বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম (National Stadium)
স্টেডিয়াম চতুর্দিক গ্যালারি বেষ্টিত পরিকল্পিত ক্রীড়াঙ্গণ। স্টেডিয়ামের সাথে যুক্ত থাকে একটি মাঠ অথবা আংশিক মঞ্চ যেখানে দর্শকগণ দাঁড়িয়ে অথবা বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে। ‘স্টেডিয়াম’ শব্দটি গ্রিক শব্দ stadion শব্দ থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হলো ২০০ মিটার দূরত্ব। প্রাচীন গ্রিসে শব্দটি প্রথম প্রচলন হয়। প্রাচীন গ্রিক অলিম্পিক উৎসব একটি দৌড় প্রতিযোগিতার বিষয় দিয়ে শুরু হয়। যার দৈর্ঘ্য ছিল অলিম্পিয়াড স্টেডিয়ামের দৈর্ঘ্যের সমান। তখন থেকেই স্টেডিয়াম কথাটি প্রচলিত হয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ১৯৫৪ সালের নির্মিত ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রধান স্টেডিয়াম। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল এলাকায় এটির অবস্থান। স্টেডিয়ামটি আগে এবং এখনও ১ নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত । নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এটির নামে বঙ্গবন্ধু যোগ করা হয়। স্টেডিয়ামটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থান।আগে স্টেডিয়ামে সব ধরনের খেলাই অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু বর্তমানে স্টেডিয়ামটিকে কেবল ফুটবল মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ধারনক্ষমতা প্রায় ৩৬,০০০। ২০০৫ সালের ১লা মার্চ পর্যন্ত স্টেডিয়ামটি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিজস্ব মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হত।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম বিশ্বের একমাত্র স্টেডিয়াম যেটিতে দুটি ভিন্ন দেশের উদ্বোধনী টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি খেলাতেই প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। প্রথম খেলায় ১৯৫৪-৫৫ সালে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তান দল ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলার মাধ্যমে টেস্ট অঙ্গনে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে এ মাঠেই ‘ইন্টারন্যাশনাল ইলেভেন’-এর বিপক্ষে ‘পাকিস্তান বোর্ড একাদশ’-এর হয়ে খেলতে নেমেছিলেন রকিবুল হাসান, ‘জয় বাংলা’ স্টিকারযুক্ত ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে। স্বাধীনতার আগে সে ম্যাচই হয়ে ছিল তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামে শেষ স্বীকৃত ম্যাচ। এর ৪৬ বছর পর ২৬ জুন, ২০০০ তারিখে, বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর প্রথম টেস্ট খেলায় ভারতের মোকাবিলা করে।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম ও সংলগ্ন জাতীয় হকি স্টেডিয়ামের আশেপাশের এলাকায় এত বেশি লোকসমাগম হয় যে একে স্টেডিয়াম হিসেবে চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে। এর একটি মূল কারণ স্টেডিয়ামের নিচ তলাকে ইলেকট্রনিক পণ্যের মার্কেট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকার অদূরে একটি নতুন ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের কারণে ২০০৪-০৫ মৌসুমে মাঠটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে বরাদ্দ দেয়া হয়।বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ১৯৫৪ সালের নির্মিত ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রধান স্টেডিয়াম। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল এলাকায় এটির অবস্থান। স্টেডিয়ামটি আগে এবং এখনও ১ নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত । নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এটির নামে বঙ্গবন্ধু যোগ করা হয়।
প্রথম ইতিহাস
ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামই বিশ্বের একমাত্র ভেন্যু যেখানে দুটি টেস্ট দেশের জন্য উদ্বোধনী হোম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে: পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। উভয় অনুষ্ঠানেই ভারত দর্শক ছিল: ১৯৫৪-৫৫ সালে, যখন ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল এবং ১৯৭৬-৭৭ সালে, যখন ইংল্যান্ড থেকে সফরকারী এমসিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবং পরের বছর শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দল বিসিসিবি একাদশ এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের বিপক্ষে কয়েকটি একদিনের, দুইদিনের এবং তিন দিনের অনানুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলার জন্য বাংলাদেশ সফর করে। এরপর ভারত থেকে ডেকান ব্লুজ এবং এমসিসির মতো দলগুলো যথাক্রমে বিসিসিবি একাদশ এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলার জন্য বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করে। ক্রিকেটের পাশাপাশি, স্টেডিয়ামটি ঐতিহাসিক ঢাকা লিগের আয়োজন করার জন্যও পরিচিত ছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেও দেশের প্রধান ফুটবল লীগ ছিল।
৮০ এর দশকে যখন ফুটবলের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী ছিল, ঢাকা ডার্বি সারা দেশ থেকে হাজার হাজার ভক্তকে স্টেডিয়ামে আকৃষ্ট করেছিল। স্টেডিয়ামটি নিয়মিতভাবে অধুনালুপ্ত আগা খান গোল্ড কাপের আয়োজন করত, যেটিকে অনেকের কাছে প্রথম সংগঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বলে মনে করা হয় যা এশিয়ার আশেপাশের ক্লাব দলগুলিকে জড়িত করে। ১৯৭৮ এএফসি যুব চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল স্টেডিয়ামে আয়োজিত প্রথম বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। এই অনুষ্ঠানের জন্য স্টেডিয়ামটিও সংস্কার করা হয়েছিল, পূর্ব গ্যালারি তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রথমবারের মতো একটি মহিলা গ্যালারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভিআইপি গ্যালারিটিও নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল, কারণ এটিই ছিল বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল সম্পর্কিত টুর্নামেন্ট। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্ট চলাকালীন নতুন সংস্কার করা স্টেডিয়ামে মোট চল্লিশটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি থেকে শুরু করে বক্সিং পর্যন্ত ঐতিহাসিক ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজনের ইতিহাস রয়েছে এই স্টেডিয়ামের। ফেব্রুয়ারী ১৯৭৮ সালে, বক্সার মুহাম্মদ আলী স্টেডিয়ামে একটি প্রদর্শনী বক্সিং ম্যাচে লড়াই করেছিলেন, তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম, একটি ১২ বছর বয়সী বাঙালি ছেলের সাথে।
নতুনরূপে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, থাকবে ২৫ হাজার আসন
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবলসহ অন্যান্য ইভেন্ট খেলার আয়োজনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সব কিছুই আধুনিকায়ন করা হবে। পুরাতন আসনগুলো ভেঙে নতুন করে আসন বিন্যাস করা হবে। এতে ২৫ হাজার দর্শক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবেন। মাঠের প্রয়োজনে বিদেশ থেকে মাটিও আনা হবে বলে জানিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গ্যালারির শেড নির্মাণ, গ্যালারির শেড নির্মাণের জন্য আরসিসি ভাঙা এবং ময়লা অপসারণ কাজ, গ্যালারির চেয়ার স্থাপন, রাস্তার কার্পেটিং ও আন্তর্জাতিক মানের দু’টি ড্রেসিং রুম নির্মাণ করা হবে। ফ্লাডলাইট, সিসিটিভি ক্যামেরা, সিসিটিভি এইচডি ক্যামেরা, এলইডি জায়ান্ট স্ক্রিন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বোর্ড, বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র, নিরাপত্তা বাতি, স্থানীয় খেলোয়াড়দের জন্য দু’টি ড্রেসিং রুম, টিকিট কাউন্টার, চিকিৎসার জন্য কক্ষ এবং ডোপ টেস্টের জন্যও কক্ষ তৈরি করা হবে।বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আসন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই জরাজীর্ণ। অনেক আসন ভেঙে গেছে। ২৫ হাজার জন যাতে বসে খেলা দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা করবো। মাঠের কাজও করতে হবে। এক কথায় প্রকল্পের আওতায় নতুনরূপে সাজবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। মাঠের প্রয়োজনীয় সাইটগুলোও পুনর্বাসন করা হবে।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া স্থাপনা। ১৯৫৪ সালে স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করা হয়। বিশ্বনন্দিত ফুটবলার লিওনেল মেসি স্টেডিয়ামটিতে খেলে গিয়েছেন। ২০০৬ সালে এই স্টেডিয়ামটি বুয়েটের প্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মোতবেক ২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন করা হয়। বর্তমানে স্টেডিয়ামের অনেক কিছুই জরাজীর্ণ। তাই ‘ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। চলতি সময় থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে ঢেলে সাজানো হবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।
প্রকল্পের আওতায় মাঠে স্থাপন করা হবে ভোকাল মাইক্রোফোন, ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন, শব্দ মিক্সিং যন্ত্র, এম্লিফায়ার ৭৫০ ওয়াট, সিলিং স্পিকার ১২ ওয়াট, কলাম স্পিকার ২০ ওয়াট, ৩০টি ডেলিগেট ইউনিট, জাংশন বক্স ও মাইক্রোফোন স্ট্যান্ড।
ফুটবল, অ্যাথলেটিক ও আর্চারিসহ অন্য খেলার উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে সব ধরনের আধুনিক সুবিধা দিতেই প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় করবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
সিসিটিভি, এইচডি আইপি বেজড ক্যামেরা, ১৬ চ্যানেলবিশিষ্ট ডিভিআর, চার টেরাবাইট বিশিষ্ট হার্ডডিক্স ড্রাইভ, ১৬ চ্যানেল বিশিষ্ট ক্যামেরা, শক্তিশালী ওয়াইফাই জোন ও এলইডি জায়ান্ট স্ক্রিনের উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ২৫ হাজার দর্শক খেলা ও ইভেন্ট উপভোগ করতে পারবে বলে জানিয়েছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের জন্ম–ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যে মাঠ
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল এলাকায় এটির অবস্থান। স্টেডিয়ামটি আগে এবং এখনও ১ নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত । নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এটির নামে বঙ্গবন্ধু যোগ করা হয়। স্টেডিয়ামটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থান।বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকায় পা দিলেই যে কেউই ধন্দে পড়ে যেতে পারেন। এটি দেশের খেলাধুলায় পীঠস্থান, নাকি বিরাট বড় এক বাণিজ্যকেন্দ্র। চারদিক বেচাবিক্রির হাঁকডাক। পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। স্টেডিয়ামে বারান্দাজুড়ে ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান। বারান্দার মেঝেও খালি নেই, পণ্য নিয়ে হাঁক দিচ্ছে ভাসমান হকার। পান-সিগারেটের দোকান তো আছেই। অথচ এই স্টেডিয়ামই দেশের খেলাধুলার সবচেয়ে বড় জায়গা। স্টেডিয়ামটির বড় জায়গা আছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসেও।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেই ইতিহাসের কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজে পাওয়ার উপায়ও নেই। কারণ, ইতিহাসের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরি করে ইতিহাসের এই মঞ্চকে বানানো হয়েছে বাণিজ্যকেন্দ্র। ইতিহাসের এই পীঠস্থানেই রাতে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ—এ লজ্জা আমাদের সবার।১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলেন। ঠিক সে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামেই চলছিল পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের ম্যাচ। সেখানেই ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল সাধারণ দর্শকেরা। দলে দলে তারা মাঠে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল অন্যায় সিদ্ধান্তের। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সেই ম্যাচ তাই ঠাঁই নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।
রকিবুল হাসান নামের ১৮ বছর বয়সী এক বাঙালি ক্রিকেটার সে ম্যাচে নিজের ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার লাগিয়ে পাকিস্তানিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকুতি। পাকিস্তানিদের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কাগজে-কলমে এক দেশ হলেও পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক দূরত্বটা। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ক্ষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কোনো নিদর্শন কি যত্ন করে রাখা হয়েছে?
এই অনন্য স্মৃতিগুলো ধূসর হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এখনকার পরিবেশে।
এই প্রজন্ম কি জানে, স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয় অর্জন করে ১৬ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই ক্যাম্প স্থাপন করেছিল ঢাকায় প্রবেশ করা মুক্তি বাহিনীর প্রথম দলটি। মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) মঈনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি সেনাদল স্টেডিয়ামের পশ্চিম গ্যালারিতে তাঁবু খাটিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ফিরে গিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। এ মাঠের প্যাভিলিয়ন প্রান্তের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যুদ্ধফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন স্বাধীনতার এই স্থপতি। এই অনন্য স্মৃতিগুলো ধূসর হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এখনকার পরিবেশে।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বাধীনতাসংগ্রামের স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনতে কিছুই কি করার নেই? ক্রিকেটের পীঠস্থান লর্ডসে রয়েছে আটটি গ্যালারি—দ্য প্যাভিলিয়ন, ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড কম্পটন স্ট্যান্ড—এমন কত নামেই না সেখানে গ্যালারির নামকরণ হয়েছে। আমাদের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কোনো এক কালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও ক্রিকেট সংগঠন মুশতাক হোসেনের নামে দুটি গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এ মাঠ থেকে ক্রিকেট সরে যাওয়ার পর ওই নামকরণও বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠে একবার হেঁটে দেখুন। সেখানকার মাটির ইতিহাস জানলে শিহরিত হতে হয়। পল্টন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কল্পনার মানসপটে হয়তো অনেক কিছুই ভেসে উঠবে। ওই যে পশ্চিম গ্যালারি বরাবর যুদ্ধফেরত সেনাদলের তাঁবু! রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা চেহারায় সেনারা বিশ্রাম নিচ্ছেন অনাগত এক ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। প্যাভিলিয়ন প্রান্তে বানানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বজ্রকণ্ঠে শোনাচ্ছেন একটি জাতির আনন্দ-বেদনার কাব্য। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরই এক সহযোগী মুষ্টিবদ্ধ স্লোগান দিচ্ছেন—জয় বাংলা!
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের সেই দৃশ্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ঢুকলে যেকোনো ইতিহাসপ্রেমীর মানসপটে ভেসে উঠবেই। কিন্তু এসব ইতিহাস কি বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়েছে? নানা উদ্যোগ, নানা স্মারকে ইতিহাসের এই আবেগ ছড়িয়ে দিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে—কিন্তু তেমনটি তো কখনোই দেখা গেল না এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সবজির ক্ষেত
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক নামে প্রসিদ্ধ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। প্রথমে নাম ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। ১৯৫৪-৫৫ সালে ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় স্টেডিয়ামটি নির্মিত হবার পর এখানে নৌকা বাইচ ও সাঁতার ছাড়া এমন কোন খেলা নেই যা অনুষ্ঠিত হয়নি। মেসি-জিদান-মোহাম্মদ আলী-কিম বো বে’র মতো রথী-মহারথীদের পদধূলি পড়েছে এই স্টেডিয়ামের ঘাসে। এখানে হয়েছে ২০১১ আইসিসি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও। হয়েছে বিভিন্ন সময় কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ। তবে ফুটবল খেলাটাই বেশি হয়েছে এখানে। স্কুল ফুটবল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ফুটবল... সবধরনের ফুটবলই। তবে স্টেডিয়ামের মাঠের ওপর অতিমাত্রায় অত্যাচার হয়েছে। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের বিরতি না দিয়েই ঘন ঘন খেলার প্রভাবে মাঠের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘোর বর্ষাকালেও এখানে প্রিমিয়ার লীগের খেলা হয়েছে। স্টেডিয়ামের পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় মাঠ যেন তখন হয়ে যায় ‘ধানক্ষেত।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঠে আক্ষরিক অর্থেই ছোটখাট একটি ‘ক্ষেতে’র সন্ধান পাওয়া গেছে। সবজির ক্ষেত। লাউ, কুমড়া, বেগুন, মুলা, পুঁই শাক, পালং শাক, লাল শাক, সবুজ শাক... কি নেই এই ক্ষেতে। গত ২০ বছর ধরে এই সবজির বাগানটি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। পল্টন প্রান্তের গ্যালারিতে যে জায়ান্ট স্ক্রিন আছে সেই গ্যালারির নিচে এ্যাথলেটিক ট্র্যাকের পাশে যে সবুজ ফাঁকা জায়গা আছে সেখানেই গড়া হয়েছে চাঞ্চল্যকর এই ক্ষেত। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে গড়া হলো এই ক্ষেত? এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বর্তমান প্রশাসক মোবারক করিম লিটন জনকণ্ঠকে জানান, ‘এই স্টেডিয়ামেরই এক মাঠকর্মী এটা করেছে। সে নাকি বহুবছর ধরেই এখানে লাউ-সবজি চাষ করে আসছে। বিষয়টি সম্প্রতিই জেনেছি। তারপরই আমি গত পরশু ওই কর্মীকে ডেকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি এগুলো যেন কেটে ফেলে। সে জানিয়েছে শীঘ্রই এগুলো কেটে ফেলবে।’ কোন স্টেডিয়ামেই এভাবে সবজি চাষ করার কোন নিয়ম নেই। তাহলে কিভাবে এটা এই ক্ষেতের জন্ম হলো? লিটন জানান, ‘আমি তো গত বছর তো প্রশাসক হিসেবে এসেছি। এই বছরই আমার চোখে পড়েছে এটা। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি পদক্ষেপ নিয়েছি। এটা করা মোটেও ঠিক না। আর স্টেডিয়ামে চাষাবাদ করার নিয়ম নাই। আমিও চাই মাঠটা পরিষ্কার থাকুক।’ এই সবজি চাষের মাধ্যমে কি ব্যবসা করা হয়? ‘না, আমি যতদূর জানি, ব্যবসা করে না। এগুলো করে সে নিজে খায়, মাঠকর্মীদের দেয়। আবার অনেককেই দেয়। তার কোন ব্যবসার উদ্দেশ্য নেই।’ এই সবজি ক্ষেতের স্রষ্টা কালাম ফকির। তার কাজ মাঠের ঘাস কাটা, পানি দেয়া। মাঠে চুন দেয়া। বরিশালে গ্রামের বাড়ি। ত্রিশোর্ধ এই মাঠকর্মীর সঙ্গেও কথা হয় জনকণ্ঠের।
পুরো বিষয়টি তার কাছে উত্থাপন করা হলে অকপটেই স্বীকার করেন সব, ‘স্যার, আমি ১৯৯৭ সাল থেকেই এই স্টেডিয়ামের এক কোণায় সবজি চাষ করে আসছি। তখন স্টেডিয়ামের সবাই বলছে এটা ভাল একটা দিক। অনেক সুন্দর। কিছু ক্রীড়া সাংবাদিকও উৎসাহ দিতেন আমাকে। কেউ আমাকে মানা করেননি। বরং তারাও মাঝে মাঝে এই ক্ষেতের সবজি নিয়ে খেতেন। তবে আমি কখনই এগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করিনি। বরং সবাইকেই এগুলো বিলিয়েছি। এগুলো আর অল্প কিছুদিন থাকবে। তারপরই শেষ। আর কখনই সবজি চাষ করব না।’ কেন করেছেন? এর জবাবে কালাম আরও জানান, ‘১৯৯৭ সাল থেকে চাকরি করে আসছি এখানে। আমি বুঝতে পেরেছি, এখানে ক্ষেত করা ঠিক হয়নি। তবে স্টেডিয়ামে যে ক্ষেত করার নিয়ম নেই সেটাই জানতাম না। স্যার (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বর্তমান প্রশাসক) আমাকে বলেছেন যে এগুলো কইরো না। এগুলো সব ওঠাই ফেল। সেটাই করব আমি। কিন্তু আগের স্যার (সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া) আমাকে খুব সমর্থন দিতেন। বলতেন এগুলো তো ভাল উদ্যোগ। ইয়াহিয়া স্যার আমার কাছ থেকে সবজি নিতেনও। আমি নিজের খরচেই সব চাষ করতাম। চাকরি করার পর থেকেই এখানে সবজি চাষ করে আসছি।’
ইতিহাস কথা বলে যে স্টেডিয়ামে
প্রস্তাবটা প্রথম আসে সৌরভ গাঙ্গুলীর কাছ থেকেই। করোনা-আক্রমণে সারা দুনিয়াতেই বন্ধ হয়ে গেছে খেলাধুলা। অলস পড়ে রয়েছে বিভিন্ন স্টেডিয়ামসহ, নানা ক্রীড়া স্থাপনা। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি, ভারতের সাবেক অধিনায়ক তাই কলকাতার ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখনো পর্যন্ত সে ধরনের জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলেও করোনার এই মহামারির সময় স্টেডিয়ামকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করার ধারণাটা সমাদৃত হয়েছে দারুণভাবেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে করোনা-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামসহ দেশের যেকোনো ক্রিকেট স্থাপনা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই তুলে দিতে চান তাঁরা। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানও বলেছেন প্রয়োজনে দেশের সব স্টেডিয়ামকে করোনা-আক্রান্তদের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
এ মুহূর্তে গোটা দুনিয়াই করোনা-মহামারির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া এ মহামারি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই। উহানে আগেই করোনা-আক্রান্তদের জন্য বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া স্থাপনায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থান করা হয়েছিল। এ মুহূর্তে ব্রাজিলের সাওপাওলোর পাকেয়াম্বু স্টেডিয়ামকে করোনা-আইসোলেশন সেন্টারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভারতের আসামের গুয়াহাটির ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়াম, তেলেঙ্গানার একটি স্টেডিয়ামও করোনা-আইসোলেশন সেন্টারে রূপ নিয়েছে। ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মাঠ লর্ডসকেও করোনার এই সময়ে হাসপাতালে রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)।
ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে খেলার স্থাপনাকে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের নজির সারা দুনিয়াতেই আছে। বাংলাদেশেও এটি নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ( সে সময়ের ঢাকা স্টেডিয়াম) ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নভাবে। ১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা স্টেডিয়াম পরিণত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাউনিতে। বিজয়ের দিনে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল হিসেবে ঢাকায় প্রবেশ করা দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে ও গ্যালারিতে সেনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে। স্বাধীনতার পরপর অগোছালো দেশে ঢাকা স্টেডিয়াম থেকেই আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও অফিসাররা।
জেনারেল মঈন ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বইয়ে সেনা ক্যাম্প হিসেবে কেন ঢাকা স্টেডিয়ামকে বেছে নিয়েছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমি ঠিক করলাম আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামেই অবস্থান নেব। কারণ ঢাকা স্টেডিয়ামে সুরক্ষিত, আচ্ছাদিত এবং ৮০০ লোকের থাকাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি এখানে বিদ্যমান।’বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কেবল সেনা ক্যাম্পই স্থাপিত হয়নি, স্বাধীনতার প্রত্যুষে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও এখানে ঘটেছিল। এই স্টেডিয়ামের মাঠেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের পর মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদায়ী প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামের মাঠেই।
অনেক কিছুরই সাক্ষী এই মাঠ। ১৯৫৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামেই ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ‘হোম’ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছিল পাকিস্তান। তার ৪৫ বছর পর এ মাঠেই বাংলাদেশ খেলে অভিষেক টেস্ট, প্রতিপক্ষ ছিল সেই ভারতই। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বক্সিং—কী হয়নি এ মাঠে! দেশের ফুটবল ইতিহাসের বেশির ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচের সাক্ষী এ মাঠ। ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার কালটা কেটেছে এ মাঠেই। ১৯৭৮ সালে এ মাঠেই ২৪ দেশকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯তম এশীয় যুব ফুটবলের জমজমাট আসর। ১৯৮৫, ১৯৯৩ আর ২০১০ সালের সাফ গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের পর ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর্দা উঠেছিল এ মাঠেই। সে বছরই লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সার্জিও আগুয়েরো, হাভিয়ের মাচেরানো, ওবি ডি মিকেল, ভিনসেন্ট এনিমিয়ারা আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মাতিয়েছিলেন এ স্টেডিয়ামের মাঠ। ২০০৬ সালে জিনেদিন জিদান হেঁটেছিলেন ঢাকা স্টেডিয়ামের ঘাসে। বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীরও স্পর্শ ধন্য এ দেশের খেলাধুলার আঁতুড় ঘর।
সুসময়-দুঃসময়, যা-ই বলি না কেন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছাড়া বাংলাদেশের চলে নাকি!
এমন একটা মাঠ পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে দেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস আর খেলাধুলার ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়েছে। করোনাভাইরাসের এ দুঃসময়ে এই মাঠ যদি আর্তের সাহায্যে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর ইতিহাসই হবে সমৃদ্ধ। সুসময়-দুঃসময়, যা-ই বলি না কেন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছাড়া বাংলাদেশের চলে নাকি!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম যদি কথা বলতে পারত...
একই শহরের দুটি স্টেডিয়াম—বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও মিরপুর শেরেবাংলা। কিন্তু দুটি স্টেডিয়ামের কতই না পার্থক্য! মিরপুর জমজমাট। দর্শকের পদচারণে মুখর। সব সময় সাজ সাজ রব। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম? দর্শকহীনতায় নীরব-নিথর। ম্রিয়মাণ ফুটবলে ম্লান এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। যে মাঠে বিশ্বের সেরা সব ক্রীড়াবিদ খেলে গেছেন সে স্টেডিয়ামটিই এখন অযত্ন আর অবহেলার শিকার। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নীরব কান্না কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছেন রাশেদুল ইসলাম
মিরপুর স্টেডিয়ামকে অনেকেই আমার ‘খুব কাছের বন্ধু’ বলেন। হতে পারে! সে আমার বন্ধু। বয়সের পার্থক্যেও তো বন্ধু পাতানো যায়। ধরে নিন মিরপুর স্টেডিয়াম আমার বন্ধুই। কিন্তু বয়সে তো সে আমার অনেক ছোট। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে তিলে তিলে বেড়ে উঠেছি আমি। একসময় টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে আমার সীমানা। কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আমার শরীর। সময়ের স্রোতে আমি পেয়েছি কংক্রিটের ছোঁয়া। আমি বেড়েছি ওপরের দিকে। একসময় আলোর বন্যা বইয়ে আমার বুকে আয়োজিত হয়েছে কত শত খেলা। দর্শকদের উন্মত্ত, উল্লাস আর আনন্দ আমাকে পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। সে তুলনায় মিরপুরের জন্ম তো সোনার চামচ মুখে নিয়েই। আশির দশকে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেই সে সময়ের সরকার মিরপুরকে প্রথম ধাক্কাতেই এক আধুনিক স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করেছিল। আলোর বন্যা মিরপুরের বুকে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথম থেকেই। ফ্লাডলাইটের চারটি টাওয়ার যেখানে আমাকে আলোকিত করছে, সেখানে মিরপুর স্টেডিয়ামের জন্মের সময়ই স্থাপন করা হয়েছিল ছয়টি টাওয়ার। টাওয়ারের সেই পার্থক্যে সে সময় মনে কিছু করিনি। আলো তো প্রায় পুরোটাই ছিল সে সময় আমার ওপর। মনে হয়েছিল মিরপুর না হয়ে দুটি টাওয়ার বেশি নিয়ে নিজেকে আলোয় রাঙাক! কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের মধ্যে যে এত পার্থক্য তৈরি হবে, সেটা কি আমি ভেবেছিলাম!
আমাকে হিংসুটে ভাবছেন? দয়া করে এমনটি ভাববেন না। আমি বন্ধু মিরপুর স্টেডিয়ামকে অনেক ভালোবাসি। এই যে দুদিন আগেই তার বুকে ১০০টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হলো, আমি যে কী খুশি হয়েছি, সেটি বলে বোঝাতে পারব না। আমার বুকেও ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫৮টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে। আমি নিজের ইনিংসটাকে বড় করতে পারলাম না। ৫৮-তেই আটকে গেলাম। দোয়া করি মিরপুর যেন নিজের সেঞ্চুরিটাকে আরও বড় করতে পারে। ওর ডাবল সেঞ্চুরির উদ্যাপনটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
এই দেখুন, আমার মন খারাপ হবে না কেন! আন্তর্জাতিক ম্যাচ প্রসঙ্গে মনে পড়ল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি মিলিয়ে আমার বুকে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা কি ১০০ পেরোয়নি! ক্রিকেট আমার অবদান মনে রেখেছে। রেকর্ড বইয়ে জ্বলজ্বল করছে ৫৮টি ওডিআই আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ১৭টি টেস্ট ম্যাচের কথা। কিন্তু এই মাঠে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচগুলোর হিসাব কি আমার অভিভাবক বাফুফে বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ রাখে বা রেখেছে?
১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দল ও মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আমার বুকে খেলেছে এ হিসাবটা জানতে বড় ইচ্ছা করছে। যোগ-বিয়োগ করে সে হিসাবটা ১০০ ছাড়িয়েও যেতে পারে। ভুলে গেছেন, লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, সার্জিও আগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েইন কিংবা হাভিয়ের মাচেরানোরা আমার বুকেই খেলে গিয়েছিলেন। নাইজেরিয়ার ওবি মিকেল, ভিনসেন্ট এনিমিয়াদের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন। ২০০৬ সালে জিনেদিন জিদান হেঁটেছিলেন আমার বুকে। আমার অবস্থা আজ যতটা ফেলনা দেখছেন, আমি এতটা ফেলনা কিন্তু নই। আমার কষ্টটা একটা জায়গাতেই। আমি নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু কখনোই পেলাম না।
পুরোনো দিনগুলোর কথা আজ খুব করেই মনে পড়ছে। আমাকে নিয়ে দেশের শীর্ষ দুই খেলার কর্তাদের একসময় কী দড়ি টানাটানিইটা না হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট মৌসুম শেষ হতে না হতেই ফুটবলের লোকজন আমার বুকে শাবল চালিয়ে বসত। নাহ, উদ্দেশ্য আমাকে হত্যা করা ছিল না। সেটা ছিল নিজেদের দখলদারিত্ব জানান দেওয়াই। ক্রিকেট পিচ খুঁড়ে ফেলে ফুটবল ফেডারেশন জানিয়ে দিত আগামী ছয় মাসের জন্য এই মাঠ আমার। মিরপুর স্টেডিয়াম সেই দিনগুলোর কথা মনে করে নিশ্চয়ই অলক্ষ্যে হেসে ওঠে। আজ আমার যে দশা, ২০ বছর আগে মিরপুরের দশা ছিল ঠিক তেমনই। গ্যালারির গায়ে শেওলা। মাঠ এবড়োখেবড়ো। আমিই যেন সে সময় ছিলাম ক্রীড়াঙ্গনের রঙ্গমঞ্চ। আমাকে না পেলে কিছুই হবে না—এমনই একটা ভাবনা ছিল সবার মধ্যে। আমাকে নিয়ে কেন এত দড়ি টানাটানি ছিল জানেন? সে সময় আমি ছিলাম ফুটবলের নিশ্চিত গেটমানির উৎস। লাখ, লাখ, কোটি, কোটি টাকা। একেবারে কাঁচা পয়সা। ক্রিকেটের গেটমানিটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ওদের তো তখন মাঠই ছিল না। মনে আছে, একবার আমাকে না পেয়ে আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলামের মতো তারকারা প্রেসক্লাবের সামনে ক্রিকেট খেলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখন আমার ওপর আকরাম, আমিনুল, মিনহাজুলদের যেমন অধিকার ছিল, অধিকার ছিল রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, রিজভি করিম রুমি কিংবা মোনেম মুন্নাদের। সে সময়টা খুব যে খুশি লাগত, সেটা বলব না। বিরক্তই লাগত। স্বাধীন-সার্বভৌম একটা দেশের খেলাধুলা একটা স্টেডিয়ামে আবদ্ধ থাকবে, ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না।
এ শতকের শুরুর দিকে সমস্যাটার একটা স্থায়ী সমাধান হলো। সমাধানটা করে দিল ক্রিকেটই। ক্রিকেটের তখন রমরমা অবস্থার শুরু। বোর্ডের তহবিলে টাকার অভাব নেই। তারাই সরকারকে প্রস্তাব দিল মিরপুর স্টেডিয়ামটা ওদের দিয়ে দিতে। বাফুফে কর্তারা সে সময় হাঁপ ছেড়েই বেঁচে ছিলেন। তাঁরা স্বর্গসুখ অনুভব করেছিলেন, ‘যাক আপদ বিদেয় হলো। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামটা এখন পুরোপুরিই আমাদের।’ ক্রিকেটের জন্য কিছুটা মন খারাপ হলেও ব্যাপারটা একটা সমাধান হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে ক্রিকেটকে বিদায় জানালাম। দারুণ সেই বিদায়। আমার বুকে শেষ ম্যাচটায় বাংলাদেশ জিতেছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। মনে আছে? তখন তো জিম্বাবুয়েকে হারিয়েই আমরা বিশ্বজয়ের আনন্দ পেতাম। শেষ ম্যাচটার দিন হরতাল ছিল। কিন্তু আমার গ্যালারিতে দর্শকের কমতি ছিল না। কানায় কানায় ভরা দর্শক। তাদের সামনেই আফতাব আহমেদের সে কী মার! জিম্বাবুয়েকে উড়িয়েই দিয়েছিল সেদিন বাংলাদেশ।
ক্রিকেট মিরপুরে চলে যেতেই আমার বুকে কবরের নিস্তব্ধতা। ফুটবলে দর্শক কমতে লাগল। লিগের একেকটা ম্যাচ হয় আর সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকের নস্টালজিয়া আরম্ভ হয়। সব দর্শকই চলে গেলেন ক্রিকেটে। আমার বুকে তখন থেকেই কেবল হাহাকার। মাঝেমধ্যে অবশ্য আমাকে খুব তোয়াজ করা হয়। ঝেড়ে-মুছে, রংটং মাখিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। আমি বুঝে যাই।
নিশ্চয়ই বড় কোনো টুর্নামেন্ট বা ক্রীড়া উপলক্ষ আসন্ন। এককভাবে ফুটবলের হয়ে যাওয়ার পর রং মেখে রঙিন হয়েছি ২০০৬ সালের এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে। এরপর ২০১০-এর এসএ গেমসে। ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা আমার বুকে খুব বড় আয়োজন। কিন্তু খারাপ লাগে ক্রিকেটের জন্য। ফুটবলের জন্যও খারাপ লাগে। ফুটবল নিয়ে আমার গ্যালারি মেতে ওঠা তো বিরল বিষয়েই পরিণত। এখন কালেভদ্রে একটু দর্শক হয়। লিগে গ্যালারি খাঁ খাঁ করে। শেষবার আমার গ্যালারি ভরে গিয়েছিল সেই ২০১৫ সালে, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ফাইনাল। অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন। কিন্তু আমি ভুলিনি।
মিরপুর এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট ভ্যেনু। কী গর্ব আমার বন্ধুর। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকদের কল্যাণে মিরপুরের মাঠ বারবার নেচে ওঠে ক্রিকেট-গৌরবে। আর আমি! চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি। কবে এ দেশের ফুটবলে প্রাণ ফিরবে। কবে আমার গ্যালারি একটু ভরে উঠবে। দর্শকদের উল্লাস আর উদ্যাপনে মিটে যাবে আমার তৃষ্ণা।
আমার বুকে কী না হয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেট হকি—সবই। হকির মাঠ নয়। তবুও ১৯৮৫ সালে এখানে হয়েছে জমজমাট এশিয়া কাপ হকি। সে বছরেরই দ্বিতীয় সাফ গেমসের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার বুকে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সাফ গেমসের পরও হয়েছে—১৯৯৩ সালে। টাট্টু শো, লেজার শো, কনসার্ট কী হয়নি আমার বুকে! আমার বুকে কতজন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া তারকা হেঁটেছেন, এই প্রজন্ম শুনলে অবাক হয়ে যাবে! কেবল খেলা আর কনসার্ট। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেও তো আমি জড়িয়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপর আমার বুকেই তাঁবু খাটিয়েছিল মুক্তিসেনার দল। মুক্তিযোদ্ধারা আমার বুকেই সমর্পণ করেছিল নিজেদের যুদ্ধকালীন অস্ত্র। মিত্র ভারতীয় বাহিনী আমার বুকেই কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ফিরে গিয়েছিল নিজেদের দেশে।
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি আক্ষেপগাথা। এই তো কিছু দিন ধরেই দেখছি আমার বুকে সবজির চাষ করছেন এক মাঠকর্মী। তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি সোচ্চার! হ্যাঁ স্টেডিয়ামে সবজি চাষ কাজটি ভালো হয়নি। কিন্তু একবারেই কি ঘৃণা করার মতো কোনো কাজ? এই সবজি বেচে কি আর সেই মাঠকর্মী বড় ভবন বানিয়েছেন? কিংবা টাকার পাহাড় গড়েছেন? আমাকে ব্যবহার করেই তো কত ভুঁইফোড় টাকার কুমির হয়েছে। আমার সংস্কারের কাজ ঠিকমতো না করেই তো ঠিকাদার টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের লোকজনের দুর্নীতির কথা আজ না হয় না-ই বললাম। আহ, সবজি চাষের এই সমালোচনাকারীরা যদি মাঠে এসে আমাকে এক দিন উৎসাহ দিতেন!
সংস্কার হচ্ছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম
অনেক দেরিতে হলেও সংস্কার হতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এই স্থাপনাটির খসড়া নকশা শতভাগ প্রস্তুত হয়েছে। টেন্ডার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ মাসেই ওয়ার্কঅর্ডার পেতে যাচ্ছে ১৯৫৪-৫৫ সালে স্থাপিত হওয়া স্টেডিয়ামটি। এমনটাই জানিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মাসুদ করিম। এ সময় বাংলাদেশ গেমসসহ অন্য ফেডারেশনের ব্যস্তসূচী থাকলেও কয়েক ধাপে স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হবে বলেও জানান তিনি। ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ফুটবল, ক্রিকেটের পাশাপাশি হকি, আরচারি, এ্যাথলেটিক্স, বক্সিং, আয়োজনের উদাহরণ আছে এই স্টেডিয়ামে। মোহাম্মদ আলী, লিওনেল মেসি-জিনেদিন জিদানের মতো তারকারাও মাতিয়ে গেছেন এই মাঠ। পাশাপাশি জাতীয় দিবস আর রাষ্ট্রীয় আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চও এই স্টেডিয়াম।
এবার স্টেডিয়ামের মূল অবকাঠামো ঠিক রেখেই সাজানো হয়েছে নতুন ডিজাইন। যার খসড়া নকশাও চূড়ান্ত। যদিও করোনায় বছরখানেক পিছিয়েছে সংস্কার কার্যক্রম। এলইডি ফ্লাডলাইট, টার্ফ, মাঠ উন্নয়ন এগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজে হবে। সেভাবেই এর টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন এটা মূল্যায়নের পর্যায়ে। আগামী এক সপ্তাহ অথবা ১০ দিনের মধ্যে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সম্মতি পেলেই এর কার্যাদেশ দিয়ে দেয়া হবে। শুরুতেই প্রেসিডেন্ট বক্স ও ভিআইপি জোন দিয়ে শুরু হবে স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। এলইডি ফ্লাডলাইট, শেড, জায়ান্ট স্ক্রিনসহ আমদানিনির্ভর স্থাপনার কাজ হবে দ্বিতীয়পর্বে। সবার শেষে মূল মাঠ ও এ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকের কাজ করা হবে। যেখানে ভিআইপি প্রবেশ পথে হল অব ফেমের ফলক নির্মাণেও আছে পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ক্রীড়া ইভেন্টগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই সংস্কার কাজ করা হবে। বাজেট ছিল। প্রয়োজনীয় অর্থও ছিল। তারপরও শুরু করা যায়নি এই স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। দেড় বছর আগে এই স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য ৯৮ কোটি টাকার বাজেট একেনেকে পাস হলেও কাজের অগ্রগতি আটকে যায় ই-টেন্ডারের মাঝেই। এই ধীরগতির কারণ সম্পর্কে কোন সদুত্তর ছিল না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে।
২০১৯ সালের জুনে পাস করা হয় আন্তর্জাতিক এই স্টেডিয়ামটির সংস্কার বাজেট। কিন্তু তখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। শুরুতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিকল্পনা ছিল স্পোর্টস স্থাপনা নিয়ে কাজ করে এমন কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়িত্ব তুলে দেয়ার। এ জন্য খোঁজ-খবরও লাগিয়েছিল এনএসসি। কিন্তু কেন যে সেখান থেকে সরে গিয়ে ই-টেন্ডারের পথে নীতি নির্ধারকরা তা তখনও অজানাই ছিল। শুধু দেশের খেলাধুলার নয় আন্তর্জাতিক মহলে লাল-সবুজের ভাবমূর্তি বহন করে এই স্টেডিয়াম। তাই এর রুগ্ন হালে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কয়েকমাস আগেই ফিফা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলÑ দ্রুত ও যথাযথভাবে সংস্কার করা না হলে এই স্টেডিয়ামের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়া হবে। সংস্কারের পর হয়তো পুরো স্টেডিয়ামই পাবে নতুন রূপ। কিন্তু বছরের পর বছর বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হওয়া স্টেডিয়ামপাড়া কী বদলাবে? যেখানে দোকানপাট-ব্যবসা নয়, থাকবে শুধু ক্রীড়াবিদদের পদচারণা।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কারব্যয় বেড়ে ১৫৫ কোটি টাকা
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য ২০১৭ সালে যখন প্রথম ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজোল) তৈরি করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি), তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০ কোটি টাকার মতো। ওই প্রজেক্ট তৈরি হয়েছিল ২০১৯ সালের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে।কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্টেডিয়াম সংস্কার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে এনএসসি। নতুন পরিকল্পনায় বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ কোটি টাকা এবং সংস্কার শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের জুন। পরে সময় বাড়িয়ে সেটা ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
৯৮ কোটি টাকায় স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সেই টাকায় আর হচ্ছে না। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্টেডিয়াম সংস্কার শেষ করার জন্য আরও ৫৭ কোটি টাকা বাড়তি চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। বর্ধিত বাজেট পাস হলে স্টেডিয়াম সংস্কারের খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ করার নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন।
ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অধিকতর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে ভাগ করা হয়েছিল ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ -এই তিন অর্থবছরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৭ কোটি টাকার কাজ হওয়ার কথা ছিল দ্বিতীয় (২০২০-২১) অর্থবছরে। প্রথম (২০১৯-২০) অর্থবছরে ২৬ এবং শেষ অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ১৫ কোটি টাকা।বিদ্যমান প্রকল্প অনুযায়ী সংস্কারকাজ সম্পন্ন করার নির্ধারিত সময় শেষ হলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ৯৮ কোটি টাকার মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা বৃহস্পতিবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই অর্থবছর হয়তো আরও টাকা পাওয়া যাবে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে যাওয়ায় পুরো টাকা পাওয়া কঠিন।’
স্টেডিয়াম সংস্কারের সবচেয়ে বড় ব্যয় ফ্লাডলাইট স্থাপন। আগে এর বাজেট ছিল ১৪ কোটি টাকা। সেটা বাড়িয়ে এখন করার প্রস্তাব করা হয়েছে ৪০ কোটি টাকার মতো। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত হচ্ছে গ্যালারিতে শেড নির্মাণ। ২২ কোটি টাকার সেই বাজেট বাড়িয়ে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। আগের ২০ কোটি টাকা বাজেটের মধ্যেই শেষের পথে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক স্থাপনের কাজ।তিনটি বড় কাজের এখনো দরপত্রই হয়নি। ২২ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে শুরু হয়েছিল গ্যালারির শেড স্থাপনের কাজ। ওই টাকায় শুধু ফ্রেমটা করা গেছে। শেড স্থাপনের কাজ শেষ করতে লাগবে আরও ১৬ কোটি টাকা। বর্ধিত বাজেট পাস হলে শেডের বাকি কাজ শেষ করতে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওই সহকারী পরিচালক।
দরপত্র হয়নি ফ্লাডলাইট ও গ্যালারিতে চেয়ার বসানোর কাজেরও। বর্ধিত ৫৭ কোটি টাকা খরচের অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত দরপত্রও আহ্বান করতে পারছে না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ভিআইপি গ্যালারির চেয়ার চলে এসেছে চট্টগ্রামে। সাড়ে ৭ কোটি টাকার সাধারণ গ্যালারির চেয়ার স্থাপনের কাজের দরপত্র এখনও হয়নি। গ্যালারির চেয়ারের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩০০। ভিআইপি ও অন্যান্য মিলিয়ে স্টেডিয়ামের মোট দর্শকধারণ ক্ষমতা ২৩ হাজার।জুনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ঢাকায় আসার একটা সম্ভাবনা আছে। যে কারণে বাফুফে দুদিন আগে জুনের মধ্যে স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।
একাধিক কাজের দরপত্রই যেখানে হয়নি, সেখানে জুনের মধ্যে কতটা কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব? ‘আমরা মার্চের মধ্যে এই স্টেডিয়াম খেলা আয়োজনের মতো প্রস্তুত করে দিতে পারবো। মাঠ, ড্রেসিংরুম, প্রেসবক্স হয়ে যাবে এই সময়ের মধ্যে। সব কাজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ’-বলেছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা
প্রকল্প শেষ করার জন্য নতুন করে সময় বাড়িয়ে যখন ২০২৪ সালের জুনে নেওয়া হয়েছে তখন গ্যালারিতে শেড স্থাপনের কাজটি সহসা সম্পন্ন হচ্ছে না বলেই ধরে নেওয়া যাচ্ছে। মাঠে খেলা ফিরলে শেড স্থাপনের কাজটি বাইরের দিক থেকেই করতে হবে। ‘খেলা শুরু হলে ভেতর থেকে এই কাজটি করা সম্ভব নয়। যে কারণে, আমাদের বাইরের থেকে অতিরিক্ত ক্রেন ব্যবহার করে শেড স্থাপন করতে হবে। তাতে খরচও কিছুটা বাড়তে পারে’-বলেছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওই কর্মকর্তা।বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বিদ্যমান জায়ান্ট স্ক্রিনটি মেরামত করার কথা ছিল সংস্কার পরিকল্পনায়। তবে এটা এখন আর ব্যবহার করা যাবে না বলে নতুন করে একটা জায়ান্ট স্ক্রিন স্থাপন করতে হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি টাকার মতো।
ফ্লাডলাইট, গ্যালারির শেড, অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক, গ্যালারিতে চেয়ার বসানো, জায়ান্ট স্ক্রিন ছাড়াও সংস্কার পরিকল্পনায় অন্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে-মাঠ উন্নয়ন, ড্রেসিংরুম আধুনিকায়ন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, জেনারেটর স্থাপন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপন, মিডিয়া সেন্টার তৈরি, টিকিট কাউন্টার, ডোপ টেস্ট রুম তৈরি, চিকিৎসা কক্ষ, ভিআইপি বক্স নির্মাণ, প্রেসিডেন্ট বক্স, টয়লেট উন্নয়ন, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সাব-স্টেশন।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার ব্যয় বেড়ে ১৫৯ কোটি টাকা
প্রায় দুই বছর আগে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। আগামী জুনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কাছ থেকে স্টেডিয়ামটি বুঝে পাওয়ার আশায় ছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। সেজন্য লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আনার তোড়জোড় শুরু করেছিল বাফুফে। কিন্তু অতি উৎসাহী বাফুফে কর্তারা এখন আর মেসিদের আনা নিয়ে কথা বলছেন না। মেসিদের এনে যে মাঠে খেলার ইচ্ছা ছিল কাজী সালাউদ্দিনের, সেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ এ বছরও শেষ হচ্ছে না। স্টেডিয়ামটি ঢালাওভাবে সাজানোর জন্য নতুন করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধিত বাজেটের পরিকল্পনা করছে এনএসসি। সংশোধিত বাজেট এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে তারা । তাই সব কাজ শেষ হতে ২০২৪ সালের জুনের আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পাচ্ছে না বাফুফে। আগামী বছর বাফুফেকে স্টেডিয়ামটি হস্তান্তর করার পরিকল্পনা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে সংস্কারের বাজেটও। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজের উদ্যোগ নেয় এনএসসি। সেই সময় প্রথম ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সংস্কারের ব্যয় ধরেছিল ৮০ কোটি টাকা। অবশ্য ২০১৯ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে ওই বাজেট করেছিল ক্রীড়া পরিষদ। ওই বছরই স্টেডিয়ামের সংস্কার পরিকল্পনা করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে এর জন্য ব্যয় বাড়িয়ে ৯৮ কোটি টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেই বাজেটে ২০২৩ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পুরো সংস্কার কাজ।
কিন্তু প্রায় ১০০ কোটি টাকায় স্টেডিয়ামকে নতুন করে সাজানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছিল এনএসসি, আপাতত তা দিয়ে হচ্ছে না। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও ৬১ কোটি টাকা বাড়তি চেয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বর্ধিত বাজেট পাস হলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কারের জন্য খরচ দাঁড়াবে ১৫৯ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পে স্টেডিয়াম সংস্কার কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্টেডিয়াম সংস্কারে সবচেয়ে বড় বাজেট ফ্লাডলাইট স্থাপনে। আগে বাজেট ছিল ১৪ কোটি, সেটা বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত ধরা হয়েছে গ্যালারির শেড স্থাপন। ২২ কোটি টাকার সেই বাজেট বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বিদ্যমান জায়ান্ট স্ক্রিন নতুন করে বসানো হবে। এর জন্য আলাদা ৮ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়েছে। অ্যাথলেটিকস ট্রাক স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু তিনটি বড় কাজ– ফ্লাডলাইট, গ্যালারির শেড এবং সাধারণ গ্যালারির চেয়ারের কাজ শুরু করতে পারেনি ক্রীড়া পরিষদ। নতুন প্রকল্প অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, তা চলে গেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
এরই মধ্যে নতুন প্রকল্পের বাজেট নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটা বৈঠকও হয়েছে। এই বাজেট আবার দেখানো হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি পুরো ডিজাইন দেখে যে সিদ্ধান্ত দিবেন, সেই মোতাবেক কাজ শুরু হবে বলে মঙ্গলবার সমকালকে জানান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা, ‘নতুন প্রকল্পে বেশিরভাগ ব্যয় মূলত এলএইডি ফ্লাডলাইট, গ্যালারির শেড নির্মাণ এবং সাধারণ গ্যালারির চেয়ারে। এরই মধ্যে আমাদের বাজেটটি অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চলে গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীকে আমরা পুরো বাজেটটি দেখাব। একনেকে অনুমোদনের পরই তিনটি বড় কাজের জন্য দরপত্রের আহ্বান করব আমরা। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজের প্রায় ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।’
ইতোমধ্যে মাঠে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এই ঘাস নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাফুফে গ্রাউন্ডস কমিটি। সম্প্রতি স্টেডিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বাবুল, ‘মাঠে যে ঘাস লাগানো হয়েছে, সেটা বাজে। বৃষ্টি হলে পুরো মাঠ কাঁদায় ভরে যাবে। তাই আমি তাদের বলেছি গলফ কোর্সের কিংবা বারমুডা ঘাস লাগাতে।’ গ্রাউন্ডের ড্রেসিংরুমে চেয়ার বসানো হয়েছে ১৪-১৬টি; যা অপর্যাপ্ত। তাই আরও ১১টি চেয়ার বসাতে এনএনসি কর্তাদের বলেছেন বাবুল।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভুলের মাশুল ৬০ কোটি টাকা!
শুরুতেই সঠিক পরিকল্পনা করে চলতে পারলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার কাজে দীর্ঘসূত্রতা হতো না বলে মন্তব্য করেছেন প্রকল্প পরিচালক শামছুল আলম। নতুন পরিকল্পনায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেষ হবে সংস্কার কাজ। সে হিসেবে ২০১৯ সাল থেকে ৫ বছর ধরে স্টেডিয়ামটিতে বন্ধ সব ধরনের খেলাধুলা।একটি স্টেডয়াম সংস্কারে যদি লাগে ৫ বছর, তাহলে নতুন করে নির্মাণে লাগতে পারে কতদিন? বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম নিয়ে এমন প্রশ্ন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কার্যসূচিতে সংযুক্ত করা যেতেই পারে! কিন্তু সমাধানে তার যে কোনো সঠিক উত্তর থাকবে না, সেটি বলে দেয়া যায়।
প্রায় ১০০ কোটি টাকা ডিপিপি সেট করে ২০১৯ সালের জুন-জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার শুরু করে এনএসসি। এর মাঝে কয়েক দফা তারিখ দিয়েও কাজ শেষ করতে পারেনি। এর মাঝে আবারও বাড়ানো হয়েছে সংস্কারের পরিধি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবেই এমন দীর্ঘসূত্রতা বলে এবার মেনে নিয়েছে ক্রীড়া পরিষদ।এ দিকে নতুন পরিকল্পনায় আবারও বেড়েছে কাজের বাজেট। এই অঙ্কটা এখন ১৬০ কোটির ঘরে। সংশোধিত ডিপিপি জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। আগামী মাসে একনেকে পাস হলে অর্থ ছাড় করে চলবে পরবর্তী কার্যক্রম। এবার আর বিলম্ব হবে না আশ্বস্ত করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনএসসি।
এর আগে, ড্রেসিং রুম, মাঠ ব্যবস্থাপনাসহ আরও বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কার কাজে ভুল পরিলক্ষিত হয়। সে জায়গাগুলোয় এবার সচেতন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। কোনো ছাড় না দিয়ে সর্বোচ্চ মান ধরে রাখার আশ্বাস জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রকল্প পরিচালক শামছুল আলম বলেন, ‘প্রথমেই পরিকল্পনা করতে পারলে অবশ্যই ভালো হতো। যেহেতু পরিকল্পনা সেভাবে ছিল না, সেজন্য আমাদের এক বছর সময় বেশি লাগছে। এটি স্বীকার করতে দোষ নেই। আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনার বিষয়ে একনেকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমতি পেলে আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করতে পারব।’বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার কাজ চলমান থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এখানে বন্ধ জাতীয় দলের খেলা। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনার বাংলাদেশ আসার কথা থাকলেও শুধুমাত্র স্টেডিয়াম প্রস্তুত না থাকায় নষ্ট হয় সে সম্ভাবনাও।
খেলা আয়োজনে প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম!
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রধান ও ঐহিত্যবাহী ভেন্যুর নাম বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। দেশের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া স্থাপনায় এক সময় ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স, কুস্তি, বক্সিং ও আরচ্যারি খেলার পাশাপাশি আয়োজন হতো বিদেশি সার্কাসও। মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম ক্রিকেটের প্রধান ভেন্যু হিসেবে গড়ে ওঠার আগে ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অয়োজন হতো ক্রিকেটের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক আসরের বিভিন্ন খেলা। সর্বশেষ ২০০৪-০৫ সালে এখানে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই সফরকারী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ ও ওয়ানডে সিরিজ খেলেছিল বাংলাদেশ। ২০০৫ সালের ৩১ জানুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে সিরিজ নিজেদের করে নেয়ার পর বঙ্গবন্ধুতে শেষ হয় ক্রিকেটযাত্রা। তখন থেকেই এই স্টেডিয়াম পাকাপাকিভাবে হয়ে যায় ফুটবলের। পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্সও ব্যবহার করে এই ভেন্যু। তবে মাঝে ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ও ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে।
বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে দেশের প্রধান ও বৃহৎ এই ক্রীড়া স্থাপনায়। তবে এই কাজ এখন থমকে আছে। আধুনিক ক্রীড়া ভেন্যু গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২১ সালের জুনে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এই সংস্কার কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরো এক বছর সময় লাগবে। কারণ কিছু কাজ বেড়ে গেছে। বর্ধিত বাজেটে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নের কাজ শেষ হওয়ার নতুন সময় নির্ধারণ হয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাস। এখানকার সংস্কার কাজের বর্ধিত বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। তৃতীয়বার বাজেট বেড়েছে ৬০ কোটি টাকার মতো। অতিরিক্ত টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পেতে বিলম্ব হওয়ার কারণেই বর্তমানে স্থবির হয়ে আছে এই স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। প্রথমত করোনাভাইরাসের ধাক্কা, দ্বিতীয়ত বাজেট বৃদ্ধি মিলিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে আধুনিক স্থাপনা হিসেবে গড়ে তুলতে।
২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজের জন্য যখন প্রথম ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজোল) তৈরি করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি), তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ওই প্রকল্প তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই স্টেডিয়ামের সংস্কার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে এনএসসি। নতুন পরিকল্পনায় বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ কোটি টাকা এবং সংস্কার শেষ করার দিনক্ষণ নির্ধারণ হয় ২০২২ সালের জুন। পরে সময় বাড়িয়ে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। তৃতীয়বার বাজেট বাড়ার পাশাপাশি প্রকল্পের সময়ও বাড়ানো হয়। বর্ধিত কাজ নিয়ে গতকাল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘বর্ধিত কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফ্লাড লাইট স্থাপন। ফ্লাইড লাইট স্থাপনের জন্য আমরা প্রথমে যে বাজেট ধরেছিলাম তার দ্বিগুণ লাগছে এখন। কারণ, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) চাহিদা অনুযায়ী আমাদের এখন এলইডি লাইট স্থাপন করতে হবে। এটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমরা উনার মৌখিক অনুমতি নিয়েছি। এখন বর্ধিত বাজেট একনেকে উত্থাপন হবে। সেখানে অনুমোদন হলেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে।’
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কবে নাগাদ খেলা হতে পারে? এ প্রসঙ্গে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘স্টেডিয়ামের মাঠের ঘাস সবুজ হয়ে গেছে। অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকও বসেছে। এখন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্স দুই ফেডারেশন চাইলে খেলা আয়োজন করতে পারে। বাফুফে যদি এখানে খেলা আয়োজন করে তাহলে আমরা স্টেডিয়াম সংস্কার কাজের কোনো কিছুই ভেতরে রাখবো না। ফ্লাডলাইট স্থাপন, শেডের বাকি অংশ বসানো এবং গ্যালারিতে চেয়ার স্থাপনের সময় মাঠের খেলায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। সব কিছু বাইরে রেখেই কাজ হবে। স্টেডিয়ামের ভেতরে খেলার উপযুক্ত পরিবেশই থাকবে। বাফুফে আগ্রহ দেখালেই আমরা মাঠ খেলার উপযুক্ত করে দেবো।’ আগামী মাসে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দু’টি ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ আছে। অক্টোবরে মালদ্বীপের বিপক্ষে আছে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলা। এ নিয়ে জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দু’টি হবে সিলেটে। অক্টোবরে মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচটিও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আয়োজনের সম্ভাবনা নেই। কারণ, হাতে আছে মাত্র দুই মাস।’
তথ্যসুত্র
ইতিহাস কথা বলে যে স্টেডিয়ামে, Prothom Alo.
খেলা আয়োজনে প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম!, Daily Inqilabb.
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভুলের মাশুল ৬০ কোটি টাকা, Somoy News.
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কারব্যয়, Jago News24.
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ, Rajshahir Somoy.
সংস্কার হচ্ছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, Daily Jana Kantha.
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম যদি কথা বলতে পারত., Prothom Alo.
ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রধান স্টেডিয়াম, Wikiwand.
নতুনরূপে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, থাকবে ২৫ হাজার আসন, Bangla News.
বাংলাদেশের জন্ম–ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যে মাঠ, Prothom Alo.