সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার (Causes and Solution for Road Traffic Accidents)
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন অমূল্য। কিন্তু সেই জীবন যেন সড়কপথের দানব যানবাহনের কাছে নিতান্তই অসহায়। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে প্রতিদিনের আরো আট দশটি ঘটনার মতো সাধারণ হয়ে গেছে। এ দুর্ঘটনায় প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো তাজা প্রাণ, ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফিরতে পারব কিনা সেখানে রয়েছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। গাড়িচালকদের বিশৃঙ্খলা এবং নিজেদের প্রতিযোগিতা ও জোরের কাছে নিঃশেষ হয়ে যায় আমাদের মূল্যবান সোনালি জীবন। গাড়ির চালক গণ ভুলে যায় বেশ কিছু মানুষের জীবন কিছু সময়ের জন্য তাদের জিম্মিদারিতে। এমনকি তারা এটাও ভুলে যায় তারা যে একটা সেবার কাজে নিয়োজিত আছে যে তা। অনেকে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবার
২২ অক্টোবর পালন হয়ে আসছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস
সড়ককে নিরাপদ করার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২২ অক্টোবর পালন হয়ে আসছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। ২০১৭ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করা হয়। একই বছরের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়।যানজট তো প্রতিনিয়ত প্রতি মুহূর্তে নাগরিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় সময় কাটাতে হয়। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। শারীরিক-মানসিক প্রতিকূলতায় মানুষের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।
যানজট কমছে না, দুর্ঘটনাও কমছে না
ট্রাফিক দুর্ঘটনা ও যানজট হ্রাস করার জন্য পুলিশ, বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টাও আমরা লক্ষ করি। পুলিশ তো প্রায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অমানবিক পরিশ্রম করেও মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ, অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান ইত্যাদি পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার এত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কেন অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না? যানজট কমছে না, দুর্ঘটনাও কমছে না, মৃত্যুর মিছিলে নিহতদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এর উত্তর একটাই। কেউ প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে, সমস্যার কারণগুলো বন্ধ করার জন্য কোনো স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিচ্ছে না। শুধু অ্যাডহক ও ক্ষণকালের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বৃহত্তর জেলাগুলোতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নির্মাণ করা প্রয়োজন
যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমেই নজর দেওয়া প্রয়োজন চালকদের প্রতি। দক্ষ, ট্রাফিক আইন জানা ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সচেতন ও সুশৃঙ্খল চালকই পারবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে এবং দুর্ঘটনা হ্রাস করতে। দক্ষ, সচেতন, দায়িত্ববান ও পেশাদার চালক তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সরকারিভাবে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে অথবা বৃহত্তর জেলাগুলোতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নির্মাণ করা প্রয়োজন। বিআরটিএ দ্বারা পরিচালিত এসব স্কুলে কমপক্ষে চার মাস মেয়াদি ড্রাইভিংয়ের বনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণের জন্য গাড়ি চালনা, যানবাহনের ইঞ্জিন ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত জ্ঞান, ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক সিগন্যাল, সাইন ও সিম্বল, দায়িত্ববোধ ও নিরাপত্তাজ্ঞান, মনস্তাত্ত্বিক, সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ, শারীরিক ফিটনেস ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত করে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য এসএসসি পাস প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। চার মাস প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর গাড়ি চালানোর দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ফিল্ড টেস্ট, ট্রাফিক আইন ও মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি বিষয়ের ওপর চূড়ান্ত লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে
যারা কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবে, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। বিআরটিএ লাইসেন্সপ্রাপ্ত এ চালকদের প্যানেল তৈরি করে রাখবে। এ প্যানেল থেকেই পরিবহন সেক্টরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ/কম্পানি/মালিক/মালিক সমিতি/সংস্থাকে চাহিদা মোতাবেক চালক সরবরাহ করতে হবে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকদের জন্য নির্ধারিত বেতন স্কেল ও অন্য সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তারা চালককে নিয়মিত নিয়োগপত্র দেবে এবং চাকরির শর্তানুসারে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করবে। চালক ও হেলপারের জন্য চাকরির বিধিমালাও থাকবে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ব্যয় সীমার মধ্যে রাখতে হবে, যাতে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিতে পারে। মালিক সমিতি কোনো চালক প্রশিক্ষণে পাঠালে তাদের ব্যয় সমিতি বহন করতে পারে।
বেসরকারি উদ্যোগে ড্রাইভিং স্কুল গঠন করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো বিআরটিএর নিবিড় তত্ত্বাবধানে একই সিলেবাস ও নীতিমালা অনুসারে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ চালকদের তালিকা প্যানেল তৈরি করার জন্য বিআরটিএর কাছে পাঠাবে।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানোই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে যাতে জীবনহানি না হয়, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পরিবার সবসময়ই চায় আপনি এবং আপনার প্রিয় গাড়ি দুটোই থাকুক নিরাপদ।
০১. সিট বেল্ট বাঁধা
নিরাপদে গাড়ি চালানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গাড়ির সিট বেল্ট বাঁধা। প্রত্যেকটি দেশেই সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালান।অবশ্যই মনে রাখবেন, শুধু আপনি নন আপনার সঙ্গে থাকা যাত্রীদেরও সিট বেল্ট বাঁধতে বাধ্য করবেন। সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো এবং গাড়িতে চড়া দুটোই নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
০২. মনোযোগ
নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য যা প্রয়োজন আপনার মনোযোগ। আপনি যখনই গাড়ি চালাবেন খেয়াল রাখবেন আপনার মনোযোগ যেন গাড়ি এবং রাস্তার দিকেই থাকে। কখনই গাড়ি এবং রাস্তা থেকে মনোযোগ সরাবেন না। একটু অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের কারণে ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
০৩. অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক
অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক দিয়ে কখনোই গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য। তাই এক্ষেত্রে গাড়ির মালিদের সচেতন হতে হবে।
০৪. রোড স্ক্যানিং বা রাস্তা বিশ্লেষণ
রাস্তা বিশ্লেষণ বা রোড স্ক্যানিং নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন গাড়ি চলাবেন তখন অবশ্যই আপনার চলার রাস্তাটিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করবেন। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তা-সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো আপনাকে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে সেগুলো হলো- রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ, রাস্তার লেনের পরিমাণ, রাস্তার গঠনগত অবস্থা, রাস্তার প্রশস্ততা।
০৫. গাড়ির গতিসীমা
গাড়ি চালানোর সময় কখনই হুটহাট করে গাড়ির গতিসীমা বাড়াবেন বা কমাবেন না। হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানো প্রায়শই বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই যতদূর সম্ভব এই বিষয়টি মেনে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করবেন।
০৬. কথা বলা থেকে বিরত থাকুন
গাড়িতে চড়ে অনেক যাত্রী আছেন যারা ভাড়া ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যান- এটি কোনোভাবেই ঠিক নয়। গাড়ি চলানোর সময় কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
০৭. প্রতিযোগিতা
অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাই ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালান। আর মনে রাখবেন আপনি গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতায় নামেননি, নিরাপদে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে গাড়ি চালাচ্ছেন।
০৮. লুকিং গ্লাস
প্রত্যেকটি গাড়ির দুটি লুকিং গ্লাস থাকে। একটি ডান হাতের পাশে আরেকটি বাম হাতের পাশে। গাড়ি চালানোর সময় লুকিং গ্লাস দেখা জরুরি। কারণ আপনার পাশ দিয়ে কোন গাড়ি যাচ্ছে- তা আপনি সহজেই দেখতে পারবেন। আর নিরাপদে গাড়ি চালাতে পারবেন।
০৯. নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালাবেন না
গাড়ি চালানোর সময় চালক নেশাগ্রস্ত থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বাসের দুর্ঘটনার কারণ নেশাগ্রস্ত চালক। তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালাবেন না।
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। নানা কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো
১. চালকদের অসাবধানতা, অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ২. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ৩. রাস্তার স্বল্পতা ও অপ্রশস্ততা ৪. প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিং ৫. প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের অভাব ও ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করা ৬. যানবাহনে ব্যবহৃত তেলে ভেজাল ৭. রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা ৮. ওভার ব্রিজের স্বল্পতা ও অসাবধানে রাস্তা পারাপার বা রাস্তা পারাপারের নিয়ম না জানা ৯. রিকশা ও ভ্যানের সংখ্যাধিক্য ১০. সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা ১১. ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ ও ক্ষেত্রবিশেষে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অদক্ষ রিকশাচালকদের রিকশা ও ভ্যান চালনা ১২. ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাস্বল্পতা ও দায়িত্বহীনতা ১৩. বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে যখন-তখন যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ১৪. অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, পথসভা, হরতাল প্রভৃতি কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়া এবং ১৫. সড়ক পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ধরনের কর্মচারীদের দুর্নীতি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ছোটখাটো নানা কারণ রয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু মানুষের মৃত্যু কিংবা মানবিক ক্ষতি না উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে
আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু মানুষের মৃত্যু কিংবা মানবিক ক্ষতি না উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সম্পদ ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদন জিডিপি ২-৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এটা আর্থিক ক্ষতির হিসাবে এক বিরাট অংক যদিও সবার আগে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে ব্যক্তি তারপর পরিবার সবশেষে রাষ্ট্র।
তথ্য অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১৮ জনের প্রাণহানি হচ্ছে
কত মা অকালে হচ্ছেন সন্তান হারা, স্ত্রী হচ্ছেন স্বামী হারা আর সন্তান হচ্ছেন পিতৃহারা। অন্যদিকে এদেশ হারাচ্ছে জনসম্পদ ও মেধা সম্পদদের। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে সংঘটিত ৩৪ শতাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট ছিল। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাসের দুর্ঘটনা ২৫ শতাংশ মাইক্রোবাস ১৫ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনা ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে “নিরাপদ সড়ক চাই” এ তথ্য অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১৮ জনের প্রাণহানি হচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে এ সংখ্যা বাংলাদেশে আরও বেশি অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৫৫ জন ব্যক্তির প্রাণহানি হচ্ছে।আর বাংলাদেশে রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত এবং ৩৬০০০ আহত হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে সব
হিসাব থানায় লিপিবদ্ধ হয়না বা সংবাদপত্র আসে না যার কারণে অসংখ্য প্রাণহানির অপ্রকাশিত ও থেকে যায়
দুর্ঘটনা ও হতাহতের হিসাব থানায় লিপিবদ্ধ হয়না বা সংবাদপত্র আসে না যার কারণে অসংখ্য প্রাণহানির অপ্রকাশিত ও থেকে যায়।আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে শিশু ও কর্মক্ষম মানুষ আর শিক্ষার্থী। যারা নবীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। তাদের অধিকাংশ সড়কের দ্বারে যান ঘাতকের ছোবলে নিজের সোনালি জীবন মুহূর্তেই মৃত্যু বরণ করে চলে যায় না ফেরার দেশে অথবা অভিশপ্ত পঙ্গুত্ব জীবনে। যা কোন ভাবেই সুখকর নয়। নিরাপদ সরক চাই (নিসচা) এর তথ্য মতে ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯৬৯ জন নিহত হয়েছে ও ৫০৮৫ জন আহত হয়েছে আর সর্বমোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪০৯২ টি।২০২০ সালে রেলপথ দুর্ঘটনায় ১২৯ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছে আর নৌপথের দুর্ঘটনায় ২১২ জন ও ১০০ জন আহত ও নিখোঁজ হন।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করাই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ
প্রতিনিয়ত সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অশিক্ষিত ও অদক্ষ আর লাইসেন্স বিহীন চালক নিয়োগ , সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স কতৃক প্রদত্ত ১১১ টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া,চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা,দৈনিক চুক্তি ভিত্তিক গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়া দীর্ঘসময় গাড়ি চালানো,ফিটনেস বিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে পূর্ণাঙ্গ আইনের প্রয়োগ না থাকা,একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা ও অসতর্কতার অপগামিতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করাই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। ২০১৮ সালে দেশব্যাপী আন্দোলনের ফলে কিছুটা
সারা পৃথিবীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৩ লাখ মানুষ নিহত হয় যা খুবই অপ্রত্যাশিত
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৫২ হাজার ৫১৪ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে আর আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। যার মধ্যে ১২৫২জন চালক-শ্রমিক, ৮৮০ জন শিক্ষার্থী, ৩২১জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ৭৮৭ জন নারী ,৪৮৭ জন শিশু, ১০৬ জন শিক্ষক,৪৩ জন সাংবাদিক,৩৩ জন চিকিৎসক,৯ জন প্রকৌশলী, ২ জন আইনজীবী, ১৯২ জন রাজনৈতিক নেতা কর্মী। সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৭ হাজার ৩৫০টি যানবাহনের পরিচয় পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি যা উপলব্ধি করা যায় দেশের বৃহত্তম শহরগুলোয় কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বন্যার বেগে ছুটে আসা মানুষ আর যানবাহনের ভিড়ে রাস্তাগুলোয় দীর্ঘ জ্যামের দিকে লক্ষ করলেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০১৬ সালে সারা পৃথিবীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৩ লাখ মানুষ নিহত হয় যা খুবই অপ্রত্যাশিত।
২০২৫ সাল নাগাদ সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানের তুলনায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে
যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানের তুলনায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উন্নত বিশ্বের তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ হাজারেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারায় এবং ১০ হাজারেরও বেশি লোক আহত হয়। ২০১৬ সালের বিআরটিএর জরিপ মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ২৩ হাজার ১৬৬ জন মানুষ নিহত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৮০ হাজার শিশু মারা যায়। ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯৬ শতাংশ শিশু ছিল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যে ক্ষতি হয় তার আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, আন্তর্জাতিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৫২০ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে এর পরিমাণ ৬৫ বিলিয়ন ডলার। সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর কারণ হিসেবে জাতিসংঘের তৃতীয় স্থান দখল করেছে
পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরোসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এ ধারা ২০২০ সালে নাগাদের সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর কারণ হিসেবে জাতিসংঘের তৃতীয় স্থান দখল করেছে। জাতিসংঘের সংস্থার তথ্য মতে এ সংখ্যা ২০৩০ সালে নাগাদ সপ্তম স্থানে আসবে মনে করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিদের মধ্যে বেশিরভাগ ১৫-২৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা বেশি।তাই এটি একটি দেশ ও পরিবারের জন্য মানবসম্পদের বিরাট ক্ষতির কারণ। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার মারাত্মক চাপ পড়ে স্বাস্থ্য খাতে রোড সেফটি সালের তথ্য মতে দেশের হাসপাতালগুলোতে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দখলে থাকে।
দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়
দেশবাসীর জন্য সড়ক দুর্ঘটনা এক অনিবার্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে যেন কোনোই মুক্তি নেই। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই অনেকবার দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার চার জেলায় পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এ সময় আহত হয়েছেন আরো ২৩ জন। নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বাসচাপায় এক মোটরসাইকেল আরোহী, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ফলভর্তি ট্রাকের ধাক্কায় লোহার খুঁটি পড়ে ফল ব্যবসায়ী এবং মেহেরপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেল আরোহী ও চালক নিহত হয়েছেন।
এভাবেই মৃত্যুর মিছিল বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির এক তথ্যে জানা যায়, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনের (নিটোর) ইমার্জেন্সিতে প্রতিদিন ৩০০ রোগী আসেন, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের অধিকাংশের বয়স ১৮-৪৫ বছরের মধ্যে এবং দেখা যায় তারাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়। দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়।
রিকশাকে আমাদের যাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে
শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত নসিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরযুক্ত রিকশা, ভ্যান, অটো রিকশা থেকে শুরু করে সিএনজি, ইজিবাইক, লেগুনা, এগুলো কোনো টেকসই ও কার্যকর পরিবহনের মধ্যে পড়ে না। এগুলো যোগাযোগের নিকৃষ্ট পরিবহন। একইভাবে, রিকশাও কোনো কার্যকর যানবাহন নয়। কোনো সভ্য ও উন্নত দেশে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জীবিকা নির্বাহের জন্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে যা দেখতে দৃষ্টিকটু ও অশোভন। এক সময় হয়ত এর প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন এর বিকল্প পরিবহন গড়ে তোলার সময় হয়েছে। রিকশাকে আমাদের যাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে। রিকশার কারনে ঢাকা শহর জঞ্জালের শহরে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির ক্রয়ে আরো কড়াকড়ি আরোপের সময় হয়েছে। মোটর সাইকেলের ব্যবহারও কমাতে হবে।
আমরা জানি এই সকল পরিবহনের পক্ষে অনেকেই যুক্তি দেখান যে, এটি গ্রাম ও শহুরে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। যেমন, হাটে বাজারে পণ্য পরিবহন, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া, কর্মস্থলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া ও আসা, প্রতিবন্ধী ও নিন্ম আয়ের মানুষদের সহজ যাতায়াতে সহায়তা, ইত্যাদি। এই সব যানবাহন পরিবেশ বান্ধব বলেও অনেকে মনে করেন। সর্বোপরি, এই সব যানবাহন চালু হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সাধারণ পরিবহনের মতই এটি ভূমিকা রাখছে।
তথ্যসুত্র
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, Jagonews24.
দেশবাসীর জন্য সড়ক দুর্ঘটনা , Protidinersangbad.
সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, Bonikbarta.
দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে, Ajkalerkhobor.
অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, Jugantor.
ট্রাফিক দুর্ঘটনা ও যানজট হ্রাস, Kalerkantho.