বাওয়ালিদের গল্প (Story of Bawalis)

বাওয়ালিদের গল্প (Story of Bawalis)

বাওয়ালি কাদের বলা হয়

বাওয়ালি' বলা হয় যারা সুন্দরবনের গোলপাতা সংগ্রহ করে।

সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণে ব্যস্ত বাওয়ালিরা

সুন্দরবনের একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। নামে গোল হলেও এ পাতা গোলাকার নয়, লম্বা। সবুজ বর্ণের এ পাতা অনেকটা নারকেলগাছের পাতার মতো। বন বিভাগের অনুমতি পেয়ে বর্তমানে গোলপাতা আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাওয়ালিরা।সুন্দরবনে যাঁরা গোলপাতা সংগ্রহ করেন তাঁদের বাওয়ালি নামে ডাকা হয়। একাধিক বাওয়ালি এই প্রতিবেদক বলেন, আগের তুলনায় গোলপাতার ব্যবহার কমলেও জীবিকার তাগিদে পুরানো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।

এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ভালো ব্যবসা নেই জানিয়ে কয়রার সদরের বাওয়ালি কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গোলপাতার ঝাড়ের মধ্যে বাঘ লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা থাকে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনে এ পাতা কাটতে যেতে হয়। অনুমতি নেওয়ার পরে বন বিভাগ নির্ধারণ করে দেয়, কে কোনো অঞ্চল থেকে গোলপাতা কাটবেন।

গোলপাতা সংগ্রহ করার অনুমতি নিয়েছেন বাওয়ালিরা।

খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা আহরণের সহকারী কুপ (জোন) কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা রেঞ্জে এ বছর ৯০ হাজার কুইন্টাল গোলপাতা কাটার অনুমতি (পারমিট) দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ১১১টি নৌকায় ২০ হাজার ৫৮২ কুইন্টাল গোলপাতা সংগ্রহ করার অনুমতি নিয়েছেন বাওয়ালিরা। অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিটি নৌকা ২৮ দিন করে গোলপাতা আহরণ করতে পারবে।

একাধিক বাওয়ালির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনের তালতির খাল, শেখের খাল, মুরুলীর খাল, বরইকাটি খালের দুই পাড়ে এবার গোলপাতার ছড়াছড়ি। সারি সারি গোলপাতার গাছগুলো ঝাড় আকারে বিন্যস্ত রয়েছে এসব জায়গায়। তুলনামূলকভাবে কম দাম, শক্ত ও অধিক টেকসই হওয়ার কারণে সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকায় ঘরের ছাউনির কাজে গোলপাতা ব্যবহৃত হয়।উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গোলপাতার ছাউনির ঘরে গরমের সময় ঠাণ্ডা এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। গোলপাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে তিন–চার বছর অনায়াসে পার হয়ে যায়।

সুন্দরবন–সংলগ্ন ৬ নম্বর কয়রা এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন বলেন, তুলনামূলকভাবে গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়ায় দিন দিন এর ব্যবহার কমছে।সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণে প্রতি নৌকায় আট-নয়জন থাকেন বলে জানিয়েছেন একই এলাকার বাওয়ালি মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, বাওয়ালিদের কেউ পাতা কাটেন, কেউ কাটা পাতা টেনে নৌকায় তোলেন, আবার কেউ নৌকায় পাতা সাজানোর কাজ করেন। এরপর লোকালয়ে আনার পর এক কাউন (১৬৮০টিতে এক কাউন) ভালো গোলপাতা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হয়।খুলনা রেঞ্জের গোলপাতার কুপ (জোন) কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাওয়ালিরা যাতে নির্বিঘ্নে গোলপাতা কাটতে পারে সে জন্য নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। তবে নানা সংকটে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ না থাকায় চলতি মৌসুমে গোলপাতা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না–ও হতে পারে।

গোলপাতা আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছেন বাওয়ালরা

টিনের দাম ম্যালা (অনেক) কম। যার জন্যি কমছে গোলপাতার কদর।সুন্দরবন সংলগ্ন পাইকগাছা উপজেলার ফকিরাবাদ গ্রামের বাওয়ালি আতিয়ার রহমান এ কথা বলেন।তিনি জানান, গোলপাতার দিন শেষ হয়ে আসছে। সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণ মৌসুমে এবার তেমন সাড়া মিলছে না বাওয়ালিদের। বনবিভাগের কড়াকড়ি আরোপ ও তুলনামূলকভাবে গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়াতে দিনকে দিন এর ব্যবহার কমছে। দুই মাসের জন্য বড় ট্রলার নিয়ে যেতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা গোলপাতা বিক্রি করে ওঠে না। তার ভাষ্য মতে, সুন্দরবনের নদী-খাল পাড়ে ও গভীর বনে গোলপাতার বিশাল বিশাল কূপ (প্রজনন ক্ষেত্র) রয়েছে। পাশ নেওয়ার পরে বন বিভাগ নির্ধারণ করে দেয় কে কোনো অঞ্চল থেকে গোলপাতা কাটবে।

একই এলাকার বাওয়ালি মোস্তাক গাজী জানান, গোলপাতার কদর আগের মতো না থাকলেও জীবিকার তাগিদে পুরানো পেশা টিকিয়ে রাখতে ও নিতান্তই দরিদ্র মানুষের চাহিদা মেটাতে অনেকেই বনে যান গোলপাতা কাটতে। আসন্ন মৌসুমকে সামনে রেখে নৌকা ও ট্রলার মেরামত করছেন মহাজন-বাওয়ালিরা। তিনি জানান, কয়েকদিন পরই এ মৌসুমের গোলপাতা আরহণ শুরু হবে। কিন্তু বন বিভাগ অনেক জায়গায় অভয়ারণ্য ঘোষিত করায় সেসব স্থানের কূপ থেকে গোলপাতা কাটা যায় না। গোলপাতা কাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাতা নষ্ট হচ্ছে। এক জায়গায় অধিক গাছ হওয়ায় গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গোলগাছ নারকেল গাছের মতো ঝোড়া বা পরিষ্কার করা না করলে ফলন কমে যায়।

বাঘের আক্রমণের কারণে গোলপাতা সংগ্রহ করা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

মোস্তাক গাজী জানান, সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কেটে আনার পর সেগুলো খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও সরূপকাঠির বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করা হয়। এক কাউন ভালো গোলপাতার দাম ২ হাজার ৭০০-৩ হাজার টাকা। বাওয়ালিরা জানান, কোনো এক সময় ঘরের চালে গোলপাতার ছাউনি উপকূলসহ বিভিন্ন জেলায় খুব জনপ্রিয়। এ পাতার ছাউনি ঘর গরমের সময় ঠাণ্ডা ভাব এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। গোলপাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে ৩/৪ বছর পার হয়ে যায়। প্রতি বড় নৌকা বা ট্রলারে ৯-১০জন বাওয়ালি গোলপাতা কাটা, আহরণ ও মজুদের কাজে নিয়োজিত থাকে। বাঘের আক্রমণের কারণে গোলপাতা সংগ্রহ করা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।তারা অভিযোগ করেন, গোলপাতা কাটার পাস পারমিট পেতে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় অনেক সময়। তাছাড়া বনে আগের মত ভালো মানের বড় গোলপাতা পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও জীবিকার টানে গোলপাতা কাটতে হয়।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে শরণখোলা, চাঁদপাই ও শ্যালা নামক তিনটি গোলপাতা কূপ রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগে খুলনা রেঞ্জেও তিনটি গোলপাতার কূপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-সাতক্ষীরা, আগুয়া শিবসা ও শিবসা কূপ। জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার লোকদের ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য গোলপাতা ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। এ কাজে যুক্ত আছে প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক। সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নদী ও খালের চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গোলগাছ জন্মে। জোয়ারবিধৌত জমির বীজতলায় সাধারণত গোলপাতার চারা তৈরি হয়। পাঁচ বছর বয়সী গাছের পাতা বছরে একবার কাটা হয়। উদ্ভিদটির মাঝের ও সংলগ্ন কিছু কচিপাতা রেখে অন্য সব পাতাই কাটা যায়।সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে গোলপাতা কাটার জন্য বাওয়ালিরা নৌকা ও লোকবল নিয়ে পাস পারমিট নিচ্ছেন। পাস পারমিটের কাজ সম্পন্ন হলে এ মাসের শেষে

বিপাকে বাওয়ালি ও গোলপাতা ব্যবসায়ীরা

ঢেউটিনের ব্যবহার বাড়ায় গোলপাতার চাহিদা কমে গেছে। মৌসুম শেষের দিকে চলে এলেও সুন্দরবনে যারা গোলপাতা সংগ্রহ করেন (বাওয়ালি) তারা গোলপাতা কেটেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না। এ কারণে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। গোলপাতার চাহিদা কমে যাওয়ায় বাওয়ালিদের সঙ্গে সঙ্গে বিপাকে পড়েছেন গোলপাতা ব্যবসায়ীরাও।খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের সুতারখালী এলাকার বাসিন্দা বাওয়ালি জামাল সানা বাংলানিউজকে বলেন, গোলপাতার দাম এখন খুবই কম। বলতে গেলে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কাউন ২৪-২৫শ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সুন্দরবনের পাস পারমিট নিয়ে শ্রমিক খাটিয়ে গোলপাতা কেটে এনে বিক্রি করে যে টাকা খরচ হয় তাও ওঠে না।

অনুরূপভাবে কালা বগি এলাকার বাসিন্দা কাওসার বলেন, সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কেটে এনে খরচই ওঠে না। বাজারে গোলপাতার কদর নেই। টিনের প্রচলন এখন বেশি। এসব কারণে খুব কম সংখক লোক এখন বাওয়ালি পেশায় রয়েছে।একাধিক বাওয়ালি বলেন, প্রতি কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব ছিল ২৫ টাকা। আর তা বাড়িয়ে প্রতি কুইন্টাল ৬০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এরপরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সে হিসাবে বড় একটি নৌকায় পাস পেতে ১৩ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হচ্ছে। শ্রমিকের খরচও অনেক বেড়েছে। আগে মাসে ৫/৬ হাজার টাকায় একজন শ্রমিক পাওয়া যেতো, আর এখন ২০ হাজার টাকা লাগে। এক নৌকা গোলপাতা আনতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। পেশা টিকিয়ে রাখতে এখনও বনে যাচ্ছি। গরানের অনুমতি মিললে আমরা টিকে থাকতে পারতাম। এছাড়া রাজস্ব মওকুফের দাবি জানান তারা।

খুলনার সোনাডাঙ্গা এম এ বারি সড়কের গোলপাতা বিক্রেতা আব্দুল আজিজ বলেন, বর্তমানে প্রতি পোন গোলপাতা বিক্রি হচ্ছে ৩শ টাকা দামে।জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার লোকদের ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য গোলপাতা ব্যাপক ব্যবহৃত হত। গ্রাম-গঞ্জের বেশির ভাগ ঘরের চাল ছাউনীতে এখন টিন কিংবা এ্যালবেস্টারের ব্যবহার হচ্ছে।এদিকে গোলপাতার চাহিদা কমলেও আহরণ খরচ বেশি হওয়ায় দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। টিন বা এ্যালবেস্টারের চেয়ে তুলনামূলক টেকসইও অনেক কম। ফলে টিন কিংবা এ্যালবেস্টারের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে আর গোলপাতার কদর কমেছে।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে শরণখোলা, চাঁদপাই ও শ্যালা নামক তিনটি গোলপাতা কূপ রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগে খুলনা রেঞ্জেও তিনটি গোলপাতার কূপ রয়েছে। এগুলো-সাতক্ষীরা, আগুয়া শিবসা ও শিবসা কূপ। সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণ মৌসুম চলছে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণ চলবে।

তবে প্রতিবছর ক্রমাগত গোলপাতা আহরণ কমছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। গত বছর অনেক অফিসে লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশও রাজস্ব আয় হয়নি।চলতি বছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় মাত্র ২৮টি নৌকার পাস নিয়ে ১৬৮ জন বাওয়ালি সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন। এবার সেখানে ৪৬ হাজার মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গতবার সাতক্ষীরায় ১০ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা আহরণ করা হয়।

খুলনা রেঞ্জের আওতায় ৫টি স্টেশনে ৩ হাজার ৬৯ মেট্রিক টন গোলপাতা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রথম দফায় ১১৮টি নৌকা পাস নিয়েছে। চাঁদপাই রেঞ্জের দুটি কুপ থেকে এবছর ৭ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে এ রেঞ্জের আওতায় মাত্র ৩৭টি নৌকার পাস দেওয়া হয়েছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে সাত হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ শতাংশ গোলপাতা আহরণ করা হয়।

সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে বাওয়ালি নিহত

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের পায়রাটুনি এলাকায় বাঘের আক্রমণে আবুল কালাম (৫৫) নামের এক বাওয়ালি নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।বাঘের আক্রমণে নিহত আবুল কালাম শ্যামনগর উপজেলার ছোটকুপোট গ্রামের মৃত আতেক গাজীর ছেলে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঘটনা নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছে। আবুল কালাম দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ছিলেন।নিহতের বড় ছেলে মহসীন হোসেন জানান, নওয়াবেঁকী এলাকার আবদুল আজিজের শ্রমিক হিসেবে তাঁর বাবা কয়েকজনের সঙ্গে ১৬ দিন আগে সুন্দরবনে যান। মঙ্গলবার পায়রাটুনি এলাকায় গোলপাতা কাটার সময় রয়েল বেঙ্গল টাইগার তাঁর ওপর আক্রমণ করে। এ সময় সহযোগীরা দ্রুত এগিয়ে এসে একযোগে পাল্টা আক্রমণ করে মৃত অবস্থায় তাঁর বাবাকে উদ্ধার করেন।

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালীনি স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ জানান, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘পাস’ (অনুমতিপত্র) নিয়ে মহাজন আবদুল আজিজের সঙ্গে আবুল কালামসহ ছয়জন সুন্দরবনে গোলপাতা কাটতে ঢোকেন। তিনি আরও জানান, ২৭ দিনের অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশের ১৬ দিনের মাথায় বাঘের আক্রমণে মারা যান আবুল কালাম। তাঁর সঙ্গীরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেছেন। বন বিভাগের আইন অনুযায়ী নিহতের পরিবারকে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হবে।

বিপদসংকুল এক বনপ্রান্তরে বাওয়ালীদের জীবন

বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট (লোনা পানির জঙ্গল) সুন্দরবন। বনের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষ অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন বনে ঢোকেন। বাঘ, সাপ, নানা ধরনের কীটপতঙ্গ এবং জলে কুমীর ও হাঙ্গরের সাথে লড়াই করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। এছাড়া সুন্দরবনের সর্বত্র রয়েছে বিভিন্ন নামে গড়ে উঠা বনদস্যু বাহিনীর মুক্তিপণের দাবীতে অপহরণ আতঙ্ক।

বাওয়ালি সুন্দরবনের কাঠকাটা শ্রমিক

বাওয়ালি সুন্দরবনের কাঠকাটা শ্রমিক। কাঠ কাটার সময় বনের হিংস্র জন্তুর আক্রমণ ও অন্যান্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বাউলদের (বনদেবীর সাধনাকারী) সাহায্য নেয় বলে তাদের নাম হয়েছে বাওয়ালি। লোকবিশ্বাস অনুসারে বাউলেরা বাঘ-বাঁধা মন্ত্র জানে। তারা গন্ডি কেটে বাঘ বন্দি করে কিংবা মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দেয়।

বৃহত্তর বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা এবং খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা বংশানুক্রমে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে স্বরূপকাঠি উপজেলার বর্ষাকাঠি, সোহাগদল, বলদিয়া, সুঠিয়াকাঠি, বলিহারি ও জগন্নাথকাঠির লোকেরাই এ পেশায় অধিক অভিজ্ঞ। বর্ষাকাঠির বাওয়ালিরা সুন্দরবনের প্রাচীন বাওয়ালিদের বংশধর বলে জানা যায়।

বাওয়ালিরা বিস্তৃত বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ করে।

বাওয়ালিরা বিস্তৃত বনভূমি থেকে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া প্রভৃতি কাঠ সংগ্রহ করে। ঠিকাদাররা ২০-১০০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত ঘের নিলামে কিনে চুক্তির ভিত্তিতে কাঠ কাটার জন্য এদের নিয়োগ করে। সুন্দরবনের বর্ষপঞ্জি এবং প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি অনুসারে বাওয়ালিদের জীবন পরিচালিত হয়।

কাঠ কাটার পারমিট (অনুমতি পত্র) সম্পন্ন হয় বর্ষাকালে। আষাঢ় মাসের মধ্যে সরকারী বনকর্মীগণ কর্তনযোগ্য কাঠের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেন এবং গাছের কান্ডে নাম্বার দিয়ে ঐসব গাছ চিহ্নিত করে থাকে। এরপর বাওয়ালিরা ছয় জন, আট জন বা দশ-বারো জন মিলে একজন সরদারের অধীনে গাছ কাটা শুরু করে। শীত মওসুম, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনে এই কাঠ কাটার মৌসুম চলে।কাঠ কাটার সময় বাওয়ালিরা টোঙ্গ ঘরে বাস করে। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাটি থেকে প্রায় ছয় ফুট ওপরে এই টোঙ্গ ঘর তৈরি করা হয়। টোঙ্গ ঘর এক তৃতীয়াংশে থাকে রান্নার ব্যবস্থা। তারা যে কাঠ কাটে তা ওখান থেকে চলে যায় খুলনার সহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায়। তাছাড়া সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রাম অঞ্চলেও এ কাঠের চাহিদা রয়েছে।

সুন্দরবনে বাওয়ালিরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে।

সুন্দরবনে বাওয়ালিরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। তারা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাতে যেমন টোঙ্গ ঘর বাস করে, তেমনি কুমির-হাঙ্গরের ভয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘটিতে পানি ঢেলে গোসল করে। তারা দৈনন্দিন কাজের জন্য খালের নোনা পানি ব্যবহার করে। রান্না ও খাওয়ার জন্য মিঠা পানি সংগ্রহ করে রাখে। কাঠ কাটতে যাবার সময় তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় এবং নদী থেকে মাছ শিকার করে খায়।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাস বাওয়ালিরা গোলপাতা কাটে। গোলপাতা ঘর ছাওয়া এবং পাটি বোনা সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এ সময় তারা জলদস্যুদের ভয়ে বড় বড় নৌকায় দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। জীবনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাওয়ালিরা সুন্দরবনে এক দ্বীপান্তরের জীবন যাপন করে। সারা দিন কাজের পর সন্ধ্যাবেলায় তারা সুর করে গাজীকালু-চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, মনসামঙ্গল ও রায়মঙ্গল-এর বাঘ ও সাপের উপাখ্যান পাঠ করে চিত্তবিনোদন করে।গাজী-কালু-চম্পাবতীর পুথিতে গাজীর বাঘবাহিনী কালু রায়ের কুমির বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। এই কাহিনীর নায়ক দক্ষিণ রায় ও গাজীকালু বাওয়ালিদের মনে সাহস জোগায়।

বাওয়ালি-তাড়ালে সুন্দরবনও বাঁচবে না

প্রচার করা হচ্ছে, বাওয়ালি-মৌয়ালরা বন খেয়ে ফেলছে। তাদের পায়ে দড়ি দিলেই বন হু হু করে বাড়বে—এ রকম একটা ধারণা নীতিনির্ধারণী মহলকে বেশ ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে বনের মালিক বন বিভাগ। পরিণামে সুন্দরবনে বাওয়ালিদের প্রবেশ কঠোরভাবে সীমিত করার চেষ্টা চলছে। মানুষের যেমন বন প্রয়োজন, বনেরও তেমনি মানুষ প্রয়োজন। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো বনে মানুষ না ঢুকালে বনের স্বাভাবিক বিস্তার বিঘ্নিত হবেই। ২০০৮ সালে সিডরে আক্রান্ত সুন্দরবনকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বনে বাওয়ালিরা যাবে না, তাহলেই বন নিজের মতো করে বেড়ে উঠবে—খুবই নান্দনিক ধারণা। কিন্তু কী পেলাম আমরা? এক বছরের মধ্যে খবর রটে গেল, সুন্দরবন লতাজাতীয় আগাছায় ছেয়ে যাচ্ছে। অজানা-অচেনা এক লতা বড় বড় গাছের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রাস করে ফেলে গাছ। আগে কেন তা করত না? এখন কেন করল? এটা কি সিডরের তাছির, না অন্য কিছু? মৌয়ালরা মধু সংগ্রহে গেলে গাছে ওঠার সময় গাছকে পরিষ্কার করে। আগাছাগুলো কেটে দেয়, গাছ ভারমুক্ত হয়। মৌয়ালদের অনুপস্থিতিতে সে কাজ কে করবে? বন কর্মকর্তা বনবাবুরা? তারা কেন দা-কাটারি হাতে ধরবে?

একই ঘটনা ঘটেছে গোলপাতার বেলায়। গোলপাতার বন বাড়তে পারেনি যেমন বাড়া উচিত ছিল। গোলপাতা তাল, নারকেল-জাতীয় গাছ। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছে নিপা পাম। তাল-নারকেল বছর বছর ঝুড়তে হয়, মানে এ গাছগুলোর পরিণত ডালগুলো কেটে দিতে হয়, গাছের মাথা পরিষ্কার করে দিলে নতুন ডাল ডানা মেলে, ফুল মুকুলিত হয়ে ফল ধরে। কয়েক বছর নারকেলগাছ পরিষ্কার না করে দিলে ফল ধরা বন্ধ হয়ে যায়, গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব গাছ পরিষ্কার করার আবার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। বর্ষার পর আশ্বিন মাসে নারকেলগাছ পরিষ্কার করতে হয়। কোনোমতেই কার্তিক পার করা ঠিক নয়। আবার তালগাছ পরিষ্কার করার সময় মাঘ-ফাল্গুন। মূলত, ফাল্গুন-চৈত্রের দাবদাহ শুরুর আগেই এভাবে তালপাতার পাখাও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

গোলপাতা পরিষ্কারের সময়ও এটা মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে—মানে মার্চের পর আর কাটা ঠিক নয়। এই পঞ্জিকা মেনেই এযাবৎ বন বিভাগ বাওয়ালিদের অনুমতি দিত। চাঁদপাই ও শরণখোলা—এই দুই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন আর খুলনা সাতক্ষীরা রেঞ্জ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন। এবার বাওয়ালিদের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে সীমিত আকারে গোলপাতা আহরণের পাস দেওয়া হলেও শরণখোলা রেঞ্জে কোনো পাস দেওয়া হয়নি। ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা চলাচলের অনুমতির রেওয়াজ থাকলেও এবার মাত্র ১৩৩টি বাছাই করা (রাজনৈতিক বিবেচনায় কি?) নৌকাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ (বন কর্মকর্তা) সংবাদমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তা ছাড়া নৌকার দৈর্ঘ্য নিয়েও বায়নাক্কা আছে। বন বিভাগের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ বছর এমনিতেই দেরি করে অনুমতি দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। আবার ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে গোলপাতা কাটার সব আদেশ স্থগিত করে বন থেকে সব বাওয়ালিকে বের করে দেওয়া হয়। পরে নানা শর্ত দিয়ে আবার অনুমতি দিলে অনেকেই পক্ষে আবার নৌকা জোগাড় করে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। লোকসানের টাকাই শুধু তাদের গুনতে হয়েছে।বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডিএফও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিতান্তই মানবিক বিবেচনায় বাওয়ালিদের সংসারের কথা ভেবে এসব সীমিত অনুমতির ব্যবস্থা। দয়ার সাগর বন কর্মকর্তা।

তাহলে গোলপাতার ঝাড় পরিষ্কার করবে কে? বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গোলপাতার ফুল হবে, বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলে গোলপাতার গুড়ের মৌসুম এবার কি শূন্য থাকবে। গোলপাতা এখনো দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান গৃহনির্মাণসামগ্রী। আসন্ন কালবৈশাখী আর বর্ষার মৌসুমের আগে তাদের ঘর ছাওয়ার কাজ শেষ করে ফেলতে হয়। গোলপাতার সরবরাহ কম থাকায় দাম এই ভরা মৌসুমেও আকাশছোঁয়া। বড় গৃহস্থরা পারলেও প্রান্তিক মানুষেরা এবার পারবে কি? সীমিত ভাগ্যবান মুখচেনা নৌকামালিকদের ভালো ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে আমরা না বনের ভালো করলাম, না প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ালাম। এই প্রান্তিক মানুষেরাই এ দেশটা স্বাধীন করার জন্য মুক্তিপণ যুদ্ধ করেছিল। ছাউনির গোলপাতা এখন আকাশের চাঁদ—গাছেরাও খুশি নয়। বনজীবীদের যাতে ভালো হয়, বনেরও তাতেই মঙ্গল। এই সত্যটা না বুঝে কীভাবে চলবে বন প্রশাসন?

বাওয়ালিদের বিপন্ন জীবিকা

সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণ শুরু হতে না হতেই চাঁদাবাজরা তৎপর হয়ে উঠেছে। সমকালের লোকালয় পাতায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত রিপোর্টে দেখা যায়, সুন্দরবনের গোলপাতা আহরণ মৌসুমকে টার্গেট করে বনদস্যু গ্রুপগুলো চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। তারা ইতিমধ্যেই নৌকার মহাজন ও বাওয়ালিদের কাছে চাঁদার নির্ধারিত অর্থ পরিশোধের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে। ধার্যকৃত চাঁদা পরিশোধ না করা হলে গোলপাতা সংগ্রহে গহিন অরণ্যে গমনকারী বাওয়ালি ও তাদের মাঝিসমেত নৌকা জিম্মি করার হুমকিও দিয়েছে। ফলে গোলপাতা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে প্রবেশের প্রস্তুতরতদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। অথচ বিডিংয়ের মাধ্যমে বাওয়ালিরা সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহের অধিকার লাভ করেছেন। বনদস্যুদের ধার্যকৃত চাঁদার অর্থ পরিশোধ করতে গেলে গোলপাতা সংগ্রহের পর তা বিক্রিলব্ধ অর্থে তাদের জীবিকা নির্বাহের মতো লাভ থাকবে না।

সুন্দরবনের বাওয়ালিরা বনে বাঘসহ জীবিকা নির্বাহ করেন

সুন্দরবনের বাওয়ালিরা গহিন বনে বাঘসহ নানা শ্বাপদের মুখোমুখি হয়ে তবেই না জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনো কোনো বাওয়ালির ওপর বাঘ হামলে পড়ে এবং অনেক আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ধরনের বিপজ্জনক পেশাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা ও পরিবার-পরিজনের নূ্যনতম ব্যবস্থা করার পথও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তারা ‘ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমির’ প্রবচনের মতো সাক্ষাৎ বিপদকে সঙ্গী করেই বেঁচে থাকেন। প্রশাসনের উচিত সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণকারী বাওয়ালিদের জীবন ও জীবিকাকে নিরাপদ করা।

এ জন্য গহিন বনের বিপদ থেকে রক্ষার পাশাপাশি বনদস্যুদের চাঁদাবাজিমুক্ত রাখাও জরুরি। সেখানে কারা এ ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত সেটা স্থানীয় প্রশাসন ও বনরক্ষীরা ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন। বনদস্যুদের গডফাদাররা আবার বনে নয় লোকালয়েই ভদ্রবেশে বিচরণ করে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নাম ও চেহারায় পরিবর্তন ঘটে মাত্র। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরমের কথা ওপেনসিক্রেট। তাই প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহল সিদ্ধান্ত নিলে বনদস্যুদের দমন করা দুঃসাধ্য হবে না। বাওয়ালিরা যখন সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন তখন তাদের যেন জীবন-জীবিকা নিয়ে সংশয়ে না থাকতে হয়।

বাওয়ালিদের অভিযোগ বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে

খুলনার পশ্চিম সুন্দরবনের কয়রা উপজেলায় কাশিয়াবাদ স্টেশনের আওতাধীন দুটি ফাঁড়ির ইনচার্জের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় জেলেরা। তারা অভিযোগ তুলে বলেন, বজবজা ফাঁড়ির ইনচার্জ তানজিরুল ইসলাম ও খাসিটানা ফাঁড়ির ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলমকে চাঁদা না দিলে নিরীহ জেলে ও বাওয়ালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তারা হয়রানি করেন।বৃহস্পতিবার (১৮ মে) বিকেল ৫টায় উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাজারে জোড়শিং, পাতাখালী, খাসিটানা গ্রামের দেড় শতাধিক মাছ ও কাঁকড়া ধরা জেলে এবং বাওয়ালিরা মানববন্ধনে নানা অভিযোগ তোলেন। সেই সঙ্গে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে অসাধু কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানান।

তারা অভিযোগ তোলেন, বৈধ পাশ-পারমিটে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে গেলেও টাকা না দিলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে হরিণ শিকারে সহায়তা করে তারা। সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দেন বন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনার কয়রা উপজেলায় সুন্দরবনের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদা না দেওয়ায় মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ এনে কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের বিপুল কুমার সরকার।

জেলে গোলাম রসুল ও আছাদুল গাজি বলেন, দীর্ঘদিন তারা সুন্দরবনে মাছ ধরতে যায় না। কী কারণে বজবজা ফাঁড়ির ইনচার্জ এক ডজনের বেশি মামলা দিয়েছেন এটা আমাদের জানা নেই। পরে আমাদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে মামলা প্রত্যাহারের কথাও বলেন তিনি। এটা তাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের হয়রানি করা ছাড়া আর কিছু নয়।উত্তর বেদকাশির আকবার হোসেন জানান, তিনি এখনো সুন্দরবনে প্রবেশ করেননি। তার নামে তিনটি হরিণ শিকারের মামলা হয়েছে। খাসিটানা গ্রামের বাসিন্দা লতিফ গাজী বলেন, খাসিটানা ফাঁড়ির বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম আমার নামে হরিণ শিকারের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। তার দাবি, তিনি কখনো সুন্দরবনে যাননি। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শতাধিক জেলে তাদের নামে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দ্রুত প্রত্যাহারসহ বন কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানান।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বজবজা ফাঁড়ির ইনচার্জ তানজিরুল ও খাসিটানা ফাঁড়ির ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা বলেন, কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলা দেওয়া হয়নি। প্রকৃত দোষী ও চিহ্নিত পেশাদার হরিণ শিকারিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।এ ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডা. আবু নাসের মোহসিন হোসেন অভয়ারণ্যে মাছ ধরার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে বলেন, আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। মানববন্ধনের বিষয় সম্পর্কেও আমি অবগত নই। আমি অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর।

সুন্দরবনে ৬ দফা দাবিতে বাওয়ালীদের মানববন্ধন

বাড়িতে চাল নি, খেতে পাচ্ছিনে" ছেলেপিলে কডার লেখাপড়ার খরচ চালাতি পাচ্ছিনে। ভাটার সিজন শেষ, এদিক আবার বাদার পাশ বন্ধ। আমরা এখন কেম্বায় আয় নোজগার করবো, কি খাবো। আঙ্গা পেটে আর লাথি মারবেন না। জঙ্গলের পাশটা খুলি দিলি আমরা জম্মের বাঁচা বেঁচি যাতাম।” আবেগ আর ক্ষোভ মাখা কণ্ঠে ছলছলে চোখ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কলবাড়ী গ্রামের সুন্দরবন নির্ভর জেলে গোপাল মন্ডল।গত ১ জুন থেকে বনবিভাগ ইলিশ প্রজনন মৌসুমকে উপলক্ষে সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

এতে জেলে বাওয়ালীরা সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ধরতে না পারার কারনে উপকূলীয় হাজারো জেলে পরিবারে নেমে এসেছে স্থবিরতা।উপার্জনের একমাত্র সম্বল হিসেবে যে সুন্দরবন ছিল, সেটিতে যাওয়া তো দূরের কথা, নদীর পানি পর্যন্ত ছুঁতে পারে না তারা।এমনই পরিস্থিতে সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ছয় দফা দাবিতে মঙ্গলবার ১১টায় উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুরস্থ বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে উপকূল সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালীরা।মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা জেলা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি মো. আজিবর রহমান।

সুন্দরবন নির্ভর জেলে-বাওয়ালীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জাগো যুব ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শেখ ফারুক হোসেন,জেলে বাওয়ালী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুঞ্জুরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, মো. আক্তার হোসেন, আব্দুল হালিম, বিলাল হোসেন প্রমুখ।বক্তারা বলেন, আমরা এই অঞ্চলের জেলে-বাওয়ালী। এই নদী, বনই আমাদের পরিবার। আমরা সুন্দরবনে যেতে না পারলে আমাদের পেটে ভাত হয় না। দয়া করে আমাদের পেটে লাথি মারবেন না।বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, যারা পয়সা দিতে পারে রাতের আঁধারে তাদের নৌকাগুলো জঙ্গলে মাছ ধরতে যেতে পারে। আর আমরা যারা ঘুষ দিতে পারি না, তাদের নৌকাগুলো ডাঙ্গায় তুলে রাখতে হয়েছে।বক্তারা বলেন, নদীকে বিশ্রাম দেওয়ার কথা বলে এবং ইলিশ ও কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম বিবেচনায় তিন মাস জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালীদের সুন্দরবনে প্রবেশের পাশ বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ সুন্দরবন সাতক্ষীরার রেঞ্জের নদীতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ে না।

তাছাড়া নদীকে বিশ্রাম দেওয়া তো দূরের কথা নিয়মিত কার্গো চলছে। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে জেলেদের পাশ বন্ধ রাখা হয়েছে, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাশ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভারতের জেলেরা আমাদের রেঞ্জের মাছ, মধু, কাকড়া আহরণ করে লাভবান হচ্ছে।বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, পাশ বন্ধ থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালীকে ৮৬ কেজি করে চাউল দেওয়ার কথা থাকলেও সঠিকভাবে তা দেওয়া হয়নি। সাতক্ষীরায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ২৩ হাজার। অথচ চাউল পেয়েছে মাত্র ১৯৭৯ জন। এছাড়াও অনিবন্ধিত লক্ষাধিক জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালী রয়েছে। তারা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বক্তারা সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সাতক্ষীরা রেঞ্জের পশ্চিম সুন্দরবন বন্ধ রেখে রায়মঙ্গল নদীসহ সকল নদী মাছ ধরার জন্য উন্মুক্তকরণ, পাশ পারমিট প্রদানে পূর্বের রেট ফিরিয়ে আনা, সাগরে মাছ ধরার জন্য সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে ফিসিং বোটের লাইসেন্স প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত বনজীবীদের আর্থিক অনুদান প্রদান ও মৎস্য বিভাগ কর্তৃক জেলে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদানের দাবি জানান।

সুন্দরবনের বাওয়ালিদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ

মুজিববর্ষ উপলক্ষে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের জেলে বাওয়ালিদের মাঝে শীতবস্ত্র, লাইফ জ্যাকেট ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। বুধবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. আশরাফুল হক এসব সামগ্রী বিতরণ করেন।বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম হাবিবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন, পশ্চিম জোন মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার বিএন এম হামিদুল ইসলাম, শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আতাউল হক দোলন, কালিগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শেখ ইয়াছিন আলী, শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলহাজ নাজমুল হুদা প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে এ সময় উপকূলীয় এলাকার ৩০০ জন দুস্থ জেলে বাওয়ালিদের মাঝে কম্বল এবং ১০০ জন জেলে বাওয়ালিদের মাঝে লাইভ জ্যাকেট, রেডিও, টর্চলাইট, রেইনকোট ও সাবানসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা হয়।বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এম আশরাফুল হক বলেন, সুন্দরবনের সুরক্ষা ও দস্যুমুক্ত করতে কোস্টগার্ডের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলে বাওয়ালিদের জীবন-জীবিকা নিরাপদ করতে কোস্টগার্ড সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করছে; আগামীতেও এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

৩ মাস পর সুন্দরবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাওয়ালিরা, খুশির আমেজ

সুন্দরবন এলাকার জেলে ও বাওয়ালিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। নৌকা মেরামত ও রঙের কাজ চলছে পুরোদমে। মেরামত করা হচ্ছে জাল। তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর মাত্র এক সপ্তাহ পর তাঁরা জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন। সাময়িক বেকারত্বের অবসান হওয়ায় জেলে, বাওয়ালি ও ট্রলারচালকদের মধ্যে খুশির আমেজ বিরাজ করছে।পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে ৯২ দিনের জন্য নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশেরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আগামী ১ সেপ্টেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।


তথ্যসুত্র

বাওয়ালীদের মানববন্ধন, Abc News24.

বাওয়ালিদের অভিযোগ, Kaler Kantho.

বাওয়ালিদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, Somoy News.

বিপাকে বাওয়ালি, Bangla News24.

বাওয়ালির খুশির আমেজ, Protidin Shebok.

বাওয়ালিদের বিপন্ন জীবিকা, Kishorgonj.

বাওয়ালি-মৌয়ালরা বন খেয়ে ফেলছে, Prothom Alo.

বিপদসংকুল এক বনপ্রান্তরে বাওয়ালীদের জীবন, Sahos24.

গোলপাতা আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছেন বাওয়ালরা, Bangla News24.

গোলপাতা আহরণে ব্যস্ত বাওয়ালিরা, Prothom Alo.

বাওয়ালি কাদের বলা হয়, Bissoi.

বাঘের আক্রমণে বাওয়ালি নিহত, Prothom Alo.

Subscribe for Daily Newsletter