বানান এবং অভিধান (Spelling and Dictionary)

বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম পুস্তিকা আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ২০০০ সালে এই নিয়মের কিছু সূত্র সংশােধিত হয় এবং তা বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর পরিমার্জিত সংস্করণের পরিশিষ্ট হিসেবে মুদ্রিত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বাের্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের পাঠ্যপুস্তকে এবং সরকারি বিভিন্ন কাজে বাংলা একাডেমি প্রণীত বানানরীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পর্যালােচনা করা হয় এবং প্রয়ােজনীয় পরিমার্জনার পর পুনর্মুদ্রণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরিমার্জিত সংস্করণের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যগণ বিভিন্ন সময়ে একাডেমিতে কয়েকটি সভায় মিলিত হন। সভাসমূহে ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ শীর্ষক পুস্তিকা ছাড়াও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বাের্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বাংলা বানানের নিয়ম বিস্তারিত আলােচনার পর বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ চূড়ান্ত করা হয়।
বাংলা একাডেমি আধুনিক অভিধান : বানান-প্রতর্ক
সৃষ্টিশীল লেখকেরা ভাষার সন্ধিগুলো ভেঙেছেন, আবার গড়েওছেন। যুগ যুগ ধরে তাই হয়েছে। কিন্তু তাঁরা জানেন, ভাষাবিজ্ঞান আর ব্যাকরণও মিথ্যে নয়। তাই শামসুর রাহমান ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবে যখন লেখেন, তখন তিনি ক্রিয়াপদটি দেন ‘দেখে’, আর কবি হিসেবে যখন লেখেন তখন ‘দ্যাখে’ (‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ আছে)। এটি সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ থেকে সচেতন লেখক মাত্রেই পরিদৃষ্ট হয়। তাঁরা সংবাদপত্রে যে ভাষারীতি অনুসরণ করে সংবাদ বা সম্পাদকীয় পরিবেশন করেন, গল্প-কবিতা-উপন্যাসে সেখান থেকে স্বাধীনতা নেন, নিজের মতো করে লেখেন। লেখকের এই বোধ, আশংকা করি, এখন আমাদের দেশে লুপ্ত হতে চলেছে।
অনেকে মনে করেন, মুখের কথাই গল্প-উপন্যাস-কবিতার ভাষা এবং সেটাই গবেষণা অথবা পত্রিকারও ভাষা। ভাষা ব্যবহারে এই একরৈখিক যাত্রা না হলে বা ব্যত্যয় হলে স্বাদেশিকতা গেল-গেল বলে তারা হামলে পড়েন! সমাজেও এই চটকদারির সমাদর একটু বেশিই। হুজুগের শব্দমালা বা চা-স্টলের আড্ডার বাক্যাংশ দিয়ে বহুজন পত্রিকায় লিখছেন, ‘কেতাব’ ছাপছেন। বাংলা ভাষা যে বিশ্বজুড়ে থাকা বাঙালির ভাষা এবং এর প্রকাশবৈচিত্র্য যে অফুরন্ত, তা ভুলে গিয়ে এভাবে বাংলাকে শুধু একটি দেশে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। ঠিকঠাক বললে, দেশও নয়, ঢাকাতে সীমিত করা হয়। ভাষাব্যবহার যদি এতোটাই সহজ হতো এবং এটি যদি শিখবার ব্যাপার না-ই হতো, তাহলে ব্যাকরণ, ভাষাবিজ্ঞান এমন কি উচ্চারণরীতি বা হালে আলোচনায় আসা বানানের নিয়মের দরকার হলো কেন?
সমোচ্চারিত শব্দের বানান, প্রয়োগ-রীতি ও অর্থ-ভিন্নতা
বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, যে যা-ই বলুন-না কেন, কথনের ভাষা এবং লিখনের ভাষা সবসময়ই ভিন্ন হবে। সুতরাং কথনের ক্ষেত্রে না হলেও লিখনের সময় অবশ্যই ভাষার শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সমোচ্চারিত শব্দ লেখার সময় অনেকেই সেই শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেন না। বিভ্রান্তিতে পড়ে প্রায়ই ভুল করে বসেন। বাংলা ভাষায় সমোচ্চারিত শব্দের সংখ্যা অনেক। সমোচ্চারিত শব্দ বলতে সেই শব্দকে বোঝায় যে শব্দ উচ্চারণের সময় ধ্বনির দিক থেকে প্রায় অভিন্ন শোনালেও অর্থের ভিন্নতা রয়েছে। সমধ্বনির কারণে এ ধরনের শব্দ লিখতে গিয়ে অনেকেই বানান-বিভ্রাটে আক্রান্ত হন। এ-থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
অনেক ভাষা-বিশারদ এ-প্রশ্নে অভিধান-নির্ভরতার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাতের কাছে অভিধান না থাকলে কিভাবে এই বিভ্রাট দূর করা যাবে- সে নিয়ে তেমন কোনো যৌক্তিক পরামর্শ নেই। কেউ কেউ ভাষাচর্চায় গভীর অভিনিবেশ ও সাবধানতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব দেন। এটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক পরামর্শ। অভিনিবেশ ও সাবধানতাবোধ যে-কোনো সমস্যা উত্তরণে কার্যকর ও সহায়ক। বানান-বিভ্রাট এড়ানোর জন্য, বিশেষ করে সমোচ্চারিত শব্দের বানান-ভিন্নতা সম্পর্কে ধারণা তৈরির জন্য গভীর অভিনিবেশ, সাবধানতা ও সচেতনতাবোধ অবশ্যই ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। সে কারণেই অতি সাধারণ ও বহুল ব্যবহৃত কতিপয় সমোচ্চারিত শব্দের বানান-ভিন্নতা ও অর্থের পার্থক্য নিয়ে হাল্কা আলোচনা করা যেতে পারে।
‘বিশ্বস্ত’ আর ‘বিশ্বস্থ’ নিয়ে জটিলতা ও বিভ্রান্তির অন্ত নেই। বাস্তবে দু’টি শব্দই শুদ্ধ, শুধু প্রয়োগক্ষেত্রটি আলাদা। ‘বিশ্বস্ত’ মানে বিশ্বাসভাজন বা বিশ্বাসী, আর ‘বিশ্বস্থ’ মানে বিশ্বের মধ্যে। হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, বিকারগ্রস্ত ইত্যাদি শব্দ সঠিক। এখানে ‘গ্রস্ত’ শব্দের অর্থ আক্রান্ত বা গ্রাস করা হয়েছে এমন। কিন্তু স্থান অর্থে শব্দের শেষে ‘স্ত’ ব্যবহার করলে ভুল হবে; এক্ষেত্রে ‘স্থ’ই সঠিক ও যথাযথ। যেমন- ‘ঢাকাস্থ পরীবাগে তার দোকান আছে’।
বাংলা বানান প্রমিতীকরণের ইতিহাস
১৯ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হলো, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হলো, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন-অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। (বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান, পৃষ্ঠা ৮৮৪)
রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ সরকার মৌলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ-র নেতৃত্বে East Bengal Language Committee গঠন করে। এরপর ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর তদানীন্তন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে বানান-সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষা পর্ষদে বাংলা বানান সরলায়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই এবং মুনীর চৌধুরী এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে একটি বিবৃতি দেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া তৈরি করে।
বানান অভিধান প্রচলিত অভিধান থেকে ভিন্ন
বানান অভিধান প্রচলিত অভিধান থেকে ভিন্ন। প্রচলিত অভিধানগুলো শব্দার্থ অভিধান, যার মূল লক্ষ্য প্রতিটি অন্তর্ভুক্তির নির্ভুল বানানের শাশাপাশি শব্দটির অর্থ ও উৎস নির্দেশ। বানান-অভিধানের লক্ষ্য কেবল শব্দের শুদ্ধ বানানরীতি নির্দেশ করা। প্রশ্ন উঠতেই পারে শব্দার্থের অভিধানেও তো বানান আছে, তাহলে এ ধরনের অভিধানের প্রয়োজনীয়তা কোথায়। প্রয়োজনীয়তা এখানে যে, ভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দ একাধিক বানানে লেখা যায় এবং হয়ও (কখনও ভুল কখনো শুদ্ধ উভয়তই), যা আদেৌ বাঞ্ছনীয় নয়। বানান-অভিধানের লক্ষ্য তাই মূল শব্দ ও তা থেকে উদ্ভূত যাবতীয় শব্দের প্রমিত, এবং সম্ভব হলে, বিকল্পহীন বানান নির্ধারণ করে দেওয়া।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান রীতি
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ করে হয়েছে,"সকল অতৎসম শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের চিহ্ন ব্যবহৃত হবে।যেমনঃ বাঙালি, ইংরেজি, উনিশ, আরবি। তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমনঃ রানী, পরী, গাভী"। কিন্তু 'রানি' বানানের ভুক্তিতে প্রথমেই আছে রানি, তারপরে আছে রানী। অর্থাৎ 'রানি' বানানটিকে অধিকতর প্রমিত বলে ধরা হয়েছে। তাহলে, "কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমনঃ রানী, পরী, গাভী" এই নিয়মের কোন যৌক্তিকতা থাকে বলে মনে হয় না। অপরদিকে, 'পরি' একটি সংস্কৃত উপসর্গ। যেমনঃ পরিশুদ্ধ, পরিমাণ, পরিণাম ইত্যাদি। আর, 'পরী' শব্দটির অর্থ পক্ষবিশিষ্টা কল্পিত সুন্দরী। আমি ব্যক্তিগতভাবে 'পক্ষবিশিষ্টা কল্পিত সুন্দরী' অর্থে 'পরি' শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে নই; এই অর্থে 'পরী' শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে।
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ করা হয়েছে"তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যার অ্যা-কারযুক্ত রূপ বহুল পরিচিত। যেমনঃব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে অ্যা অপরিবর্তিত"।
অন্যদিকে বাংলা একাডেমি তার 'পরিমার্জিত সংস্করণের মুখবন্ধ ও ব্যবহারবিধি' তে উল্লেখ করেছে "কোন শব্দের একাধিক বানান থাকলে সুপ্রচলিত ও নির্বাচিত বানানবিশিষ্ট শব্দটি সর্বপ্রথম এবং অন্যান্য বানানবিশিষ্ট শব্দগুলো উক্ত মানানুযায়ী পরস্পর কমাসহ লিখতে হবে"।কিন্তু বাংলা একাডেমি তার অষ্টাদশ সংস্করণের ১০৬০ পাতায় উল্লেখ করেছে 'লেঠা, ল্যাঠা, লেটা'; অর্থাৎ প্রথম ভুক্তি হল লেঠা। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কেন নিয়মে 'ল্যাঠা' থাকবে ? আর অভিধানে কেন 'লেঠা' থাকবে? প্রথমেই 'লেঠা' উল্লেখ করে বাংলা একাডেমি 'ল্যাঠা' বানানের নিয়মকে অগ্রাহ্য করেছে।একইভাবে এসেছে চ্যাং, চেঙ, চ্যাঙ । তাহলে কোনটি শুদ্ধ? 'চ্যাঙ' অধিকতর শুদ্ধ হলে তা ভুক্তিতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি কেন?
বাংলা বানান ও শব্দ ব্যবহারে কিছু প্রচলিত ভুল
ইংরেজিতে একটি শব্দের একটিই বানান, পৃথিবী জুড়েই তা এক। আমেরিকা তার নিজস্ব স্টাইলে কিছু ইংরেজি বানান লেখে, যা ইংল্যান্ডের বানানের সঙ্গে মেলে না (colour-color)। সেটা ব্যতিক্রম, তা মোটেই বাংলা বানানের মতো যথেচ্ছ নয়। বাংলায় আছে প্রায় দেড় লাখ শব্দ, তার সবটার বানান মনে রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর তা সম্ভব নয় বলেই অভিধান থাকে। অভিধান থেকে শব্দের অর্থ এবং বানান দুটোই পাওয়া যায়। দেখা যায় একই শব্দের একাধিক বানানও চলে, ফলে শব্দের সংখ্যাও আরও বেড়ে যায়। বাংলা বানানের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি হলো, বানানে একক রীতি না-হওয়া। বাংলা বানানে নীতি হচ্ছে সংস্কৃতের বানান এই, অন্য শব্দের বানান এই, দেশি শব্দের বানান এই। পৃথিবীর সব ভাষায়ই মৌলিক এবং আগন্তুক ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু বাংলা ভাষার ইতিহাসে যেভাবে ঘটেছে তা অন্যত্র বোধহয় তুলনীয় নয়। তাই এখানে বানানের যে জটিলতা তা এই ইতিহাসের কারণেই এবং তা এই ভাষার নিজস্ব।
বানান বিতর্কের আগে-পরে যা ভাবা উচিত
ইদানীং বাংলা বানান নিয়ে তর্ক উঠলে অনেকেই বুঝে না-বুঝে বাংলা একাডেমিকে আক্রমণ করে বসেন। বাংলা একাডেমি একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র; সেখানে কাজের জন্য প্রায় ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালের বানান কমিটিতে এবং এর আগে-পরে বিভিন্ন অভিধান প্রণয়নের কাজে যাঁরা ছিলেন, সেই নামগুলো লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন। ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের দুর্বলতা থাকতে পারে; সেই দায় নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানেরও আছে; তবে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সব ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত হয় না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে ধর্ম্ম, কর্ত্তা প্রভৃতি শব্দকে বদলিয়ে ধর্ম, কর্তা গ্রহণ করতে বলার পরে দেবপ্রসাদ ঘোষের মতো অনেকেই তখন মেনে নিতে পারেননি। এখন পর্যন্ত কলকাতায় অসংখ্য নতুন সাইনবোর্ডে আপনি দেখতে পাবেন ‘ধর্ম্ম’, ‘কর্ত্তা’ বানান। এমনকি সম্প্রতি রং করা অনেক গাড়ির গায়েও বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘ধর্ম্মতলা’।
বানানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে
বানানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাঙলা’র বদলে ‘বাংলা’ বানানকে জনপ্রিয় করেছেন। আবার সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবদুল হাই, এনামুল হক, হুমায়ুন আজাদ সারা জীবন রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেই ‘বাঙলা’ লিখে গেছেন। তাহলে ‘বাঙলা’ ঠিক, নাকি ‘বাংলা’? প্রয়োগের ব্যাপারে একটি বানানকে অধিকতর উপযোগী বা যথার্থ বলেছেন ভাষাপণ্ডিতেরা। তাঁরা আরেকটিকে ভুল বলেননি। অথচ বানান নিয়ে প্রচলিত ধারণায় ত্রুটি থাকার কারণে প্রায় সব মানুষ একটি বানানকে ‘শুদ্ধ’, আরেকটিকে ‘অশুদ্ধ’ মনে করেন। ফলে তর্ক ওঠে ‘ইদ’ ঠিক, না ‘ঈদ’? ‘গরু’ না ‘গোরু’? এ রকম তালিকায় পড়তে পারে ‘কুরবানি’ না ‘কোরবানি’; ‘ওজু’ না ‘ওযু’; ‘শিয়াল’ না ‘শেয়াল’ প্রভৃতি অজস্র বানান। সব শব্দ একক বানান নিয়ে চলে না। কোনো কালে একটি বানান অধিকতর ব্যবহৃত হয় মাত্র। একসময় পাখি-পাখী, স্টার-ষ্টার প্রভৃতি বানান নিয়েও তর্ক চলেছে।
মনসুর মুসার মতো কারও কারও চিন্তায় ওই তর্কের অবসান হয়নি। বানানের নতুন রূপ দেখে মনে করা ঠিক নয়, আগে আমরা অনেক বানান ভুল লিখতাম, এখন ঠিক লিখি। কিংবা আগে অনেক বানান ঠিক লিখতাম, এখন ভুল লিখি। বাংলা একাডেমির বানান বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মান্য করার বিধান রয়েছে; জাতীয় পাঠ্যপুস্তকেও সেই বানানের প্রতিফলন ঘটে। ফলে ‘গরু’ বানানে অভ্যস্ত এই প্রজন্ম ‘গোরু’ দেখে যেমন ‘অশুদ্ধ’ মনে করছে; তেমনি একাডেমির সুবাদে পরবর্তী প্রজন্ম আবার ‘গোরু’ বানানেই অভ্যস্ত হয়ে গেলে ‘গরু’ বানানকে ‘অশুদ্ধ’ মনে করবে।
সে কাজে অভিধানকার দীর্ঘদিন লেগে থাকেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে একটি শব্দের নির্দিষ্ট বানানে পৌঁছান। বানানও পরিবর্তনশীল যদি তা ওই ভাষার ব্যাকরণ অনুমোদন করে। কিংবা কোনো জাতির জিহ্বার কারণেও বদলায়। অভিধানে সে ব্যাখ্যাও থাকে।
লেখকরা কেউ কেউ প্রকাশ করেন জেদ ও বিজ্ঞের মূর্খতা
হঠাৎ একদিন টেলিভিশনে দেখেছিলাম, একজন বিশিষ্ট অভিনেত্রী একজন প্রখ্যাত অভিনেত্রীকে বলছেন, হ্রস্ব ‘ই’-কার দিয়ে লিখুন, এখন তো বাংলা একাডেমি সব বানান হ্রস্ব করে দিয়েছে। প্রবীণ অভিনেত্রী সাহিত্যের ছাত্রী, তিনি কিছু বললেন না, অনায়াসে মেনে নিলেন। অর্থাৎ, কোনো পক্ষেরই বাংলা ভাষা তো ভালো কোনো ভাষার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ওদিকে আমি ভাবলাম স্থাপত্যজ্ঞানসম্পন্ন এত বড় নায়িকা যখন আইনপ্রণেতা নায়িকাকে এই জ্ঞান দিতে পারেন তো বাংলা একাডেমি অভিধান খুলে দেখি ঘটনা সত্য কি না। দেখলাম, ‘নারী’ আর ‘অভিনেত্রী’ বানান দুটো বাংলা একাডেমির সব অভিধানে দীর্ঘ ‘ঈ’-কার। ওই বানান দুটো দেখার কারণ, তারা নারী ও অভিনেত্রী। আজকাল অভিনেত্রী শব্দটা অচল বলে দেখলাম, অভিনয়শিল্পী। সেখানে ‘শিল্পী’ শব্দটিও দীর্ঘ ‘ঈ’-কার। তারা জানেন না, এসব আলটপকা কথা অজ্ঞানতারই উলটো পিঠ। প্রচার মাধ্যমে এসব বললে দর্শকশ্রোতা সহজে মেনে নেয়। এদিকে লেখকরা কেউ কেউ প্রকাশ করেন জেদ ও বিজ্ঞের মূর্খতা। সেটা খারাপ। আর, জনপ্রিয়রা যখন বলেন সেটা অজ্ঞতার প্রচারক। আর, এর বাইরে প্রকাশক মহোদয়রা যা করেন বই সম্পাদনা নিয়ে সে বিষয়ে আর কথা না তোলাই ভালো। তবে সে কথা পেটে রাখা কাজের কথা নয়!
ব্যাকরণের রূপতত্ত্ব অংশে আলোচিত হয় প্রত্যয়
ব্যাকরণের রূপতত্ত্ব অংশে আলোচিত হয় প্রত্যয় । নতুন শব্দ গঠনে প্রত্যয়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য । শব্দের রূপ পরিবর্তনে, অর্থ পরিবর্তনে এবং নতুন শব্দ গঠনে এসব প্রত্যয়ের ভূমিকা রয়েছে । প্রত্যয়ের সঠিক ব্যবহার না জানলে বানান শুদ্ধ হয় না । ফলে,প্রত্যয়ঘটিত অশুদ্ধি ঘটে । ব্যাকরণে কৃত্-প্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয় পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে । ২১ টি বাংলা কৃত্-প্রত্যয় এবং ১১টি সংস্কৃত প্রত্যয়ের ওপর নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে আলোচনা করা হয়েছে । এছাড়া ১৬টি বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয়, ১০টি বিদেশি তদ্ধিত প্রত্যয় এবং ১৮টি সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় ওপর নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে আলোচনা করা হয়েছে ।
বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তন কতটা প্রয়োজন
আমরা বানান সংস্কারের বিরোধিতা করি না। কিন্তু যে বানানটি সাহিত্যে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তার পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন দেখি না। যে যুক্ত অক্ষরটি দ্রুততার সঙ্গে লেখা যায় এবং সৌন্দর্যম-িত তাও ভাঙ্গার দরকার আছে বলে মনে হয় না। শিশুদের জন্য অক্ষরের স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে সত্য, কিন্তু শিশুটি তো আর চিরকাল শিশু থাকবে না। সে বড় হবে, তার বোধশক্তি বাড়বে, সে বৈচিত্র্যের সন্ধানী হবে।
প্রচলিত যুক্তাক্ষর তখন তার কাছে কোন সমস্যাই হবে না। যেমন হয়নি আপনার, আমার এবং অন্য সকলের। কেউ কেউ বলেন, বাংলা ভাষায় ঈ-কারের উচ্চারণ নেই। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কবিরা ঈ-কারকে ত্যাগ করবেন কীভাবে? তাঁরা লেখেন “সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ/ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে” অথবা “স্পেন থেকে চীন প্রদেশে বিলীন/ অথচ তাদের চিনি”। যাঁরা কবিতা পড়েন তাঁরা ‘দ্বীপ’, ‘চীন’, ‘বিলীন’ প্রভৃতি শব্দে জোর না দিয়ে পারবেন না। সেক্ষেত্রে ওসব শব্দে ঈ-কার দেয়া কি প্রয়োজন নয়? তাছাড়া দিন/দীন, চির/চীর, কৃতি/কৃতী, বিনা/বীণা, গিরিশ/গিরীশ, বিজন/বীজন প্রভৃতি শব্দের পার্থক্য টানা হবে কীভাবে? ণ, ষ এবং স-এর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
ওগুলোকে বাদ দিলে বাংলা ভাষা থেকে শত শত শব্দ ঝরে পড়বে। বলা হয় তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে বানান ঠিক থাকবে। কিন্তু বানান পরিবর্তনের মায়াজালে পড়ে অনেকে তৎসম শব্দেও ই-কার দিয়ে লিখছেন। শ্রেণী ও পদবী দুটিই তৎসম শব্দ। সংস্কৃতে শব্দটি বিকল্পে ই-কার দিয়েও লেখা হয়। যেহেতু শ্রেণী এবং পদবী সুপ্রচলিত, তাই শব্দ দুটিকে শ্রেণি এবং পদবি বানানে না লিখলেও চলে। কিন্তু অনেকে এখন শ্রেণী এবং পদবী বানানকে ভুল বলে থাকেন সংস্কারকদের প্ররোচনায়। অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা বানান অভিধানে’ লিখেছেন, “সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম শব্দের বিকল্প বানান রাখা হল। অন্তরিক্ষ, অন্তরীক্ষ। যুবতী, যুবতি। শ্রেণি, শ্রেণী। পরিবেশন, পরিবেষণ।
তথ্যসুত্র
শুদ্ধ বানানটিকেও পরিবর্তন করে ভিন্ন রূপ দেয়া হচ্ছে, Daily Jana Kantha.
প্রত্যয়ের সাহায্যে গঠিত কিছু শব্দ, Ittefaq.
অনেকগুলো ভাষা খুব ভালো জানতেন, Desh Rupantor.
বানান শব্দের লিখিত চেহারা মাত্র, Prothomalo.
বানানের যে জটিলতা তা এই ইতিহাসের কারণেই , Deshrupantor.
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ করে হয়েছে, Bangla. News24.
সংশোধন ও পরিমার্জন করার প্রয়োজন পড়ে, Somewhereinblog.
বাংলা ভাষায় সমোচ্চারিত শব্দের সংখ্যা অনেক, Shomoy BD.
সৃষ্টিশীল লেখকেরা ভাষার সন্ধিগুলো ভেঙেছেন, Risingbd.