বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প (Tourism Industry of Bangladesh)

আমাদের দেশের প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। রয়েছে আলাদা বিখ্যাত পর্যটনসমৃদ্ধ স্থান। যেসব স্থান ঘিরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। এসব পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে প্রচুর কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে। নারী-পুরুষ তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘ কয়েক মাস এসব মানুষ দুর্ভোগে ছিল। এখন তারা আবার আগের জীবনে ফিরছেন। তবে ফের বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। এখন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেসব স্থান চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে।
পর্যটকদেরও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জমায়েত হওয়া উচিত
পর্যটকদেরও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জমায়েত হওয়া উচিত। কারণ করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আবার থমকে যেতে পারে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। অথচ দেশের পর্যটন শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এই খাতের পূর্ণ গতিতে চলা প্রয়োজন। কিন্তু এখনো করোনা মহামারির প্রকোপ চলছে। এর মধ্যেই পর্যটন শিল্পকে বিশ্বমানের করে তুলতে হবে, যাতে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৩৩৫ মিলিয়েনে দাঁড়িয়েছে। পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করলে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশ সমাধান করা সম্ভব। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং দেশের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে এই পর্যটনশিল্প। তাই করোনা মহামারির পর যাতে তা দ্রুত গতিতে বিকাশমান হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে।
বিনোদনমূলক পর্যটনের জন্য এ দেশের নদনদী আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বহুকাল যাবৎ। বাংলাদেশ নদীবহুল দেশ। ২৫৭টি ছোটবড় নদনদী জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে সারা দেশময়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্য অনেকাংশেই ফুটে ওঠে নৌভ্রমণের মাধ্যমে।পাহাড়-পর্বত ঘেরা বান্দরবান, রাঙ্গামাটির সবুজ বনানীতে অপরূপ সৌন্দর্য সহসাই মনকে উচাটন করে দেয়। ছোট-বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী, ঝরনা আর হ্রদের অপার নান্দনিকতা। যেকোনো মানুষকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়ি উপজাতিদের কৃষ্টি সংস্কৃতি জীবনযাত্রার বর্নাঢ্যতা মুগ্ধ করে পর্যটনপ্রিয়দের।
এই বাংলাদেশেই অবস্থিত পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন যার নাম সুন্দরবন। খাল, নদী, সাগরবেষ্টিত সুন্দরবনের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। যে বাঘ ভুবন বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে অভিহিত। সুন্দরবন ছাড়া এই বাঘ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ ছাড়া আছে ঝাঁকে ঝাঁকে চিত্রল হরিণ, বানর, শূকর, বনমোরগ, অজগরসহ নানা প্রকার বন্যপ্রাণী। সুন্দরবনে অবস্থানকালে পর্যটকদের ঘুম ভাঙাবে অগুনতি পাখির কল-কাকলী যা একজন পর্যটককে স্বপ্নিল আবেশে মুগ্ধ করতে পারে।সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোও বেশ সৌন্দর্যমণ্ডিত, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। জাফলংয়ের জলপ্রপাত, ছাতকের পাথর কেয়ারি নয়নভোলানো স্থান।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, এই বিপুল সংখ্যার ৭৩ শতাংশই আবার ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এই বিশাল বাজার ধরতে পারে তবে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে থাকে। দেশে ২০১৯ সালে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি, যার ফলে ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২৫তম স্থান থেকে ১২০ এ গিয়ে পৌঁছেছি আমরা।
আমাদের পর্যটন শিল্পের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক কম
আপাতদৃষ্টিতে পর্যটন শিল্পের উন্নতি মনে হলেও ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে শুধু পাকিস্তানই বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। আবার পর্যটন আয়ের বেশির ভাগই আসছে দেশীয় উৎস থেকে। এটি প্রমাণ করে যে, বিদেশি পর্যটকের কাছে আমাদের পর্যটন শিল্পের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক কম। পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালের মতো দেশ। পর্যটন আকর্ষণে পিছিয়ে নেই দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও। ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন আয় ছিল ৩৯.৪ বিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আয় ছিল ১৫১.৯ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আয়ের মধ্যে বাংলাদেশের আয় খুবই নগণ্য। ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের বিপুল পরিমাণ আয় এসেছে পর্যটন শিল্প থেকে
পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সুপরিকল্পনার অভাবই বড় বাঁধা
বাংলাদেশ উদীয়মান শিল্পের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পর্যটন শিল্প। দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৪.৪ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্পকে উন্নত করে দেশের বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের অভাবসহ আরও নানা কারণে এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না দেশের পর্যটন শিল্প।
২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন আয় ছিল ৩৯.৪ বিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আয় ছিল ১৫১.৯ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আয়ের মধ্যে বাংলাদেশের আয় খুবই নগণ্য। শুধুমাত্র ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম থেকে প্রায় ৮৬% আয় এসেছে পর্যটন শিল্পে।
বাংলাদেশের এই শিল্পে পিছিয়ে থাকার সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে
১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা:
পর্যটন কাঠামোর দিক থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। এশিয়ার মধ্যে শুধু পাকিস্তান ছাড়া বাকি সব দেশ থেকেই পিছিয়ে আছি আমরা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও এখনো রয়েছে অনেক দুর্বলতা। দীর্ঘ যানজটের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নেই পর্যাপ্ত হোটেলের সুব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রগুলো অবহেলিত। এগুলোর সুপরিকল্পিত আধুনিকায়ন ও শুল্কমুক্ত বিপণির অভাবও এ ক্ষেত্রে বড় বাঁধা।
২. দেশীয় বিমান ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা:
বিদেশি পর্যটকদের কাছে নিজের দেশকে তুলে ধরতে দেশীয় এয়ারলাইনসগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বাংলাদেশকে উপস্থাপন করলেও এশিয়ার বাইরে শুধু কয়েকটি শহরে ফ্লাইট সার্ভিস দিয়ে থাকে। যার ফলে বাকি দেশের পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের পরিবহন ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে বিমান ব্যবস্থার দিক থেকে আমাদের অবস্থান ১১১তম। যা এশিয়ার মাঝে সবচেয়ে পেছনে।
৩. প্রচারের অভাব:
বিশ্ব দরবারে আমরা আমাদের পর্যটনকে পরিচিত করতে চাই কিন্তু নেই কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আজকে আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বিবিসি, সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ প্রাকৃতিক রূপ অবলোকন করে থাকি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রচার নেই বললেই চলে। প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
৪. নিরাপত্তার অভাব:
বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুরক্ষা ব্যবস্থা অনেক বড় একটি ইস্যু। অস্থিতিশীলতা, চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি, সহিংসতা থেকে পর্যটকদের রক্ষা করতে হবে। পর্যটকদের দিতে হবে নির্বিঘ্নে চলাফেরার নিশ্চয়তা।পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তবেই না তারা এ দেশের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
৫. উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব:
দক্ষ, মার্জিত জনবলের অভাব এ শিল্পের একটা বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে রয়েছে উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব। বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না প্রয়োজনীয় তেমন কোনো তথ্য। দিতে ব্যর্থ হচ্ছে পর্যটকের কাঙ্ক্ষিত সেবা।
৬. পর্যটকের জন্য বাড়তি খরচ:
পর্যটন শিল্পে উন্নত কিছু দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনের ব্যয় অনেকটাই বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। বাড়তি যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে মানের তুলনায় হোটেলগুলোর উচ্চমূল্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় প্রায়শই। এটি অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। কেননা এর চেয়ে কম ব্যয়ে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে অন্য দেশগুলো।
৭. পশ্চিমা দেশের পর্যটকের অভাব:
বাংলাদেশের পর্যটকের প্রায় বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। মাত্র ৫ শতাংশ পর্যটক ইউএসএ থেকে আসলেও বেশির ভাগই রয়েছে প্রবাসী বাঙালি। বিশ্বব্যাপী পর্যটন বাজারের ৫৩ শতাংশ আসে আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে। যা থেকে আমরা অনেকটাই বঞ্চিত। এশিয়ার বাইরে থেকে আসা পর্যটকের হার শতকরা ২০ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ। যেখানে আমাদের দেশের হার মাত্র ৭ শতাংশ।
পর্যটন শিল্পের বহুমাত্রিকতা ও সম্ভাবনা
পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনের গুরুত্ব সর্বজনীন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে।
পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি।
সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে
সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটন খাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা। তাছাড়া সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। একই বছর প্রায় ৪ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান।
টেকসই উন্নয়নে পর্যটন শিল্প
ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। কারণ টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটি সরাসরি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, করোনা মহামারি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটন খাত কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একটি শিল্প। সাম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ২৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পর্যটন খাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
‘আওয়ার কমন ফিউচার’ নামের একটি প্রতিবেদন
‘টেকসই উন্নয়ন’ ধারণাটি প্রথম পাওয়া যায় ‘ক্লাব অব রোম’ নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে। পরবর্তীকালে জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (WCED)’ ১৯৮৭ সালে ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে সুস্পষ্ট করা হয়। প্রতিবেদনটি ‘ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট’ নামেও পরিচিত। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে মূলত টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। এই সংজ্ঞায় ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ বা অভিন্ন ক্ষেত্র বোঝাতে তাঁরা টেকসই উন্নয়নের বৃহত্তর সংজ্ঞায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতাকে অপরিহার্য শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে যে ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা পায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) ও মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
টেকসই উন্নয়নের এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতিসংঘ ২০০০ সালে প্রথম সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এমডিজি) প্রণয়ন করে এবং ২০১৫ সালের শেষ দিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল এসডিজি) প্রণয়ন করে, যেখানে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং সদস্য দেশগুলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে তা পূরণ করতে বলা হয়।
জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে এমডিজিতে বেশ ভালো করে বাংলাদেশ এবং দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়ায়। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক এক প্রতিবেদনে জানায়, এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ ভালো করছে এবং বিশ্বের যে তিনটি দেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ১৬৫টি দেশের মধ্যে ১০৯তম। চার বছর আগে ২০১৭-তে ছিল ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম। অর্থাৎ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে।
WTTC তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে, দেশের ভ্রমণ ও পর্যটন খাত ২০২০ সালে ৫৩,৯৬০ কোটি টাকার মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) সঞ্চয় করেছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮০,৪৫০ কোটি টাকা। সুতরাং, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ৩২.৯% হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া সংকটের মধ্যে গত বছর দেশের পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত চার লাখের বেশি লোক চাকরি হারিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প ১.৮৬ মিলিয়নেরও বেশি কাজের (মোট কর্মসংস্থানের ২.৯% জন্য দায়ী ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে চাকরির সংখ্যা ২১.৯% কমে ১.৪৫ মিলিয়ন (মোট কর্মসংস্থানের ২.৩%) হয়েছে।
বৈশ্বিক ভ্রমণ ও পর্যটন খাত
দেশের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয় ৩৩.৯% হ্রাস পেয়েছে- ২০১৯ সালের ৬৮,৬৫০ কোটি টাকা থেকে ২০২০ সালে কমেছে ৪৫,৩৮০ কোটি টাকা। এদিকে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের ব্যয় ২০২০ সালে ৫৯.৭% কমেছে – যা ২০১৯ সালে ৩,০৩০ কোটি টাকা থেকে কমেছে। ২০২০ সালে মাত্র ১,২২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি বছর, WTTC এবং Oxford Economics ১৮৫টি দেশে আমাদের সেক্টরের অর্থনৈতিক অবদানকে কভার করে প্রতিবেদন তৈরি করে।২০২১ সালের রিপোর্ট অনুসারে, বৈশ্বিক ভ্রমণ ও পর্যটন খাত গত বছর প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং খাতটি প্রায় ৬২ মিলিয়ন চাকরি হারিয়েছে।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন অবদান রাখে ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপিতে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। এই শিল্পের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে ৩৩০ মিলিয়ন মানুষ কর্মরত রয়েছে। সমগ্র বিশ্বে ১৫০ কোটি পর্যটক রয়েছে। অতএব প্রতি সাতজনে একজন পর্যটক। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটির ওপরে অভ্যন্তরীণ পর্যটক সারা দেশে ভ্রমণ করে এবং ৪০ লাখের বেশি মানুষ এই শিল্পে কর্মরত রয়েছে। উল্লেখ্য, এশিয়ার কয়েকটি দেশের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে, তাইওয়ানের আসে ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ।
ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করেছে
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এ খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উপরন্তু সম্প্রতিক রোনা ভাইরাস পর্যটন শিল্পকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, বৈশ্বিক পর্যটন পুনরায় চালুকরণের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি এবং ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করেছে দেশগুলো।
তথ্যসুত্র
পর্যটন শুধু নিছক বিনোদন, Dainikbangla.
পর্যটন শিল্প, Dailyinqilab.
চিত্রকর্মের সাথে তুলনীয়, Dailynayadiganta.
জীবন ও জীবিকাকে , Bangladesherkhabor.
সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্প , Jugantor.
একটি হচ্ছে পর্যটন শিল্প, Prothomalo.