মুক্তিযুদ্ধ (Liberation War)

মুক্তিযুদ্ধ (Liberation War)

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এ স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া একমুঠো মুক্তো বা বদান্যতার উপহার নয়, এর রয়েছে সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাস। এক সাগর রক্তও ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।

মোরা একটি ফুলকে বাচাঁবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্যে অস্ত্র ধরি

আমরা বাঙ্গালী বাংলাদেশের অধিবাসী। কিন্তু এ দেশ এক সময় পরাধীন ছিল। আমরা ছিলাম পরাধীন দেশের নাগরিক। সুদীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক।  বিশ্ব দরবারে আমরা বীর বাঙ্গালী হিসেবে পরিচিত।

তাই দেশ প্রেমের কবি সুকান্ত ভট্রাচার্য এর কন্ঠে উচ্চারিত হয়..
সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ১২ আগস্ট প্রকাশিত র্যাডক্লিপ রোয়েদাদে পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গেঁর মধ্যে সীমানা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়।

পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ১২ আগস্ট প্রকাশিত র্যাডক্লিপ রোয়েদাদে পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গেঁর মধ্যে সীমানা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়। Taken from BBC

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামেও পরিচিত, একটি বিপ্লব এবং সশস্ত্র সংঘাত ছিল যা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের উত্থানের ফলে স্বাধীনতা লাভ করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ছিল একটি বিপ্লব এবং সশস্ত্র সংঘাত যা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উত্থানের ফলে উদ্ভূত হয়েছিল।পূর্ব পাকিস্তানে আত্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন যার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়। যুদ্ধ শুরু হয় যখন ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে, বাংলাদেশ গণহত্যার সূচনা করে। এটি জাতীয়তাবাদী বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সশস্ত্র কর্মীদের সুপরিকল্পিত ধ্বংসের অনুসরণ করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে এবং প্রধানমন্ত্রী মনোনীত শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭১ সালের১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যারা বাংলাদেশে ছিল তারা আত্মসমর্পণ করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৈন্যদের সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ ছিল।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধারা। Taken from Daily Asian Age

১৯৭০ সালের নির্বাচনের অচলাবস্থার পরে গঠিত আইন অমান্যের জোয়ারকে দমন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে ব্যাপক সামরিক অভিযান এবং বিমান হামলা দেখা যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যাদের ইসলামপন্থীদের সমর্থন ছিল, স্থানীয় জনগণের উপর অভিযান চালানোর সময় এটিকে সহায়তা করার জন্য উগ্র ধর্মীয় মিলিশিয়া- রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস- তৈরি করেছিল।  বাংলাদেশে উর্দুভাষী বিহারীরাও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ছিল। রাজধানী ঢাকা ছিল অপারেশন সার্চলাইট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাকান্ড সহ অসংখ্য গণহত্যার দৃশ্য। আনুমানিক১০ মিলিয়ন বাঙালি উদ্বাস্তু প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যায়, যখন ৩০ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। বাঙালি এবং উর্দুভাষী অভিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। একটি একাডেমিক ঐকমত্য বিরাজ করে যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা একটি গণহত্যা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন রকম পরিসংখ্যান প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিশ্বকোষ ও বইতে এই সংখ্যাটিকে ২,০০,০০০ থেকে শুরু করে ৩০,০০,০০০ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাটিকে ৩০,০০,০০০ হিসেবে অনুমান করা হয়। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, যারা সে সময় দেশত্যাগ না করলে হয়তো গণহত্যার শিকার হত।

স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে - যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী - ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের দল ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়, যার মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি অন্যতম ,বর্তমানে এ বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি। Taken from Wikipedia

বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং মাঝে মাঝেই এমন নতুন বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হচ্ছে উদাহরণস্বরূপ ঢাকায় অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে একটি কূপের ভেতর গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান কনসুলেট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেটস ডিপার্টমেন্টে পাঠানো টেলিগ্রামেও যুদ্ধ শুরুর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনতার ওপর চালানো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ রয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বহুসংখ্যক বাঙালি নারী সম্ভ্রম হারায়; যার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ধারণা করা হয় প্রায় ২,০০,০০০ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম নেয়। ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে পাকিস্তানি সৈন্যরা বহুসংখ্যক মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রচার করা হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা- বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত জাতীয় মুক্তিবাহিনী। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী এবং এগারোটি সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণ গেরিলা যুদ্ধ চালায়। তারা সংঘাতের প্রথম মাসগুলিতে অসংখ্য শহর ও শহর মুক্ত করে। বাঙালি গেরিলারা পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট সহ ব্যাপক নাশকতা চালায়। নবজাতক বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে ফ্লাইট চালায়। নভেম্বরের মধ্যে, বাংলাদেশ বাহিনী রাতের বেলা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে তার ব্যারাকে সীমাবদ্ধ করে। তারা গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করেছিল।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত সংগ্রামে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের পক্ষে লেপটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত সিং আরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লেপটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করেন। ফলে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের অবসান ঘটে এবং বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় লাল সবুজ পতাকার স্বাধীন সার্বভেীম বাংলাদেশের।

পাকিস্তানি কমান্ডার আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। Taken from Dhaka Tribune

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিশে আছে্ এদেশের ছাত্র -শিক্ষক , কৃষক-শ্রমিক ,সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী তথা আপামরজনতার রক্তিম স্মৃতি। লাখো শহীদের রক্তের উপরে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। তাই মুক্তিযুদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে আমাদের দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাদের স্মৃতিচারণ না করে তাদের মতো দেশাত্ববোধে জেগে উঠতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের সার্থকতা প্রতিফলিত হবে।


তথ্যসুত্র:

প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

Subscribe for Daily Newsletter