পহেলা বৈশাখ (Bengali New Year)

এটি গােটা জাতির তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ-অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখণ্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে।
বৈশাখ
এলো রে
ঝড়ো হাওয়া বয়ে
বৃক্ষের ডালে নব পল্লবে,
ঘরে ঘরে আনন্দ ধারা নিয়ে;
পুরাতন ধুয়ে মুছে বৈশাখ এলো রে।
পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে একটি অন্যতম দিন। এই দিনে বাঙ্গালী জাতি দল-মত, ধনী-গরীব নির্বিশেষ উৎসবে মেতে উঠে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস সুপ্রাচীন।পহেলা বৈশাখ একসময় গ্রামীণ জীবনের অংশ থাকলেও বর্তমানে গ্রাম এবং শহর উভয়েই সমানভাবে পালিত হয়। কয়েকটি গ্রাম মিলে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এছাড়াও ঢাকার রমনা বটমূলে পালিত হয় মনো মুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার।পান্তা ভাত এবং ইলিশ বাংলা নববর্ষের অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ।

পহেলা বৈশাখ ইতিহাস সম্পর্কে কারো কারো ধারনা পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয় সপ্তম শতাব্দীর রাজা শশাঙ্কের সময় কাল থেকে। পরবর্তিতে মোঘল সম্রাট আকবর পরিবর্তিত করেন রাজস্ব আদায়ের কারনে। মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্রাটরা হিজরি সাল মোতাবেক খাজনা আদায় করত। হিজরি সন চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারনে সম্রাটদের খাজনা আদার করার ব্যাঘাত ঘটতো। এর প্রধান কারন হলো তারা কৃষকের ফসল ওঠার পরে খাজনা আদায় করতো। কিন্তু ফসল ওঠা এবং হিজরি সালের তারতম্য ঘটার কারনে ঠিকভাবে খাজনা আদায়ের কাজে ব্যাঘাত ঘটতো। আর এ কারনেই সম্রাটরা তাদের জোতির্বিদদের দিয়ে বাংলা পঞ্জিকার প্রণয়ন করে। এবং এ সনের নাম দেওয়া হয় ফসলি সন। পরবর্তি কালে তা বঙ্গাব্দ নামকরন করা হয় এবং এ সন কার্যকর করা হয় ৫-ই নভেম্বর ১৫৫৬ সালে যখন সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহণ করেন। এ সনের প্রথম মাস বৈশাখ এবং বৈশাখের ১ তারিখ অর্থাৎ পহেলা তারিখে বিভিন্নি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।এবং এর নাম দেওয়া হয় পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ।
বৈশাখে বাঙালির নাচে মন প্রাণ !!””
মন নাচে প্রাণ নাচে
হাসে কবি গুরু
ঝড় এলে বুক কাঁপে
ভয়ে দুরু দুরু !!
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।

বাংলা নববর্ষের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান বৈশাখী মেলা। পহেলা বৈশাখ বাংলার গ্রাম-গঞ্জে বটেব। মূলে, নদীর কূলে বৈশাখী মেলা বসে। উৎসবমুখর বৈশাখী মেলা মূলত একটি সর্বজনীন লোকজ মেলা। প্রাণের আবেগ আর উইলে পড়া আনন্দে বৈশাখী মেলা প্রাঙ্গণে গ্রাম-বাংলার মানুষ এক অকৃত্রিম উৎসবের আনন্দ খুঁজে পায়। নাগরদোলা, সার্কাস, তাল-পাতৰ ভেঁপু, মাটির খেলনা, হাড়ি-পাতিল, কাঁচের চুড়ি, কারুপণ্য, মণ্ডা-মিঠাই, বাউল গান, লোকগীতি প্রভৃতির সমারোহ বৈশাখী মেলার এক চিরায়ত ঐতিহ্য। নানা রকম জিনিসপত্রের সমারোহে, নানা বয়সী মানুষের সমাবেশে নববর্ষের আনন্দময় রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায় বৈশাখী মেলাতে। আধুনিক সভ্যতা ও ক্ষয়িষ্ণু অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলে বৈশাখী মেলার ঐতিহ্য আজ অনেকটা স্লাদ হয়ে পড়েছে। তবুও বৈশাখী মেলা বাঙালির সংস্কৃতিকে ঐতিহ্যের এক চিরায়ত আনন্দ-উৎসব।

বাংলাদেশে বৃহৎ বাঙালি সমাজের পাশাপাশি রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন উপজাতীয় নৃগোষ্ঠী। এসব নৃগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। এরাও তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে বর্ষবরণ করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পার্বত্য উপজাতীয় নৃগোষ্ঠী আনন্দমুখর পরিবেশে তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বৈসাবি’ পালন করে থাকে। এ উৎসবকে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী ‘বৈসুক’ মারমা নৃগোষ্ঠী ‘সাগ্রাই’ এবং চাকমা নৃগোষ্ঠী ‘বিজু’ নামে আখ্যায়িত করে থাকে। তবে সময় পার্বত্য এলাকায় (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) এই বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
নববর্ষের উৎসব-অনুষ্ঠান একটি সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান। এ বর্ষবরণকে উপলক্ষ করে বাঙালি জীবনে এক আনন্দময় সামাজিক যোগাযোগ ঘটে। নববর্ষ আমাদের সামনে সম্ভাবনার যে নতুন আহ্বান বয়ে মানে তাকে জীবনের আনন্দ ও কল্যাণে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। নববর্ষের উৎফুল্ল মিলনোৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক চেতনা ও মানবিক চেতনা যেন আরো উজ্জীবিত হয়। আমরা যেন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র-চেতনার ঊর্ধ্বে ওঠে পারস্পরিক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিনির্মাণ করতে পারি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী।
উচ্ছ্বাসের এই দিনে নবীন
ছড়াও প্রেমের বার্তা,
তোমরা জাতির ধরবে হাল
আর হবে দেশের কর্তা !!
শোষণ যুলুম রুখে দাড়াও
বাঙালির রঙিন উৎসব বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কামনা করি, হে বৈশাখ তুমি এসো স্নিগ্ধতা আর সুন্দর নিয়ে, পুরনোকে ভুলে গিয়ে, আনন্দময় হয়ে, হতাশা বিদায় দিয়ে। এসো স্নিগ্ধ সাজে বাঙালিপনা নিয়ে, লাল আর শুভ্রতার নান্দনিক চমক নিয়ে, পবিত্রতা আর উৎসবের প্রতীক হয়ে। এসো হে বৈশাখ বৈষম্য দূরের প্রত্যয় নিয়ে, আগামীর উজ্জ্বলতা নিয়ে, বৈশাখী শাড়ির আঁচলে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে, উজ্জ্বল হৃদয়ে উজ্জ্বল আবেগ নিয়ে, বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে আর সমাজের সব কুসংস্কারের আবর্জনা নিরসনের প্রত্যয় নিয়ে। এসো শুধুই শালীন আর নির্মল আনন্দ সহকারে মঙ্গলের প্রতীক হয়ে।