বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disasters in Bangladesh)

আজ ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আসছে। এসব ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী, টর্নেডো, নদীভাঙন, উপকূলে ভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি। এছাড়া সিসমিক জোন—অর্থাত্, ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এতে আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য ও ঘনবসতির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদীতীরবর্তী এলাকার জীবন ও জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা নিঃসন্দেহে বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) ২০০৯, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে নেয়া এসব পদক্ষেপ যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় নিজের অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে যুগোপযোগী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ

যেসব উন্নত দেশ অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে এ দেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরতে হবে এসব বৈঠকে। উন্নত দেশগুলোর অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে জরিমানা দিতে বাধ্য। সেই ফান্ড দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। বর্তমানে যে হারে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কিনা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে জরিমানার পূর্ণ হিস্যা বাংলাদেশ পাচ্ছে কিনা এবং তা যথাযথ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে একই সঙ্গে যুগোপযোগী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 

লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়তে থাকলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার আরো অনেক সমস্যা আছে। এর ফলে সমুদ্রের নোনা পানি কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ে। পরিণতিতে জমিগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হারায়। ‘বাংলাদেশ সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’-এর বরাতে প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত চার দশকে এ দেশের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এভাবে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়তে থাকলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত এক কোটি লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাস্তুচ্যুত এ বিপুল জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে শহরে এসে অপরিকল্পিত বস্তি তৈরি করছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের শহরের বস্তিবাসীদের প্রায় ৫০ শতাংশ নদীভাঙনের ফলে সৃষ্ট বন্যায় গৃহহারা হয়ে বস্তিতে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানে তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। সংগত কারণেই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে উঠেছে বস্তিগুলো।

‘অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে

রাজনীতি ও অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের প্রকৃতিও ২০২৩ সালের প্রায় পুরো সময় বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। এ বছরটা বাংলাদেশের ইতিহাসে উষ্ণতা আর কম্পনের জন্য রেকর্ডের বছর ছিল তো বটেই; আর বঙ্গোপসাগর তো রীতিমতো ঘূর্ণিঝড় তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছিল।যেখানে ১৯৭১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করত, সেখানে ২০২৩ সালে চার চারটি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের ওপরে প্রভাব ফেলেছে।যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট গত অক্টোবরে ‘অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।

অতিবৃষ্টির আঘাতেও প্রতি বছর প্রচুর মানুষ নিজের আবাসস্থল হারিয়ে দেশের অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে

এর আগের বছরের মে মাসেও আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ আরেক ঘূর্ণিঝড় ফণী। সে সময় দুই দেশের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। গত এক দশকে এমন অনেক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুধু উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস নয়; খরা, বন্যা, নদীভাঙন ও অতিবৃষ্টির আঘাতেও প্রতি বছর প্রচুর মানুষ নিজের আবাসস্থল হারিয়ে দেশের অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। আবার গত বছরের মে মাসে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ইয়াশের প্রভাবেও দেখা গিয়েছে এ চিত্রের পুনরাবৃত্তি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ।

দুর্যোগজনিত মোট অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটছে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে গোটা বিশ্বেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এ ধরনের দুর্যোগের মাত্রা ও ভয়াবহতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিকে দুর্যোগজনিত মোট অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটছে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়। এদিক থেকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।

গোটা বিশ্বেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বাড়ছে

অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি বলতে একটি দেশ বা অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের যেকোনো কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ওই দেশ বা অঞ্চলের অন্যত্র চলে যাওয়াকে বোঝায়। গোটা বিশ্বেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বনেতারাও এখন জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি নিয়ে উত্কণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। নিউইয়র্কে চলমান জাতিসংঘের সম্মেলনেও এখন আলোচিত ইস্যুগুলোর অন্যতম হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন

১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে, ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে এবং মোট ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালের বন্যায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং ৭.৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে, প্রতিবেদনে যোগ করা হয়েছে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্র ০.২৫ শতাংশের জন্য দায়ী হলেও দেশটির ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন, তা না হলে বাংলাদেশের পরিণতি মারাত্মক হবে।

প্রতি বছর ২৭ লাখ ১০ হাজার পরিবারের ১ কোটি ২১ লাখ মানুষের ওপর বিভিন্ন জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের প্রভাব পড়তে পারে

বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনে দায়ী মূলত কৃষি এবং জ্বালানি খাত। কৃষিখাতে ৪৪ শতাংশ এবং জ্বালানিখাতে ৩৯ শতাংশ কার্বণ নিঃসরণ হয়। ২০৪০ সালে এটি সর্বোচ্চ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।৭ বছরে সংঘটিত দুর্যোগের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, প্রতি বছর ২৭ লাখ ১০ হাজার পরিবারের ১ কোটি ২১ লাখ মানুষের ওপর বর্ষার বন্যা, আকস্মিক বন্যা, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস ও ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের প্রভাব পড়তে পারে।গবেষণায় কালবৈশাখী, শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো অন্যান্য দুর্যোগগুলোও বিবেচনা করা হয়েছে।

২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৬৪টি জেলায় অন্তত ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের সংস্পর্শে আসতে পারে

গবেষণায় আরও ধারণা করা হয়েছে, ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৬৪টি জেলায় অন্তত ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং তাদের ৬৬ শতাংশের জীবনে এর প্রভাব পড়বে।এতে আরও অনুমান করা হয়েছে, একই সময়ে দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হবে অন্তত ৩৩৭ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে স্বীকৃত

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে স্বীকৃত। জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বহার এবং এর প্রভাবে বিপদাপন্নতা আরো অনেকাংশে বেড়ে যাচ্ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ ও খরার মতো আপদগুলো নানা মাত্রা নিয়ে এ দেশে আঘাত হানতে পারে্। ফলে গত দশকগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্যবিমোচনের মতো পদক্ষেপগুলো হুমকির মুখে পড়বে এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০০৮ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা ২০০৯’ প্রণয়ন করে।

ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় মোট ছয়টি বিষয়কে স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে

এই পরিকল্পনায় মোট ছয়টি বিষয়কে স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যেমন:খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব থেকে রক্ষা করা, ক্রমবর্ধমান ও বারবার সংঘটিত হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দেওয়া, উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় অবকাঠামো, যেমন:ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, কার্বন নিঃসারণ ও প্রশমন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।

পূর্বের ত্রাণ ও পুনর্বাসন ধারণার পরিবর্তে জনগণের অংশগ্রহণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি কাঠামোগত রূপরেখা প্রণীত হয়

১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ব্যাপক বন্যা এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সনাতন ধারণার পরিবর্তে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসমূলক ধারণার প্রয়োগ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্বের ত্রাণ ও পুনর্বাসন ধারণার পরিবর্তে জনগণের অংশগ্রহণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি কাঠামোগত রূপরেখা প্রণীত হয়।

সারা বিশ্বে মোট ১৬৫ বিলিয়ন বা ৪১ শতাংশ মানুষ বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে

তথ্য বলছে, গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। সারা বিশ্বে মোট ১৬৫ বিলিয়ন বা ৪১ শতাংশ মানুষ বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে শুষ্কতা বা খরার কারণে, ১.৪৩ বিলিয়ন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ঘূর্ণিঝড়ে ৭২৭ মিলিয়ন বা ১৮ শতাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০ বছরের শুধু ঘূর্ণিঝড়েই ক্ষতি হয়েছে ১.২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বন্যায়, ৬৫১ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ গত দুই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমেরিকা মহাদেশে, যা মোট ক্ষতির ৪৫ শতাংশ বা ১.৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে এশিয়া মহাদেশে, ৪৩ শতাংশ বা ১.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে আছে ইউরোপ মহাদেশ।প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ গত দুই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে; যার ফলে প্রাণহানি কমে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় আগে যেমন প্রাণহানি হতো, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতে সেভাবে প্রাণহানি হয়নি।

৩০ বছরে প্রতিবছর গড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ হারাতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে

তথ্য বলছে, গত দুই দশকে চীনে পাঁচ শর বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে ৪৬৭টি। প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮০ সালের পর বিশে^ চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বেড়েছে। গত ২০ বছরে গড়ে প্রতিবছর ৯০০টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮০ দশকে বছরে যেখানে বৈশি^ক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি ডলারে। গত ৩০ বছরে প্রতিবছর গড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ হারাতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালকে ১৮৫০ সালে রেকর্ড শুরুর পর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানায়, বিশ্বের দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর ২০১৬, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২২ সাল। তাপদাহ, খরা, দাবানল ও প্রবল ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়া সংক্রান্ত এ বিষয়ের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে একটি বছরকে চিহ্নিত করা হয়, সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালকে ১৮৫০ সালে রেকর্ড শুরুর পর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রচণ্ড গরমে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়ায় ব্যাপক দাবানল হয়। বিশাল অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এসব আগুনের ধোঁয়া বিশ্বজুড়ে মেঘের মতো স্তর তৈরি করে।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে দেশের ১৭ ভাগ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ তাদের আবাসন হারাতে পারে, হারাতে পারে তাদের পরিচিত গ্রাম ও অসংখ্য সুখস্মৃতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জলবায়ুর প্রভাবে ২০২৪ সাল আমাদের আরেকটি অস্বাভাবিক গরমের বছরের লাল সংকেত দেখাচ্ছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানবপাচারের ঘটনা বাড়ছে

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানবপাচারের ঘটনা বাড়ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত মানবপাচারের ঘটনা দেখা যায়। বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের মধ্যবর্তী এলাকায় সুন্দরবন অবস্থিত, আর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের প্রত্যক্ষ সাক্ষী সুন্দরবন। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ট্রাফিকিং ইন পারসন -২০২২ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিনিয়ত বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবন এলাকার ফসল এবং সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে সেখানের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে আসে। জোরপূর্বক ও বাধ্যতামূলক শ্রম এই এলাকার মৎস্য আহরণের কাজে দেখা গেছে। যার ফলে প্রায়ই এসব এলাকায় শিশুদের কাজে বাধ্য করা হতো। সংঘবদ্ধ চক্র এই সুযোগের ফায়দা নিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের শোষণ করছে। এতে করে , সংঘবদ্ধ অপরাধীরা ব্যাপক আকারে এসব এলাকার মানুষকে বিদেশে কাজের কথা বলে প্রলুব্ধ করে। দেশে এবং বিদেশে এই চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করে, যার ফলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে যারা ঢাকা কিংবা কলকাতায় যায়, তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। 


তথ্যসুত্র

জলবায়ু পরিবর্তন একটি হুমকি, Jaijaidin.

 দুর্যোগ প্রশমন দিবস, Ittefaq,

জলবায়ু বিপর্যয়ের বহুমুখী, The Daily Star.

বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি , The Daily Star.

আরেক ঘূর্ণিঝড় ফণী, Bonikbarta.

বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, Prothomalo.

বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা, Bonikbarta.