বৃদ্ধাশ্রম (Nursing Home)

আভিধানিকভাবে বৃদ্ধ ও আশ্রম শব্দ দুটি মিলে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। শব্দগতভাবে অর্থ দাঁড়ায় বৃদ্ধনিবাস বা বৃদ্ধের আশ্রয়স্থল। অন্য অর্থে জীবনের শেষ সময়ের আবাসস্থল, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে বৃদ্ধাবস্থায় পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের আশ্রয় ব্যতীত সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় লালিত-পালিত হওয়ার স্থানকে বৃদ্ধাশ্রম বলে।

বৃদ্ধাশ্রম! একটি শব্দ। শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটি স্থান, যেখানে বাস করছে শত শত বাবা-মায়ের অভিমান, বেদনা ও সন্তানদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে অপরিচিত চার দেওয়ালের ভেতরে বন্দি জীবনের গল্প। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পরিবারবিহীন এক যাতনার জীবন কাটাতে কাটাতে ও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সময় পার করা বাবা-মায়ের আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রমের গান কাকে না নাড়া দেয়!

সারা বাংলাদেশে প্রায় ৩২টির মতো বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে

সারা বাংলাদেশে প্রায় ৩২টির মতো বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে ষাটোর্ধ প্রবীণ নারী-পুরুষের ঠাঁই হয়েছে। অধিকাংশের ছেলেমেয়েরা তাদের খোঁজখবর রাখেন না। কারও আবার ছেলেমেয়ে নেই। কারও সন্তানরা দেশের বাইরে থাকেন। বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রিত হতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে।আর সেই অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবার কথা চিন্তা করে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামে ১৮ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম বৃদ্ধাশ্রম ‘হেনরী ভুবন’।

পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমেও দেন না

আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো একক বা একক বর্ধিত পরিবারে, বৃদ্ধ মা-বাবার যত্ন নেওয়া, তাঁদের শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। যে কারণে কোনো সন্তান যদি মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, সেটিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক ভাবে সন্তানের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এমন সন্তানদেরও দেখেছি, যাঁরা নিজেদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত চিকিৎসা এবং যত্নের অভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া অসহায় বিধবা মাকে নিজেদের কাছে তো রাখেনই না, সামাজিক ও পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমেও দেন না।

অ্যাসিস্টেড লিভিং ফ্যাসিলিটির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার দিন শেষ

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন হওয়ার এবং গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রবীণ সদস্যদের জন্য মানসম্পন্ন যত্ন এবং সহায়তা প্রদানকারী বৃদ্ধাশ্রম বা অ্যাসিস্টেড লিভিং ফ্যাসিলিটির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার দিন শেষ।তবে শুধু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেই হবে না। এর জন্য দরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং নির্দেশিকা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন এবং সেগুলোর কঠোর তদারকি, পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে দক্ষ জনবল।

পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে

একই সঙ্গে বৃদ্ধ বয়সের যত্ন, বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।তবেই বৃদ্ধাশ্রমগুলো পরিণত হবে প্রবীণদের আনন্দাশ্রমে।এখানে উল্লেখ্য যে বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, প্রবীণদের সেবা প্রদানে দক্ষ কর্মীদের প্রচুর চাহিদা আছে। ভারত, ফিলিপাইন এবং পূর্ব ইউরোপ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আমরাও কিন্তু সেই সুযোগ নিতে পারি।

সভ্যতার সভ্য মানুষের অসহায় মা-বাবার শেষ আশ্রয় বৃদ্ধাশ্রম

 বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি হয়েছে মূলত অসহায় বৃদ্ধ মানুষের জন্য, যাদের কোনো আশ্রয় নেই কিন্তু কালক্রমে তা রূপ নিয়েছে সভ্যতার সভ্য মানুষের অসহায় মা-বাবার শেষ আশ্রয় হিসেবে। তবে প্রশ্ন-ই উঠে, বৃদ্ধাশ্রম কোন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি? কোন সমাজব্যবস্থা এই বিচ্ছেদের ঘর সৃষ্টি করেছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ পড়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি। এই সমাজব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো ‘পুঁজি বা অর্থনীতি’। যারা যথেষ্ট অর্থ বা পুঁজির অধিকারী নন, তারা যেন এই সমাজব্যবস্থায় মূল্যহীন বস্তু হিসেবে গণ্য হন।

বৃদ্ধাশ্রম হলো মূল্যহীন মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের দ্বারা সৃষ্ট নরকের নাম

এই সমাজব্যবস্থার মানুষের মধ্যে এক জনের প্রতি অন্য মানুষের সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা নির্ভর করে মূলত তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। যে অর্থনৈতিকভাবে যত স্বাবলম্বী তাকে ঘিরে অন্যদের দরদও বেশি, আবার যে সর্বস্ব সে অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। শেষ বয়সে মা-বাবাদের চাকরি-বাকরি কিংবা অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকার কারণে তারা হয়ে যায় পরিবারের বোঝা। তাই বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠে একমাত্র আশ্রয়। অনেক সময় এমনো হয়, যে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা হয়েছে তাদের সম্পত্তির খোঁজখবর পেলে অনেক সন্তান ছুটে যায় যা মূলত ঐ বিষয়কে ফুটিয়ে তুলে যে, সন্তান এ মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বস্তুগত জিনিসের ওপর ভিত্তি করে। বৃদ্ধাশ্রম হলো মূল্যহীন মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের দ্বারা সৃষ্ট নরকের নাম। এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ আত্মিকভাবে মিলিত হয় না বরং তাদের মধ্যে একটা নামমাত্র বস্তুগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে মানুষের মধ্যে আত্মার সম্পর্কের চেয়ে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সম্পর্ক তৈরি হয়। যার প্রভাব সমাজ থেকে পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বৃদ্ধাশ্রমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে

আমাদের দেশের অনেক পত্রিকা বৃদ্ধাশ্রমের প্রশংসা করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের মতো ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বৃদ্ধাশ্রমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, অথচ কোরআন মাজিদে সবচেয়ে বড় গোনাহ শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য বলা হয়েছে; তার পরই বলা হয়েছে- মা-বাবার সঙ্গে দয়াপূর্ণ আচরণ করো। এভাবে একাধিকবার এসেছে। এখানে আয়াতটি প্রাসঙ্গিক। সুরা বনি ইসরাইলে বৃদ্ধ বয়সের কথা বলা হয়েছে। এখনকার বৃদ্ধাশ্রমের লোকদের কথাই বলা হয়েছে সে আয়াতের মধ্যে, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত কোরো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদের ‘উফ্’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ -সুরা বনি ইসরাইল : ২৩

পুঁজিবাদ ও বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ আমাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে বলছেন, তারা যদি তোমার কাছে বৃদ্ধ হয়ে যান, তাকে তোমরা ‘উফ্’ শব্দটিও বলবে না। কষ্টদায়ক কিছু বলবে না। তাহলে কি যুবক বয়সী মা-বাবাকে ‘উফ্’ বলার সুযোগ আছে? বিষয়টা এমন নয়। আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্য হলো, বয়স হয়ে গেলে মানুষের মেজাজ বিগড়াতে পারে। একটু খিটখিটে হতে পারে। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, যা কিছুটা বিরক্তিকর লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রেও তাদের সঙ্গে সদাচারের প্রতি কোরআন মাজিদে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর আমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দিচ্ছি। আবার সেই কথা মানুষের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষের গল্প বড় করে দেখা হচ্ছে। এখানে সন্তানরা যে ভয়ংকরভাবে পাপে জড়িয়ে যাচ্ছে, আল্লাহর হুকুম না মানার বিষয়কে ভালো থাকা ভাবছে, এটা কোন মানসিকতা? পুঁজিবাদ ও বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ আমাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আমাদের এসব ঘটনার পেছনের কারণগুলো বের করতে হবে। আর না হয় এ ধরনের পৈশাচিকতা বাড়বে বৈ কমবে না। বাবা-মা উপার্জন অক্ষম হলেই তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে, কয়েকদিন পর ওই সন্তানকে তার সন্তানও সেখানেই পাঠাবে, এমন ধারাবাহিকতা চলতে পারে না। আল্লাহতাআলা সবাইকে ইসলামের শেকড় ধরার তওফিক দান করু

পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত  সেই  বৃদ্ধাশ্রমে  ছিল  বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা।[1] কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা-মাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সবকিছু থেকে দায়মুক্তি ঘটে। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণাবোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি। যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই।

বাংলাদেশের নিবন্ধনকৃত শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রমের) সংখ্যা ছয়টি

কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২৮.১০.২০১৮ইং তারিখে প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য মোতাবেক বর্তমান বাংলাদেশের নিবন্ধনকৃত শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রমের) সংখ্যা ছয়টি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সারা দেশে প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমে ৫০টি করে মোট ৩০০টি সিট রয়েছে।[2] রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আশ্রিত ব্যক্তিদের নিজস্ব অর্থায়নে চলে একটি আশ্রম ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ নামে। এটি একজন পরিচালক ও দু’জন কর্মচারীর সহযোগিতায় চলে। প্রায় ৩০/৪০ জন থাকতে পারে এখানে। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় কাপ্তাই সড়কের দক্ষিণ পাশে ২০১৪ সালের ১লা মে চালু হয় ‘আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’।

মানবতার উন্নয়নের আশায় কেন্দ্রটি চালু করেন শিল্পপতি শামসুল আলম। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের অবহেলিত, অসহায় প্রবীণদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিল্পপতি মুকুল চৌধুরী ১৯৮৭ সালের গোড়ার দিকে ঢাকার উত্তরায় আজমপুরে গড়ে তোলেন ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হয় গাযীপুরের মণিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ীতে। ১৯৯৫ সালে ২১শে এপ্রিল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির বর্ধিতাংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখানে প্রবীণদের থাকার জন্য ১টি বিশাল টিনশেড ভবন ও ৩টি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রবীণ নিবাস হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। কেন্দ্রটি ৭২ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হ’লেও বর্তমানে তা সম্প্রসারিত হয়ে ১০০ বিঘায় উন্নীত হয়েছে। মহিলা-পুরুষদের আলাদা ভবনে মোট ১২০০ মানুষ থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে এই কেন্দ্রে। বর্তমানে ২ শতাধিক বৃদ্ধ সেখানে অবস্থান করছেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য রয়েছে পাঁচতলা ভবনের চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানে ২ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, ২ জন নার্স, একজন কম্পাউন্ডার ও ১টি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানে নিয়োজিত আছে।

বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা

বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ বৃদ্ধাশ্রম বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, বৃদ্ধাশ্রম থাকলে বৃদ্ধা মা-বাবাকে সেখানে পাঠাতে সন্তানরা আগ্রহী হবে। ধীরে ধীরে সেটা রীতিতে পরিণত হবে। অনেকে আবার বলছেন, শেষ বয়সে এসে সন্তানদের অনাদর অবহেলায় দিন কাটানোর থেকে বৃদ্ধাশ্রমই ভালো আশ্রয়স্থল। এ কারণে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ানো উচিৎ।

সরকারি উদ্যোগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রমের দাবি করছেন অনেকে

বাস্তবতা হলো, বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়লেও, প্রায় সবগুলোরই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এই খাতে সরকারি বরাদ্দও খুবই সামান্য। অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রমই গড়ে উঠছে বেসরকারি উদ্যোগে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের মর্জিমাফিক এগুলো তৈরি করছেন। পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রবীণরা সেখানেও মানবেতরভাবে দিন কাটাতে বাধ্য হন। এ অবস্থা নিরসনে সরকারি উদ্যোগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রমের দাবি করছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বলছেন, বৃদ্ধাশ্রম নয়, বরং বৃদ্ধ মা-বাবার অধিকার রক্ষায় কঠোর আইন করা উচিৎ। পরিবারে বয়জ্যেষ্ঠ সদস্যের উপস্থিতি যেমন পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করে তেমনি নৈতিক মূল্যবোধ তৈরিতেও সাহায্য করে।

এই অসহায় মানুষগুলোর একমাত্র ভরসাস্থল হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম

পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অভিভাবকরা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সাধ্যের বাইরে যেয়ে ধার দেনা করে উন্নত দেশে পাঠাচ্ছেন। সন্তান লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি নিয়ে উন্নত জীবন যাপনের জন্য উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। দেশে বৃদ্ধ বাবা-মা কখনো শুধু মা অথবা বাবা একা থাকছেন। অনেকের হয়তো টাকা পয়সার সমস্যা থাকে না। কিন্তু যে সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে তা তাদের দেখাশোনা করার। পয়সা দিলেও বিশ্বস্ত লোকের অভাব। যে তাদের সততার সঙ্গে দেখাশোনা করবে। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। মেরে ফেলে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই এমন খবর পত্রিকার পাতা দখল করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লাইভ দেখা যায়। যা মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এমতাবস্থায় এই অসহায় মানুষগুলোর একমাত্র ভরসাস্থল হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম।

 নির্ভরযোগ্য বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য

কেন বলছি? আমার আজকের লেখা বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যে আমাদের নেগেটিভ ধারণা এবং সামাজিক সমালোচনা আছে সেটাকে ইতিবাচকভাবে আমরা দেখতে পারি কিনা ভেবে দেখতে বলবো। যাদের সন্তান বাবা-মাকে দেখে না অথবা দেশের বাইরে থাকার ফলে দেখেশোনা করতে পারে না তারা কোথায় যাবে? কে তাদের বাজার করে দেবে, অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নেবে? বাড়ির যত বিল সংক্রান্ত কাজ কে করে দেবে? অনেকেই বলবেন আত্মীয়-স্বজন। কিন্ত কয়দিন? রাতে হাসপাতালে নিতে হবে কে নেবে? আর হাসপাতালে রোগীর কাছে কে থাকবে? বাস্তবতা অন্যকথা বলে। সামাজিকভাবে অনেক কথা বলতে পারি কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ভাবলে মনে হবে নির্ভরযোগ্য বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য। যদি এই আশ্রমগুলোকে সেভাবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে সকলে একটা অ্যাসোসিয়েশন পাবে। তাকে অসুস্থ হলে ডাক্তারের চিন্তা করতে হবে না। বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। প্রচুর বই থাকবে। সকাল বিকাল দল ধরে হাঁটার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে খেলাধুলার ব্যবস্থা। বাগান করার সুযোগ থাকবে। যিনি পছন্দ করবেন তিনি ফুল ফোটাবেন মন ভালো করা। মাঝে মাঝে দল ধরে বেড়াতে নেবার ব্যবস্থা থাকবে। ধর্মকর্ম করার সুব্যবস্থা থাকবে। এতকিছুর মধ্যে থাকলে মন ভালো থাকবে মানুষগুলোর। ভাবুন তো নিজের বাড়িতে একা একা থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম ভালো না?  একা ঘরে রাতের প্রহর গুনে একাকিত্বকে সঙ্গী করে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার চেয়ে, সমবয়সী অনেকের সঙ্গে সময়ের বৈঠা বাওয়া ভালো না?  


তথ্যসুত্র

হৃদয় স্পর্শ করা বিষয়টি, Daily Sokalersomoy.

নৈতিক মূল্যবোধসহ, , Bangla Insider.

অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের, At-Tahreek.

বৃদ্ধাশ্রমের প্রশংসা করে, Deshrupantor.

আশ্রিত হতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে, Jugantor.

অসহায় বৃদ্ধ মানুষের জন্য, Ittefaq.

বৃদ্ধ মা-বাবাকে চাইলেও, Prothomalo.