রোহিঙ্গা ইতিহাস (Rohingya History)

রোহিঙ্গা ইতিহাস (Rohingya History)

জনগোষ্ঠীকে বলা হয় "বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ" এবং "বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু"। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারণামায় স্বাক্ষর করতে হয়।

রোহিঙ্গা কারা?

সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে : ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানের উল্লেখ রয়েছে রোসাং নামে।

রোহিঙ্গা ইতিহাস নিয়ে বিচিত্র তথ্য


রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন। আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা। আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে। ১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে। ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।

ইতিহাসের পাতায় রোহিঙ্গা

রাখাইন অঞ্চলে কত ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠী ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায় যে, প্রায় বিশ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছিল যার প্রায় পনের লাখ মিয়ানমারের বাইরে রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় আট লাখ এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার ১৯৭৪ সালের পর হতেই প্রকাশ্যে এদের বহিরাগত বিশেষ করে ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করা শুরু করে। একই সাথে, যেহেতু এই জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়াতে, সার্বিকভাবে ‘বাঙালি’ এবং মুসলমান হিসেবে যেভাবে ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণা ছড়ানো হয়েছে সে কারণে মিয়ানমারের বৃহত্তর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছে।

তাদের ধারণা, এরা এক বিপজ্জনক জনগোষ্ঠী। অথচ মিয়ানমারের বহু উপজাতি আজ পর্যন্ত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিগত ৭০ বছর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। অনেক উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের মুক্তাঞ্চল তৈরি করতে পেরেছে। সে তুলনায় রোহিঙ্গারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কিছুই করতে পারেনি। এমনকি কারেন, সান, কাচিনদের মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের যতগুলো উপজাতি জনগোষ্ঠী তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং নিরীহ বলে প্রমাণিত। বাংলাদেশে যে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে রয়েছে তাদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করলেই এ বক্তব্যের সত্যতা মিলবে।

বার্মার আরাকান রাজ্য  ও রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস

রোহিঙ্গাদের আদি পুরুষরা হচ্ছেন আরব মুসলিম বণিক। কথিত আছে, আরাকানের সমুদ্রোপকূলে তাঁদের জাহাজডুবি হলে ‘রহম রহম’ বলে তাঁরা বাঁচানোর জন্য আহ্বান করেছিলেন তাই স্থানীয়রা তাদের রোহিঙ্গা নামকরণ করে (যদিও রোহিঙ্গা নামকরণের কারণ হিসেবে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়) এ দেশে বিয়েশাদী করে তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এভাবে একটি মুসলিম জনপদ গড়ে উঠে।

একসময় আরাকান রাজ্যটি আমাদের চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে আমাদের পূর্ব দিকে অবস্থিত আসাম প্রদেশের পাঁচটি কোণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুতরাং সে যুগে এ দেশ থেকে ও দেশে যাওয়া বা ঐ দেশ থেকে নাগরিকদের এ দেশে বিচরণ এবং নিজেদের সুবিধামত অভিবাসন গ্রহণেও কোনো বাধা-নিষেধ ছিল না। তাই ঘন জঙ্গলাকীর্ণ আরাকান থেকে বৌদ্ধ মগরা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলিতেই অভিবাসনের উৎকৃষ্ট স্থান রূপে বেছে নেয়। তাদের এই স্থানান্তরের কারণে আরাকান রাজ্য আরো বেশি জঙ্গলাকীর্ণ ও অনাবাদী বিচরণভূমি হয়ে উঠে। তাই ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও আমাদের দ্বীপাঞ্চল থেকে প্রচুর সংখ্যক লোক নিয়ে আরাকান রাজ্যটিকে সুজলা-সুফলা করে তোলার প্রয়াস পায়।


আমাদের বাঙালী মুসলমানদের একটি বিরাট জামাত যেখানে বৃটিশ আমল থেকে প্রায় দুই আড়াই শ বছর পূর্বে আরাকানে গিয়েছে, তেমনি সে দেশের তথা রাখাইন রাজ্যের মগরাও আমাদের  পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে এসে অভিবাসন গ্রহণ করেছে। তারা বার্মিজদের সমজাতীয় ও সমধর্মীয়, সমভাষী লোক। এখন কেবলমাত্র ধর্ম ও নৃতাত্বিক ও কৃষ্টিগত কারণে যদি রাখাইন রাজ্য তথা বৃহত্তর মায়ানমারের বাংগালী বংশোদ্ভুত ও মুসলমানরা নাগরিকত্বের অযোগ্য- এ যুক্তটি মেনে নেয়া যায় তাহলে একই যুক্তিতে আমাদের দেশে বসতকারী প্রায় দশ লাখ মগ ও বৌদ্ধ এ দেশের নাগরিকত্বের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং এই যুক্তিতে মায়ানমারকে সে দায়িত্বটি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

আমরা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ওদেরকে এখানে জামাই আদরে রাখব। আর তাদেরকে স্বতন্ত্র স্বাধীন আরেকটি পূর্বতিমুর রাজ্য গড়ার পথ খুলে দেব। আর আমাদের সমজাতীয়, সমধর্মীয়  ও কাছাকাছি ভাষার লোক হওয়ায় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হবে, বিতাড়িত হবে- এ হতে পারে না। বিশ্ব দরবারেও আমাদের কূটনৈতিকরা এ যুক্তিটা তুলে ধরতে পারেন। মায়ানমারের সামরিক-জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার যদি এ যুক্তি মেনে নেয়, তাহলে আর কোনো নতুন দেন দরবারের প্রয়োজনই থাকে না। বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানীগুণী ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ  তথা সরকার বিবেচনা করবে

আরাকানে রোহিঙ্গা উৎপীড়ন : এক রক্তমাখা ইতিহাস ও মানবতার লজ্জা

 নরমিখলার (১৪৩০-১৪৩৪) সময় থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের রাজ দরবার মুসলিম প্রভাবিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রী, কাযী এবং রাজ্যের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী পর্যন্ত ছিল মুসলিম। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুর, (থদোমিন্তার শাসনকাল ১৬৪৫-১৬৫২), প্রতিরক্ষামন্ত্রী মো: সোলাইমান (সান্দা থু ধম্মার শাসনকাল ১৬৫২-৮৪), প্রতিরক্ষামন্ত্রী আশরাফ খান (রাজা থিরি থু ধম্মার শাসনকাল ১৬২২-৩৮)। তাছাড়া তখন আরাকান রাজসভার (অমাত্যসভা) পৃষ্ঠপোষকতায় ও উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় মুসলিম কবিগণ সাহিত্য সাধনা করতেন এবং তাদের হাতেই বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল

আরাকানে রোহিঙ্গাদের উৎপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনী

১৯৪২ সালের পূর্বে দু’একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া রোহিঙ্গারা ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সকল প্রকার স্বাধীনতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিল। স্থানীয় মগ সম্প্রদায়ের সাথে তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৩৭ সালে বৃটিশ বার্মা আলাদা করার পর বৃটিশ প্রশাসন HOME RULE (local self Government of 1937) জারি করে বার্মায় অভ্যন্তরীণ স্থানীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে বর্মী নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেয়। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানী দিয়ে ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুইনসহ নিচু অংশে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে ৩০,০০০ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাছাড়া ১৯৪০ সালে মুসলমানদের উপর বৌদ্ধ ধর্ম ও তার প্রচারক গৌতম বুদ্ধের অবমাননার অভিযোগ এনে থাকিন পার্টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করে, যার পরিণতি হিসেবেই ১৯৪২ সালে আরাকানে মুসলিম নিধনযজ্ঞ সংগঠিত হয়।

গবেষণায় উদ্ভাসিত রোহিঙ্গা নিধনের মর্মান্তিক ইতিহাস

লুণ্ঠিত আরাকানে রোহিঙ্গা জাতির আর্তনাদ’ শীর্ষক বিপুলায়তন গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৬২ সালে বার্মার এক আইনে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। তারা সকল সভ্য নাগরিক অধিকার তথা মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়। তখন থেকেই তাদের দুর্ভাগ্য ও নির্যাতনের শুরু। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গমস্থলে সমুদ্রতীরবর্তী হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ আরাকান। ঐতিহাসিকভাবে রাজ্যটি ছিল বরাবরই স্বাধীন ও অতিশয়  সমৃদ্ধিশালী। ম্রোহং বা রোসাঙ্গ শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এই রাজ্যের রাজধানী। চট্টগ্রাম, পেগু ও আরাকান এই তিন জনপদের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে এই রাজ্যের পরিধি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে‌‌‌ই ইয়েমেনীয় ও ব্যাবিলনীয় অঞ্চলের আরবগণ (অমুসলিম আমলের) সমুদ্রবিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে চীনা ও ভারতীয় অঞ্চলের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকারী ছিল।

১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে অনরথ নামক এক রাজা এ অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে একটি একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং পগান প্রদেশে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা অনরথের রাজত্বকালকে স্বর্ণকাল বলা চলে। বৌদ্ধধর্মে অতিমাত্রায় অনুরক্ত এই রাজা শহরজুড়ে অনেক মন্দির ও প্যাগোডা নির্মাণ করেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে এই রাজ্যের একদিকে  ‘শান’ ও আরেকদিক থেকে  ‘মোঙ্গল’ জাতি দখল করে এবং একে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে দেশটি চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলো হলো উচ্চ বার্মা, নিম্ন বার্মা, শান প্রদেশ ও আরাকান প্রদেশ।

১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে এক অবাঞ্ছিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আভার রাজা মেঙ্ৎ শোঅই (মিন কৌং) আরাকান আক্রমণ করেন। তিনি নরমিখলাকে (১৪০৪-১৪৩৪) পরাজিত করে আরাকান দখল করেন। নরমিখলা বাংলার (গৌড়ের) সুলতানের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে তার রাজ্য উদ্ধারে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। নানান ঘটনাপ্রবাহের কারণে আশ্রয়ের দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৪-১৪৩১ খ্রি.) সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে গৌড়ের বিশাল সেনাবাহিনীসহ নরমিখলাকে আরাকান রাজ্যে প্রেরণ করে তা দখল করে নেন। যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে  ‘সান্ধিকান’ নামে একটি মসজিদও প্রতিষ্ঠিত করেন।

রোহিঙ্গা: আত্মপরিচয়-বঞ্চিত এক জাতির ইতিহাস

যাদের জীবন কেটেছে ক্যাম্পে, যাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সক্ষমতা অর্জনের সব অধিকার; আজ ৪০ বছর যারা গণহত্যার শিকার- হতে পারে সে গণহত্যা শ্লথ বা সময়ে সময়ে নারকীয়, তাদের হয়ে অর্থাৎ সেই রোহিঙ্গাদের কথা বলা কিন্তু আমাদের দায়িত্ব।বার্মিজ রাজনীতির পালা বদলের সাথেই চলেছে রোহিঙ্গাদের উপর নাগরিকত্ব আইনের নানা ধরনের পরীক্ষারোহিঙ্গাদের নিজের ঘর-বাড়ি বলে কিছু নেই। তাদের নাম, ধাম কোন না কোন ক্যাম্পের তালিকায় নথিভুক্ত।

 বেঁচে থাকার তাগিদে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যেতে হয়, বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলতেই থাকে নিরন্তর। হাবিবর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আরাকান ছেড়ে ঈয়াঙ্গুন, এরপর থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া আসেন ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর। এর মধ্যে ১০ বছর চলে গেছে। মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়তে হয়েছে, বাচাঁর তাগিদে বন্দী পাচারকৃত শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে থাইল্যান্ডের জেলেদের নৌকায়। ছোট ছোট কিছু অর্জন আছে। ২০০১ সালে মালয়শিয়া UNHCR রোহিঙ্গাদের প্রথম বার্মিজ রেফুজী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

রোহিঙ্গা: এক রাষ্ট্রহীন জাতির জন্মকথা

বলা হয়ে থাকে, যখন সামনে আর পথ পাওয়া যায় না, তখন পেছনে একবার ফিরে তাকাতে হয়। যেকোনো সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন তার শিকড় জানা। বাংলাদেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে শীর্ষে রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। নিজ দেশে পরবাসী এই রোহিঙ্গা জাতি বছরের পর বছর লাগাতার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে জর্জরিত হয়ে আজ রাষ্ট্রহীন এক জাতিতে পরিণত হয়েছে।

মায়ানমারের অতি-সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সামরিক বাহিনীর গণহারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে এই নিরীহ মুসলিম সম্প্রদায়। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ইতিমধ্যে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখনও সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। নেই খাদ্য, নেই বাসস্থান, নেই শিক্ষা, নেই নিরাপত্তা- আন্তর্জাতিক মহল বরাবরের মতো নিশ্চুপ মানবতার এমন তীব্র দুর্দশার দিনে। কিন্তু কারা এই রোহিঙ্গা? জানতে হলে যেতে হবে অনেক পেছনে। কাহিনী পুরোনো, কিন্তু খুব অজানা নয়।

বর্তমান মায়ানমার (সাবেক বার্মা) এর একটি রাজ্য হলো রাখাইন। এই রাজ্যের সাবেক নাম আরাকান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত আরাকান রাজ্যটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোটামুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। দীর্ঘ কয়েকশ বছর ধরে উত্তর আরাকানে ‘আরাকান’ ও দক্ষিণ আরাকানে ‘চাঁদা’ নামক দুটি পৃথক স্বাধীন রাজ্য ছিলো। ত্রয়োদশ শতকে রাজ্য দুটি একত্রিত হয়ে ‘আরাকান রাষ্ট্র’ গঠিত হয়। ১৭৮৫ সালে বার্মারাজ বোধপায়া আরাকানের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে রাষ্ট্রটি দখল করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। তখন থেকে আরাকান বার্মার একটি প্রদেশ হিসেবেই আছে। ১৯৭৪ সালে মায়ানমার সরকার আরাকান প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট’ রাখে।

রোহিঙ্গা 'বদমাশ' নাকি ইতিহাসের দূত?

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেখুন। আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী মর্যাদার পূর্ণ দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এবং পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক লীলাখেলার রসদ হয়েছে তারা। তাদের মারলে কোনো দোষ নেই। তাদের জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হস্তক্ষেপ কিংবা উদ্বাস্তু তহবিলের টাকার টানাটানি কখনো শেষ হয় না। এখানেই প্রাসঙ্গিক ইতালীয় রাজনৈতিক দার্শনিক আগামবেনের হোমো সাসেরের ধারণা।

রোমান সাম্রাজ্যের আইনে একধরনের মানুষকে ‘হোমো সাসের’ (Homo Sacer) বর্গভুক্ত করা হতো। এই হোমো সাসেরদের হত্যায় অপরাধ হতো না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো বালাই তাদের জন্য খাটবে না। এমনকি শহীদ বা মার্টায়ার হওয়ার মতো পবিত্র ছিল না তাদের দেহ। তারা ছিল মানুষ ও জড় বস্তুর মাঝামাঝি কোনো অবস্থার জীব। আজ দেখা যাচ্ছে, কালো, মুসলিম, আরব, রোহিঙ্গা, দরিদ্র ও ক্ষমতাবঞ্চিত মানুষের স্ট্যাটাস হোমো সাসেরের স্ট্যাটাস। তাদের খরচযোগ্য, মানব–বর্জ্য, ‘নিউ ক্রিমিনাল’ ভাবা তাদের হত্যাকারীদের নৈতিক শক্তি জোগানোর শামিল।

বাংলাদেশ যখন বুক পেতে রোহিঙ্গাদের ঢল নিচ্ছে, তখন আরব, ভারত ও পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা ‘দুর্গ মানসিকতা’র পরিচয় দিচ্ছেন। আর শরণার্থী শিবিরের মানুষেরা স্থায়ীভাবে ‘অস্থায়ী দশা’য় ঝুলে থাকছেন। এঁরা নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক, এঁরা খরচযোগ্য। এরা ভূরাজনীতি, নেতিবাচক বিশ্বায়ন এবং সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের শিকার। এঁরা নিজ সমাজ হারিয়েছেন, নতুন সমাজেও তাঁদের দেখা হয় মানব-বর্জ্য হিসেবে। প্রশ্নটাও আর মানবিকতার থাকছে না, করা হচ্ছে রাজনৈতিক। শরণার্থীদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতির চাষবাস। বহিরাগত আতঙ্ক জাগিয়ে লাভবান হচ্ছে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদ: মিয়ানমার ও ভারত হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা অবধি। অভিবাসী শরণার্থী ঠেকাতে যে ঘৃণা ও শত্রুতার আবেগ উসকানো হচ্ছে, তা নেশনের আচরণ নয়, জাতির আচরণ নয়। সমাজতাত্ত্বিক জিগম্যুন্ট বাউমান বলছেন, এই পুনর্জাগ্রত কুসংস্কার ও শত্রুতার চরিত্র ‘ট্রাইবাল’। এবং তার পরিণতি প্রায়ই গণহত্যা

শরণার্থীরা মানববর্জ্য নয়

শরণার্থীরা মানববর্জ্য নয় যে তারা জাতির মধ্যে মানবদূষণ ঘটাবে। তা ছাড়া বাঙালিরাও কোনো রেস বা একক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। পৃথিবীতে কোনো বিশুদ্ধ ‘স্বজাতি’ নেই; বাঙালিরাও তার বাইরে নয়। হরহামেশাই হাজার বছরের বাঙালির কথা আমরা শুনি। এর মাধ্যমে কী বোঝায়, তা এর প্রবক্তারা পরিষ্কার করতে পারেননি। জাতিগত ঐক্য জাগাতে তাঁরা হয়তো চাইছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিমান মিথ সৃষ্টি করতে। অথচ আজ বাঙালি বলতে যা বোঝায়, মধ্যযুগের সুলতানি আমলে তা ছিল না, আবার বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগে—দশম-একাদশ শতকে তা বোঝাত অন্য কিছু। এখন বোঝানো হয় সাংস্কৃতিক জাতি, চর্যার যুগে বোঝানো হতো নিম্নবর্গীয় জনজাতির ধারণা।


তথ্যসুত্র

শরণার্থীরা মানববর্জ্য নয় , Prothomalo.

রাষ্ট্রহীন এক জাতিতে পরিণত হয়েছে, Roar Media.

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস তুলে ধরতে আবেদন, Bangla. BD News24.

রোহিঙ্গা জাতির আর্তনাদ’ , Bangla News24.

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়, Kalerkantho.

মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা, Tawheederdak.

রোহিঙ্গারা নেতৃত্বে কেন মনোযোগ দিচ্ছে না, Bangla. BD News24.

রোহিঙ্গাদের আদি পুরুষরা হচ্ছেন আরব মুসলিম বণিক, Alkawsar.

এক অবাঞ্চিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীর নাম, Daily Inqilab.

রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি , BBC.

Subscribe for Daily Newsletter