রোহিঙ্গা সংকট (Rohingya Crisis)

রোহিঙ্গা সংকট (Rohingya Crisis)

নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা সংকট

ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা, সহায়তা কমে যাওয়া এবং প্রত্যাবাসনে অচলাবস্থা—এই তিনটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিষয়গুলো এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

মিয়ানমারসহ রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের গণহারে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ছয় বছর পরও পরিস্থিতি তাদের ফেরার কাছাকাছি পর্যায়েও নেই। আর এমন সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমছে।

অবনতিশীল পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শিবিরে

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণের কক্সবাজার জেলায় বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা শরণার্থীশিবিরগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একসময়ের প্রভাবশালী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মতো গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে বেশ কিছুসংখ্যক শরণার্থী নিহত হয়েছে। মুক্তিপণের জন্য শরণার্থীদের অপহরণ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠী ও অপরাধী চক্রগুলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অপহরণের ঘটনা ২০২৩ সালে প্রায় চার গুণ বেড়েছে। আগে যেখানে সহিংসতা শুধু রাতের বেলায় ঘটত, জঙ্গিরা এখন ছুরি এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক নিয়ে দিনের বেলায় শিবিরে ঘুরে বেড়ায়। তারা বাসিন্দাদের হুমকি দিচ্ছে আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রাণ নিতেও দ্বিধা করছে না।প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরে সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ তোলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানে সাড়াদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন-সহযোগিতা কমছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবিক আবেদনে মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। আর ২০২৩ সালে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি আরো কমেছে। এর ফলে মানবিক সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলো থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) দুবার খাদ্য রেশনের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছে। প্রতি মাসে জনপ্রতি ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলার করা হয়েছে, যা এক দিনে ২৭ সেন্ট করে পড়ে।

রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছর

২৫ আগস্ট ২০১৭ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগণ চাপের মুখে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য পালিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই অঞ্চল জুড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের বেশির ভাগই অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বসবাস শুরু করে।

এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি ট্র্যাজেডি যে, ছয় বছর পূর্ণ হতে চলল আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এবং মিয়ানমারকে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার অনুরোধ সত্ত্বেও সমস্যাটি অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট এবং বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব

মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমানায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংঘাত ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে, আবার কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে মানবিক কাজকে অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এটি ১৯৪৫ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে এটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, আদালতের দুটি ভূমিকা রয়েছে: প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এর কাছে জমা দেওয়া আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি করা (এর রায়গুলোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য আপিল ছাড়াই); এবং দ্বিতীয়ত, যথাযথ অনুমোদিত জাতিসংঘের সংস্থা এবং এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত আইনি প্রশ্নগুলোর পরামর্শমূলক মতামত দেওয়া।

জেনারেল অ্যাসেম্বলি এবং জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিল নয় বছরের মেয়াদে নির্বাচিত ১৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে এই আদালত গঠিত।নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের পুরো অঞ্চলটির নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিক আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব অসুবিধায় পড়েছে। যাদের বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ারমারের রাখাইন রাজ্যে অমানবিক সহিংসতায় এক কাপড়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

২০১৯ সালে গাম্বিয়া নিয়ে আসা মামলায় আইসিজে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা গণহত্যা রোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। ১৭ জন বিচারকের একটি প্যানেল সর্বসম্মতিক্রমে শাসিত আদেশে আদালত ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের বিধানকে বহাল রেখেছে- মিয়ানমার 'রোহিঙ্গাদের অধিকারের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে' বলে জানিয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষা এবং গণহত্যার সব ক্রিয়া রোধ করার নির্দেশ দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট কি বৈশ্বিক গুরুত্ব হারাচ্ছে?

এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩ শতাংশ কমিয়ে প্রতি মাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে। ফলে ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অফ হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে, যা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ।

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল।২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০ শতাংশ আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার।

এ বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন ডলার আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এ সমর্থন চলমান রয়েছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সংকট মোকাবিলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

২০ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ১৮তম এশিয়া কো-অপারেশন ডায়ালগে (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। 

উর্ধ্বমুখী জন্মহার রোহিঙ্গা সংকট বাড়াচ্ছে

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৫টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। বছরে এই সংখ্যা ৩০ হাজার। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে চায় না রোহিঙ্গারা। ফলে তাদের মাঝে শিশু জন্মহার বেশি। রোহিঙ্গা সংকটে নতুন করে মাথা ব্যথার কারণ এই উর্ধ্বমুখী জন্মহার। 

২০১৭ সালের ২৫শে আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সেদেশের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৭ জন। পরিবার আছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০৩টি। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জনের বেশি। 

ক্যাম্পে থাকা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পরিবারই সংখ্যায় বড়। এর মূল কারণ তাদের উচ্চ জন্মহার। ক্যাম্পগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর।গেলো ছয় বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এরমধ্যেই বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে কমেছে আন্তর্জাতিক সহায়তায়ও। যা সংকটকে আরও বেশি জটিল করছে বলে মনে করেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের একমাত্র পথ?

চীনের পাশাপাশি আসিয়ানের সদস্যরা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন করলে অত্র সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে বলে মনে করি। ভারতকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেয়া উচিত, কেননা ভারতে এ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ২০ হাজারের অধিক সদস্য অবস্থান করছে। তবে বাংলাদেশ যদি ওই প্রচেষ্টাগুলোকে সামনে এগিয়ে না নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, অদূরভবিষ্যতে নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং আরো বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে সেটি মোটেও কোনো আকস্মিক ঘটনা হবে না। কাজেই দেশের এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দিতে সামগ্রিকভাবেই প্রত্যাবাসনের বিষয়টির ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে অনতিবিলম্বে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। 

রোহিঙ্গা সংকটে বিশ্বকে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা ও উত্তরণে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধি দল।প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে আশ্রয় প্রদান ও তাদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রশংসা করেন এবং ধন্যবাদ জানান।

প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য রিপাবলিকান পার্টির রিচার্ড ম্যাকরমিক বলেছেন, 'রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে যে তথ্য পেয়েছি, তা লিখিতভাবে আমেরিকা সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।' এই সংকট মোকাবিলা ও উত্তরণের জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে একযোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান জানান তিনি। 

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি

রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেওয়া কার্যক্রমগুলোকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই এবং এতে কেউ লাভবান হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। এর জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক ও সহযোগিতাপূর্ণ উদ্যোগ। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই এ সংকট সমাধানে কোনো এক পক্ষকে দোষারোপ না করে বহুমুখী এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা হিসাবে সফলতার সঙ্গে ছয় বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আগ্রহী যে কোনো পক্ষকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়, তারা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার বিষয়ে কাজ করতে পারে; বাংলাদেশ যা করছে তার পাশাপাশি তারা সহায়তা বাড়াতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাদের সক্ষমতা আছে, কীভাবে তা নিশ্চিত করা যায়, সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গারা যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তা জেনে নিয়ে কীভাবে ও কোথা থেকে তার ব্যবস্থা করা যায়, স্থায়ী সমাধানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, কারা তা নেবে ও নিতে গেলে কী ধরনের সহযোগিতা দরকার-এগুলো জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত সমাধান ও কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সমালোচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাই চলমান এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক হলে সব মহলকে উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত এ সংকট সমাধান হোক-এটাই প্রত্যাশা।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রচেষ্টা বহুগুণ বাড়াতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে প্রচেষ্টা বহুগুণ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক ইভেন্টে তিনি এ আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা তার প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন বিষয়টি সমাধান করে এবং এই দুর্দশাগ্রস্ত ও অসহায় মানুষের জীবনধারণের জন্য আমাদের মানবিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এই বিষয়টিকে তাদের এজেন্ডার শীর্ষে রাখে।

তৃতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, এই জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত, নিয়মে পরিণত করা এবং ঘৃণ্য নৃশংসতাকারী অপরাধীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য চলমান এবং প্রচলিত আইনি এবং বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ছয় বছর ধরে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক বিতাড়নের ঘটনা দেখে আসা বিশ্বকে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের স্থায়ী দুর্ভোগের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে তারা আজ এখানে সমবেত হয়েছেন।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্মম  হত্যাকাণ্ডের কারণে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর থেকে আমরা আমাদের মাটিতে তাদের আশ্রয় এবং তাদের মৌলিক ও মানবিক সেবা দিয়ে আসছি। আমি আমাদের সব অংশীজন এবং বন্ধুদের তাদের সংহতির পাশাপাশি মানবিক সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে উপস্থিত অনেক দেশ আছে, যারা কয়েক দশক ধরে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। তার বিশ্বাস মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরব বাংলাদেশের সঙ্গে একমত হবে। এক মিলিয়নেরও বেশি বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য আশ্রয় দেওয়া কখনোই বাংলাদেশের জন্য একটি বিকল্প ছিল না বলে উল্লেখ করেন তিনি

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মতে, প্রত্যাবর্তনকারীদের প্রথম ব্যাচের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে পথ দেখাতে এবং প্রক্রিয়ার ফাঁক-ফোকরগুলো পূরণ করতে গুরুত্বপূর্ণ হবে।শেখ হাসিনা বলেন, আমার দেশ জবাবদিহিতা প্রক্রিয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং আমরা আইসিজে, আইআইএমএম এবং আইসিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। আমি অন্য সব সদস্য রাষ্ট্রকে এই বিষয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সাথে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানাই।

রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছরে কিছু শঙ্কা ও প্রত্যাশা

তাৎক্ষণিক ত্রাণ তৎপরতার বাইরেও রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলোকে সমাধান করাও গুরুত্বপূর্ণ। যে জটিল ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো তাদের নিপীড়নের দিকে পরিচালিত করেছিল তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং তাদের মূল সমস্যা সমাধান করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারে সংলাপ, পুনর্মিলন এবং মানবাধিকারের প্রচারে উৎসাহিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

বৈশ্বিক সংহতি অবশ্যই আর্থিক সহায়তার বাইরে প্রসারিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের মানবতা স্বীকার করা এবং তাদের কণ্ঠ হৃদয় দিয়ে শোনা। এটি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমান সদস্য হিসাবে তাদের পরিচিতি, জন্মভূমি, ও দেশের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা ও গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধীদের জবাবদিহিতার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা উচিত এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে রোহিঙ্গারা আবারও নিপীড়নের ভয় ছাড়াই নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমারের ওপর চাপ বজায় রাখতে হবে রোহিঙ্গাদের অভিযোগের সমাধান করতে এবং জাতীয় পুনর্মিলন ও শান্তি-নির্মাণের একটি প্রকৃত প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য ও নির্ভরশীলতার চক্র ভাঙ্গার জন্য শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ দিয়ে রোহিঙ্গাদের ক্ষমতায়ন অত্যাবশ্যক। শিক্ষা তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান দিয়ে সজ্জিত করে, যখন কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের সমাজে অর্থপূর্ণভাবে অবদান রাখার ক্ষেত্র তৈরি করে। আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত শরণার্থী শিবিরের মধ্যে শিক্ষাগত সুবিধা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা, আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশার পথ প্রশস্ত করা।


তথ্যসুত্র


জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে চায় না রোহিঙ্গারা, Boishaki Online.

রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলোকে সমাধান করা, Kalbela.

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রচেষ্টা, Bangla News.

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে, Jugantor.

ত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, Bonikbarta.

রোহিঙ্গা সংকট কি বৈশ্বিক গুরুত্ব হারাচ্ছে, Jugantor.

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর প্রভাব, Jaijaidinnbd.

রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছর, Ittefaq.

ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা সংকট, Kalerkantho.

Subscribe for Daily Newsletter