থ্যালাসেমিয়া রোগ (Thalassemia Disease)

থ্যালাসেমিয়া রোগ (Thalassemia Disease)
Photo by Aman Chaturvedi / Unsplash

প্রতি বছর ৮ মে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। বিশ্বের কোথাও না কোথাও অহরহ বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট চলছে৷ আবার জিন থেরাপিও চলছে কোথাও কোথাও। আর কোথাও চলছে শুধুই রক্ত পরিসঞ্চালন। আয়রন চিলেশনের ওষুধটিও সহজলভ্য না। এমন অসাম্য দূর করতেই এবারের প্রতিপাদ্যটি গ্রহণ করা হয়েছে। সবার জন্য সমতাভিত্তিক, সহজলভ্য থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

থ্যালাসেমিয়া হচ্ছে এমন একটি রোগ, যেটি উত্তরাধিকারসূত্রে হয়ে থাকে। আর এ রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরে রক্তের ব্যাধি হয়ে থাকে, যা শরীরের হিমোগ্লোবিন এবং লোহিত রক্তকণিকা তৈরির ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কম থাকে এবং লোহিত রক্তকণিকা আকারে খুব ছোট হতে পারে। আর এ রোগটি হলে তার প্রভাব হালকা থেকে শুরু করে অনেক গুরুতর ও প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে।

বছরে প্রায় এক লাখ নবজাতক গুরুতর থ্যালাসেমিয়াসহ নিয়ে থাকে। আর এটি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো যেমন— মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোয় এ সমস্যা বেশি থাকলেও গ্লোবালাইজেশনের কারণে এখন পৃথিবীর সব দেশেই এ রোগী পাওয়া যায়।থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ থ্যালাসেমিয়া রোগের ধরনের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।

থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ

রোগীর ব্লাড নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে বা ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-থ্যালাসেমিয়া মেজর (অতিমাত্রা), মাইনর (অল্প মাত্রা) এবং ইন্টারমিডিয়েট (মধ্যম মাত্রা)। থ্যালাসেমিয়া অনেক ধরনের যেমন-বিটা থ্যালাসেমিয়া, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ, আলফা থ্যালাসেমিয়া, এস বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন ডি পাঞ্জাব, হিমোগ্লোবিন ডি আরব ইত্যাদি।

থ্যালাসেমিয়া কেন হয়

বাবা ও মা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জেনেটিক কারণে কি থ্যালাসেমিয়া হয় মানবদেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। এ প্রতি জোড়ার অর্ধেক মায়ের আর বাকি অর্ধেক বাবার থেকে আসে। ১৬নং ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১নং ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে যা অনেক এমাইনো অ্যাসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ বা ১১নং ক্রোমোজোমের আলফা অথবা বিটা জিন সঠিকভাবে এমাইনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না। ফলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা বা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বলে লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়। মানবদেহে যেহেতু জোড়ায় জোড়ায় জিন থাকে তাই একটা জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক/মাইনর/ট্রেইট/হেটারোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া বলে। আর দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা রোগী বা হোমোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া বলে। থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী এক কথা নয়।

থ্যালাসেমিয়ায় কেন রক্তস্বল্পতা থাকে

লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন (হিম+গ্লোবিন) থাকে বিধায় রক্ত লাল দেখায়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রোগীর ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ

থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী জন্মের ৬ মাস বয়স থেকে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা দেয়। পেটের প্লীহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না।

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা

রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি মাসেই রক্ত নিতে হয়। ঘনঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালি থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রোগী মারা যায়। প্রতিবার রক্ত নেওয়া ও আয়রন কমানোর ওষুধসহ অন্যান্য খরচে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসায় প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হলেও সঠিক চিকিৎসা বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

১. চিকিৎসার প্রধান বিষয় হচ্ছে ব্লাড ট্রান্সফিউশন। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা যারা ট্রান্সফিউশন নির্ভরশীল অর্থাৎ যাদের শিশুকাল থেকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়, রক্ত না নিলে সিভিয়ার রক্তশূন্যতা (৬ গ্রামের কম) দেখা দেয়, যেমন- থ্যালাসেমিয়া মেজর হলে শিশুর ৬ মাস বয়স থেকেই রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। তখন তাকে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। নিয়মিত এবং পরিমিত রক্ত পরিসঞ্চালন করলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে, প্লিহা স্বভাবিক থাকে, হাড়ের বিকৃতি হয় না। কারো ১ মাস পরপর, আবার কারো ২ মাস পরপর ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে হয়।

শিশুকালে স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি জন্য ও থ্যালাসেমিয়াজনিত উপসর্গ রহিত করার জন্য প্রয়োজন হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৯ গ্রামের বেশি ধারাবাহিকভাবে চালু রাখা। অর্থাৎ হিমোগ্লোবিন ৯ গ্রাম হলেই শিশুদেরকে রক্ত দিতে বলা হয়। কারণ রক্ত ৯ গ্রামের কম হলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে। ফলে শিশুর মধ্যে দেখা দেবে ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা। তাদের শারীরিক বৃদ্ধিও বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই সাপোর্টিভ চিকিৎসা হিসেবে থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রয়োজনমতো নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন জরুরি।

২. এক বছর রক্ত দেওয়ার পর বা ১০ থেকে ১২ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রোগীর শরীরে আয়রনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। তখন শরীর থেকে আয়রন বের করার জন্য আয়রন চিলেটিং জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়, যা নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়। শরীরের কী পরিমাণ আয়রন আছে তা পরীক্ষা করে মুখে খাওয়ার বা ইনজেকশনের মাধ্যমে আয়রন চিলেটিং ওষুধ দেওয়া হয়। রক্ত দেওয়া নিয়ে অনেক বাবা-মার মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। তারা শিশুকে নিয়মিত রক্ত দিতে চান না। ফলে শিশুর মারাত্মক উপসর্গ দেখা দেয়, এমনকি শিশুর অকালমৃত্যুও হতে পারে।

৩. এ ছাড়া হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়। যেমন; Hydroxyurea এবং Thalidomide জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে হিমোগ্লোবিন-এফ বাড়ার ফলে শরীরের হিমোগ্লোবিন ও অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে। যার ফলে থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজনীয়তা কমে আসে।

৩. ইনজেকশন লুসপ্যাটারসেপ্ট এক ধরনের ওষুধ সদ্য আবিষ্কার হয়েছে, যা উন্নত দেশে পাওয়া যায়। যার ব্যবহারে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। এটি ১৮ বছর বয়স থেকে চামড়ার নিচে ইনজেকশনের মাধ্যমে ৩ সপ্তাহ অন্তর অন্তর  দিতে হয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এক ডোজ ওষুধের দাম প্রায় ৪ লাখ টাকা। আমাদের দেশ ও আশপাশের দেশে এখনও এই ওষুধ সহজলভ্য হয়নি।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে?

স্বামী ও স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন, তবে শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে শতকরা ৫০ ভাগ বাহক হিসেবে এবং ২৫ ভাগ সুস্থ শিশু হিসেবে জন্ম নিতে পারে। তাই সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃগর্ভে বাচ্চার ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় তাঁদের একমাত্র ভরসা।

এসব পরীক্ষায় কোনো ঝুঁকি আছে কি?

এ পরীক্ষাগুলো করার কারণে ১০০ থেকে ২০০ জনের মধ্যে একজনের বাচ্চা নষ্ট হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে যিনি এই পরীক্ষাটি করবেন সেই চিকিৎসকের দক্ষতার ওপর। খুবই বিরল ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমুনা সংগ্রহ না হওয়ার কারণে পরীক্ষাটি আবার করার প্রয়োজন হতে পারে।

পরীক্ষার পর সাবধানতা কী কী?

পরীক্ষাটি সম্পন্ন করতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। পরীক্ষার পর ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে বাসায় যাওয়া যায়। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ও প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক খেতে হয়। বাসায় গিয়ে দুই-তিন দিন ভারী কাজ ও দূরের ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হয়। মাসিকের রাস্তায় কোনো প্রকার পানিজাতীয় স্রাব বা রক্ত গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানাতে হয়।

 এসব পরীক্ষা কতটা নির্ভরযোগ্য?

এই পরীক্ষার রিপোর্ট প্রায় শতভাগ নির্ভরযোগ্য। তবে মনে রাখতে হবে, যে রোগের কারণে পরীক্ষাটি করানো হচ্ছে অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য করা হলে কেবল বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কি না তা বোঝা যাবে, অন্য রোগ নয়। ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য পরীক্ষাও ভিন্ন।

 রিপোর্ট বা ফলাফল খারাপ হলে কী করণীয়

সাধারণত এক সপ্তাহের ভেতর পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। পরীক্ষার রিপোর্টে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়লে গর্ভবতী মাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাবেন কি না। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তান সংসারে আনতে না চাইলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। পরবর্তী সময় করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসক মায়ের জন্য মঙ্গলজনক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন।

 থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুর শরীরে কী ঘটে

মানুষের রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। লোহিত রক্ত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে হার্ট,  প্যানক্রিয়াস,  লিভার, অণ্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। বার বার রক্ত পরিবর্তনের কারণে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন-হেপাটাইটিস হতে পারে, অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং এতে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর খাবারের উপদেশ

থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর রোগীর খাবারের উপদেশ এক নয়। বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মতো। আয়রন জাতীয় খাবারের নিষেধ নেই বরং আয়রনের ঘাটতি হলে বেশি বেশি আয়রন জাতীয় খাবার খেতে দিতে হয়। আর থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য আয়রন জাতীয় খাবার কম খেতে হয় এবং প্রয়োজনে শরীর থেকে আয়রন কমানোর ওষুধ দিতে হয় যা ব্যয়বহুল। তবে কোনো কারণে আয়রনের ঘাটতি থাকলে অবশ্যই আয়রন জাতীয় খাদ্য ও ওষুধ দিতে হবে।

বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়

থ্যালাসেমিয়া স্ক্রেনিং প্রোগ্রাম না থাকায় অনেকেই জানে না তিনি বাহক কি না। তাই অজান্তেই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রোগী বাড়ছেই

বংশাণুক্রমে কীভাবে বাহক বা রোগী হয়

বাবা-মা উভয়েই বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ। বাবা-মা যে কোনো একজন বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ, তবে রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়

যেহেতু মা-বাবা দু’জনের জিনেই বাহক থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে না হওয়া বা বন্ধ করা। একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ তাদের সন্তান রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করাই উত্তম। কারণ সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

দুজন বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায় বা স্বামী স্ত্রী দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে বাচ্চা পেটে আসার আট থেকে চৌদ্দ সপ্তাহের মধ্যে ক্রওনিক ভিলাস স্যাম্পল বা এমনিওসেন্টেসিস করে বাচ্চার অবস্থা জানা যায়। পেটের বাচ্চা রোগী হলে কাউন্সিলিং করতে হবে যাতে একজন নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম না হয় (গর্ভপাত)। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে বাচ্চার স্বাভাবিক জন্মদানে অসুবিধা নেই। তাই বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গেলেই থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

কীভাবে জানা যাবে কেউ বাহক কি না

হেমাটোলজি অটো এনালাইজার মেশিনে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের ধারণা পাওয়া যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে, ক্ষেত্রবিশেষ ডিএনএ এনালাইসিস পরীক্ষা করা লাগে। বংশগত রোগগুলো চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর উন্নত চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রোগী যাদেরকে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা এলোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (বিএমটি)। জিনথেরাপির ব্যবহার এখনো সীমিত ও পরীক্ষাধীন।

বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধা ও অসুবিধা

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে এককালীন বেশি টাকার দরকার হলেও তা সারাজীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে অনেক কম। সঠিক রোগীদের বেলায় ৮৭-৯০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। আমাদের দেশে ডোনার রেজিস্ট্রি না থাকায় উপযুক্ত ম্যাচিং বোনম্যারো ডোনার পাওয়া দুষ্কর। ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি আছে।

ট্রান্সপ্ল্যান্টের জটিলতা কমাতে ও ভালো ফলাফল পেতে হলে নিয়মিত সঠিকভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন শুরুর ১৮ মাসের মধ্যে আয়রন চিলেশন শুরু করে আয়রন নিয়ন্ত্রণ এবং লিভার স্বাভাবিক রাখা অপরিহার্য। কারণ দীর্ঘদিন অধিক আয়রনের উপস্থিতি দেহের অনেক অঙ্গ বিশেষ করে লিভার ও হার্টের ক্ষতি করে, যা পরে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।

কোন বয়সে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা উচিত

সুনির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নেই, তবে দুই বছরের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অনিয়মিতভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন থেরাপি যারা গ্রহণ করে থাকে তাদের বেলায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরিবর্তে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হওয়া মূখ্য। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া অনেকখানি কমানো যেতে পারে। দুজন ক্যারিয়ারের মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া কমানো সম্ভব। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে বাচ্চা পেটে আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করতে হবে। রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যাবরশন করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ উপায়ে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ কমানো গেছে।থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। সরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, গণমাধ্যম সব দিক থেকেই সর্বস্তরের জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।


তথ্যসুত্র

একটি জন্মগত রক্তরোগ, Kalerkantha.

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস, NTV BD.

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির, Jugantor.

 হিমোগ্লোবিনই জীবনীশক্তি অক্সিজেন, The Daily Star.

Subscribe for Daily Newsletter