দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি (Rising commodity prices)

দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি  (Rising commodity prices)

শরীরের মেদ কমাতে মানুষ নানাভাবে ‘ডায়েট’ করে। এখন সীমিত আয়ের সংসারগুলো ‘ডায়েট’ করছে, মানে খরচ কমাচ্ছে। সাধারণ একটি সংসারে খাওয়ার জন্য দিনে যা লাগে, তার বেশির ভাগের দামই বাড়তি অথবা চড়া।মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় সর্বশেষ যোগ দিয়েছে চাল। মোটামুটি আয়ের পরিবারে সবচেয়ে জনপ্রিয় মিনিকেট চালের দাম কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের এক কেজি চাল কিনতে লাগছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা। ভালো মানের মোটা চালের দাম দুই টাকার মতো বেড়ে কেজি উঠেছে ৩৫ টাকায়।চালের আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে বেড়েছিল মোটা দানার মসুর ডালের দাম। কেজিতে প্রায় ২০ টাকা। এ ডাল আবার নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি কেনে। অ্যাংকর ডাল ও মুগ ডালের দামও কিছুটা বাড়তি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের সংসার চালানোই দায়

নভেম্বর থেকে কয়েক ধাপে বেড়েছে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম, লিটারে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বোতলের তেলও লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চিনির দাম কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে। আটা নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু ময়দার দাম অনেক দিন ধরেই চড়া।দেশি পেঁয়াজের কেজি এখনো ১০০ টাকার নিচে নামেনি। নতুন করে ১০ টাকা বেড়ে চীনা রসুন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় উঠেছে। দেশি রসুনের কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। আদা কিনতেও প্রতি কেজি ১৪০ টাকা লাগছে। শীত প্রায় শেষ, শীতের সবজির দাম এবার এখনো ততটা কমেনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে ঢাকায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, যা আগের বছর বৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশ। ক্যাব বলেছে, গেল বছর জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেশি হারে বাড়ত, যদি চাল, ডাল, তেল, চিনির দাম কম না থাকত। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই দেখা গেল, চাল-ডালের দামই বাড়তি।

এভাবে মূল্যবৃদ্ধি কতটুকু চাপ তৈরি করেছে, তা জানতে গত তিন দিনে অন্তত ১০ জনের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের একজন একটি বেসরকারি ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, নাম গোলাম কিবরিয়া। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন কাঁঠালবাগানে। দুই শয়নকক্ষের বাসাটির ভাড়া ১৬ হাজার টাকা, সঙ্গে সেবা মাশুল বা সার্ভিস চার্জ ৩ হাজার। তিনি বলেন, ৬৫ হাজার টাকা বেতনেও তাঁর সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। জানুয়ারিতে বাসাভাড়া ১ হাজার টাকা বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেতন না বাড়লে তিনি ৩ হাজার টাকার একটি মাসিক সঞ্চয় স্কিম ভেঙে ফেলার চিন্তা করছেন।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

জ্বালানি তেল ও সিন্ডিকেটের কারনে দ্রব্যমুল্যের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে।বর্তমানে সময়ে  অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দ্রব্য বা সেবার ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সম্প্রতি চাল, ডাল, তেল, সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এতে করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে চরম দুর্দশা দেখা দিচ্ছে।

প্রায় সব দ্রব্যমূল্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তবে যত দিন যাচ্ছে বাজারে ততই দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়ছে। দাম না কমায় বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। তবে জ্বালানি তেলের দাম কমলে সব সবজির দামই নাগালের মধ্যে চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন ক্রেতা- বিক্রেতারা।বাজার দরের ব্যাপারে অনেকে মনে করেন, বর্তমানে ব্যবসা চলে গেছে সিন্ডিকেটধারীদের হাতে। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন দাম বাড়ানো যায়। সারাদেশে তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করছে।তারা মনে করে সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং করলে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনজীবন দুবির্ষহ হয়ে উঠছে

চাল, তেল-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশচুম্বি মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন দুবির্ষহ হয়ে উঠছে। তরিতরকারি, চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশচুম্বি মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে চরম নাভিশ্বাস উঠেছে।সরকার জনগনের সম্পদ লুটপাটে সফল হলেও সাধারন জনগনের প্রধান সমস্যা দ্রব্যমুল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রন করতে ব্যার্থ হয়েছে। ১০ টাকা চাল খাওয়ানোর মিথ্যা শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে ১২ বছরেও জনদুর্ভোগ নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করেনি।

তিনি আরো বলেন, সরকার দলীয় কালোবাজারী সিন্ডিকেট চক্র সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। আর এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত সরকারদলীয় লোকজন। ফলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।দেশজুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ জীবনের তাগিদে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।

মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ

মূল্যস্ফীতি বাড়তি

পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশে ওঠে। পরের তিন মাস ওঠা–নামার মধ্যে ছিল। নভেম্বরে এসে তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ছিল ২৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের মাস ডিসেম্বরে অবশ্য তা কিছুটা কমেছে। দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে।অবশ্য বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা বেশি জানুয়ারিতে। ফলে এ মাস শেষ হলে মূল্যস্ফীতির আসল চিত্রটা দেখা যাবে। এ ছাড়া অশনিসংকেত হলো, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়তি।

সরকার কী করছে

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কয়েক মাস ধরে বেশ কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। তবে বাজারে তেল, চিনি ও ডালের দাম বাড়লেও টিসিবির কার্যক্রম নেই। তারা পবিত্র রমজান মাসে এসব পণ্য বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে।বিশ্ববাজারে তেল-চিনির দাম বাড়তির দিকে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন (বিটিসি) পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারকে কর কমানোর সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

তবে এ বিষয়ে অগ্রগতি কী, তা গত রাতে তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন।সরকার বলছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সোমবার ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে বৈঠক করেছে।বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বিবিসিকে বলেছেন, পেঁয়াজ-ভোজ্যতেল-চিনিসহ যে ক'টি পণ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমদানি করা হয়, সেগুলোর দাম কমানোর জন্য শুল্ক প্রত্যাহার এবং শুল্ক হ্রাসের জন্য রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এরকম অনুরোধ জানানোর পর আগেও এনবিআর শুল্ক কমিয়েছিল বা কোন ক্ষেত্রে প্রত্যাহার করেছিল, ফলে দাম কমেছিল।

মি. মুন্সী আশা করছেন এবারো দ্রুতই এনবিআর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে এবং দ্রুত সমাধান হবে।এছাড়া দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া ছাড়াও আড়তদারেরা পণ্য মজুদ করছে কিনা তা মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এক্ষেত্রে কেউ পণ্য মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আয় কত বাড়ছে

পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে মানুষের আয় বাড়ার চিত্রটা দেখা যায়। কিন্তু এ জরিপ সর্বশেষ ২০১৬ সালে করেছে বিবিএস। এতে দেখা যায়, আয়ের দিক দিয়ে সবচেয়ে নিজের স্তরে থাকা ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪ হাজার ৬১০ টাকা, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৫৩৯ টাকা কম।বিপরীতে সবচেয়ে উচ্চ আয়ের পরিবারে মাসিক গড় আয় ৯ হাজার ৪৭৭ টাকা বেড়ে ৪৫ হাজার ১৭২ টাকা দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ জরিপে সবচেয়ে ধনীদের প্রকৃত হিসাব আসে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। সার্বিকভাবে বিবিএসের হিসাবে, আয়বৈষম্য অনেকটাই বেড়েছে।

এখন কী অবস্থা, তা কিছুটা বোঝা যায় বিবিএসের মজুরি হার সূচক দেখে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মজুরি হার সূচক বিশ্লেষণ করে বলেন, নির্মাণ খাত ও মৎস্য খাতে প্রকৃত মজুরি বাড়ার বদলে কমছে। আর সেবা ও কৃষি খাতে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ১ শতাংশীয় বিন্দুর কম। তবে উৎপাদনশীল খাতে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ২ শতাংশীয় বিন্দুর বেশি।

প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি হিসাব করা হয় মজুরি বাড়ার হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিয়ে। সাধারণভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশীয় বিন্দু। সর্বশেষ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে বৃদ্ধির গতি কমেছে বলে উল্লেখ করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।এখনকার বাজার পরিস্থিতি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জীবনমানে প্রভাব ফেলে। ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। অনেক সময় মানুষকে সঞ্চয়ে ছাড় দিতে হয়।

মূল্যস্ফীতি কী, কেন বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম, কতটা বেড়েছে

গৃহিনী লাবনী আহমেদ সিদ্ধেশ্বরীর অধিবাসী। তার দাবি ঠিক এক বছর আগেও তার বাজার খরচ ছিলো এখনকার অর্ধেক।"গরুর মাংসের দাম একশ টাকা বেড়েছে। সয়াবিনের কী অবস্থা সেটাই তো সবাই জানে। বাজারে এমন কোন পণ্য নাই যেটার দাম বাড়েনি। সেই বাড়াটাও ১/২ টাকা না। কোনটি প্রায় দ্বিগুণ," দাম বাড়ার প্রসঙ্গে বলছিলেন তিনি।আর এভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াই হলো মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ বেশি টাকা দিয়ে এখন পণ্য বা সেবা কিনতে হচ্ছে।বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে।

দ্রব্যমূল্য: মূল্যস্ফীতিতে টালমাটাল বিশ্ব, বাংলাদেশ খাপ খাওয়াচ্ছে কীভাবে

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমান দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেকদিন ধরেই টালমাটাল। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পেরে দেশটি নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। গভীর সংকট হাতছানি দিচ্ছে এ অঞ্চলের আরেক দেশ নেপালকেও। তবে সেরকম সংকটে না পড়লেও বাংলাদেশের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতিতে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরীব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, গত এক যুগের মধ্যে পুরো বিশ্বই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে আছে।আর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানী তেলের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে - স্থানীয় বাজারে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরণের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি এবং কোভিডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেয়ার কারণে।আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব তো আছেই। যদিও এটি কীভাবে কতদিন অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে তা এখনো অজানা।

মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কেমন, কবে কমবে

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে সব খাদ্য পণ্যের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।করোনা আর যুদ্ধের প্রভাবে উন্নত বা গরীব কোন দেশই এখন আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাইরে নেই।কোভিডে নাগরিকদের বড় ধরণের প্রণোদনা দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার রেকর্ড গড়েছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে সাত শতাংশে ঠেকেছে।আর ব্রিটেনে জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিক্ষোভও করেছে মানুষ। ইউরোজোনে যে উনিশটি দেশে ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা হয় সেসব দেশে এই জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিলো পাঁচ শতাংশের বেশি, যা ২৩ বছর আগে ইউরো চালুর পর সর্বোচ্চ।

কেবল ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, এশিয়ার দেশগুলোও জর্জরিত একই সমস্যায়।জাপানে যেখানে আশির দশকের মন্দার পর ধারাবাহিকভাবে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছিলো বলে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক, সেই দেশটিতেও গত ডিসেম্বরে প্রায় ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।আবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ডিসেম্বরে সাড়ে পাঁচ শতাংশ পার হয়েছিলো।আর পাকিস্তানে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ শতাংশ এবং সেখানে খাদ্য-পণ্যের দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছিলো।এর জের ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সেখানে উত্তাল হয়ে নানা সমীকরণে শেষ পর্যন্ত পতন হয়ে গেছে ইমরান খানের সরকারের।আর বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন হলেও নানা সংস্থার হিসেবে এখন মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের মতো।

বাংলাদেশ: মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কেমন ছিলো, হয়েছে কেমন

দুই হাজার একুশ-বাইশ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।অথচ ফেব্রুয়ারিতেই মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা গত প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৭।সরকারি এই সংস্থাটির হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে দেশের গ্রাম এলাকায় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশে উঠেছিলো।তবে কবে এই পরিস্থিতি ঠিক হবে তা কারও ধারণায় নেই বরং বলা হচ্ছে এই বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেশিই থাকবে।তবে চূড়ান্ত পরিস্থিতি নির্ভর করবে ইউক্রেন যুদ্ধ কবে কিভাবে শেষ হয় তার ওপর।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে চাপে ভোক্তা

সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে।বৈশ্বিকভাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাহিদা বৃদ্ধি, মালামাল পরিবহনে খরচ বৃদ্ধি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতার কারণে বেড়েছে।সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই ধীরে ধীরে মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি তাদের জন্য বাড়তি বোঝায় পরিণত হয়েছে।'তিনি যোগ করেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। তবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী কর কমাতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে যেসব উপকরণ রয়েছে তা সদ্ব্যবহারের এখনই উপযুক্ত সময়।'

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করুন

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, তেল, নুন, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে, মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফলে আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, সম্প্রতি ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি কমেছে এমন ১৫টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক, সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম নেই। ওই ১৫টি দেশে যে গতিতে দারিদ্র্য কমেছে, বাংলাদেশে কমেছে এর চেয়ে কম গতিতে।

এর কারণ হিসেবে বলা যায়, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না।আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ যে নেই তাতো আরও সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল পেঁয়াজ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড দেখে।

অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাজারে চাহিদা ও জোগানের ওপর দব্যমূল্য নির্ভর করে; কিন্তু এ সংজ্ঞা এখানে ফেল করেছে। জানা যায়, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন। বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।বাজারে প্রচুর সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় গিয়ে ঠেকল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রয় হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি। সরকারি উদ্যোগ, পত্রিকায় লেখালেখি, আলোচনা, সমালোচনা বহু কিছু হলেও ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম কমায়নি, বরং অনেক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পেঁয়াজ গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এমনকি বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠলেও দাম কমছে না। পেঁয়াজের মতো পচনশীল দ্রব্য গুদামজাত করায় টনকে টন পেঁয়াজ পচিয়ে নদীতে ফেলে দেয়ার মতো দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। মানুষ কতটা অমানবিক, অর্থলোভী, পিশাচ হলে এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে পারে।শুধু পেঁয়াজ নয়, বাজারে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। চাল, ডাল, তেল, নুন, শাকসবজি, ওষুধপত্র থেকে শুরু করে এমন কোনো দ্রব্য নেই, যার দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। শুধু কি তাই, এত উচ্চমূল্য দিয়ে যেসব দ্রব্য কিনছি তা-ও ভেজালে ভরা।

জীবন রক্ষাকারী ওষুধও ভেজাল মেশানো ও মেয়াদোত্তীর্ণ বিক্রয় করা হচ্ছে। তার ওপর প্রায় প্রতিটি ওষুধের দামও অনেক বেড়ে গেছে। নামিদামি কিছু প্রতিষ্ঠানও ভেজাল ওষুধ বিক্রয় করছে। আমরা নিরীহ ক্রেতারা জীবনরক্ষার জন্য চড়া মূল্যে বিষ ক্রয় করছি বলা যায়।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সব থেকে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন অধিকাংশ প্রবীণ। তারা না ঘরের মরা, না ঘাটের মরা।

যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছেন, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ চাকরি জীবনের তাদের একমাত্র সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার-জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়।প্রবীণ বয়সে খাদ্যদ্রব্যের চেয়েও বেশি জরুরি ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসেবা। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখছি, প্রবীণ বয়সে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সুস্থ থাকার জন্য মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রেসার, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হয়, হাসপাতাল খরচ বা অন্যান্য খরচের কথা বাদ দিয়েই। আমরা জানি, বর্তমান সরকার প্রবীণবান্ধব সরকার।কিন্তু প্রবীণদের এ দিকটি চিন্তাভাবনা না করেই হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দিয়ে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশে এখন প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ প্রায়। প্রবীণ জনগোষ্ঠীসহ নিম্নবিত্ত ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দ্রব্যমূল্যের বাজার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ভোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না।সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়।ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছেন তা সর্বসাধারণের বিচার্য। এ ছাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে, অনেক রফতানিকারক শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অতিরিক্ত লাভের আশায় দেশের চাহিদা না মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করছেন।

ইলিশ মাছ বাঙালিদের একটি প্রিয় খাদ্য। কিন্তু বহু রফতানিকারক দেশের চাহিদা না মিটিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ইলিশ রফতানি করে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা পছন্দের এ পণ্যটি ক্রয় করতে পারে না, সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি পণ্যের রফতানির একটা নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত।বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও প্রতিটি সবজির দাম চড়া। পেঁয়াজপাতা এখনও ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে।প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রাজধানী শহরে নিম্ন ও মধ্যম আয় এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। গ্রামের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। তবে প্রবীণদের জন্য ভালো নয়, কারণ প্রবীণদের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রয়োজন ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, যা গ্রামে পাওয়া প্রায় কষ্টসাধ্য।

তাই প্রবীণ ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট এবং দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রবীণবান্ধব বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন প্রতিটি দ্রব্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা ও সমন্বয়ে আরও বেশি বেশি মোবাইল কোর্ট চালু করে ভেজালকারীদের গুরুদণ্ড প্রদান, ক্যাবকে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেইসঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার বিষয়টি আবারও বিবেচনার জন্য সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

২০২২-২৩: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অর্থবছর

দ্রব্যমূল্য কমায় এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এখনো তা উচ্চহারেই রয়েছে।পণ্যমূল্য এপ্রিলে ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়েছিল ছিল, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি।সরকার এই অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা পরে সংশোধন করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান হার তার চেয়েও বেশি। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংকট আরও গভীর হয়েছে।

গত এক বছরে ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু জিতু বা বাংলাদেশের কোনো ভোক্তা স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব দেখেননি।কারণ মার্কিন ডলারের ঘাটতি এবং সরকারি সংস্থাগুলো পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকরা দাম কমায়নি।তবে, এর পেছনের কারণ হিসেবে সরবরাহ শৃঙ্খলের অসঙ্গতিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা।সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়।

এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা।গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। তবে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই দীর্ঘ।সরকারি সংস্থা বাংলাদেশের ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল, ভোজ্যতেল ও মসুর ডালের দাম কমেছে। অন্যদিকে ঢাকায় পেঁয়াজ, আলু, ডিম ও চিনির মতো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে।বাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম ওঠানামা করলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি ছিল। এ ছাড়া সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনী, টিস্যুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশ বেড়েছে।

জনজীবনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব ও করণীয়

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান করোনা মহামারি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ইত্যাদি কারণে সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ও সাধারণ মানুষের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে, নির্দ্দিষ্ট আয়ের পরিবারগুলি মাংস, মাছ এবং ডিম খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে এবং আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি রক্ষায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে কম খরচ করার পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম আগে থেকেই বেশি ছিল এবং জ্বালানি তেলের দামের সর্বশেষ রেকর্ড বৃদ্ধি সেটিকে আরও উপরে ঠেলে দিয়েছে এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে খাদ্যের যোগান ঠিক রাখতে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে। নিন্ম আয়ের লোকদের জন্য প্রোটিনের প্রধান উৎস ডিম যার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।

পরিসংখ্যান দেখায় যে গত বছর (২০২১) নভেম্বর থেকে জ্বালানির দাম কয়েক দফায় ৭৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ডলারের ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত আট মাসে কমপক্ষে ৪০ ভাগ বেড়েছে। প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য যেমন চাল, ডাল, আটা, তেল, মাছ, মাংস, শাক, সবজী , কাঁচা মরিচ ছাড়াও গৃহস্থালীর বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে। যদিও নিন্ম ও নির্দ্দিষ্ট আয়ের আয়ের লোকেরা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক শিকার, মধ্যম আয়ের লোকেরাও এর প্রভাব তীব্রভাবেই অনুভব করছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আয়ের সাথে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেড়ে যায়, তখন স্বল্প ও সীমিত আয়ের লোকেরা প্রথমে শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ কমিয়ে দেয়। তারা মাংস, মাছ, ফল এবং দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা বন্ধ করে এবং চাল ও আলু সহ শর্করা জাতীয় খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশে একটি অপুষ্টিজনিত প্রজন্ম তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১ কোটি ৭০ লাখ বিবাহিত নারী অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে অপর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে তীব্রতম অপুষ্টিতে (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন বা এসএএম) ভুগছে দেশের অনেক শিশু। বিশেষ করে গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির এ তীব্রতম মাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে এতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যাও।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশেরও বেশি। সুতরাং সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নারী ও শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা যে আরো বাড়িয়ে দিবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা যে কম হয় তা আমরা সবাই জানি।একথা সত্য যে করোনা মহামারি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। এছাড়াও আমদানি ও রফতানির ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসায় বৈদেশিক মুদ্রার বিশেষ করে ডলার রির্জাভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে জ্বালানীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে খাদ্য , শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি সেক্টরে এর প্রভাব পড়েছে। এই সুযোগে অনেক অসৎ ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে জনজীবনকে দূর্বিষহ করে তুলছে। জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। সুতরাং এ বিষয়ে সরকারকে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বল্প ও নির্দ্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যাংকগুলোকে গ্রাম পর্যায়ে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে।সর্বোপরি, অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে থাকে। এছাড়া দেশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আয়ত্বে আসবে।তবে শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষকেও দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আমাদের করণীয়

বর্তমান সময়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নামিদামি পত্রপত্রিকা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সেটি হচ্ছে  দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমন অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আকস্মিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনধারণ ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। তাদের কাছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন নতুন এক অভিশাপের নাম! এভাবে  চলতে থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে।

উল্লেখ করা দরকার, কোভিড মহামারির ধাক্কায় গত দুই আড়াই বছরের মধ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার অনেকেই বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ তো দেখছেনই না, বরং উলটো মালিকপক্ষ নানান অজুহাতে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। দ্রব্যমূল্য না কমলে এসব মানুষের অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমান করা যায় খুব সহজেই। যাহোক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনে কীরকম বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্যে টিসিবির পণ্যের গাড়িতে কিংবা ওএমএসের পণ্যের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের দীর্ঘ লাইনের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রেশ শুধু যে কাঁচামালের বাজারকেই গরম করেছে তা কিন্তু নয়, বরং শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষাসামগ্রী ক্রয় করত সেগুলোর মূল্যও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কারণ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অত্যধিক হারে মুনাফা লাভের আসক্তি, অবৈধভাবে যে কোনো পণ্যের মজুত বৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্য কিংবা বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও জ্বালানি সংকট, ন্যায়সংগত ও নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ না করা, বাজার তদারকিতে অনীহা ইত্যাদি। তবে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের সংকট কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে অনেকাংশে কঠিন করে তুলেছে। চলমান যুদ্ধের কারণে তেল আমদানিতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এমনকি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে অযাচিতভাবে!

দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে অতি দ্রুত আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই এখনই সরকারকে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে যে কাজটি করা দরকার বলে মনে হয় তা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান যেমন টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটানো দুষ্কৃতকারীদের মূলোত্পাটন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অবৈধভাবে অধিকহারে পণ্য মজুত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে।

পচনশীল খাদ্যপণ্যের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে হবে। দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। অপচয় রোধ করার পাশাপাশি সরকার প্রধানের নির্দেশনা মোতাবেক এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উত্পাদনে সচেষ্ট হই, তবে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে আসবে, ঠিক তেমনি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক বিষয় আমাদের হাতে থাকে না বটে, কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্নগামী হতে বাধ্য।

দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ ঠেকাতে যা করা দরকার

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন রোজার পরেও মানুষের স্বল্প মূল্যে পণ্যের চাহিদা থাকবে এবং সে কারণে এটা চালিয়ে যেতে হবে ও প্রয়োজনে পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।এছাড়া সামনে বাজেট আসবে যেখানে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে।"এখন গ্রামীণ বয়স্করা সহায়তা পাচ্ছে। শহরের গরীব বয়স্কদের এর আওতায় আনার দরকার। এছাড়া আরও বেশি সংখ্যক বয়স্ক ব্যক্তিকে এই কর্মসূচির আওতায় এনে সহায়তার পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে হবে," বলছিলেন তিনি।

তবে মূল্যস্ফীতির ধকল কমাতে বাজার ব্যবস্থায় মনিটরিং আরও জোরদার করা দরকার যাতে করে মানুষ বাজারে যে দামে আসে সেই দামের চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা দিতে না হয়।"পণ্য যে মূল্যে আনা হয় আর বাজারে যে মূল্যে থাকা উচিৎ সেটিই যেন থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মজুতদারি, পণ্য বন্দরে রেখে দেয়া, লোকাল মার্কেটে (স্থানীয় বাজার) চাঁদাবাজি, পুলিশী হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে দাম বেড়ে যাওয়া ঠেকালে মানুষ স্বস্তি পাবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য হরদম বেড়েই চলেছে।

পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যেসব কারণ বেরিয়ে আসে, তা নিম্নরূপ :

ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এসব ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে। শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়।

শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি বিরাট কারণ।দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিভিন্ন সময় দায়ী করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় খুব কমই। ফলে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য কমে না।ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন সব কালজয়ী কল্যাণধর্মী সুচিন্তিত নীতিমালা ও সুদূরপ্রসারী বাজার পরিকল্পনা রয়েছে; যা বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অনাকাক্সিক্ষত মূল্যস্ফীতি রোধ এবং সর্বোপরি বাজারের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীলতা দূর করা সম্ভব। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে ইসলামের ব্যবসায়িক নীতিমালা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

ইসলামে লোভে মজুদদারি নিষিদ্ধ

মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ইসলাম অধিক মুনাফার লোভে মজুদদারি নিষিদ্ধ করেছে। মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ফাজালা (রা) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না।’ (তিরমিজি)অন্য হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না।’অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ (দারেমি, হাদিস : ২৪৩৩)

ইবনে মাজাহ শরিফে বর্ণিত একটি হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিন পর্যন্ত মজুদ করে রাখে, আল্লাহতায়ালা তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ)মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতার নিন্দা করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মজুদদার কতই না নিকৃষ্ট! দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর তার কাছে খারাপ লাগে; আর মূল্যবৃদ্ধির খবরে সে আনন্দিত হয়।’অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মজুদদারের ওপর আল্লাহতায়ালা, ফেরেশতাকুল ও মানবজাতির লানত। আল্লাহতায়ালা তার কী ফরজ, কী নফল কোনো ইবাদতই কবুল করেন না।’ (শামি : ৬/৩৯৮)

মজুদদারি সম্পর্কে ফিকাহি নীতিমালা

ফিকহে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হিদায়া’য় উল্লেখ রয়েছে, ‘মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য মজুদ করা মাকরুহ, যদি তাতে শহরবাসীর ক্ষতি হয়। যদি শহরবাসীর ক্ষতি না হয়, তাহলে মাকরুহ নয়।’ (হিদায়া, ৪/৪৭০)‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘নগরবাসী বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মজুদদারকে বাধ্য করবে, যেন সে তার পণ্য সাধারণ মূল্যে বা যতটুকু বেশি মূল্যে মানুষ মেনে নেয়, সেই মূল্যে বিক্রি করতে।’ (আলমগিরি : ৩/২১৪)

অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে, মজুদদার সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার তাকে তার এবং তার পরিবারের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য বিক্রির আদেশ দেবে এবং মজুদ করতে নিষেধ করে দেবে। যদি সে বিরত না হয়, তাহলে উপদেশ দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে। এরপরও যদি বিরত না হয়, তার বিরুদ্ধে আবার মজুদদারির অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাকে বন্দি করবে। (আল-মুহিত)‘আল-মুজারাআত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ফকিহরা এ ব্যাপারে একমত, প্রয়োজনে মজুদদারদের সম্মতি ছাড়াই বিচারক মজুদকৃত খাদ্য বিক্রি করতে পারবেন।

মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীদের এহেন অপতৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন। (তিরমিজি)অর্থাৎ পণ্যের মালিক বা তেজারতি (বাণিজ্যিক) কাফেলা শহরে পৌঁছার আগেই তাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফার লোভে পণ্য কেনা রাসুল (সা.) নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ, এতে সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ বিনষ্ট হয় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো শহরবাসী কোনো গ্রামবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করবে না। মানুষকে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও, যেন আল্লাহতায়ালা তাদের একের দ্বারা অন্যের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। (তিরমিজি)।অর্থাৎ সাধারণত গ্রামবাসীই অনেক খাদ্যের উৎপাদনকারী। গ্রামবাসী সরাসরি শহরে এসে সেসব খাদ্য বিক্রি করলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে, শহরবাসীকে উচ্চমূল্য দিতে হয় না। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে নিয়ে নিজেরা দালালি করে বাজারদর বাড়িয়ে ফেলে। তাই রাসুল (সা.) এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করেছেন।

এক হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে আগুনের হাড়ে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (তাবরানি : ৮/২১০)অনেক সময় কেনার উদ্দেশ্যে নয়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে দালাল চক্রকে অধিক মূল্যে দর-দাম করতে দেখা যায়। রাসুল (সা.) সেটাও নিষিদ্ধ করেছেন। হাদিসে এটাকে ‘নাজাশ’ বলা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নাজাশ (ক্রেতাকে প্রতারিত) করার জন্য দর-দাম করবে না।’ (তিরমিজি)

শরিয়তের বিধান হচ্ছে- সাধারণত সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.)-এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। লোকেরা তখন বলে, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন।’ রাসুল (সা.) তখন বললেন, ‘মূলত আল্লাহতায়ালাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সঙ্কীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি যে, তোমাদের কারও যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে।’ (তিরমিজি : ১/২৪৫)

এই হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতেই ফকিহরা বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না; তবে ব্যবসায়ীরা যদি অতিরিক্ত মূল্য নেয় অথবা দ্রব্যমূল্য যদি এতই বেড়ে যায় যে, মূল্য নির্ধারণ না করলে জনসাধারণের ভোগান্তি হয়তাহলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। সর্বসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যে সরকার তখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াটাকে কল্যাণকর বলেই বিবেচনা করবে।’ (হিদায়া, আলমগীরি)

ফকিহরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ীরা যেন যোগসাজশ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি তারা পরস্পর যোগসাজশ করে মূল্যবৃদ্ধি করে, তাহলে মুসলিম সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে, যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। (তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিম : ১/৩১২)আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায় এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ শুধু বৈধই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে জরুরিও বটে।’ (আত-তুরুক : ১/৩৫৫)

দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের নীতিমালা প্রসঙ্গে ‘বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার যখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে চাইবে, তখন সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজারের গণ্যমান্য লোকদের একত্র করবে। ক্রেতাসাধারণকে সরকার উপস্থিত করবে। বিক্রেতারা কী দামে বিক্রি করছে এবং ক্রেতারা কী দামে কিনছে, তা জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করবে। এরপর উৎপাদক-আমদানিকারক-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় না, আবার ক্রেতাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে না যায়এমনভাবে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। সরকার কর্তৃক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের পর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কেউ বিক্রি করলে সরকার বা বিচারক প্রথমত তাকে উপদেশ দেবেন। তবে পরে তার ব্যাপারে একই অভিযোগ পাওয়া গেলে আবারও তাকে উপদেশ দেবেন। তৃতীয়বার তার সম্পর্কে একই অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে বন্দি করবেন, যাতে সে এহেন তৎপরতা থেকে বিরত হয় এবং জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হয়।’


তথ্যসুত্র


দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব, Jago news24.

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, Ittafaq.

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অর্থবছর, The Daily Star.

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা, Desh Rupantor.

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে চাপে ভোক্তা, The Daily Star.

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করুন, Jugantor.

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ, Amader Shomoy.

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনজীবন দুবির্ষহ হয়ে উঠছে, Barta24.

মূল্যস্ফীতিতে টালমাটাল বিশ্ব, BBC.

মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ, BBC.

মধ্যবিত্তের সংসার চালানোই দায়, Prothom Alo.

Subscribe for Daily Newsletter