পোলিও টিকা (Polio Vaccine)

পোলিও টিকা (Polio Vaccine)

পোলিও রোগের টিকার নাম OPV ।পোলিও ভাইরাস থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বে দুই প্রকার পোলিও টিকা ব্যবহার করা হয়, যেগুলো মুলতঃ poliomyelitis (পোলিও) নামক রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এই দুই প্রকার টিকার মধ্যে একটিতে অক্রিয় পোলিও ভাইরাস এবং অপরটিতে দুর্বলকৃত পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। এই দুই প্রকার টিকা যথাক্রমে ১৯৫৫ এবং ১৯৬২ সাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এ টিকা দেয়ার ফলে পোলিও ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে না। ফলে পোলিও রোগ নির্মূলে সারা বিশ্বে এ টিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ একে তো পোলিও ভাইরাস রোগীদের মাঝে দীর্ঘদিন অবস্থান করতে পারে না, তথাপি প্রকৃতিতে স্তন্যপায়ীরা ছাড়া অন্য কোনো পোলিও বাহকও নেই, তাছাড়া এ ভাইরাসটি প্রকৃতিতে খুব লম্বা সময়ের জন্য বাঁচতেও পারে না। ফলে এই দুই প্রকার টিকা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ থেকে পোলিওকে বিলুপ্ত করেছে, এবং পৃথিবীতে পোলিও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩, ৫০, ০০০ (১৯৮৮) থেকে মাত্র ২২ (২০১৭) - এ নিয়ে এসেছে।

জোনাস এডওয়ার্ড সল্ক প্রথম পোলিও টিকার উদ্ভাবন করেন

জোনাস এডওয়ার্ড সল্ক প্রথম পোলিও টিকার উদ্ভাবন করেন। ওই টিকাতে তিনি অক্রিয় পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করেন। তিনি এই টিকায় বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহৃত এক ধরনের বিশেষ কোষ (HeLa কোষ) ব্যবহার করেন, এবং ১৯৫২ সালে সর্বপ্রথম এর পরীক্ষা চালান। ডাঃ টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র ১৯৫৫ সালের ১২ এপ্রিল গোটা বিশ্বে এই টিকার কথা ঘোষণা করেন। আলবার্ট সাবিন দূর্বলকৃত পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করে দ্বিতীয় প্রকার টিকা উদ্ভাবন করেন, যা কিনা মুখ দিয়ে খাওয়া যায় (অর্থাৎ ওরাল)। ১৯৫৭ সাল থেকে সাবিনের এ টিকা দেয়া শুরু হয়, এবং ১৯৬২ সালে এর লাইসেন্স করা হয়।

জাতিসংঘের এমডিজি-৪ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ

দেশকে পোলিওমুক্ত রাখা ও পোলিও পুনঃসংক্রমণ রোধকল্পে এর মধ্যেই দেশের শতভাগ শিশুকে টিকা প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসসহ স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যের জন্য জাতিসংঘের এমডিজি-৪ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ।এমনকি নাতিশীতোষ্ণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে টিকা প্রবর্তনের ফলে পোলিওর পতন এবং শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য হওয়ার দিকে পরিচালিত করা হলেও, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের স্বল্প-উন্নত দেশগুলিতে মাত্র ৫শতাংশ স্কুলছাত্রীকে নিয়মিত টিকা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে এই রোগটি ছিল না । একটি সমস্যা হিসাবে বিবেচিত। যাইহোক, যখন ১৯৭০এর দশকে বেশ কয়েকটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে "পঙ্গুত্ব সমীক্ষা" পরিচালিত হয়েছিল, তখন এটি যথেষ্ট আশ্চর্যজনকভাবে জানা গিয়েছিল যে প্রতি ১,০০০ স্কুলছাত্রীর মধ্যে ৫ থেকে ৯ জনের প্যারালাইটিক পোলিওর কারণে পঙ্গুত্বের প্রমাণ রয়েছে। পোলিওর বিরুদ্ধে টিকাদানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে১৯৭৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা টিকাদানের সম্প্রসারিত কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যে শিশুদের টিকাদানের অনুপাত প্রায় ৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়।

1994 সালে সমস্ত পশ্চিম গোলার্ধকে দেশীয় পোলিও মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল৷

১৯৮৫সালেপ্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন , আমেরিকার জন্য ডব্লিউএইচও-এর আঞ্চলিক সংস্থা, ১৯৯০ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বের সেই অংশ থেকে পোলিওর দেশীয় সংক্রমণ নির্মূল করার একটি উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। যা শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার এই রোগ নির্মূলে সাফল্যই নয়, বরং এছাড়াও অন্যান্য দেশের মধ্যে ব্রাজিল এবং কিউবায় সাফল্য। কিউবা ১৯৬২সালে গণ টিকাদান শুরু করে এবং ১৯৫০ এর দশকে প্রতি বছর ২১৪ টি মামলা থেকে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে মোট ৫ টি ক্ষেত্রে নামিয়ে আনে। ব্রাজিল ১৯৮০ সালে একটি টিকাদান অভিযান শুরু করে; সেখানে রিপোর্ট করা মামলাগুলি ১৯৭০এর দশকের শেষের দিকে প্রতি বছর গড়ে ২,৩৩০টি থেকে ১৯৮২ সালে ৬৯টি ক্ষেত্রে নেমে আসে৷ ১৯৯৪ সালে সমস্ত পশ্চিম গোলার্ধকে দেশীয় পোলিও মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল৷

পোলিও একটি স্থানীয় রোগ হিসাবে নাইজেরিয়া , ভারত , পাকিস্তান, আফগানিস্তানের দেশগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল

২০০০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল করার আহ্বান জানানোর জন্য ১৯৮৮ সালে ডব্লিউএইচও'র বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশের সিদ্ধান্তের একটি প্রধান কারণ ছিল আমেরিকার অগ্রগতি।গ্লোবাল পোলিও নির্মূল উদ্যোগ ইউনিসেফ , রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে যোগ দেয় এবং ২০০০ সালের মধ্যে প্যারালাইটিক পোলিওর নতুন মামলার সংখ্যা প্রতি বছর ২৫০,০০০ থেকে কমিয়ে প্রায় ১,০০০-২,০০০এ নেমে আসে। ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও বিতরণের জটিলতা, দারিদ্র্য ও সংঘাতে জর্জরিত দেশগুলিতে রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যাঘাত এবং স্থানীয় কিছু নেতার পক্ষ থেকে সন্দেহ ও প্রতিরোধের কারণে লক্ষ্যমাত্রা বছরের মধ্যে রোগের সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও, পোলিও একটি স্থানীয় রোগ হিসাবে নাইজেরিয়া , ভারত , পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের দেশগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।

পোলিও রোগের কারণ

পোলিও রোগের কারণ পোলিওমাইলাইটিস একটি আরএনএ ভাইরাসজনিত রোগ। পোলিও ভাইরাস রোগীর মলমূত্র দিয়ে বের হয়।যদিও আক্রান্ত রোগীর মলমূত্রে প্রথম সপ্তাহেই অধিক পরিমাণে বের হয়। ছয় থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত তা বের হতে থাকে, অর্থাৎ ওই সময়কাল পর্যন্ত একজন পোলিও রোগী রোগ ছড়াতে পারে। পরে এই জীবাণু মলমূত্র দ্বারা কোনো খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে মিশে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। সাধারণত এই সংক্রমণ শিশু-কিশোরদের মাঝে বেশি দেখা যায়।

পোলিও রোগের লক্ষণ

প্রথম দুই-তিন দিন সাধারণ জ্বর থাকে এবং এরপর জ্বর ভালো হয়ে যায়। চার থেকে ছয় দিন মাথা ব্যথা করে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়। সারা শরীর, বিশেষ করে হাত-পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা করে। পোলিও ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রে কোন অংশে আক্রমণ করল তার ওপর নির্ভর করে অন্যান্য রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

 স্পাইনাল টাইপ : শিশু দাঁড়াতে পারে না। তার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পা দুটি, কখনো হাত দুটি, কোনো কোনো সময় এক হাত কিংবা এক পা প্যারালাইজড অর্থাৎ অবশ হয়ে যেতে পারে।

বালবার টাইপ : স্নায়ুতন্ত্রের যেসব কেন্দ্র শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃত্স্পন্দন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, এ ধরনের পোলিও সেই সব কেন্দ্রকে আক্রমণ করে।

স্পাইনো বালবার টাইপ : এ ধরনের পোলিওতে স্পাইনো ও বালবার দুই ধরনের লক্ষণ একত্রে দেখা যায়।

এনকেফালাইটিস টাইপ : এতে শিশুর মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়। তখন রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

পোলিও রোগের চিকিৎসা

এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হওয়ার কারণে শিশু অজ্ঞান হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে।পোলিও রোগের সুন্দর প্রতিষেধকব্যবস্থা আছে। ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন অথবা ক্ষেত্রবিশেষে ইনজেকশন নেওয়ার সাহায্যে পোলিও থেকে শিশুকে মুক্ত রাখতে হবে।শিশুর ছয় সপ্তাহ বয়স থেকে এক মাস পর পর তিন ডোজ পোলিও ভ্যাকসিন প্রতিবার ডিপিটির সঙ্গে দুই ফোঁটা করে শিশুকে খাওয়ানো গেলে এবং চতুর্থ ডোজ দুই ফোঁটা পোলিও টিকা শিশুর ৯ মাস বয়সে হামের টিকা নেওয়ার সময় খাওয়ানো হলে তা শিশুর দেহে পোলিও প্রতিরোধ করে।

সিভিল সার্জন বলেন, ‘উন্নত এলাকার লোকজন শিক্ষিত হওয়ায় সন্তানকে পোলিও টিকা খাওয়ানোর ব্যাপারে সচেতন। আমরা বেশি জোর দিচ্ছি অনুন্নত এলাকায়। পোলিও হচ্ছে চট্টগ্রামের ভাষায় লুলা ব্যারাম। রোগী দেখে পোলিও হয়েছে এমনটি বলা যাবে না, যতক্ষণ না মল পরীক্ষা করা না হয়। ’ 


তথ্যসুত্র

 পোলিও টিকা, Bangla News24.

পোলিও রোগের কারণ, Kalerkantho.

পোলিওর কারণে পঙ্গুত্ব, Bratannica.

বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত, Bangla News.

পোলিও টিকার উদ্ভাবন, Sattacademy.

Subscribe for Daily Newsletter