মৃৎশিল্প (Pottery)
মৃৎশিল্প বলতে শিল্পকলার একটি শাখাকে বোঝায়, যেখানে কুমোরের মাটি বা এই জাতীয় গঠন-উপাদান দিয়ে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা হয়। টালি, ক্ষুদ্র মূর্তি, ভাস্কর্য এমনকি ব্যবহারিক কারিগরি মৃৎশিল্পে উৎপন্ন কিন্তু শৈল্পিক অভিব্যক্তিবিশিষ্ট খাবার টেবিলের তৈজসপত্রকেও মৃৎশিল্পের একেকটি রূপ হিসেবে গণ্য করা যায়।
মৃৎশিল্প" শব্দটি "মৃৎ" এবং "শিল্প" এই দুই শব্দের মিলত রূপ। "মৃৎ"শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর "শিল্প" বলেত এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে দিয়ে তৈরি সব শিল্পকে কর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায়। এই ধরণের কাজের সাথে জড়িত তাদেরকে কুমার বা কুম্ভকার বলা হয়।
পরিষ্কার এঁটেল মাটি দিয়ে দক্ষ হাতের নিপুণ কারুকার্যে যে শিল্পকর্ম তৈরি হয় তাকেই মৃৎশিল্প বলে। মাটির তৈরি শখের হাঁড়ি, টেরাকোটা, পুতুল, মাছ, পেয়ালা, সুরাই, ফুলদানি- এ সবই মৃৎশিল্পের নিদর্শন। খ) মৃৎশিল্প তৈরিতে নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়। মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি, তবে সব ধরনের মাটি দিয়ে এ কাজ হয় না।
আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে আমরা বলি মৃৎশিল্প। কারণ, এ শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। তবে সব মাটি দিয়ে যে এ কাজ হয় তা নয়। এ কাজে পরিষ্কার এঁটেল মাটির প্রয়োজন হয়। কেননা, এঁটেল মাটি বেশ আঠালো। দোআঁশ মাটি তেমন আঠালো নয়। আর বেলে মাটি তো ঝরঝরে—তাই এগুলো দিয়ে মাটির শিল্প হয় না।
মৃৎশিল্প মানুষের প্রাচীনতম আবিষ্কার। খৃষ্টপূর্ব ২৯ হাজার থেকে ২৫ হাজার অব্দের নব্যপ্রস্তর যুগে এর সূচনা।ইতিহাস অনুযায়ী চীনের বিখ্যাত শহর থাংশান এ মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। নব্যপ্রস্তরযুগে চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রাভেতিয়ান সভ্যতার ডলনে ভোসনিসে, জাপানের জোমোন (খ্রিস্টপূর্ব ১০,৫০০), রাশিয়ার সর্ব পূর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ১৪,০০০), সাব-সাহারান দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এর আবিস্কারের তথ্য পাওয়া যায়।
মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা
প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পেছনে রয়েছে দেশ বা জাতির অবদান। আমাদের দেশের অন্যতম শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক অনেক গভীর। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে দিয়ে তৈরি সব শিল্পকর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায়।
প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আজকাল কুমারপাড়ার মেয়েদের ব্যস্ততা অনেক কমে গেছে। কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না। তবে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো কিছু জরাজীর্ণ কুমার পরিবার ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার এই ব্যবসায়।
মৃৎশিল্প হচ্ছে প্রাচীন শিল্পকলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আদিম মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম উপাদান মাটি দ্বারা মৃৎপাত্র নির্মাণ করেন। মৃৎপাত্র নির্মাণ থেকেই আদিম মানুষের শৈল্পিক চিন্তাভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। মৃন্ময়পাত্র বিশ্বের সব উন্নত সভ্যতায় সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত নিদর্শন মৃৎশিল্পের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। সুদূর অতীতে মানুষ কবে মৃৎপাত্র সৃষ্টি করেছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ধারণা করা হয়, নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। হেনরি মর্গানের (Henry Morgan) মতে, “মৃৎশিল্পের আবিষ্কারকে বন্যদশা থেকে মানুষের উত্তরণের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।”
মৃৎশিল্পের সঙ্গে চীনের বড় একটা ঐতিহ্য আছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে চীনের বিখ্যাত শহর থাংশান-এ মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। চীনের অন্যতম প্রাচীন শহর পেইচিং থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই শহরটি। এই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্কগুলোতে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়।
থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে-এর সময়কালে। এ শহরের রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাস। এখানে নানা ধরনের চীনামাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি ইত্যাদি অন্যতম। বিভিন্ন দোকানে গিয়ে অনেক ক্রেতা এখনো চীনের তৈরি জিনিসপত্র খোঁজ করেন।
চীনা শিল্পের যেমন ঐতিহ্য আছে, ঠিক তেমনি আমাদের দেশেরও আছে। শত শত বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত আছেন। আমাদের দেশে এই ধরনের কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আমরা কুমার বলি। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশ বেশি। পরিবেশ বান্ধব এ শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির তৈরি কলসি, ফুলের টব, সরা, বাসন, সাজের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক, শিশুদের বিভিন্ন খেলনাসমগ্রী নানা ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করত কুমারেরা। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ এঁটেল মাটি, জ্বালানি কাঠ, শুকনো ঘাস, খড় ও বালি।
আমাদের দেশে এই শিল্পের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে। পোড়ামাটির নানাবিধ কাজ, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, টপ, শো-পিসসহ অসংখ্য জিনিস আজও কুমারশালায় তৈরি হয়ে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। কথিত আছে, কাউকে মাটির তৈরি হাঁড়ি কিংবা গণেশের মূর্তি দিলে বিনিময়ে ওই পাত্রে বা মূর্তির পেটে যত চাল ধরে ততটাই দেওয়া হতো শিল্পীকে। মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমারি আসবাবপত্র চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি আজ প্রচুর চাহিদা লক্ষণীয়। তাছাড়া মেয়েদের বিভিন্ন মাটির তৈরি গয়না সহজেই চোখে পড়ে দেশের মেলাগুলোতে এছাড়া বিভিন্ন দোকানে।
মৃৎশিল্প : ইতিহাস আছে, সমৃদ্ধি নেই
মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শেখে এবং পশুর মাংস পোড়ানো খাওয়া শেখে, তখন তাদের দৃষ্টিগোচর হয়, যেখানে মাংস পোড়ানো হতো, সেখানের মাটি পুড়ে সাধারণত একটু শক্ত হয়ে যায়। তখন থেকে আদিম মানুষেরা নিজের প্রয়োজনে নমনীয় মাটি দ্বারা জল বা খাবার সংরক্ষণের প্রয়োজনে মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। তারা নানাবিধ কৌশলে নরম মাটিকে ইচ্ছেমাফিক পাত্রের আকার দিত। মৃৎপাত্রে প্রথমত জ্যামিতিক ফর্মে নকশা আঁকত। তারপর মাটির পাত্রকে আগুনে পোড়াত। পোড়ানো মাটির পাত্রটি অনেক শক্ত হয়ে যেত। তখন থেকে মাটির পাত্রকে তারা ব্যবহারের উপযোগী মনে করে।
মৃৎশিল্পের আবিষ্কার অনুমাননির্ভর হলেও নৃতাত্ত্বিকরা সুদূর অতীতে যে পুরোনো মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ থেকে বাণিজ্যের স্থান ও পথসমূহ নির্ণয় করেছেন, তা থেকে বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। মৃৎশিল্পের ইতিহাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর সব সভ্যতায় মৃৎশিল্পের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। আমেরিকায় খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে মৃৎশিল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীন মৃৎশিল্পীদের মতো এখনো কুম্ভকাররা প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারায় মৃৎশিল্প নির্মাণ করেন। আমেরিকার শিল্পকলায় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আদিবাসীরা। তারা মৃৎদ্রব্য নির্মাণ করত কয়েলিং ও ছাঁচের মাধ্যমে। তারা চাকার ব্যবহার ছাড়াই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মৃৎপাত্র নির্মাণ করত। আমেরিকায় হোহোকাম জাতির এবং মেক্সিকানদের মৃৎপাত্রের সাদৃশ্য বিদ্যমান। তারা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বহু মৃৎমূর্তি নির্মাণ করত। মেক্সিকোর কুইকুইলকো অঞ্চল এবং মেক্সিকোর অববাহিকা ও উপসাগরীয় অঞ্চল অলমেকে (Olmec) মৃৎপাত্রসহ আঙুলে টিপেটিপে বহু পুতুলসদৃশ্য মূর্তি নির্মাণ করত।
মিসরের কিছু কিছু মৃৎপাত্রের সঙ্গে মেসোপটেমিয়া মৃৎপাত্রের অনেক মিল লক্ষ করা যায়। মেসোপটেমিয়া পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রাচীন সভ্যতাসমূহের অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ সভ্যতা। প্রাচীন মিসর ও রোমান মৃৎশিল্পের সঙ্গে ইসলামি মৃৎশিল্পের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ইসলাম ধর্মে প্রাণিচিত্র আঁকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুসলিম মৃৎশিল্পীরা জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিওগ্রাফি, বিমূর্ত নকশা এবং তরুলতা ফুলের নকশা মৃৎপাত্রে ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ইসলামি শিল্পকলায় মৃৎপাত্র ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ইসলামি শিল্পকলায় লক্ষ করা যায় বর্ণিল টালি দ্বারা মসজিদ, রাজপ্রাসাদ অলংকৃত করে। ইসলামি সভ্যতায় মৃৎশিল্পের ব্যবহার, প্রয়োগ ও উৎকর্ষ পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতায় উচ্চস্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষ ব্যবহারে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল। ইসলামি মৃৎশিল্পের উন্নতির শীর্ষে ছিলেন বাগদাদের মৃৎশিল্পীরা।
বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পীরা হলেন মৃৎরাজ মরণচাঁদ পাল, লালচান পাল, হরিপদ পাল, সন্তোষচন্দ্র পাল ও গোবিন্দচন্দ্র পাল প্রমুখ। বৈদিক কাল থেকে শূদ্র শ্রেণির সম্প্রদায়গণ কুম্ভকার নামে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এদের উপাধি পাল। বংশপরম্পরায় এঁরা মৃৎশিল্পে কর্মরত থাকলেও সমকালীন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ পেশা সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষ মৃৎশিল্প পেশায় নিয়োজিত। বর্তমানে এ পেশায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মৃৎশিল্পী বা শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
মৃৎশিল্পের ব্যবহার বৃদ্ধি জরুরী
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়লেও নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। এ শাখার মৃৎশল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি শিল্প। এরা টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খোদাই করে সুন্দর সুন্দর শোপিস তৈরি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মূর্তি, অলঙ্কার, নকশি পাত্র, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করছেন। ঢাকার অনেক দোকানে এসব শৌখিন মৃৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলো ‘মৃৎশিল্প’। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে ‘মৃৎশিল্প’ বলে, এবং যারা এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জরিত তাদের বলা হয় কুমার। কুমররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে।
কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎ শিল্প। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যা নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. অসিত বরণ পাল বলেন, ‘সভ্যতার বিকাশ থেকেই মৃৎ শিল্পের কাজ চলে আসছে। আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগে ঢাকা জেলার ধামরাই এবং সাভারে কয়েকটি পল্লীই ছিল, যারা মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় এ শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। নয়তো লোকশিল্প, তামা কাসা শিল্পের মতো করে মৃৎ শিল্পও একদিন আমাদের থেকে হারিয়ে যাবে।’
বাংলা মৃৎশিল্পের এমন এক জনপথ ঢাকা জেলা। বংশী নদীর পাড় ঘেঁষে কাগজিয়াপাড়া, ধামরাই পৌরসভার পালপাড়া, সাভারের নবীনগর, নলাম, ভাগলপুর সহ একাধিক স্থানে কয়েকশত বছর ধরে তাদের বসতি। তবে কাজের সেই জৌলুস ও ব্যস্ততা এখন আর নেই। বাঁচার তাগিদে অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ধরে রাখলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তারাও জর্জরিত। এ মানুষগুলোকে সহযোগিতা করার কেউ নেই। নেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
দিন বদলের হাওয়ায় বদলে গেছে মৃৎ শিল্পের ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পের জৌলুস, ঐতিহ্য। প্রকৃতিতে ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার। ক্রমেই মানুষ মৃৎ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে, মৃৎ শিল্পীরাও কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বাজারে মূল্য হ্রাস, আয়-ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় বেকার হয়ে অনেক মৃৎ শিল্পী ছুটছেন অন্য পেশায়।
বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলাে মৃৎশিল্প। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। 'মৎ' মানে মাটি আর শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প' বলে, এবং যারা এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জরিত তাদের বলা হয় কুমার। কুমররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানাে সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে।
মৃৎশিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মৃৎসামগ্রী : মাটির কলস, হাঁড়ি, সরা, বাসনকোসন, পেয়ালা, সুরাই, জালা, মটকা, পিঠা তৈরির ছাঁচ ইত্যাদি। মৃৎসামগ্রী যুগ যুগ ধরে আমাদের গৃহকার্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মৃিশল্পী : এ দেশের কুমোর সম্প্রদায় বংশপরম্পরায় এ শিল্প তৈরি করে আসছে
কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎ শিল্প। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যা নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর অন্যতম হচ্ছে মৃৎশিল্প। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও বাহারি নকশার কারণে এই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে যাতে বাইরের রাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায় তার জন্য আরো বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে।
তথ্যসুত্র
মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা, Ittefaq.
মৃৎশিল্প হচ্ছে প্রাচীন শিল্পকলাগুলোর মধ্যে অন্যতম, Songbadprokash.
মৃৎশিল্প মানুষের প্রাচীনতম আবিষ্কার, Quora.
মৃৎশিল্প : ইতিহাস আছে, সমৃদ্ধি নেই, Odhiker News.
বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, Local Guides Connect.
প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প।, Prothom Alo.
ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, Bangla Insider.