বর্ষাকাল (Rainy Season)

বর্ষাকাল (Rainy Season)

গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষা। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে প্রকৃতি যখন জ্বলেপুড়ে যেতে থাকে, তখন শান্তির পরশ নিয়ে আসে বর্ষাকাল। দিনরাত অবিরাম বৃষ্টির ধারা প্রকৃতিকে করে তােলে শান্ত ও মনােরম। আকাশে সারাদিন চলে মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি।

টাপুর টুপুর
রিম ঝিম-ঝিম বৃষ্টি
আকাশ উপুড়
ঝাপুর ঝুপুর
বন্ধ চোখের দৃষ্টি

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ বর্ষা আসে সম্পুর্ণ ভিন্ন সাজে।গ্রীষ্মের পরই বর্ষার আগমন ঘটে।আষাঢ় শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। ঋতুবৈচিত্রের এই দেশে এ সময় বাংলা লাভ করে এক ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর অতি ভৈরব হরষে’ সজল গুরুগম্ভীর বর্ষার নব আবির্ভাব। বর্ষা বাংলাদেশের অকাশে, ও মাটিতে আনে রং ও রসের অফুরন্ত উপহার। সে রূপকথার রাজপুত্রের মতাে ছুটে আসে। তার রথের মর্মরধ্বনি শােনা যায়, তার বাঁকা তলােয়ার ঝলসে ওঠে। এসময় মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, নদী-নালা, খাল-বিল, জলপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রকৃতির খরতপ্ত দিনের হয় অবসান, মাটির কঠিন বাধা ছিন্ন করে শস্য শিশুর দল আবির্ভূত হয়। তাদের হাতে থাকে নব-অঙ্কুরের জয় পতাকা। আসে পুষ্প বিকাশের লগ্ন। রূপ-রস-বর্ণ-শব্দ-গন্ধ গীতে বর্ষার সমারােহ-উতসবে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস ভরে ওঠে। কবি রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,

এই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে, জলসিঙ্ক্ষিত ক্ষিতিসৌরভরভসে

গ্রামের নদী-নালা, ডােবা-পুকুর, খাল-বিল সব পানিতে থৈ থৈ করে। নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। ফলে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যেই কৃষকের মাঠে যায়, গৃহিণীরা গৃহের কাজকর্ম করে। নদীতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। খাল-বিলে শাপলা ফুলের সমারােহ দেখা যায়। শহরে বর্ষার অবস্থা। বর্ষায় শহরের নিম্নাঞ্চলগুলাে মাঝে মধ্যে প্লাবিত হয়। বাইরে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবুও প্রয়ােজনের তাগিদে মানুষকে বাইরে যেতে। যাতায়াতে দুর্ভোগ পােহাতে হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে কাঁচা তরকারির দাম বাড়ে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্রের কষ্ট বেড়ে যায়।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের কানে বর্ষার আগমন বার্তা জানান দিয়ে যায়। এ বৃষ্টির রয়েছে ভৌগোলিক কারণ। গ্রীষ্মকালে মৌসুমি বায়ু ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং উত্তর-পূর্বে বয়ে যায় প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প বুকে ধরে। হিমালয়ের গায়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তা বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।

বর্ষার আগমন বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য প্রতীক্ষার সমাপন। গ্রীষ্মের রোদে যখন প্রকৃতি শুষ্কপ্রায়, মৃতপ্রায়; একফোঁটা বৃষ্টির জন্য যখন মানুষ ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ বলে গান গেয়ে ওঠে; খরতাপে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত কুকুরটির যখন তৃষ্ণায় জিভ ঝুলে যায়, এক পশলা বৃষ্টি তখন নতুন মাত্রার ছন্দ নিয়ে অবসান ঘটায় সব প্রতীক্ষার। পরিপূর্ণতা দেয় সকল প্রত্যাশার আর শীতল করে দেয় সব তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের উত্তাপকে। অদ্ভূত সুন্দর শিহরণে শিহরিত হয় প্রকৃতি। টিনের চালের ঝুম বৃষ্টির নৃত্যে মুখরিত হয় গ্রামবাংলা। সাথে নেচে ওঠে বর্ষা-প্রেমিক মানুষগুলোর মন।

বাংলার সংস্কৃতিতে একাকার হয়ে মিশে আছে বর্ষা ঋতুর ভেজা সৌন্দর্য। বর্ষাকে নিয়ে বাংলায় যতো গান রচিত হয়েছে, অন্য কোনো ঋতু নিয়ে তা হয়নি। রবীন্দ্র সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বর্ষা ঋতুর বন্দনা, বর্ষার সৌন্দর্য বন্দনা। রবীন্দ্রনাথের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ কিংবা ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর ভাদর দিনে’ প্রভৃতি গান আজও বৃষ্টির দিনে আমাদের ভাবনার জগতে টেনে নেয়। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন পল্লীর আরশিতে বর্ষাকে যেভাবে প্রতিফলিত করেছেন তা সত্যিই অতুলনীয়।

বর্ষাকাল সব সময়ই বাঙালির মুখে হাসি ফোটায় তা নয়। খরস্রোতা নদী মাঝে মাঝে লাগামছাড়া হয়ে বান ডাকে, ভাসিয়ে নেয় উপকূলের অনেক মানুষের বসতবাড়ি। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদি বর্ষাকালেই বেশি আঘাত হানে। অতিবৃষ্টির ফলে অনেক সময় ফসল নষ্ট হতে পারে, আবার কখনো তা মানব জীবনে স্থবিরতা এনে দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর অনেক মহামারী ছড়িয়ে জনজীবনকে বিষিয়ে তোলে।

বর্ষার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি বর্ষার অপকারিতাও কম নয়। বৃষ্টির পানিতে পল্লির রাস্তাঘাট কাদায় ভরে ওঠে এবং কোনাে কোনাে জায়গা পানিতে ডুবে যায়, চলাচলের অসুবিধা হয়। দিনমজুররা হয় ঘরে আবদ্ধ; তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। গরিবের ভাঙা চালা দিয়ে পানি পাড়ে ঘর ভেসে যায়। ময়ুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে মেঘের গুরু-গুরু মাদল বালিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ঝরে পড়ে বর্ষা। উত্তর দিক থেকে নেমে আসে মরণঢালা ভয়ংকরী বন্যা। এসময় দূষিত পানি পানের ফলে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রােগ মহামারি আকার ধারণ করে।

বর্ষণমুখর সন্ধ্যার একটা নিজস্ব রূপ আছে। তা একান্তে অনুভব না করলে তার মহিমা বােঝা যায় না। হৃদয়ের বেদনা স্মৃতিমুখর সন্ধ্যায় বুক ভরে জেগে থাকে। হৃদয় এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। বিরহী বকুল হৃদয় শাখায় সুবাস ছড়ায়; একটা অলস অতলতা মনের গভীরে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে। সে যে কী অনুভূতি, কী যন্ত্রণা বলে বােঝানাে যায় না-

“কী জানি কী হলাে আজি,
ওরে জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,উথলি উঠছে বারি”-র মতাে।

বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ছায়ায় বনভূমি শ্যামল হয়ে ওঠে। বর্ষা মনকে সহজ, সরল ও সৃষ্টিশীল করে তােলে। মন হয় উদাস। এমন দিনে মন যেন কারাে নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। তাই কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন চুল ছল জলধারে
বেনুবানে বায়ু নাড়ে এলােকেশ, মন যেন চায় কারে।

অপূর্ব রূপশ্রী নিয়ে বর্ষা এদেশে আগমন করে। বর্ষার অপকারের চেয়েও উপকার অনেক বেশি। বর্ষা না হলে আমাদের দেশ মরুভূমিতে পরিণত হতাে। শুধু বর্ষার কারণেই এদেশ সুজলা-সুফলাশস্য-শ্যামলা অনিন্দ্যসুন্দর হয়েছে।


তথ্যসুত্র:

বর্ষাকাল রচনা, BengaliForum.

“বর্ষাকাল” রচনা [২০টি পয়েন্ট] PDF, Explorebogura.

Subscribe for Daily Newsletter