নবান্ন উৎসব (Navanna Festival)

নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতু কেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি আবহমান বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের কষাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব। তবে নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথমদিনে আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসব। সত্যিই কথা বলতে কী- শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী।
বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। "নবান্ন" শব্দের অর্থ "নতুন অন্ন"। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
নবান্ন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ধানের বা পিঠার উৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। "নবান্ন" শব্দের অর্থ "নতুন অন্ন"। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব।
নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে।
আদিগন্ত মাঠ জুড়ে এখন হলুদে-সবুজে একাকার নয়নাভিরাম অপরূপ প্রকৃতি। সোনালি ধানের প্রাচুর্য। আনন্দধারায় ভাসছে কৃষকের মন-প্রাণ। বাড়ির উঠোন ভরে উঠবে নতুন ধানের ম-ম গন্ধে। এসেছে অগ্রহায়ণ। হিম হিম হেমন্ত দিন। হেমন্তের প্রাণ-নবান্ন আজ। বাঙালির প্রধান অন্ন, আমন ধান কাটার মাহেন্দ্র সময়। এ উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। কৃষিনির্ভর এই সমাজে কৃষিজমির সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক সূত্রেই নবান্ন হয়ে উঠেছে বাংলার লোকায়ত উৎসব।
আমাদের দেশে আবহমান কাল ধরে প্রচলিত এই 'নবান্ন' উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত। তাই নবান্ন উপলক্ষে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। কৃষকের আঙিনা-উঠান লেপে-পুছে ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা হয়। নতুন কাস্তে, ডালি, কুলা, চালুনি, ঝাঁটা, চাঁটাই তৈরি হয়। কৃষক মাথায় অথবা কোমরে নতুন গামছা বেঁধে সোনার ধান কেটে নিয়ে আসেন উঠানে।
কৃষাণ বধূর ব্যস্ততা বেড়ে যায় ধান মাড়াই-ঝাড়াই, সিদ্ধ-শুকানো, চাল-আটা তৈরি আর রকমারি রান্না-বান্না নিয়ে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামগুলো। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা-পুলি, ক্ষীর-পায়েস ইত্যাদি।পল্লীকবি জসীম উদ্দীন হেমন্তে মাঠ ভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে বলেন-
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি-কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,
কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।'

দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে 'নাইওর' আনা হয়। নবান্ন উপলক্ষে অনেক গ্রামে লোকমেলার আয়োজন হয় কোনো বটের তলায় কিংবা খোলা মাঠ-প্রান্তরে। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো এই লোকমেলা। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মণ্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটি-বাঁশ-বেত কাঠের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আর বসে পালাগান, লোকনাট্য, কেচ্ছা-কাহিনী, বাউল গানের আসর। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ওঠে বাঙালিমানস।
হেমন্ত ঋতুর পহেলা মাস কার্তিক। আর কার্তিকের শুরু থেকে ধান পাকতে শুরু করে। হলুদ রঙা এ পাকা ধান দেখে খুশি হন কৃষক। এরপর কৃষক সে ধান কেটে গোলায় তোলেন। রেখে দেন বারো মাস খাওয়ার জন্য। নতুন এ ধান গোলায় তোলা উপলক্ষ্যে কৃষকের পরিবারে উৎসবের সৃষ্টি হয়। খাওয়া হয় নতুন ধানের ভাত। তৈরি হয় পিঠা-পায়েস। খাওয়ার পাশাপাশি কৃষকরা সবাই মিলে আনন্দও করেন। নতুন ধান তোলার এ আনন্দের নামই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ উৎসব হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই।
এ ছাড়া হেমন্ত ঋতু শীতের পূর্বাভাস হলেও আমাদের কৃষকের কাছে এ ঋতুর বেশি গুরুত্ব ফসল ঘরে তোলার মৌসুম হিসাবে। সে জন্য অগ্রহায়ণ ধান কাটার পুরোপুরি মৌসুম হলেও কার্তিকের শুরু থেকেই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। অন্যদিকে কার্তিক কৃষকের কাছে মঙ্গার মাস হিসাবেও পরিচিত। কারণ দীর্ঘ ৪-৫ মাস অপেক্ষার পর কৃষক অগ্রহায়ণে তার গোলায় তোলেন দীর্ঘ পরিশ্রমের সোনালি ফসল। তাই কৃষকের কাছে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয় অগ্রহায়ণের আগমনে। শুধু মঙ্গা দূর নয়, অগ্রহায়ণ মানেই কৃষকের আনন্দ। কৃষকের শস্যোৎসব। কৃষকের এ শস্যোৎসবই আমাদের কাছে নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। আসলে নবান্ন শব্দের অর্থ-নতুন অন্ন বা নতুন খাবার। অথবা বলা যায়-নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। গ্রামবাংলায় সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কিছু এলাকায় মাঘ মাসেও নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। আবার নবান্ন নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও রয়েছে আলাদা আচার।কৃষকের এ নবান্ন উৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ গান-কবিতাও লিখেছেন। নজরুল লিখেছেন-ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলো কি ধরনীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।
‘বিন্নী পলাশ’ চালের ফিরনি
তশতরী ভরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।
শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।
হেমন্ত ঋতু আমাদের চতুর্থ ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে এ ঋতু। অর্থাৎ এর আগে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ গেছে। আর সামনে আছে শীত ও বসন্ত। বলা যায় হেমন্ত আসে শীত আসার খবর নিয়ে। আর যারা গ্রামে থাকেন তারা নিশ্চই এরই মধ্যে শীতের আমেজ পাচ্ছেন? অবশ্য নগরে যারা থাকেন তারা হয়তো শীতের আমেজটা এখনো টের পাননি। শীতের আমেজের পাশাপাশি গ্রামে হেমন্ত ঋতুতে আরও অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসে। আর সেটি হলো মাঠজুড়ে হলুদ রঙা পাকা ধান, ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক, গোলায় ধান তোলা, বাড়ির উঠানে ধান সিদ্ধ করা-ইত্যাদি।
শীতকে কেন্দ্র করে পাড়া-মহল্লা কিংবা বিভিন্ন রাস্তার পাশে ইতিমধ্যেই পিঠার দোকান দিয়ে বসছেন পিঠা বিক্রেতারা। কৌতূহলবশত কথা হলো সিংগারদীঘি পুকুর পাড়ে পিঠা বিক্রেতার সঙ্গে। জানা যায়, মৌসুমি শীতের পিঠার প্রতি মানুষের বেশ আগ্রহ রয়েছে। তাই সাময়িক সময়ের এই পিঠার দোকান শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে বেশ জমে উঠেছে। মূলত সকাল ও সন্ধ্যায় পিঠা বিক্রি হলেও তুলনামূলকভাবে সন্ধ্যায় পিঠার চাহিদা বেশি থাকে। চিতই, কুলি, চই, ভাপা, ডিমচিতই, দুধচিতই, তেলচিতই, পিরামিড এবং পাটিসাপটা পিঠাসহ সব ধরনের পিঠাই এখন পাওয়া যায় রাস্তার পিঠার দোকানে। তবে ভাপা এবং চিতই পিঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পিঠা খেতে আসা একজন জানান, সন্ধ্যায় চিতই পিঠার সঙ্গে সরিষা ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, মরিচের সঙ্গে ধনেপাতা বাটা এবং খেজুরের রস, জিভে জল আসার মতো স্বাদের কারণেই তারা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পিঠা খেতে আসেন পুকুর পাড়ের এই পিঠার দোকানে।
সমাজ ও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষের খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভব ঘটেছে নানা উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের। অরণ্যচারী আদিম মানুষ যখন খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি, বেঁচে থেকেছে কেবলমাত্র প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত খাদ্যের জোরে। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় ‘খাদ্য আহরণ অর্থনীতি’র সেই আদিস্তরেও খাদ্য সংগ্রহের সাফল্যে উৎসবের আয়োজন হয়েছে তাদের দলে বা গোষ্ঠিতে। এমনি এক উৎসবের প্রথম আয়োজন হয়েছিল হয়তো বড় দুর্জয় কোন বন্যপশু শিকারের আনন্দকে বড় রূপ দেওয়ার জন্য।
দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘টোরেস ফেরেস’ গুহাগাত্রে পাথর খোদাই করে অঙ্কিত হরিণের চামড়া ও শিং পরে নৃত্যরত মানুষের চিত্রসহ আরও অনেক গুহাচিত্র থেকে সমাজ বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন। আফ্রিকার ব্যুশম্যান উপজাতির মধ্যে আজও প্রচলিত ‘কৃষ্ণষাঁড় নৃত্য’, যা খাদ্য সংগ্রহের সাফল্যকেন্দ্রিক একটি প্রাচীন উৎসব। এ ধরনের উৎসব আদিম মানুষকে খাদ্য আহরণে সংঘবদ্ধ ও সাহসী করেছে। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানব সভ্যতার যখন ‘খাদ্য আহরণ’ যুগ থেকে ‘খাদ্য উৎপাদন’ অর্থাৎ কৃষি অর্থনীতির যুগে উত্তরণ ঘটে তখন ফসল উৎপাদনের পেছনে কোন না কোন অদৃশ্য দৈব শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে নানা বিশ্বাস ও সংস্কার। যার ভিত্তিতে ফসল উৎপাদন কেন্দ্রিক উৎসবের ধরন বৈচিত্রপূর্ণ এবং তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের দৈবশক্তির সাহায্য প্রার্থনা করে নানা আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা যুক্ত হয়েছে এসব উৎসবে।
হিন্দু কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজন চলে ধুমধামে। হিন্দুদের বারো মাসের তেরো পার্বণের বড় পার্বণ হলো এই নবান্ন। এই নবান্নকে ঘিরে তাদের বারো পূজার প্রচলন আছে। তারা নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক প্রভৃতি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন নবান্ন গ্রহণ করেন। হিন্দু লোকবিশ্বাসে কাকের মাধ্যমে ঐ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’।
বাংলার কবি-সাহিত্যিকরাও নতুন ফসল ঘরে ওঠার ঋতু হেমন্ত আর নবান্ন উৎসবকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা-গান। ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্রে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালী দিন। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালী ধানের সম্ভার স্বগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ। তাই বিপুল বিস্ময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গেয়ে ওঠেন-
‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥’
হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও; মাঠ ভরা সোনালী ফসল নতুন স্বপ্ন জাগায় চোখে।কবি সুকান্ত’র ভাষায় যেন
-‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে।’
‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান’।
নবান্নের বর্ণনা তিনি তাঁর ‘এই নবান্নে’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন। হেমন্ত ঋতুর দিন-রাতের অবিশ্রান্ত শ্রমে কৃষকের ঘরে ওঠে সোনার ধান। বাংলার গ্রাম-গঞ্জ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে।জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এভাবে নতুন আমন ধানের আঘ্রাণে অগ্রহায়ণকে মাৎ করে দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়েছে।
‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।’
কবি আল মাহমুদ লেখেন-
একদা অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হত,সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিলো। কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। তবে এখনও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার শালগ্রামসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে আবহমানকাল ধরে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ,বীরভূম, বর্ধমান সহ বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়।
১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন শুরু হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। উৎসব বাংলা ৩ দিন ব্যাপি নবান্ন উৎস বআয়োজন করে আসছে রমনা বট মূলেl এছাড়া সাংকৃতিক সংগঠন শোবিজ এন্টারটেইনমেন্ট রাজধানীর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর বিগত ১২ বছর যাবত ৩ দিন ব্যাপি নবান্ন উৎসব ও পিঠা মেলা আয়োজন করে আসছে । এ উৎসবের ৩৩ টি স্টলে ২০০ ধরনের পিঠা থাকে । এ ছাড়া উৎসব প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আয়োজন করা হয় নবান্নের নাচ, নবান্নের গান, লোকগীতি লালন গীতি বাউল গান,সাপ খেলা বানর খেলা, লাঠি খেলা, নাগর দোলা, পুতুল নাচ, পালকি, পথ নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এই নবান্ন উৎসবের সমাপনী দিনে সেরা পিঠা শিল্পীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বিভিন্ন উৎসবের আমেজে বাংলাদেশের মানুষ আবহ। তেমনি নবান্ন উৎসব বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী উৎসব। নবান্ন মূলত ঐতিহ্যবাহী ধান বা পিঠা উৎসব। বাংলার কৃষি সমাজে ধান উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে উৎসব পালিত হয় তার মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম। আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত হয় নবান্ন উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বসবে গ্রামীণ মেলা। এ মেলা হয়ে উঠবে মানুষের মিলনমেলায়। নবান্ন থেকে কৃষক ‘রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান’ কেটে আনে ঘরে। কুয়াশায় মোড়া প্রকৃতির ভেতর ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় হেমন্তের বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির মুখরতা নেই। তারপরও সেই আনন্দঘন পরিবেশ একবারে ম্লান হয়নি। এদিন নতুন চালের পিঠার জন্য শুরু করেন খেজুরের রস সংগ্রহ। নতুন রস আর নতুন চালের পিঠা হয়ে আছে বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কোথাও কোথাও মাঘ মাসে ও নবান্ন উৎসব করতে দেখা যায়। নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দু শাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ এবং কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় 1998 সাল থেকে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়ে আসছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। রাজধানীর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর বিগত ১২ বছর যাবত ৩ দিন ব্যাপি নবান্ন উৎসব ও পিঠা মেলা আয়োজন করে আসছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের পিঠা স্টল থাকে। যেখানে প্রায় 200 ধরনের পিঠা বা তার বেশি থাকে। শীতের আগেই হেমন্ত আসে। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণে মূলত নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। এ সময়ে নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ-কৃষাণীরা।
এসময় নতুন ধানের পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করা হয়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। সাথে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম, বর্ণ উপেক্ষা করে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। বর্ণিল আয়োজন এর মধ্য দিয়ে তারা তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নানা রকম পিঠা পুলির আয়োজন থাকে নবান্ন উৎসবে। নবান্ন উৎসবে অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন রকম গান গাওয়া হয়। যেমন জারি-সারি, মুর্শিদি, লালন ইত্যাদি। ছোটদের আনন্দ দিতে মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস। বায়োস্কপ ইত্যাদি আসে।
হেমন্তের শীত শীত সকালে মাটির চুলায় ঢেঁকিতে ভানা নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করেন গ্রামের গৃহস্থ ঘরের নারীরা। সেগুলো খেয়ে দিন শুরু হয় পরিবারের সদস্যদের। শহরে এই দৃশ্য অপরিচিত। তবে এই শহরেও নেওয়া যাবে হরেক রকমের পিঠার স্বাদ। ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে শুরু হওয়া নবান্ন উৎসবে পিঠার স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি উপভোগ করা যাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
এক সময় আমন ধান কাটার পরই শুরু হতো নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নতুন পিঠা, পোলাও, পায়েস, ক্ষীর এবং রকমারি খাবার তৈরি করা হতো কৃষকের ঘরে ঘরে। ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উপলক্ষে গ্রামগঞ্জের কৃষক পরিবারের ঝি-জামাই এবং আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে নতুন চালের বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি করে ভূরিভোজের আয়োজন করা হতো। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা এবং বাড়ি বাড়ি নতুন চাল রান্নার ম-ম ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত। খেতেও বেশ লাগত নতুন চালের পিঠা, পোলাও, পায়েস আর ক্ষীর। তাই কৃষক পরিবারের ঝি-জামাই এবং আত্মীয়স্বজনরা নবান্ন উৎসবের দাওয়াত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। প্রাচীনকাল থেকে বাংলার কৃষকরা নবান্ন উৎসব উদযাপন করে এলেও বর্তমান সময়ে অগ্রহায়ণ-পৌষের নবান্ন উৎসব আগের মতো তেমন দেখা যায় না। পিঠার গুঁড়ি কুটার ঢেঁকির আওয়াজে কান পাতা যেত না পাড়া-গাঁয়ে অথচ কৃষকপল্লী এখন যেন নীরব নিস্তব্ধ। নেই নানার কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে শীতের পিঠার ধুমধাম আয়োজন। আত্মীয় আছে আগের মতোই, নেই শুধু মধুর সম্পর্ক। মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেলেও কমেনি মনের সংকীর্ণতা। সবাই যেন আত্মকন্দ্রিক, কেউ কারও খোঁজ রাখতে চায় না।
মাঠে মাঠে সোনালী ধানের সমারোহ, বাতাসে দোল খাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। নতুন আমন ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ। চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। ফলন যেমনই হোক, কৃষকের মুখে ধানকাটার গান মনে করিয়ে দেয় নবান্ন উৎসবের কথা।
নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। নতুন ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় সোনালি ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের সোনালি রঙ দেখে কৃষকের মন ভরে যায় আনন্দে। কারণ, কৃষকের গোলা ভরে উঠবে ধানে। বছর ঘুরে আবার এসেছে অগ্রহায়ণ। বাঙালির প্রধান কৃষিজ ফল কাটার ক্ষণ।
নবান্নের উৎসব কৃষকপাড়ায় খুব একটা দেখা না গেলেও শীতে পিঠা খাওয়ার পুরনো অভ্যাস বদলাতে পারেনি গ্রামগঞ্জের মানুষ, তাই গ্রামের অলি-গলিতে, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, স্টেশন কিংবা খেয়াঘাটে গড়ে ওঠা মৌসুমি পিঠার দোকানে অফিসগামী, পথচারী অনেককেই দেখা যায় পিঠার স্বাদ নিতে। দেরিতে হলেও এখন ভোর এবং সন্ধ্যায় বেশ হিমভাব অনুভূত হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে শীত এসে গেছে। শীত এলেই বাঙালির মনে পড়ে শীতের পিঠার কথা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত যেন পরিপূর্ণ হয় না। শীতে পিঠা খাওয়ার রীতি বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ, তবে শহরের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের দিনে অধিকাংশ আচার অনুষ্ঠান বদলে গেছে। সনাতন মাড়াই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। যন্ত্রযুগে প্রবেশ করেছে গ্রাম। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। শুধু তাই ধানের জমির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না। আর নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। নেই বললেই চলে। তবে গ্রামে নতুন ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে এবারও ঘরে ঘরে নানা পদ রান্না হবে। থাকবে পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। নেমন্নও বাদ যাবে না।ফসল ঘরে তোলার আনন্দ প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও।
‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’
গ্রামের মতো শহরেও, বিশেষ করে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়। জাতীয় নবান্নোত্সব উদযাপন পর্ষদ প্রতি বছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে। প্রতিবছর ১লা অগ্রহায়ণ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নবান্ন উৎসব ১৪২৯-এর আয়োজন করা হয়েছে।