বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং প্রতিকার (Power Outages and Solutions)

বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং প্রতিকার (Power Outages and Solutions)

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সমানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একটি দেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বাড়বে, সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত বেশি হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ৫৬ শতাংশ বাসাবাড়িতে, ২৮ শতাংশ শিল্পে, ২ শতাংশ কৃষিতে ও ১২ শতাংশ ব্যবহার হয় বাণিজ্যিক খাতে।

বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, দেশে প্রতিদিন বিদ্যুৎ চাহিদা স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট, তবে চলতি বছরে দাবদাহের কারণে চাহিদা তৈরি হয় ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এই সময়ে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি থেকেছে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশকে মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেল, কয়লা ও সোলার এনার্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ৫১ শতাংশ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, ২৬ শতাংশ উৎপাদন হয় ফার্নেস অয়েল থেকে ও বাকি অংশ উৎপাদন হয় অন্যান্য উৎস থেকে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য জ্বালানি হলো প্রাকৃতিক গ্যাস

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য জ্বালানি হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। একসময় বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৮০ শতাংশ উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, বর্তমানে তা কমে ৫১ শতাংশে নেমেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ পেট্রোবাংলা নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারেনি এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস- এলএনজি) বাংলাদেশে ব্যবহার হয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য দুই থেকে চার গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও জরুরি

ঘরে ঘরে আলো জ্বালব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের একটা ঘরও আর অন্ধকারে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এরূপ বিপুল আশ্বাস পেয়ে জনগণ আশান্বিত হলেও একটি তথ্য কিছুটা হলেও জনগণকে হতাশ করেছে। সেটি হলো বাংলাদেশ এখন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে এশিয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তবে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে চাহিদাও বেড়েছে ব্যাপক। তাই এ কথা স্পষ্ট, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও জরুরি।

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সরকারের শিরস্ত্রাণের সবচেয়ে রঙিন পালকটি নি®প্রভ হয়ে পড়ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত ছয় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে যতটা নজর দেয়া হয়েছে, সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণে ততটা নজর দেয়া হয়নি। সাধ ও সাধ্যের বৈপরীত্যও হয়তো এজন্য দায়ী। তা ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি, অবৈধ সংযোগ, বিদ্যুৎ পাচার, পুল ও তার সংযোগ স্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা, অতিরিক্ত বিল আদায় করাসহ নানা অসঙ্গিমূলক কাজের কারণেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যাচ্ছে।

গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বৃহদায়তন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসন করা যেতে পারে

এসব সমস্যার রোহিতকরণ ছাড়া বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রতিকার সম্ভব নয়। আবার ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে পানি, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বৃহদায়তন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসন করা যেতে পারে। তবে আমরা আশা করি, এ সমস্যার গ্রন্থিমোচনে বিদ্যুৎ বিভাগ জরুরিভাবে পদক্ষেপ নেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে সঞ্চালন ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। বিদ্যুৎ যেমন আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গ তেমনি উন্নয়নের হাতিয়ার। তাই জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিদ্যুতের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

রাজধানীতে এ সমস্যা কিছুটা কম হলেও মফস্বল ও জেলা শহরগুলোতে এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই সমস্যা নিরসনকল্পে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লিখেও কোনো প্রতিকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সাধারণত বৃষ্টি মৌসুমে কম-বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যায়। তবে গ্রামাঞ্চলে কথিত আছে মেঘ দেখে বিদ্যুৎ পালায়। কিন্তু বতর্মানে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই তবুও নিয়মিত চলে বিদ্যুতের আসা যাওয়ার খেলা। কোনো কারণ ছাড়াই কেন এই পুনঃ পুনঃ বিদ্যুৎ বিভ্রাট? বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সরকারের কতার্ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে বিদ্যুৎ-এর কোনো ঘাটতি নেই।

লোডশেডিং শব্দটা নিয়েও তাদের ঘোরতর আপত্তি। তবে তারা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সাব-স্টেশনের অভাব রয়েছে। ফলে বিদ্যুতের পযার্প্ত সরবরাহের মধ্যেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট কোনো কোনো এলাকায় ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন মাগরিব এর আজান দেওয়ার সাথে সাথে লোড শেডিং শুরু হয়, যা স্থায়ী হয় রাত ১০-১১টা পযর্ন্ত। প্রতিটি স্কুল কলেজে শুরু হতে যাচ্ছে বাৎসরিক পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর আগে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে অবাধে চলছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষাথীের্দর পড়ালেখার উপযুক্ত সময়। মফস্বলের শিক্ষাথীের্দর পড়তে হচ্ছে চরম বিপাকে। 

বিদ্যুৎ বিভ্রাট: শিল্প উৎপাদনের স্বার্থে সমাধান করুন

বর্তমানে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে; কিন্তু তারপরও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়ে ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে শিল্প-কারখানাকে, যা খুবই দুঃখজনক। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে যেমন কেমিক্যাল নষ্ট হয়ে উৎপাদনকারীর ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়, তেমনি শ্রমিকদের কাজে ব্যাঘাত ঘটে ও কাক্সিক্ষত মাত্রায় উৎপাদন করা যায় না। ফলে অনেক ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয় শিল্পোৎপাদকদের। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিদ্যুতের উৎপাদন কম হওয়ার কারণে লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কবলে পড়তে হচ্ছে না; বরং পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও কেবল দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে হরহামেশা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শিল্পোৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্প-কারখানা অঞ্চলগুলোতে হলেও শক্তিশালী বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নিশ্চিত করা

বিদ্যুতের উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশনের অপ্রতুলতা, সরকারের অনেক আগের উদ্যোগ থাকলেও বিভিন্ন জেলায় ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন বসানোর কাজ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের কোথাও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। বিতরণ লাইনের সক্ষমতার অভাবে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কালবৈশাখীর মতো ঝড়েও অনেক ক্ষেত্রে এসব সঞ্চালন লাইন দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং দেখা দেয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। অথচ প্রয়োজন ছিল শিল্পোৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্প-কারখানা অঞ্চলগুলোতে হলেও শক্তিশালী বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নিশ্চিত করা। বিতরণ কোম্পানিগুলোরও অভিযোগ, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকার পরও লাইনের সমস্যার কারণে তা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিদ্যুতের অপচয় রোধ ও শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ লাইনে মনোযোগ দেয়া দরকার।

দ্রব্যমূল্যের চিত্রটি নাগরিকদের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। একটি উপাদান হলো বণ্টন সংকট। সাধারণ নাগরিকের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন এটা নয়, এটা নির্দ্বিধায় শোষণ ও বঞ্চনা। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১৪ তে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা এভাবে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা। অনুচ্ছেদ ১৫ এর ‘ক’ ধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ, জনগণের বেঁচে থাকার সামগ্রিক শর্ত নির্মাণে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। ধারাসমূহ খেয়াল করলে দেখা যায়, কৃষক-শ্রমিক এবং অনগ্রসর জনগণের কথা বলা হয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ

এখন যদি আমরা মিলিয়ে দেখি দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি ও বিদুৎ সংকটে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, নিঃসন্দেহে শহরের মধ্যবিত্ত চাকুরে শ্রেণি, শ্রমিক-কৃষক এবং অনগ্রসর অংশ। সুখ বলে একটি প্রত্যয় সমষ্টির মাঝে প্রতিষ্ঠার দাবি রাখে। সংকীর্ণভাবে এটা বলা যায়, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মতো মৌলিক প্রয়োজন ন্যূনতম মাত্রায়ও যদি পূরণ হয়, তবে বলা যায় মানুষ সুখে আছে। সরকারের তিনটি বিভাগ- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং সমন্বয়হীনতার তীব্রতা যতটা পরিণাম বয়ে আনে, সেসবের মধ্যে অন্যতমটি হলো পরিচালন ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দেয়া। এই ভঙ্গুরতাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ।

প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে জমি সেচ দিতে না পারলে খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে

বিদ্যুৎ সংকট একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবারও ক্ষতি করছে। বিশেষত অপারেশন করার সময় লোডশেডিং হলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাছাড়া অনেক মুর্মূষু রোগী আইসিইউ ও সিসিইউতে থাকে লোডশেডিং তাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে। এভাবে হাসপাতালে হাজার হাজার রোগীর জীবন সংকটাপন্ন করতে পারে লোডশেডিং। কৃষি খাতে সেচের জন্যও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে জমি সেচ দিতে না পারলে খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে, যা খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াবে।

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ গ্যাসসংকট

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা স্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, গ্যাসের সংকটের কারণে এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে গ্যাসের সরবরাহ একটু কমে গিয়েছে। এই সরবরাহ কমে যাওয়ায় একটু প্রেসার পড়েছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে।’এ কারণে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।তিনি বলেন, ‘গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে বলেই এটা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে কাজ চলছে।’

বর্তমানে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৫৭টি। সেখানে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ঘাটতি থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন কমে আসে, তেমনি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আর তাই বুধবার থেকে পিক আওয়ারে অর্থাৎ বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি ফিলিংস্টেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও পরে সেটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, এই সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বহাল রাখার কথা বলা হলেও অক্টোবরের মাঝামাঝি এসে তুলে নেয়া হতে পারে।গ্যাসের চাহিদার কারণে যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে, সেটি জানা গিয়েছে আরও একটি মাধ্যম থেকে।সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মঙ্গলবার পেট্রোবাংলার সভা হয়। সভা শেষে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন ও মাইনস) আলি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, দেশে এখন এলএনজির ঘাটতি রয়েছে, যার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিয়েছে।আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সিএনজির কারণে ৮২ থেকে ৮৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস খরচ হয়। তবে এটা বেশি দিন লাগবে না।‘নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে। আর এই সময়ে এলএনজি দেশীয় সোর্স থেকে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করবে। এর মধ্যেই উৎপাদন ঠিক হবে।’

বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সঞ্চালক ব্যবস্থা

বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সঞ্চালক ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটাই সমাধান হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্য অনেক দেশের মতো বিদ্যুৎ-সংকটে পড়েছে বাংলাদেশও।

জনসচেতনতার পাশাপাশি সরকারকে কঠিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে

জনসচেতনতার পাশাপাশি সরকারকে কঠিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে যা যা করা দরকার তা করাসহ বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্তা-কর্মীর যোগসাজশে পাওয়া অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্নকরণ ও সিস্টেম লস সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যবস্থা নিতে হবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সুষমভাবে বণ্টনেরও। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি আনুকূল্যের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। এ ছাড়া এনার্জি সেভিংস বাল্ব কমমূল্যে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ করাসহ সবদিক বিবেচনায় নিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ব্যর্থ হলে চড়া মূল্য দিতে হবে জনগণ তথা গোটা দেশকে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

বিদ্যুৎ বিভ্রাটে এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ

বিদ্যুৎ বিভ্রাট বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি কেমন সেটা জানার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা কতটা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পায় সেটা জানা। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এক মাসে গড়ে ৬৫ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। নেপালে এক মাসে এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে মাসে ৫১ বার, পাকিস্তানে ৩১ বার। এ ছাড়া আফগানিস্তান ও ভারতে মাসে গড়ে ১০ বারের বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়ার আর কোনো দেশে মাসে গড়ে ১০ বারের বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে না।

বিভ্রাটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণেও বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের সারিতে। বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৩ শতাংশ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের দুর্বলতার কারণে নষ্ট হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ চাহিদার (পিক আওয়ার) সময়ে দৈনিক গড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এডিবির হিসাব বিবেচনায় নিলে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে উৎপাদিত ৮ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে অপচয় হয় ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

তবে বিদ্যুৎ অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেপাল। দেশটিতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৩০ শতাংশই বিতরণব্যবস্থার সমস্যার কারণে নষ্ট হয়। নেপালের পরে বেশি বিদ্যুৎ নষ্ট হয় যথাক্রমে কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, কিরগিজ রিপাবলিক, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, হংকং ও আজারবাইজানে। এরপরেই বাংলাদেশের অবস্থান।প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এশিয়ায় গড়ে বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে গড়ে ৬ শতাংশ।

গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে দেশটিতে কৃষি উৎপাদন, শ্রমিকের মজুরি ও কর্মদক্ষতা বেড়েছে, পণ্য উৎপাদনের খরচ কমেছে। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি উপকৃত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সড়কের মান ও রেলপথের পরিমাণ আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে এডিবি।

টেলিযোগাযোগ খাতে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ভালো উন্নতি করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময়ে দেশটিতে মুঠোফোন ব্যবহারে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ শতাংশ। সুপেয় পানির বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নগর অঞ্চলে গড়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ লোকের বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে।প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল এশিয়ার অবকাঠামোর উন্নয়নে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২৬ লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এ জন্য প্রতিবছর ব্যয় করতে হবে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার।


তথ্যসুত্র

এশিয়ায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট, Prothomalo.

 বিদ্যুৎ স্টোর করে, Ajkerpatrika.

বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে, Newsbangla24.

বিদ্যুৎ ব্যবহার, Bonikbarta.

বিদ্যুতের লাগামহীন ভোগান্তি, Dailyjanakantha.

বিদ্যুৎ উৎপাদন, Jugantor.

বিদ্যুৎ বিভ্রাট আঞ্চলিক ও জাতীয়, Jaijaidinbd.

 বৃষ্টি মওসুমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট , Dailynayadiganta.

Subscribe for Daily Newsletter