স্বদেশপ্রেম (Patriotism)

স্বদেশপ্রেম (Patriotism)

স্বদেশ প্রেম বা ভালোবাস আল্লাহ প্রদত্ত একটি নিয়ামত। যা মানুষকে বেচে থাকার সাহস ও প্রাণ বির্সজনে সাহসী করে তুলে। স্বদেশ প্রেম ছাড়া স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব,দেশের সাফল্য ও উন্নয়নের চাকা সচল থাকতে পারে না।স্বদেশপ্রেম অর্থ হচ্ছে নিজের দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, ভাষার প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করা। দেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ, নিবিড় ভালােবাসা এবং যথার্থ আনুগত্যকে দেশপ্রেম বলে। জন্মভূমির স্বার্থে সর্ব ত্যাগের সাধনাই স্বদেশপ্রেম ।

মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সেটিই তার জন্মভূমি। জন্মভূমির প্রতি, স্বজাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধই স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, সীমাহীন আনুগত্য। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্বদেশভূমির প্রতি ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলেন-

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!’

মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি প্রতিটি মানুষের দেহে, মনে, প্রাণের সাথে মিশে থাকে। মা আর মাতৃভাষার সাথে মাতৃভূমি মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণীয় ও মূল্যবান সম্পদ। তাই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায় বলা যায়-

‘মিছা মণি মুক্তা হেম

স্বদেশের প্রিয় প্রেম

তার চেয়ে রত্ন নেই আর।’


বাঙালির স্বদেশপ্রেম

বাঙালির স্বদেশপ্রেমের তুলনা মেলা ভার। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে বিদেশি শক্তি প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা করেছে আর স্বদেশপ্রেমিক বাঙালি দেশের স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষার্থে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হাতে বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার ও বরকতের আত্মদান দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে মুক্তির লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তখন তাদের সবার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে একই মূলমন্ত্র—

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়,

দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়

চিন্তায়, কথায়, কাজে স্বদেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাইই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে গেলে বলতে হয়, স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলো হলো- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য ও একাত্মবোধ। কবির ভাষায় বলা যায়-

‘কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত

স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ

জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর

অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।’

স্বদেশপ্রেমের উপায়

শিক্ষা, যােগ্যতা ও অবস্থানের ভিন্নতাভেদে নানান মানুষ নানান অবস্থানে থাকে। কিন্তু প্রতিটি মানুষ স্বীয় অবস্থান থেকেই দেশের উপকার সাধন করতে পারে। ছােট থেকে বড় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায়। দেশ ও জাতির কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে কিছু করার মধ্যেই দেশপ্রেম নিহিত আছে তা ছােটই হােক আর বড়ই হােক। নিজের স্বার্থ, নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মহান ব্রত গ্রহণ করতে হবে। অবস্থানভেদে কৃষক যেমন ফসল উৎপাদন করে দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারেন। তেমনি একজন। শিল্পী কিংবা সাহিত্যিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে স্বদেশপ্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তাবােধ বর্জনীয়। কেননা অন্ধ স্বদেশপ্রেম এবং উগ্র জাতীয় চেতনা মানুষকে সংকীর্ণ করে বিরােধের জন্ম দেয়।

স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ

আরবি ভাষায় একটি প্রবচন আছে, ‘আল্ হব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান,’ অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম হচ্ছে ইমানের অঙ্গ’। ইমান তথা বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র ও পাঁচটি স্তম্ভের একটি। তাই প্রবচনটি অনুসারে, যাঁর অন্তরে দেশপ্রেম আছে, ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমানও আছে; পক্ষান্তরে যাঁর অন্তরে দেশপ্রেমের দীপশিখা প্রজ্বলিত নেই, তাকে মোমিন বলে অভিহিত করলেও ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমান পরিপূর্ণ নয়।

আমাদের মহানবী (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে জন্মভূমি, আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইনি; কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে থাকতে দিল না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৎকালে পৃথিবীতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না এবং মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। আজকাল সড়কপথে গাড়িযোগে তিন ঘণ্টায় এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়; কিন্তু মহানবী (সা.)-এর সময়ে উটের পিঠে আরোহণ করে মক্কা থেকে মদিনায় যেতে, অবশ্য ঘুরপথে, তাঁর সময় লেগেছিল দুই সপ্তাহ।সে যা হোক। বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণীরা দেশপ্রেম সম্পর্কে অনেক সুচিন্তিত মন্তব্য করে গেছেন, যেগুলোর কতক এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে:

যখন রক্ত চক্ষু বিদেশি শাসকের, যখন পরাধীনতার বিষ জ্বালায় জর্জরিত মানুষ মুক্তি কামনায় উদ্বেল অস্থির, যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়, তখনই আসে মানুষের স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষালগ্ন। জীবন অপেক্ষা স্বদেশ তখন হয়ে ওঠে আরো অতি প্রিয়তর। তখন মনে হবে, দেশের জন্য নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান মন্ত্রণার মতো। বিদেশ গেলে বা ফেরত এলে এই দেশের মর্মগত অর্থ বোঝা যায়। তাই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কণ্ঠে ভেসে আসে,

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।

বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম

বর্তমানের এই আধুনিক সমাজে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। মানুষ দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে এবং নিজের স্বার্থের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে। দেশ ও দেশের মানুষের কথা না ভেবে দেশের ক্ষতি করে নিজেদের উদরপূর্তি করছে। তারা দেশপ্রেমের চেতনাকে ভুলে গিয়ে নিজ স্বার্থকে বড় করে দেখছে। এই ধরনের মানসিকতার কারণে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর গরিবেরা দিন দিন আরও গরিব হচ্ছে। তাই এই ধরণের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে দেশের ও দশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় স্বদেশপ্রেমের অমর বাণী উচ্চারিত হয়েছে বারবার। তাদের দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমে রূপ নিয়েছে। দেশপ্রেমিক না হলে বিশ্বপ্রেমিক হওয়া যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ দেশকে ভালোবেসেছিলেন বলেই বিশ্বপ্রেমের অমর বাণী প্রচার করেছেন। দেশকে ভালোবাসা মানে দেশের মানুষকে ভালোবাসা। দেশের মানুষকে ভালোবাসলে পৃথিবীর সকল মানুষকে ভালোবাসা যায়। মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ডুনান্ট প্রমুখ বিশ্ব মানবসেবীদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। কেননা বিশ্বের সব মানুষই পৃথিবী নমক এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও বিশ্বমানবতা উচ্চকিত হয়ে ওঠে। বিশ্ব জননীর আঁচল ছায়ায় দেশ জননীর ঠাঁই বলে বিশ্বপ্রেমে বিভোর কবি রবীন্দ্রনাথ গভীর আবেগে বলে ওঠেন—

‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা,

তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা’

দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে সম্পর্ক

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেম যখন সঙ্কীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দি হয়ে উগ্র ছিন্নমস্ত রূপ ধারণ করে, তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়। স্বদেশকে একমাত্র পরম প্রিয় মনে করে আমরা বিশ্বকে শত্রু মনে করি এবং তাকে ধ্বংস করবার জন্য ধাবিত হই। তখন শুভ বিচার-বুদ্ধি স্বদেশপ্রেমের অন্ধ আবেগে লুপ্ত হয়। ফলে পরপর হানাহানি এবং অবারিত রক্তক্ষয় অনিবার্যরূপে দেখা দেয়। আর, নানা মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে সেই হানাহানি অচিরেই ধারণ করে বিভীষিকাময় রূপ।

সাহিত্যের আয়নায় স্বদেশপ্রেম

বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।

স্বদেশপ্রেম মানুষের ভেতরকার সব সংকীর্ণতা দূর করে তাকে মহৎ হওয়ার দীক্ষা দেয়। স্বদেশপ্রেমের স্পর্শে মানুষের ভেতরের সব পশুত্ববোধ দূর হয় এবং মানব কল্যাণে মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করার মন্ত্রণা অর্জন করে। যাবতীয় সুন্দর ভাবনা ও মহৎ উদ্দেশ্য স্বদেশপ্রেমে অধিভূক্ত। তাই মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলা যায়-

স্বদেশের উপকারে নাই যার মন

কে বলে মানুষ তার পশু সেই জন।’

সংকীর্ণ ও প্রগতিশীল স্বদেশ প্রেম

পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়েরই ভাল ও মন্দ দুটি দিক রয়েছে। সাধারণ মানুষের পরম আবেগ স্বদেশ প্রেমও তার ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে শঙ্খিনী এবং প্রগতিশীল এই দুই ধরনের স্বদেশপ্রেম লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাসের এই সংকীর্ণ এবং প্রগতিশীল স্বদেশ প্রেম সম্পর্কে জানার পূর্বে শান্তিপূর্ণ স্থিতির জন্য প্রাথমিক শর্তাবলীকে জানা প্রয়োজন। এ পৃথিবী পরিচালিত হয় মানুষের মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি দ্বারা।

সে কারণে ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’ এই চিরন্তন পালনীয় কর্তব্যের অন্যথা হলেই পৃথিবীর বুকে অশান্তির অভিশাপ নেমে আসে। স্বদেশ প্রেমের ক্ষেত্রেও এই কথা ভীষণভাবে প্রযোজ্য। তাই ‘আমার দেশ শ্রেষ্ঠ’- স্বদেশ সম্বন্ধে এই উক্তি বিবেচিত হয় প্রগতিশীল স্বদেশ প্রেম রূপে; আর ‘একমাত্র আমার দেশই শ্রেষ্ঠ’- স্বদেশের ব্যাপারে এই ধারণা বিবেচিত হয় সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতীকরূপে।একদিকে প্রগতিশীল স্বদেশ প্রেম যেমন স্বজাতির উন্নতি ঘটিয়ে স্বদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দরবারে সম্মানীয় উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। আর অন্যদিকে সংকীর্ণ দেশপ্রেম স্বার্থান্বেষী মানসিকতার বশবর্তী হয়ে পৃথিবীর বুকে অশান্তির অভিশাপ ডেকে এনে স্বদেশের জন্য আদপে অন্ধকারের বার্তা বয়ে আনে।

এধরনের সংকীর্ণ দেশপ্রেমের উদাহরণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি কিংবা ইতিহাসের বুকে দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্ব করা উপনিবেশিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করা যায়। আধুনিক বিশ্বায়িত পৃথিবীতে মানব সভ্যতার উন্নতিকল্পে সর্বদা প্রগতিশীল স্বদেশপ্রেমই কাম্য।স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সেতু বানাতে পারি। তাই,যত বড় ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ আসুক না কেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে দেশকে রক্ষা করবো, দেশের সেবা করবো আর  এতেই স্পষ্ট হবে আমাদের স্বদেশপ্রেমের অনন্যতা।

স্বদেশপ্রেমের বিকৃত রূপ

স্বদেশপ্রেম পবিত্র। তা দেশ ও জাতির জন্যে গৌরবের ও কিন্তু উগ্র ও অন্ধ স্বদেশপ্রেম কল্যাণের পরিবর্তে রচনা করে ধ্বংসের পথ । জন্ম স্বদেশপ্রেম উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। তা জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ও জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনি উগ্র জাতীয়তা ও অন্ধ দেশপ্রেমের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল ও বিপন্ন হয়েছিল বিশ্বমানবতা।

পৃথিবীতে বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষেরা তাদের বীরত্ব ও ত্যাগের মহান আদর্শ রেখে গেছেন। স্বদেশপ্রেমের শক্তিতেই তারা পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন সুন্দর, কল্যাণকর ও শান্তিময়। মূলত দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ এবং অমূল্য সম্পদ । একটি মহৎগুণ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দেশপ্রেম থাকা উচিত। দেশপ্রেমের মূল লক্ষ্য মানুষকে ভালোবাসা । তাই দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই অংশ বিশেষ। ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে ভালোবাসাই দেশপ্রেম। আর দেশের উর্ধ্বে সমগ্র পৃথিবীকে ভালোবাসাই বিশ্বপ্রেম।


ইংরেজ কবি Sir Walter Scott-এর ভাষায় :

‘Breathes there the man with soul so dead

Who never to himself hath said

This my own, my native land!

Whose hearth hath never within him burn’d.’

তাই স্বদেশ বলতে আমাদের বাংলাদেশ আমাদের হোক :

পালা-পার্বনের ঢাকে ঢোলে

আউলবাউল নাচে-পুণ্যাহের সানাই রঞ্জিত

রোদ্দুর আকাশ তলে দেখ কারা হাঁটে যায়, মাঝি

পাল তোলে, তাঁতি বোনে, খড়ে ছাওয়া ঘরের আঙনে

মাঠে ঘাটে শ্রমসঙ্গী নানা জাতি ধর্মের বসতি

চিরদিন বাংলাদেশ।’

স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রেরণাময় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তাই সবাই এক চেতনায়, এক প্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্যে ব্রতী হয়। কাজেই ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। দেশ গড়ার কাজে, মঙ্গলজনক কাজে আমাদের সবাইকে নিবেচিতপ্রাণ হতে হবে। কবির ভাষায়—

কাহারেও তুমি ভাবিও না পর হিন্দু-মুসলমান

ব্রাহ্ম, বৌদ্ধ, যেই হোক, সে যে স্বদেশের সন্তান। ’

একুশ শতকের পৃথিবীতে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আজ সবার হৃদয়ে দেশপ্রেমের সঞ্চার ঘটিয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তবে অর্জিত হবে দেশপ্রেমের চূড়ান্ত সার্থকতা।

পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অতিরিক্ত কোনো কিছুই যেমন ভালো নয়, তদ্রূপ অতিমাত্রায় ‘দেশপ্রেমও’ বাঞ্ছনীয় নয়। ইংরেজি ভাষায় এ প্রসঙ্গে দুটি আলাদা শব্দই আছে—‘শভিনিজম’, অর্থাৎ উৎকট স্বদেশপ্রেম ও ‘জিংগোইজম’, অর্থাৎ সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জার্মানদের উৎকট ও সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেমই ছিল পৃথিবীতে দু–দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বোধ করি এ কারণেই প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসা পরিহাসভরে বলে গেছেন, ‘দেশপ্রেম হচ্ছে একটি ডিম, যা ফুটে যুদ্ধের জন্ম হয়।’

অতএব আমরা সবাই অবশ্যই দেশপ্রেমিক হব, তবে অতি-দেশপ্রেমিক হব না এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির প্রতি ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করব না।


তথ্যসুত্র

স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া

বাঙালির স্বদেশপ্রেম

স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই ভিত্তি।

দেশপ্রেম নিয়ে সাতকাহন

দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি

স্বদেশপ্রেমের বিকৃত রূপ

সংকীর্ণ ও প্রগতিশীল স্বদেশ প্রেম

Subscribe for Daily Newsletter