বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (Suhrawardy Udyan)

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করতঃ "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান" রাখা হয়। ১৯৭০ দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এখানে প্রচুর গাছ-গাছালি রোপণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।’ ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে।ইট পাথরের এই ঢাকা শহরে সবুজে ঘেরা এই উদ্যানে মিলবে প্রশান্তি। মনোরম পরিবেশ, ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রতিদিনই এখানে ভীড় করে ছোট বড় অনেকেই।টাঙ্গাইল থেকে বাবা মার সাথে ঘুরতে এসেছে মাহফুজুর রহমান। সে জানায়, এখানে এসে তার খুবেই ভালো লাগছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এখানে ভাষণ দিয়েছিলেন তাই এই ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে সে এখানে এসেছে।সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে স্থাপন করা হয়েছে ‘শিখা চিরন্তন’।
রমনা রেসকোর্স থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেস কোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনও কখনও ঢাকা রেস কোর্স নামে ডাকা হত।
রমনা রেসকোর্স ময়দানের ১৮৯০ সালের একটি পুরোনো ছবি পাওয়া গেল ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওয়েবসাইটসহ ঢাকার পুরোনো ছবির অনেকগুলো সাইটে। ঢাকাবিষয়ক কয়েকটি বইয়েও ছবিটি আছে। অবশ্য রমনা রেসকোর্স বললে এই প্রজন্মের অনেকে জায়গাটি খুঁজে না-ও পেতে পারেন। ব্রিটিশ আমলে প্রতি রোববার এখানে বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘৌড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এ কারণে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘৌড়দৌড় বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করতঃ "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান" রাখা হয়।
১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করলে রমনার ইতিহাস শুরু হয়। তবে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরোনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ কালেক্টর ডয়েস এখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে পরিচ্ছন্ন রূপ দিয়ে নাম দেন রমনা গ্রিন। ওই সময়ে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে তিনি জায়গাটি ঘিরে দেন। এরপর নবাবদের আনুকূল্যে সেখানে ঘোড়দৌড় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবাবেরা আরও সুন্দর বাগান করে নাম দেন ‘শাহবাগ’ বা রাজকীয় বাগান। ১৮৫১ সালে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্য রমনাকে নির্বাচন করা হয়। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এখানকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। রেস কোর্স ময়দানের অদূরে অবস্থিত তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান হিসেবে প্রথমে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীকালে আত্মসমর্পণের জন্য এই মাঠটি নির্বাচন করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এখানে আরেক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৯ সালে এখানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করা হয়। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল যেখানে স্বাক্ষর হয়েছিল, সেখানে গড়া হয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ। সব মিলিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এই ভূখণ্ডের বহু ইতিহাসের সাক্ষী।
রমনা রেসকোর্সের দক্ষিণে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, তিন জাতীয় নেতা শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী-এর সমাধি (তিন নেতার মাজার); পশ্চিমে বাংলা একাডেমী, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, পাবলিক লাইব্রেরি এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর; উত্তরে বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রীম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্ক।
প্রাথমিক ইতিহাস
তখন পশ্চিমে আজিমপুর, নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি, দক্ষিণে বর্তমান সচিবালয় ভবন, কার্জন হল, চাঁনখার পুল ও পূর্বে পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা, ও রাজারবাগ আর উত্তরে সেন্ট্রাল রোড, পরিবাগ ও ইস্কাটন পর্যন্ত এলাকাটি বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনামলে ঢাকার চারটি থানার একটির নামকরণ করা হয়েছিল রমনা। বর্তমানেও ঢাকার ২০টি থানার একটি হচ্ছে রমনা।
রমনার ইতিহাস শুরু হয় ইংরেজি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাহদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সময় ঢাকার উত্তর শহরতলিতে দুটি চমৎকার আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। সুবাহদার ইসলাম খান চিশতির ভাইয়ের নামানুসারে এর একটির নামকরণ করা হয় মহল্লা চিশতিয়া এবং সুবাহদার ইসলাম খানের একজন সেনাধ্যক্ষ সুজা খানের নামানুসারে অপর এলাকাটির নামকরণ হয় মহল্লা সুজাতপুর। এই এলাকায় তখন উন্নত বসতবাড়ি ছাড়াও মসজিদ, বাগান, সমাধিসৌধ, মন্দির ইত্যাদি গড়ে ওঠে। মুগল সাম্রাজের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরানো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সরকারি কাগজপত্রে রমনার নাম তেমন একটা চোখে পড়ে না। বস্তুত ঐ সময় রমনা ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত এলাকা যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠা, মন্দির, সমাধি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
ব্রিটিশ আমল
১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েস ঢাকা নগরীর উন্নয়নকল্পে কতগুলি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই ঢাকা আবার তার পুরানো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করে।
ঐ সময় কালেক্টর ডয়েস কালী মন্দির ছাড়া অন্যান্য বেশির ভাগ পুরানো স্থাপনা সরিয়ে ফেলেন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে একটি পরিচ্ছন্ন এলাকার রূপ দেন। পুরানো হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে বর্তমানে অবস্থিত মসজিদ এবং সমাধিগুলি তিনি অক্ষত রাখেন। পুরো এলাকাটি পরিষ্কার করে তিনি এর নাম দেন রমনা গ্রীন এবং এলাকাটিকে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন। রমনা রেসকোর্সের মাঝখানে একটি কালী মন্দির ছিল। এটি ছিল দশনামী গোত্রের হিন্দুদের কালী মন্দির। মনে করা হয় যে, নেপাল থেকে আগত দেবী কালীর একজন ভক্ত এই মন্দির নির্মাণ করেন। ঢাকা শহরের অন্যতম পুরানো এবং বনেদি এই কালী মন্দিরটি পরে ভাওয়ালের রানী বিলাসমণি দেবী সংস্কার ও উন্নয়ন করেন।
নাজির হোসেন কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে লিখেছেন, "ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি শনিবার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক ও সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদের এক বিবরণ থেকে জানা যায়, চার্লস ডজ রমনায় রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘৌড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এ কারণে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘৌড়দৌড় বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করতঃ "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান" রাখা হয়। ১৯৭০ দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এখানে প্রচুর গাছ-গাছালি রোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে ফাঁকা জায়গা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ছোটোখাটো বৈশাখী মেলা জাতীয় অনুষ্ঠানের পরিসর এখনো আছে কিন্তু কোনরূপ জনসভা করার অবকাশ আর নেই। এটি সময় কাটানো, হাঁটাহাটিঁ প্রভৃতির জন্য উপযুক্ত।
ঢাকার নওয়াবদের আনুকূল্যে একসময় ঘোড়দৌড় ঢাকায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রাবাস মহসীন হলের উত্তরপাশে নওয়াবদের ঘোড়ার আস্তাবল কিছুদিন আগেও ছিল অক্ষত। ঢাকার নওয়াবগণ রেসকোর্স এলাকাটির উন্নয়ন সাধন করেন এবং এলাকায় একটি সুন্দর বাগান তৈরি করে তার নাম দেন শাহবাগ বা রাজকীয় বাগান। নওয়াবগণ এলাকাতে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। পরে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নবগঠিত প্রদেশের গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্যও রমনা এলাকাকে নির্বাচন করা হয়। এই গভর্নমেন্ট হাউজ পরে হাইকোর্ট ভবনে (পুরাতন) রূপান্তরিত হয়। গভর্নমেন্ট হাউজের পাশে মিন্টো রোড এলাকায় পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং হাইকোর্টের বিচারকদের বসবাসের জন্য বেশ কিছু সুন্দর ও উন্নতমানের ভবন তৈরি করা হয়। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এলাকাটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।
পাকিস্তান আমল
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরও রমনা ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেই থেকে যায়। শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয় এবং এই রাস্তার পূর্বদিকের অংশে রমনা পার্ক নামে একটি চমৎকার বাগান গড়ে তোলা হয়। বর্তমানের সুপ্রীম কোর্ট ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণের চিড়িয়াখানাটি তখনও বিদ্যমান ছিল। তবে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মধ্যে ছিল শুধু গুটিকয়েক বাঘ, ভালুক এবং বিভিন্ন জাতের কিছু পাখি। পরে চিড়িয়াখানাটি মীরপুরে তার বর্তমান অবস্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া এবং এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে জনসভায় শপথ গ্রহণ করেন যে, কোন অবস্থাতেই এমনকি পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপের মুখেও তারা বাংলার মানুষের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আবার এই রমনাতে এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন এবং ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন।
৯ মাস বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে এবং রমনা মাঠেই (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটি বাংলাদেশের বিজয় দিবস।
এই ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন। এ সময় থেকে রমনা রেসকোর্স গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাবেশের স্থানে পরিণত হয়।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত গঠন করে। এই গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করা হয়।
১৯৯৬ সলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পূর্তির উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ও ফিলিস্তিন মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতও বক্তব্য রেখেছেন এই ঐতিহাসিক ময়দানেই।
উদ্যানের বিভিন্ন স্থাপনা
১৯৭৫ সালের পর এলাকাটিকে সবুজে ঘেরা পার্কে পরিণত করা হয়। পার্কের একপাশে শিশুদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র তথা পার্ক গড়ে তোলা হয়। এখানে শিশুদের জন্য নানা ধরনের আকর্ষণীয় খেলাধুলা, খাবার রেস্তোরাঁ এবং ছোটখাটো স্মারক জিনিসপত্র ক্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করা হয়েছে এবং একইসাথে তার পাশেই যেখানে পাকিস্তানি সেনাগণ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে স্বাধীনতা টাওয়ার।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জনতার দেয়াল নামে ২৭৩ ফুট দীর্ঘ একটি দেয়ালচিত্র। এটি ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যুরাল। এর বিষয়বস্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খনন করা হয়েছে একটি কৃত্রিম জলাশয় বা লেক। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে চারদলীয় জোট সরকার-এর শাসনামলে আমলে উদ্যানের ভেতর ঢাকা জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সংবলিত একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়।
জনতার দেয়াল টেরাকোটা ম্যুরালের নিচের অংশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। এখানে দেশের বৃহত্তম মুক্তমঞ্চ অবস্থিত, যেটি ২০১১ সালের ৭ মার্চ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।
ছবির হাট (ইংরেজি: Chobir Hat) বাংলাদেশের ঢাকার শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সম্মুখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে অবস্থিত, গ্রামীণ সংস্কৃতির অাদলে সৃষ্ট সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্যের চর্চার মিলনস্থান। এটি প্রচলিত কোনো সংগঠন নয়। এই মিলনস্থানে প্রায় সারা বছর প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিল্পকর্ম, নাটক-চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, এবং সংগীতসহ নানা অনুষ্ঠানের অয়োজন হয়ে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে স্থানটি ‘ছবির হাট’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
স্থান
রমনা রেসকোর্সের দক্ষিণে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, তিন জাতীয় নেতা শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি; পশ্চিমে বাংলা একাডেমী, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্
কিভাবে যাওয়া যায়
ঢাকা ইউনির্ভাসিটি এলাকা হতে রিকশাযোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যাওয়া যায়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেস কোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেস কোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনও কখনও ঢাকা রেস কোর্স নামে ডাকা হত এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। একটি জাতীয় স্মৃতিচিহ্নও বটে কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ এখানেই প্রদান করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। রেস কোর্স ময়দানের অদূরে অবস্থিত তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের স্থান হিসেবে প্রথমে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আত্মসমর্পনের জন্য এই মাঠটি নির্বাচন করা হয়।
রমনা রেসকোর্সের দক্ষিণে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, তিন জাতীয় নেতা শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি; পশ্চিমে বাংলা একাডেমী, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, পাবলিক লাইবে্ররি এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর; উত্তরে বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রীম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্ক।
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
স্বাধীনতা স্তম্ভ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অভ্যন্তর ভাগে অবস্থিত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর পাশে স্থাপিত শিখা চিরন্তন-এর বরাবর দক্ষিণ দিকে এটির অবস্থান। ভূমি থেকে কিছুটা উপরভাগে নির্মিত একটি প্রশস্ত চৌকো কংক্রিটের চাতালের দক্ষিণ পাশে এটির অবস্থান। এই চাতালের পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম জলাধার এবং পূর্ব পাশে রয়েছে টেরাকোটায় আচ্ছাদিত একটি অনতিউচ্চ দেয়াল যার পেছনেই ভূগর্ভস্ত স্বাধীনতা জাদুঘর-এ যাওয়ার সিঁড়ি। সন্ধ্যা বেলায় কাঁচ নির্মিত স্তম্ভটি একটি আলোকস্তম্ভে পরিণত হয়।
এ থেকে বিচ্ছুরিত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোক রশ্মি চারপাশের আকাশকে আলোময় করে তোলে। স্বাধীনতা স্তম্ভের নকশা করেছেন আরবানা নামীয় স্থাপত্য সংস্থার দুই স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। এটি মূলত একটি গ্লাস টাওয়ার। টাওয়ারটির কাঠামো ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এর উপরিভাগে রয়েছে স্বচ্ছ কাঁচ। এতে সূর্যের আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলন হয়। রাতে বৈদ্যুতিক আলোর মাধ্যমে স্তম্ভটি আলোকিত করা হয়। টাওয়ারটি উচ্চতায় ১৫০ ফুট ও প্রস্থ ১৬ ফুট। নানা ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা সংশ্রয় নির্মাণের পরিকল্পনা করে। স্বাধীনতা স্তম্ভ এই সংশ্রয়েরই অন্যতম আঙ্গিক।

চারশো বছরের পুরনো উদ্যান
রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এই উদ্যানটি এখন পরিচিত হলেও এর ইতিহাসে একাধিকবার এর নাম পরিবর্তন হয়েছে।ইতিহাসবিদদের মতে, এই উদ্যানের জন্ম হয় আসলে মুঘল আমলে।ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ''সেই মুঘল আমল (১৬১০) থেকেই বিশেষ এলাকা হিসাবে রমনার ইতিহাসের শুরু। ঐ সময় বর্তমান নীলক্ষেত অঞ্চলে মহল্লা চিশতিয়ান এবং মহল্লা শুজাতপুর নামে গড়ে উঠেছিল দুটি আবাসিক এলাকা।''''শুজাতপুর ছিল বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। পুরনো রেসকোর্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল চিশতিয়া। পুরো এলাকাটি ছিল মৌজা শুজাতপুরের অন্তর্গত। মৌজা শুজাতপুর নাম হয়েছিল রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর ভাই শুজাত খান চিশতীর নামে।''
রেসকোর্স ময়দান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
“এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না / এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না / এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না / তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? / তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানেঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?” কবি নির্মলেন্দু গুণের সেই ঢাকার হৃদয় মাঠটি হলো আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কিন্তু এই কবিতা থেকেই বোঝা যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একসময় কোন উদ্যান ছিল না। তবে কেমন ছিল, কি ছিল?

রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। হ্যাঁ, সেই রেসকোর্স ময়দান। যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়া হয়েছিল এই রেসকোর্স ময়দানেই।কিন্তু ক’জন জানি এই রেসকোর্স ময়দানের পেছনের গল্প!
রমনার ইতিহাস শুরু হয় ইংরেজি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে যখন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। এই এলাকায় তখন উন্নত বসতবাড়ি ছাড়াও মসজিদ, বাগান, সমাধিসৌধ, মন্দির ইত্যাদি গড়ে ওঠে। মোঘল সাম্রাজের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরোনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সরকারি কাগজপত্রে রমনার নাম তেমন একটা চোখে পড়ে না। বস্তুত ঐ সময় রমনা ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত এলাকা যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠা, মন্দির, সমাধি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েস ঢাকা নগরীর উন্নয়নকল্পে কতগুলো বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই ঢাকা আবার তার পুরোনো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করে। ঐ সময় কালেক্টর ডয়েস কালী মন্দির ছাড়া অন্যান্য বেশির ভাগ পুরোনো স্থাপনা সরিয়ে ফেলেন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে একটি পরিচ্ছন্ন এলাকার রূপ দেন। তবে পুরানো হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে বর্তমানে অবস্থিত মসজিদ এবং সমাধিগুলো তিনি অক্ষত রাখেন। পুরো এলাকাটি পরিস্কার করে তিনি এর নাম দেন রমনা গ্রীন এবং এলাকাটিকে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন।বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এলাকাটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।
নাজির হোসেন কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে লিখেছেন, “ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি শনিবার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক ও সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান।”১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘৌড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এ কারণে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘৌড়দৌড় বন্ধ করে দেয়।১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাঁকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া এবং এখানেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে জনসভায় শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আবার এই রমনাতে এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ৯ মাস বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে এবং রমনা মাঠেই (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান" রাখা হয়।
রমনা রেসকোর্স ময়দানের ১৮৯০ সালের একটি পুরোনো ছবি পাওয়া গেল ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওয়েবসাইটসহ ঢাকার পুরোনো ছবির অনেকগুলো সাইটে। ঢাকাবিষয়ক কয়েকটি বইয়েও ছবিটি আছে। অবশ্য রমনা রেসকোর্স বললে এই প্রজন্মের অনেকে জায়গাটি খুঁজে না-ও পেতে পারেন। ব্রিটিশ আমলে প্রতি রোববার এখানে বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। তবে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামেই সবাই জায়গাটি চেনে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করলে রমনার ইতিহাস শুরু হয়। তবে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরোনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ কালেক্টর ডয়েস এখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে পরিচ্ছন্ন রূপ দিয়ে নাম দেন রমনা গ্রিন। ওই সময়ে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে তিনি জায়গাটি ঘিরে দেন। এরপর নবাবদের আনুকূল্যে সেখানে ঘোড়দৌড় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবাবেরা আরও সুন্দর বাগান করে নাম দেন ‘শাহবাগ’ বা রাজকীয় বাগান।
১৮৫১ সালে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্য রমনাকে নির্বাচন করা হয়। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এখানকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৬ ডিসেম্বর এখানেই হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এখানে আরেক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৯ সালে এখানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করা হয়। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল যেখানে স্বাক্ষর হয়েছিল, সেখানে গড়া হয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ। সব মিলিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এই ভূখণ্ডের বহু ইতিহাসের সাক্ষী।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আহত কেন?
বাংলাদেশের প্রাচীন উদ্যান কোনটি? কিংবা এমন স্মৃতিময় ঐতিহাসিক উদ্যানগুলোর কয়টি আজ টিকে আছে? হতে পারে উয়ারী-বটেশ্বর, ভিতরগড়, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, বিক্রমপুর, জৈন্তিয়া বা ধূমঘাটে গড়ে উঠেছিল অবিস্মরণীয় সব উদ্যান। কিন্তু আজ সেসবের কোনো অবশেষ নেই।
৪১০ বছরের এক প্রাচীন উদ্যান
১৮৯৪ সালে উদ্যানবিদ ঈশ্বরচন্দ্র গুহ জামালপুরে ৪৫ বিঘা জমিতে ‘চৈতন্য নার্সারী’ নামে এক কৃষিভিত্তিক গবেষণা উদ্যান ও নার্সারি গড়ে তুলেছিলেন। এর কোনো চিহ্নই আজ নেই, এখানে এখন জামালপুর ফায়ার সার্ভিস। দেশে সুপ্রাচীন উদ্যানগুলোর খুব কমই আজ টিকে আছে। যদিও চৈতন্য নার্সারির বহু আগে ১৮০০ শতকে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গড়ে ওঠে বিপিন পার্ক। পার্কটি এখনো আছে, কিন্তু এর সেই প্রাচীন বাস্তুসংস্থান আর উদ্ভিদবৈচিত্র্য কিছুই আজ নেই। গাজীপুরের বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০৯ সালে ঢাকার ওয়ারীতে গড়ে তোলেন ‘বলধা গার্ডেন’। জমিদার মঙ্গল চাঁদ চুনিলাল খুলনায় প্রায় চার বিঘা জমিতে ১৯২৮ সালে গড়ে তোলেন বিশেষ উদ্যান ‘প্রেমকানন’। ১৯৬১ সালে ঢাকার মিরপুরে প্রায় ২০৮ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয় ‘জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান’। প্রেমকানন, বলধা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কিন্তু টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। তাহলে দেশে বিনে পয়সার প্রাচীন উদ্যান কোনটি? যেখানে সকল শ্রেণি-পেশা ও বর্গের মানুষ বিনেপয়সায় প্রবেশের অধিকার রাখে? নিঃসন্দেহে ৪১০ বছরের প্রাচীন ঢাকার সোহরাওয়াদী উদ্যান ও রমনা পার্ক। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে যে উদ্যানে মিশে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দৃঢ় স্মৃতি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক সবুজ বলয় আজ আহত কেন? কার পরিকল্পনায়? কার স্বার্থে?
নিদারুণভাবে দুনিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই উদ্যান আজ উন্নয়নের যন্ত্রণায় কাতর। প্রবীণ বৃক্ষদের কেটে রেস্টুরেন্ট ও ওয়াকওয়ে বানানোর কথা শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছে চল্লিশের মতো বড় গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, অশোক, বকুল, সাদা রঙ্গন, জারুল, গগন শিরিষ, মেহগনি, সেগুন গাছ কাটা পড়েছে। বড় গাছগুলোতে টিকে থাকা পরাশ্রয়ী গুল্ম, চিলে বা বাস্কেট ফার্ণ, শৈবাল, লাইকেন, অণুজীব, পতঙ্গের সংসারও তছনছ হয়েছে। গাছ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ভুবন চিলের বাসা, বসত হারিয়েছে অনেক পাখি ও প্রাণীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে তর্ক উঠেছে। উন্নয়নের নামে গাছ কেটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক এবং সাংষ্কৃতিক চরিত্রকে চুরমার করা যাবে না। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, বাস্তুসংস্থান, ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্য সুরক্ষিত রেখেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক উদ্যান’ হিসেবে বিকশিত করতে হবে। আজকের এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাচীন রমনা কোনোভাবেই কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাস নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও এই উদ্যান গুরুত্ববহ। দুনিয়ায় খুব কম দেশেই ৪১০ বছরের কোনো ‘পাবলিক উদ্যান’ টিকে আছে। চীনের সুজো উদ্যান (৬ষ্ঠ শতক), ইতালির ওরটো উদ্যান (১৫৪৫), পারস্যের ফিন উদ্যান (১৫৯০), ফ্রান্সের জারডিন্স উদ্যান (১৫৯৩), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড উদ্যান (১৬২১) ও রয়েল উদ্ভিদ উদ্যান (১৬৭০), যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি উদ্ভিদ উদ্যান (১৮৫৯) এসব প্রাচীন উদ্যানের মতোই ঢাকার রমনাও (১৬১০) সুপ্রাচীন। আমরা কি পারি গাছ কেটে, পাখিদের তাড়িয়ে অপরিকল্পিত স্থাপনা বানিয়ে এই উদ্যানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশের সাথে জনমানুষের স্মৃতিময় সম্পর্ক মুছে দিতে?
সোহরাওয়ার্দী কীভাবে ‘পাবলিক উদ্যান’ হয়ে উঠলো
১৬১০ সালে বিহারের রাজমহল থেকে সুবা বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। সেই মুঘল শাসনের সময়েই বিস্তীর্ণ রমনা অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় উদ্যান ‘বাগ-ই-বাদশাহি’। রমনা হয় ওঠে বনেদী অভিজাতদের এক বিলাসী উদ্যান। ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে নেওয়া হয়। বাদশাহি বাগান থেকে রমনা ধীরে ধীরে এক বুনো উদ্যান আর বন্যপ্রাণীর আবাস হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ১৮২৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস ঢাকা জেলের কয়েদিদের দিয়ে দক্ষিণ অংশে ঘোড় দৌড়ের জন্য ‘রেসকোর্স’ তৈরি করেন। রেসকোর্স ঘিরে রমনা আবারো অভিজাতদের ‘রমনা গ্রিন’ নামের উদ্যান হয়ে ওঠে।
১৮৪০ সালের দিকে বনেদীরা এখানে বাগানবাড়ি করতে থাকেন। নবাবেরা সেসময় এই এলাকার নাম রাখেন ‘শাহবাগ’। ১৮৪০ সালে উদ্যানের কোণে গড়ে ওঠে ‘ঢাকা ক্লাব’। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের পর বিশাল রমনা অঞ্চলও তিন টুকরো হয়ে যায়। রেসকোর্স ও বর্তমানের রমনা উদ্যান মিলিয়ে একটি অংশ, শাহবাগ এবং মিন্টো রোডের আবাসিক এলাকা। দীর্ঘদিন রমনার দক্ষিণ অংশ রেসকোর্স হিসেবেই পরিচিত ছিল। রমনা উদ্যানের পাশে একসময় একটা চিড়িয়াখানাও তৈরি হয়েছিল। এভাবেই বিশাল রমনা অঞ্চল ৩৫০ বছর ধরে কেবলি বনেদী আর অভিজাতদের বিলাসী অঞ্চল হিসেবেই ‘বন্দি’ হয়ে ছিল। জনমানুষের প্রবেশাধিকার ছিল প্রায় রুদ্ধ। এখন আমরা কী দেখি? একদিকে রমনা পার্ক আরেকদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। প্রতিদিন এখানে ঘুরে বেড়ায় কত গরিব ভাসমান মানুষ। সকল শ্রেণি-পেশা-বর্গের মানুষ এখানে আসতে পারছে। কীভাবে একদার এই অভিজাত এলাকা আজকের এই পাবলিক উদ্যান হয়ে উঠলো? বঙ্গবন্ধুই প্রথম রমনাকে ধনী-গরিব সকলের জন্য মুক্ত করেন। ১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রমনা রেসকোর্সেই বিশাল গণসংবর্ধনা পান শেখ মুজিবুর রহমান। এই মাঠেই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয় আর রমনা উদ্যানে বাড়তে থাকে জনমানুষের চলাচল। ৫ জুন বিশ্বব্যাপি বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। জুন মাস দেশব্যাপি বৃক্ষমেলা আর বৃক্ষরোপণের মাস। দেশ স্বাধীনের পর এমনি এক জুন মাসে বঙ্গবন্ধু এই উদ্যানে নানা প্রজাতির চারা রোপণ করেন। রমনা রেসকোর্সের নাম দেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’। আর তখন থেকেই রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক উদ্যান’ হয়ে ওঠে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জঞ্জালে ভরা
ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন পায়ে পায়ে আবর্জনার স্তূপ। উদ্যানের বড় অংশজুড়ে ভবঘুরেদের সংসার। শুকনো পাতা আর পলিথিনে ছেয়ে আছে সবুজ ঘাসের মাঠ।একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এসেছিল যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘোষণা। ১৬ ডিসেম্বর এই উদ্যানেই বিজয়ের দলিল সই হয়। স্বাধীনতাস্তম্ভ, স্বাধীনতা জাদুঘর, শিখা চিরন্তনের অবস্থান এই প্রাঙ্গণে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যানটির পরিবেশ নোংরা, অস্বাস্থ্যকর।
গতকাল গিয়ে দেখা যায়, টিএসসি-সংলগ্ন প্রবেশ গেটে পলিথিন, কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গেটের ওপরের চওড়া অংশে ভবঘুরে কিশোরদের আবাস। তাদের বিছানা-বালিশ পাতা। চারুকলা অনুষদের উল্টো পাশে, ছবির হাট লাগোয়া প্রবেশ গেটটিও আবর্জনার দখলে।উদ্যানে ঢোকার গেটগুলোতে চা-সিগারেট-ভাতের অস্থায়ী দোকান চোখে পড়ে। ভেতরে বড় গাছগুলোর গুঁড়ি ঘিরে ছোট-বড় ভাগাড়। ডাবের খোল, প্লাস্টিকের প্যাকেট, আখের ছোবড়া, ব্যবহৃত প্যাকেট, লেবু, আইসক্রিমের কাপসহ নানা আবর্জনার ঢিবি। আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিনগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফি আহমেদ বলেন, বাইরের ভাসমান দোকানগুলো তাদের আবর্জনা এনে ভেতরে ফেলে। এভাবে পরিবেশ আরও নষ্ট হচ্ছে। বেড়ানোর পরিবেশ আর নেই।
শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত উদ্যানের প্রাচীর ঘেঁষে শখানেক ছিন্নমূল পরিবারের বাস। গাছগুলোতে দড়ি বেঁধে কাঁথা-চাদর শুকাতে দেওয়া হয়েছে। গাছের ডাল আর ঝরে পড়া শুকনো পাতা দিয়ে রান্না করতে দেখা যায় অনেককে। তাদের একজন আয়েশা খাতুন বলেন, ছয় বছর ধরে ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে থাকছেন। উদ্যানে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সরে যেতে হয়। এ ছাড়া কোনো সমস্যা বা বাধা আসেনি।
গতকাল গিয়ে বইমেলার স্টলের বেশ কিছু বাঁশের স্তূপ এখনো পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্বাধীনতাস্তম্ভের সামনে বড় গর্তটিও ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। স্বাধীনতাস্তম্ভের আশপাশের আবর্জনা পরিষ্কার করছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাসান আলী। উদ্যানটিও এই অধিদপ্তরের অধীন। তিনি বলেন, ২৬ মার্চকে সামনে রেখে ১৫ জনের একটি দল ১৪ তারিখ থেকে উদ্যান পরিষ্কারের কাজ করছেন। জাতীয় দিবসগুলোর আগে বড় দলে ভাগ হয়ে এমন পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। এমনিতে সারা বছর তিন-চারজনের একটি দল কাজ করে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নগর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শওকত উল্লাহ উদ্যান দেখভালের দায়িত্বে আছেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আয়তন প্রায় ৬৮ একর। পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন চারজন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই লোকবল নিয়ে এত বড় এলাকা পরিষ্কার রাখা কঠিন। তাই উদ্যান পরিষ্কার রাখতে ৭১ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়মিত কাজ করবেন, এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই তাঁরা কাজ শুরু করবেন।
তথ্যসুত্র
ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সোহরাওয়ার্দী, Prothom Alo.
রমনা রেসকোর্স ময়দানের, Prothom Alo.
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, BD News24.
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আহত কেন?, The Daily Star.
রেসকোর্স ময়দান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, Bangla Insider.
রেসকোর্স থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান , BBC.
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ।, Khola Kagoj BD.
একটি সুপরিসর নগর উদ্যান, Dhaka Gov Bd.