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি উদযাপন করা শুরু হয় ১৯৫৩ সাল থেকে। এদিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করে এবং  শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য  অর্পণ করে। সারা দিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।

বাংলা আজ শুধু বাংলাদেশের ভাষা নয়, এটি বিশ্বের কাছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিকারী পরিচিত ভাষা। আর এই পরিচয় দেয়ার প্রথম অবদানটুকু হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ১৯১৩ সালে তার অমর কাব্য গীতাঞ্জলি তাকে এনে দেয় ‘নোবেল পুরস্কার’ আর এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, শুরু হয় বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ  দেয়ার জন্য জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার এই  উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘে কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচটি ভাষায়। সব দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তথা জাতিসংঙ্গের নিযুক্ত  প্রতিনিধিরা উক্ত পাঁচটি ভাষার যেকোনো একটি ভাষায় ভাষণ দেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ  জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার মহত্ব।

স্বীকৃতির উদ্যোক্তা

কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিকদের সংগঠন "Mother language of the world" ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাতিসংঘের পরামর্শ মতে তারা এ ধরণের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব UNESCO এর সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর UNESCO এর সাধারণ পরিষদে শিক্ষামন্ত্রী এই প্রস্তাবটি তুলে ধরেন। এর পক্ষে বিশ্বের ২৭টি দেশ সমর্থন দেয়। অতঃপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষনা দেয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে টঘঊঝঈঙ কর্তৃক বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি বিশ্বদরবারে এনে দিয়েছে এক বিশাল খ্যাতি। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বজুড়ে অমর একুশের উদযাপন নিঃসন্দেহে এক বিশাল জাতীয় গৌরব ও সম্মানের। ২০০০ সাল থেকে UNESCO এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে।

সিয়েরালিয়ন বিশ্বের বুকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশ। গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত ঐ দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল জাতিসংঘ। সেজন্য সিয়েরালিয়নে পাঠানো হয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীরা সেখানে গিয়ে বিনা রক্তপাতে সেই গৃহযুদ্ধ থামাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশী সেনাবাহিনীদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ও তাদের মুখে বাংলা ভাষা শুনে সেই দেশের মানুষেরা মুগ্ধ হয়। তারা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাকে তাদের দেশের অন্যতম মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা তথা বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

ভাষা আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির নিকট একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ও বাংলা ভাষার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে বাঙালিরা নিয়েছে নানান পদক্ষেপ। ভাষা আন্দোলনের সেই গুলি লেগে থাকা আমগাছের অবশিষ্ট অংশ আজও সংরক্ষিত আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায়। তাছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে অতি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের অনেক তথ্য ও স্থিরচিত্র।

২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার  উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষাসংক্রান্ত  গবেষণা,ভাষা সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এটি ভাষার ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে যা বাংলা ভাষাকে বিশ্বমর্যাদায় আসীন করতে ভূমিকা রাখছে।

২০১০ সালের ৩ নভেম্বর জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে ৪র্থ কমিটিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে এটি বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত  সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিক চর্চা  বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে। মাতৃভাষার সংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষা পৃথিবীর একটি শক্তিশালী ভাষা।

রাষ্ট্রীয় পর্যায় বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা মূলত একটি-বাংলাদেশ। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রদেশ, আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা, ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রদেশিক ভাষা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে

এই মুহূর্তে বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। এছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্র  রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন

১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করে। এরপর থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় ১৮৮টি দেশ মাতৃভাষাকে সম্মান জানিয়ে এই দিনটিকে পালন করে থাকে। অনেক বিদেশী জনগণেরাও এসময় আমাদের দেশে আসে আমাদের ভাষা দিবস উদযাপন সচক্ষে পরিদর্শন করার জন্য।  এই দিনে সাধারণ জনগণ শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করে। তাদের পা থাকে নগ্ন এবং মুখে থাকে গাফফার চৌধুরীর সেই গান,

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।"

স্মরণে ও বরণে একুশ

২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহ্যবাহী দিন। এই দিনে আপামর বাঙালি জাতি শহীদ মিনারে আসে পুস্পস্তবক অর্পন করার জন্য। উক্ত দিনে প্রথম প্রহরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পন করেন। তারপর একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানান ব্যক্তিবর্গ শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। অতঃপর আপামর সাধারণ জনগণ শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহিদের আত্মার প্রতি। এই দিনে মসজিদে মসজিদে ভাষা শহিদদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা হয়। তাছাড়া এই সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় এই দিনে।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইর্য়ক,শিকাগো,ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বের ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্রিটেনে ছয়টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বিট্রেনে ১২টি  বাংলা সাপ্তাহিক প্রত্রিকা বের হয়। ‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি—এই তিনটি শব্দের অর্থ এক নয়। এর প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা আলাদা অর্থ ও বৈশিষ্ট্য। আভিধানিকভাবে অর্থ ও বৈশিষ্টে্যর ভিন্নতা থাকলেও এর তাৎপর্য এক ও অভিন্ন। তিনটি শব্দের সঙ্গেই ‘মা, যুক্ত। মা যেমন তার সন্তানের কাছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার পাত্র, তেমনি একটি জাতির কাছে তার ভাষা, দেশও শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার বস্ত্ত। নিজের ভাষা ও দেশকে নিজের মায়ের মতোই দেখা উচিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি শব্দ একই তাৎপর্যে অন্বিত। যার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করি, যার দুগ্ধপান করে বেড়ে উঠি, তিনি মা। মায়ের মুখ থেকে যে ভাষার ব্যঞ্জনায় মঞ্জুরিত হয়ে উঠি, সেটি মাতৃভাষা, আর যে ভূখণ্ডে আমার জন্ম, সেই ভূখণ্ড একটি দেশ। সেই দেশের প্রকৃতি, সৌন্দর্যে জীবন অতিবাহিত করি, সেটি আমার মাতৃভূমি প্রিয় স্বদেশ।

স্বদেশের ভাষা ও স্বদেশের মর্যাদা রক্ষা মানেই মায়ের মর্যাদা রক্ষা। মাতৃভাষার সম্মান এবং মাতৃভূমির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রতিটি জাতিকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া মাতৃভূমি সমৃদ্ধ হয় না। মানুষ সাধারণত মাতৃভাষার মাধ্যমেই স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জনগণের কথায়

‘ভাষা হচ্ছে চিন্তার পোশাক।’

জার্মান দার্শনিক ফিক্ট জাতি গঠনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মা, মাতৃভাষা নাড়ির টান ও সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা বাঙালি জাতি, বাঙালা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের অনেক সংগ্রাম ও রক্ত দিতে হয়েছে। তারই ফলে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ লাভ করেছি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস দেশপ্রেমের এক অক্ষয় দৃষ্টান্ত

ভাষার চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, যারা বাংলা ভাষাকে বিশ্বে স্বীকৃতি দিতে তৎপর ছিলেন, তাদের দেশপ্রেমের মহৎ দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে পড়েছে আজ জাতিতে জাতিতে। এভাবেই বিভিন্ন জাতি তার ভাষাকে, তার দেশকে, তার ইতিহাসকে কাছ থেকে জানার চেষ্টায় আরও নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। স্বদেশ চেতনা, স্বদেশপ্রেমের জাগরণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কাজ করবে এক মাইল ফলক হিসেবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,

” আগে চাই বাংলার গাঁথুনি , তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন”

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ আরো সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হব। বাংলাদেশের জনগণকে জ্ঞানের সব স্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একুশের চেতনাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি বাঙালিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা ভাষার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিশ্বপরিচয়ে বাঙালি হয়ে উঠবে অনন্য এক শক্তিশালী জাতি।

বাঙালির বাংলা এখন কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ফান তার রং ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের সর্বত্র। নিজ নিজ ভাষাকে সম্মান জানাতে বিশ্ববাসী এখন একযােগে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিবসটি উদযাপন করে। ভাষার প্রতিবন্ধন আর মর্ম উপলব্ধিতে একুশ যেন এক শানিত চেতনা হয়ে সমস্ত বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অন্তরকে নাড়া দিয়েছে।

” ছেলে হারা মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের অহংকার আমাদের গর্ব।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এ শ্রদ্ধা জানাই  সেই শহীদের যারা আমার চেতনাকে রক্তে রাঙিয়ে দিয়েছে।


তথ্যসুত্র:


সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, Jugantor.

মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম, Ittefaq.

দিবস পালনের উদ্যোক্তা, Bangla Notebook.

মাতৃভাষার ভূমিকা অসীম, Scholarsme.

বাঙালির নিকট একটি স্মরণীয় ঘটনা, Blog.

Subscribe for Daily Newsletter