রেল আসছে ককসবাজার (Train's Coming to Cox's Bazar)

কক্সবাজার-দোহাজারী রেল পথ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ২০২৩ সালের নতুন বছরে শতাব্দীর স্বপ্ন রেল আসছে কক্সবাজারে। রেল চালু হলে পর্যটক যাতায়াত সহজ হবে। কম সময়ে এবং কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে সহজে। এতে করে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
পর্যটন, লবণ, চিংড়ি ও কৃষিপণ্যসহ নানা কারণে গুরুত্ব বেড়ছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের। এছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ফোকাস পেয়েছে কক্সবাজার। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশের উন্নয়ন অগ্রতি ও অর্থনীতির বিকাশে। আধুনিক উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণের কোন বিকল্প নেই। এরই প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের সাথে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ করণের দাবী ছিল বহুদিনের। এই দাবীর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকার কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দের উন্নিত করে এবং শতাব্দীর দাবী দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প গ্রহণ করে।
ঘুরে যাবে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকাও।
শতাব্দীকালের দাবী দোহাজারী কক্সবাজার রেল লাইন এক সময়ের স্বপ্ন হলেও এখন আর স্বপ্ন নয়। এটি এখন বাস্তব। ২০২৩ সালের নতুন বছরে রেল আসছে কক্সবাজারে। কক্সবাজার থেকেই রেলে চড়ে মানুষ যাবে দেশের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সহজ হবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আনা নেয়া। আর কক্সবাজারে বাড়বে পর্যটকের স্রোত। পর্যবেক্ষদের মতে কক্সবাজার দোহাজারী রেললাইন চালু হলে পর্যটকদের পাশাপাশি ঘুরে যাবে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকাও।এই গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে দেহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিমি রেল পথের ৭৬ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন কক্সবাজারবাসী আশা করছেন দ্রুতই ট্রেন আসবে কক্সবাজারে।
জানা গেছে, আগামী জুনের মধ্যেই ট্রেন আসছে পর্যটননগরী কক্সবাজারে। এই টার্গেট নিয়েই কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।ইতোমধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন এখন দৃশ্যমান হয়েছে। এরই মধ্যে এই মেগা প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প কর্মকর্তাদের। বাকি ২৪ শতাংশ কাজ দ্রুত শেষ করে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু করতে পারবেন বলে তারা আশাবাদী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ চালু হলে শুধু পর্যটন খাতে সম্ভাবনা বাড়বে তা নয় লবণ, মৎস্য, কৃষিসহ অন্যান্য খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাওয়ার জন্য অপেক্ষায়
রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আগামী জুনের মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হবে। তখন সারাদেশ থেকে মানুষ ট্রেনে চড়ে সরাসরি কক্সবাজারে যাবে। গত ৮ ডিসেম্বররেলপথ মন্ত্রী নতুন : রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনের সময় কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।এসময় রেল মন্ত্রী বলেন, একসময় এটি স্বপ্ন ছিল, এখন সেটা বাস্তবায়নের পথে। কক্সবাজারবাসী যেমন অপেক্ষায় আছে, তেমনি সারা দেশের মানুষও ট্রেনে করে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাওয়ার জন্য অপেক্ষায়। আশা করা যাচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আগামী বছর জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
মানুষ অনায়াসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে
তিনি আরো বলেন, কক্সবাজারে চলাচলের জন্য টুরিস্ট কোচের আদলে উন্নত মানের কোচ দিয়ে ট্রেন চালানো হবে। এজন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি কোচ কেনা হবে যেগুলোর জানালা সুপ্রশস্ত। মানুষ অনায়াসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে। এসময় মন্ত্রী বলেন, রেল লাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রেলমন্ত্রী এ সময় নির্মাণাধীন আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলা ঘুরে দেখেন। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে স্টেশন বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। মন্ত্রী পরে পরিদর্শন কারে চড়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার নতুন লাইন পরিদর্শন করেন।এ সময় কক্সবাজার সদর-রামুর সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান, বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল পথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন থাকছে আটটি। এগুলো হলো- সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর ও উখিয়া। এ জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়া এই রেলপথে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দু›টি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে
১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন কপ্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের মতে ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। বেশির ভাগ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ হবে। গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তিনি আরো জানান, আমরা চেষ্টা করছি ২০২৩ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে। একই সাথে রেলস্টেশনগুলোর নির্মাণকাজও চলমান আছে।জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডোয়েল গেজ ও সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
এদিকে, কক্সবাজার সদর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দাবি করেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। এরপরও কাজ চলছে। একইভাবে সাগরপথে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অন্য দেশ থেকে মালামাল আনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‹কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর পাশে আরেকটি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। নতুন সেতুটি হবে পদ্মা সেতুর আদলে। এই সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৭৮০ মিটার। আর সেতুর উচ্চতা হবে ১২ দশমিক দুই মিটার। সেতুর ওপরে চলবে গাড়ি আর নিচে দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুটি নির্মাণে সব ব্যয় বহন করবে কোরিয়ান সরকার। শিগগিরই এই সেতুর কাজ উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি।
ট্রেনে পর্যটক যাতায়াত সহজ হবে।
কক্সবাজার সদর রামুর এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল এ প্রসঙ্গে বলেন, শতাব্দীকালের দাবী দোহাজারী কক্সবাজার রেল যোগাযোগ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় নতুন বছরে রেল আসছে কক্সবাজারে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেল লাইন চালু হলে অবশ্যই কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। ট্রেনে পর্যটক যাতায়াত সহজ হবে। কম সময়ে এবং কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ সহজে পরিবহন করা যাবে।
খুলছে রেলের দখিনা দুয়ার, সমুদ্রের গর্জন শুনবে ট্রেনযাত্রীরাও
দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজার। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সড়ক, নৌ, বিমানপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলেও এতদিন রেলপথে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। তবে বর্তমান সরকার পর্যটন নগরীকে রেলওয়ে যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হবে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরেই চালু হবে ঢাকা-কক্সবাজার রেল চলাচল। আর এর মাধ্যমেই খুলতে যাচ্ছে রেলের দক্ষিণের দুয়ার। এতে কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যেমন যোগ হবে, আবার ট্রেনে বসেই যাত্রীরা শুনতে পারবে সমুদ্রের উত্তাল গর্জন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১০ সালে এই কাজ শুরু হয়, শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পথে রেলস্টেশন থাকছে ৯টি। পুরো প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশন। সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক স্থাপন ও স্টেশনের কাজ এরই মধ্যে ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর ফলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা যাবে।
পর্যটকরা এখন সহজেই ছুঁয়ে দেখতে পারবেন সমুদ্রের নীলজল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় ২০ একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে ঝিনুকের আদলে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। শতাধিক শ্রমিক-কর্মকর্তা এখন পুরো রেলস্টেশনজুড়ে করছেন নানা ধরনের কাজ। স্টেশনের প্রবেশমুখে একপাশে গাড়ি রাখার স্থান প্রস্তুতসহ নানা অবকাঠামোর কাজ চলছে। স্টেশনের তিনটি প্ল্যাটফর্মে ছয়টি রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলছে স্টেশনের মূল ভবনের কাজও। ছয়তলা ভবনের নিচ তলায় যাত্রীদের টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকবে, অন্য তলায় থাকবে যাত্রীদের জন্য নানা সুবিধা। এছাড়া ক্যান্টিন, হোটেল, মার্কেটসহ ৫ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার কনভেনশন সেন্টার থাকবে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে।
পর্যটকরা যেন স্বাচ্ছন্দে কেনাকাটা করতে পারেন সেজন্য মার্কেট স্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে এসে ঘোরাঘুরি শেষে দিনে দিনেই ফিরতে চাইলে নিজেদের জিনিসপত্র যেন রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে থাকবে পাঁচ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার কনভেনশন সেন্টার। সেখানে কক্সবাজারসহ যেকোনো এলাকার মানুষ কনফারেন্স বা যেকোনো অনুষ্ঠান করতে পারবে।
এরই মধ্যে আইকনিক স্টেশনের ৮০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজও চলছে পুরোদমে। নান্দনিক সৌন্দর্যের এই স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন মো. রাসেল মিয়া। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে টানা কাজ করছি। খুব দ্রুত কাজ চলছে। স্টেশনের কাজ শেষ হলে পর্যটকদের বেশ আকৃষ্ট করবে।চলতি বছরেই ঢাকা থেকে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এর মধ্যদিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হবে নতুন মাত্রা। সড়ক পথের দীর্ঘ যাত্রার ভোগান্তি ছাড়াই পর্যটকরা এখন সহজেই ছুঁয়ে দেখতে পারবেন সমুদ্রের নীলজল।
ইউরোপের মতো রেলস্টেশন কক্সবাজারে
দোহাজারি-কক্সবাজার রেল প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মুফিজুর রহমান জানান, এ প্রকল্পের কাজ দুটি লটে হচ্ছে। প্রথম লটের সব কাজই শেষ। বাকি কাজগুলো আশা করছি জুন মাসে শেষ করতে পারব।তিনি জানান, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনের দুটি অংশের মধ্যে কক্সবাজার অংশে ৫১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের সব ধরনের কাজ শেষ বলা যায়।
দোহাজারি কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের সিনিয়র ম্যানেজার মো. আনোয়ার হোসাইন জানান, রেললাইনের বনাঞ্চলের ভেতরে হাতি চলাচলের জন্য দুটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সবগুলোর সেতুর স্প্যান ও পিলারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে একটি আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ভবন নির্মিত হচ্ছে।
কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথটিতে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু স্টেশন। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন। চট্টগ্রামের দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন, যা ছিল কক্সবাজারবাসীর জন্য স্বপ্নের মতো। এখন বাস্তবায়নের পথে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্মাণাধীন আইকনিক স্টেশন ও রেললাইন ঘুরে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, জুনে কক্সবাজারে আসবে স্বপ্নের রেল। আধুনিক কোচগুলো যুক্ত হবে এই রেলপথে। আমাদের বর্তমানে যে কোচগুলো আছে সেগুলোর জানালা ছোট, এখানে বড় জানালার আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ কোচ যুক্ত করা হবে। যাতে রেলে বসে পুরো প্রকৃতি উপভোগ করা যায়।কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষিত রেল চালু হলে বদলে যাবে কক্সবাজারের চেহারা। যোগাযোগে সৃষ্টি হবে নতুন দিগন্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতার কারণে কক্সবাজারে পর্যটক আগমন অনেকগুন বেড়ে যাবে।
খুশি স্থানীয় বাসিন্দা-ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা
ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা। কক্সবাজার থেকে ঢাকা যেতে বাস কিংবা চট্টগ্রামে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হয় এখন। এতে সড়ক পথে যানজট বা ভ্রমণ করতে সমস্যা যেমন হয়, আবার সময়ও লাগে বেশি। ব্যবসায়ীদেরও সড়ক বা নৌপথে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে অনেক সময় নানা সমস্যায় পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। রেল চলাচল শুরু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন করতে পারবেন কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা।ঝিলংজা স্টেশন এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ির কাছেই আসবে চট্টগ্রাম বা ঢাকা যাওয়ার ট্রেন। ফলে সকালে বা রাতে যেকোনো সময় টিকিট কেটেই কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া চট্টগ্রাম বা ঢাকায় চলে যেতে পারবো।
রেলস্টেশনের সামনে কথা হয় স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মাজহার আলীর সঙ্গে। জাগো নিউজকে মাজহার বলেন, সরকারের খুব ভালো একটি কাজ এটা। খুব সুন্দর করে রেলস্টেশন করছে সরকার। এখন সহজেই মানুষ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখতে আসতে পারবে। রেলপথ পেয়ে আমরাও খুশি।স্থানীয় গ্যালাক্সি হোটেলের মালিক মো. মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হলে পর্যটকরা সহজেই কক্সবাজারে আসতে পারবে। এতে পর্যটক আরও বাড়তে পারে। এড়াছা অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজে ও পণ্য পরিবহনে আগের তুলনায় অনেকটাই সহজ হবে রেলপথ চালু হলে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসা পর্যটকরাও বলছেন, সড়ক পথে ভ্রমণ কিংবা সড়কে যানজটের ফলে ভোগান্তি এড়িয়ে অনেকেই রেলপথে সহজেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারে আসতে পারবেন। সমুদ্রের নীলজল দেখে মানসিক প্রশান্তি নিয়ে দুর্ভোগ এড়িয়ে মানুষ ফিরতে পারবে নিজ গন্তব্যে।কক্সবাজার ঘুরতে আসা ফয়সাল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা থেকে বাসে এসেছি। ১৪ ঘণ্টা লেগেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসতে। অনেক কষ্ট হয়েছে। বিমানে আসলে হয়তো ভোগান্তি এড়িয়ে আসা যেতো, কিন্তু ব্যয় বেশি হতো। তবে ট্রেন চলাচল শুরু হলে অনেক সহজে এবং স্বাচ্ছন্দে কক্সবাজার আসতে পারবেন পর্যটকরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের ফলে বদলে যাবে কক্সবাজারের দৃশ্যপট। এই অঞ্চলসহ দেশের পর্যটনেও যোগ হবে নতুন দিগন্ত। অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে আরও দ্রুত। ঢাকার সঙ্গে ট্রেনের যোগাযোগ ও দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন নিয়ে উচ্ছ্বসিত তারা।প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর বা উন্নত বিশ্বের পর্যটন নগরীর আদলে তৈরি করতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার। বিভিন্ন প্রকল্পে পুরো কক্সবাজারজুড়ে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাজ চলছে। ট্রেন চলাচল শুরু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ পর্যটনে যোগ হবে নতুন সম্ভাবনা।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, এ প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সামান্য কিছু বাকি আছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম তথা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রায়াল ট্রেন চলবে। তবে সেপ্টেম্বরে ট্রায়াল ট্রেন চললেও বাণিজ্যিকভাবে যেতে আরও দুই-তিন মাস লাগবে। চলতি বছরের শেষ দিকে এই রেলপথে আমরা ট্রেন চালুর চেষ্টা করবো।
ঝিনুকের আদলে একটি আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজারে রেলপথ চালু হলে এর মাধ্যমে এশিয়ান কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই বর্তমান সরকার এখানে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়।চলতি বছরের জুনে সমুদ্র নগরী কক্সবাজার শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে রেল চালুর আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সার্বিক কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। অপর ১০ শতাংশের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
সোমবার (২ জানুয়ারি) এসব তথ্য জানিয়েছেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. আহমেদ সূফী।এ বিষয়ে দোহাজারি-কক্সবাজার রেল প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মুফিজুর রহমান বলেন, ‘এ প্রকল্পের কাজ দুটি লটে হচ্ছে। প্রথম লটের সব কাজই শেষ। বাকি কাজগুলো আশা করছি জুন মাসে শেষ করতে পারব।দোহাজারি-কক্সবাজার রেলওয়ের প্রজেক্ট ম্যানেজার (ইএমডি) আকরামুজ্জামান বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনের দুটি অংশের মধ্যে কক্সবাজার অংশে হচ্ছে ৫১ কিলোমিটার রেলপথ। এরই মধ্যে রেলপথ নির্মাণের সব ধরনের কাজ শেষ বলা যায়।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের সিনিয়র ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ারিং রাসেল মিয়া বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা ২০২৪ সাল। তবে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এ কাজ শেষ হবে। চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরে ২০১৬ সাদোহাজারি-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের সিনিয়র ম্যানেজার মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘রেললাইনের বনাঞ্চলের ভেতরে হাতি চলাচলের জন্য দুটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সবগুলোর সেতুর স্প্যান ও পিলারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে একটি আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ভবন নির্মিত হচ্ছে।
রেলওয়ের প্রকল্প সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। তবে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের কাজ আপাতত হচ্ছে না।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশেরতমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড আলাদা দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথটিতে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু স্টেশন। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন।ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্মাণাধীন আইকনিক স্টেশন ও রেললাইন ঘুরে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘জুনে কক্সবাজারে আসবে স্বপ্নের রেল। যেখানে আধুনিক কোচগুলো যুক্ত হবে এই রেলপথে। আমাদের বর্তমানে যে কোচগুলো আছে সেগুলোর জানালা ছোট। এখানে বড় জানালার আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ কোচ যুক্ত করা হবে, যাতে রেলে বসে যাত্রীরা পুরো প্রকৃতি উপভোগ করতে পারেন
চালুর আগেই বেঁকে গেল রেললাইন
সাতকানিয়ায় বানের পানিতে ভেসে গেছে রেললাইনের পাথর ও মাটি। উঁচু-নিচু হয়ে পড়েছে রেললাইন।ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে রেল যাওয়ার কথা আগামী সেপ্টেম্বরে। কিন্তু গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নির্মাণাধীন রেললাইনের একটি অংশে পাথর ও মাটি ভেসে গেছে। রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে গেছে। এতে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকায় বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে এ অবস্থা হয়েছে। টানা অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডুবতে শুরু করে। মঙ্গলবার ভোরে রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পরদিন বুধবার পানি নামে। এরপর রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে যাওয়া এবং লাইন থেকে পাথর ও মাটি সরে যাওয়া দৃশ্যমান হয়। এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। তাঁরা বলছেন, ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানিনিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করেন। তাঁদের মতে, এক কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না।বিশেষজ্ঞদের মতে, যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। রেললাইন নির্মাণের সময় তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। এখন রেললাইন করার কারণে পানিনিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। মানুষকে যেমন ভুগতে হচ্ছে, তেমনি রেলের সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
গতকাল শুক্রবারও রেললাইনের দুই পাশের এলাকা ও বিলে পানি জমে ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। রেললাইনের কারণে পানিনিষ্কাশনের পথ আটকে যাওয়ায় তাঁদের এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে। যদি রেললাইনে পর্যাপ্ত কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হতো, তাহলে এত ক্ষতি হতো না।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করেন। তাঁদের মতে, এক কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না। বন্যার পানিতে রেললাইনের এ অবস্থার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং তা সংস্কারে কত অর্থ ব্যয় হবে, তা এখনো পরিমাপ করা হয়নি বলে জানান তাঁরা।সিএনজিচালক মোহাম্মদ হোসাইন (৪৩) বলেন, তাঁদের এলাকায় রেললাইনে চারটি মাত্র কালভার্ট দেওয়া হয়েছে। শুরুতে আরও কম ছিল। তাঁরা আন্দোলন করলে কালভার্ট বাড়ানো হয়। আরও যদি বাড়ানো হতো, তাহলে এই সর্বনাশ হতো না। ভবিষ্যতেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে ১২ কিলোমিটার।
রেলওয়ের প্রকল্প–সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। মিয়ানমার সম্মত নয় বলে কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার অংশের কাজ আপাতত হচ্ছে না। প্রথমে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরে দুই বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
অতিবর্ষণকে দায়ী করলেন রেল কর্মকর্তারা
গতকাল শুক্রবার সকালে কেঁওচিয়ার তেমুহনী এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, এই এলাকায় অন্তত চারটি স্থানে রেললাইন দেবে গেছে। কোথাও কোথাও এক–দেড় ফুট পর্যন্ত নিচে দেবে গেছে। নিচ থেকে পাথর ও মাটি সরে গিয়ে শূন্যে ভাসছিল রেললাইনের স্লিপারগুলো। গর্ত হয়ে যাওয়া অংশে পানি জমে ছিল। আবার কিছু অংশে রেললাইন ঠিক থাকলেও নিচে পাথর ছিল না। আর রেললাইনের দুই পাশ গতকালও পানিতে ডুবে ছিল।
অপরিকল্পিত রেলপথের কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে—এলাকাবাসীর এই বক্তব্য মানতে নারাজ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ১০০ বছরের বন্যার বিষয়টিও হিসাবে রাখা হয়েছিল। যে অংশে রেললাইন ডুবেছে, সেখানে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে লাইন করা হয়। এবার অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে রেললাইন ডুবে গেছে। আর ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে মফিজুর রহমান বলেন, পানিনিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কালভার্টের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তাঁর দাবি, যদি রেললাইনের কারণে বন্যা হতো, তাহলে এক পাশে পানি থাকত, অন্য পাশে থাকত না। কিন্তু এবার তো দুই পাশে সমান সমান পানি ছিল।রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, বন্যায় রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা সংস্কারে বাড়তি অর্থ লাগবে না। কেননা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এ কাজ করানো হবে।প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে রেললাইন চালু হওয়ার সম্ভাব্য সময়। এর আগেই সংস্কারকাজ শেষ করতে হবে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ঠিক করতে অন্তত পাঁচ শ থেকে এক হাজার বাড়তি জনবল যুক্ত করতে হবে।
পরিকল্পনায় ভুল, নকশায় ত্রুটি
পরিকল্পনায় ভুল এবং প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কারণে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন এই রেলপথ দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশেষ করে সাতকানিয়ায় সাম্প্রতিক বন্যার অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন তাঁরা।পরিকল্পনায় ভুল, নকশায় ত্রুটিনদী ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্য অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলের পানির স্রোত ও পাহাড়ি ঢল পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী।
আর রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী। এতে নির্মীয়মাণ নতুন রেললাইন পানির স্রোতের মুখোমুখি হয়ে চাপ নিতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে দুর্বলতা ছিল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে এর ভিত্তিতে প্রকল্পের যে নকশা করা হয়েছে তা-ও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে।
পানির গতিপথের আড়াআড়ি রেলপথ করা হলেও যে সংখ্যায় ও আকারের ওয়াটারপাস বা পানিপ্রবাহের পথ করার দরকার ছিল তা করা হয়নি। ১০০ বছরের বন্যার তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়েছে বলা হলেও এই ক্ষয়ক্ষতি মূলত পর্যালোচনার অসারত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই রেলপথ নির্মাণ শুরুর পর গত পাঁচ বছরে তিনবার বন্যা বা বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় রেলপথের কারণে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারমুখী নির্মীয়মাণ রেলপথের প্রায় ১০ কিলোমিটার। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে রেললাইনের পাথর ও মাটি সরে গেছে। কিছু জায়গায় রেললাইনও সরে গেছে। এ ছাড়া কিছু অংশে মাটি, ঘাচট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মীয়মাণ ১০০ কিলোমিটার রেলপথের প্রায় ২৫ কিলোমিটার অংশ পড়েছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়। পুরো রেলপথের মধ্যে এই অঞ্চল তুলনামূলকভাবে অনেক নিচু। ফলে কিছু জায়গায় মাটি থেকে ২০ ফুট উঁচুতে রেলপথের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক প্রবণতায় দেখা যাচ্ছে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, পথের যে অংশে মাটি উঁচু করে রেলপথ করা হয়েছে সেখানে যদি খুঁটির ওপর রেলপথ বানানো হতো তাহলে পানিপ্রবাহে সমস্যা হতো না। আলাদা সেতু-কালভার্ট ও হাতি চলাচলের পথও তৈরি করতে হতো না। মানুষের চলাচলেও যেমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতো না, তেমনি বিপুল ফসলি জমিও বেঁচে যেত।যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পরিকল্পনা করেই সব করা হয়েছে। এমন বন্যা ১০০ বছরেও হয়নি। প্রয়োজনে এখন আবার বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা হবে। তবে কাজের মান নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। ১০০ কিলোমিটার পথে দু-তিন কিলোমিটার ক্ষতি হয়েছে। রেলের বাঁধের জন্য আগে বা এখন বন্যা হয়েছে এটাও ঠিক নয়। বাঁধের দুই পাশেই পানি সমান ছিল। ফলে বাঁধের কারণে পানিপ্রবাহে সমস্যা হয়েছে বলা যাবে না।কামরুল আহসান বলেন, রেললাইন বেঁকে গেছে, ভুলভাবে এমনটা বলা হচ্ছে। আসলে সব জায়গায় এখনো জয়েনিং ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। তাই কিছু জায়গায় ডিসপ্লেস হয়েছে। এটাকে বেঁকে যাওয়া বলে না।
এরই মধ্যে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। পুরোপুরি ক্ষতি নির্ধারণ করতে আরো অন্তত দুই দিন সময় লাগবে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মতো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।প্রকল্প সূত্র বলছে, আর্থিক ক্ষতি পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। কেননা রেলওয়ে এখনো প্রকল্পটি বুঝে নেয়নি। দুর্যোগের কারণে আর্থিক ক্ষতি পোষাতে ব্যয় বাড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, পানিপ্রবাহের বিপরীত মুখে এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর বিশদ নকশায়ও ভুল আছে। স্রোতের বিপরীতমুখী রেলপথ হওয়ায় ক্ষতি এত বেশি হয়েছে। এই ত্রুটিযুক্ত নকশার জন্য বিনিয়োগকারী সংস্থা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, পরিকল্পনা কমিশন, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সবার দায় আছে।আইনুন নিশাত বলেন, এই রেলপথে পানি যাওয়ার পর্যাপ্ত পথ রাখা হয়নি। এখানে শুধু মাটি উঁচু করে রেলপথ বানানো হয়েছে। এটা পরিকল্পিত বাঁধও নয়। এখন এটা ভেঙে নতুন করে বানানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জোড়াতালি দিয়ে ভুলের সমাধান করার চেষ্টা হবে আরেকটি ভুল।
২০২১ সালের আগস্টেও কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টি ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়ে চকরিয়ার ১৮টি ইউনিয়নের মানুষ। এই রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর পাঁচ বছরে তিনবার বন্যার কবলে পড়েছে এই এলাকার মানুষ।জানতে চাইলে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের অন্য জায়গায় পানির প্রবাহ উত্তর-দক্ষিণমুখী হলেও এখানে পূর্ব-পশ্চিমমুখী। এ জন্য রেলপথ খুঁটির ওপর করা জরুরি ছিল। ওই অঞ্চলে কোনো প্রকল্পই বাঁধনির্ভর করা ঠিক হবে না। এই অঞ্চলের জন্য বাঁধ একটি বড় সমস্যা। তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাটে সহজে দুর্নীতি করা যায়। তাই বাঁধের প্রকল্পের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে।
শামছুল হক বলেন, এখন পরিষ্কার হয়েছে প্রকল্প পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের বাধ্যবাদকতার কারণে নামমাত্র একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ভালোভাবে স্ট্যাডি করা হলে তখনই ভবিষ্যৎ সমস্যা চিহ্নিত করা যেত।প্রকল্পে কর্মরত প্রকৌশলী আবদুল জব্বার মিলন জানান, পুরো পথে ২১৪টি কালভার্ট এবং ১৬টি সেতু রয়েছে। সেই সঙ্গে মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও সাঙ্গু নদীতেও সেতু রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রতি কিলোমিটারে গড়ে তিনটি ছোট-বড় সেতু আছে, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। এ জন্য কালভার্ট অপর্যাপ্ত, এটা বলা যাবে না।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে হাতে নেয় সরকার। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের বাকি অংশের কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু। ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। লেভেলক্রসিং রয়েছে ৯৬টি।
চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।সর্বশেষ জুলাইয়ের প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার লাইন বসানো হয়ে গেছে। ৯টি স্টেশনের কাজ চলমান আছে। স্টেশনের সার্বিক কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে ডুলাহাজারা স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পটি ২০১০ সালে অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর সব জটিলতা কাটিয়ে ২০১৮ সালে প্রকল্প নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে। ফাস্ট ট্র্যাক এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো রেলপথের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। আর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যাত্রী পরিবহন। কিন্তু বন্যার কবলে পরা ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামত করার পাশাপাশি পুরো কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। অক্টোবরের শুরুর দিকে ট্রেন চলাচল শুরুর ভাবনা থাকলেও সেখান থেকে সরে আসছে রেল কর্তৃপক্ষ।
ট্রেন চলবে ১২০ কিলোমিটার গতিতে
রেল সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘বর্তমান সরকার রেলপথের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন হচ্ছে। নতুন রেলপথ দিয়ে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। মানুষ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পর্যটন শহরে যাবেন।’এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কারকাজের সময় সেতুর বিকল্প হিসেবে যাতায়াতের জন্য ফেরি চালু করা হবে। সেতুতে যান চলাচল বন্ধ থাকলে মানুষের সাময়িক অসুবিধা হবে। তবে সংস্কারকাজ হয়ে গেলে সেটা আর থাকবে না। আর ২০২৮ সালে নতুন সেতু হলে দুর্ভোগে দূর হয়ে যাবে।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া শহরের চান্দগাও এলাকাসহ কয়েক লাখ মানুষ নির্ভরশীল কালুরঘাট সেতুর ওপর। শহর এলাকা থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ এ সেতু পার হতে দশ মিনিটের পথ লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে সেতুটি। এর বিভিন্ন জায়গায় জং ধরে যানবাহন ও ট্রেন চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে ৯২ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুটিতে ষাট কোটি টাকা ব্যয়ে আরেক দফা সংস্কার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেপ্টেম্বরে। ১০০ কিলোমিটারের এই ডুয়েলগেজ রেলপথের মধ্যে ৭০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। বাকি ১৭ শতাংশ কাজের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার রেললাইন এবং ৮৬টি স্টেশন ভবন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে।সভায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘সেতুর বিকল্প হিসেবে নদীতে ফেরি সার্ভিস চালু করা হবে। এ জন্য দু'টি ফেরি রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ফেরি রাখা হয়েছে বিকল্প হিসেবে।’
তবে সভায় জুন মাসে সেতুর সংস্কার কাজ শুরু করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ও পৌর চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম। দু’টি ফেরির পরিবর্তে চারটি ফেরি চালুর পরামর্শ দেন দুই জনপ্রতিনিধি।বর্তমানে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনে দশ টন ভারী ইঞ্জিন চলাচল করতে পারে। এ সময় গতি থাকে সর্বোচ্চ দশ কিলোমিটার।
ট্রেন আসছে কক্সবাজারে, সাজানো হচ্ছে বগি
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত নতুন বিলাসবহুল মিটারগেজ কোচের কম্পোজিশনে তৈরি নতুন ট্রেন যাত্রী নিয়ে যাবে কক্সবাজার। সেই আমদানিকৃত নতুন মিটারগেজ কোচের কাজ চলছে পুরোদমে। তবে, কোচ সংকট ও ইঞ্জিন স্বল্পতার কারণে চাইলেও অতিরিক্ত ট্রেন চালানো সম্ভব হবে না।
রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই রেললাইন আছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ চলছে। আমরা আশা করছি, আগস্টের মধ্যে অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে পারবো। সেপ্টেম্বর ফিনিশিং ওয়ার্কসহ অবশিষ্ট কাজ শেষ করে আমরা ট্রায়াল রান উদ্বোধন করতে পারব। কক্সবাজার রুটে ভাড়া ঢাকা হতে নন এসি ৭০০-৮৫০ টাকা, এসি ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে সেমি ননস্টপের নন এসি ভাড়া ২০০ টাকা, এসি ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। লোকালের ভাড়া ৯০-১২০ টাকা। কেবিন ভাড়া ঠিক হয়নি।জানা গেছে, কক্সবাজার রুটে ১৫-১৬টি বগি নিয়ে চলবে ট্রেন। ট্রেনগুলোতে পাওয়ার কার কোচ, কেবিন, এসি চেয়ার, এসি বার্থ, শোভন চেয়ার, গার্ড র্যাক, ব্যুফে কার সাজানো হচ্ছে।
পাহাড়ের বুক চিরে, নদীর ওপর দিয়ে স্বপ্নের রেল আসবে কক্সবাজার
কক্সবাজার-দোহাজারী রেল পথ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ২০২৩ সালের নতুন বছরে শতাব্দীর স্বপ্ন রেল আসছে কক্সবাজারে। রেল চালু হলে পর্যটক যাতায়াত সহজ হবে। কম সময়ে এবং কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে সহজে। এতে করে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এরই প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের সাথে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ করণের দাবী ছিল বহুদিনের। এই দাবীর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকার কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দের উন্নিত করে এবং শতাব্দীর দাবী দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প গ্রহণ করে।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের বলেন, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। বেশিরভাগ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো আগামি কয়েক মাসেই শেষ হবে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তবে আমরা চেষ্টা করছি ২০২৩ সালের জুন-অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করতে।
শতাব্দীকালের দাবী দোহাজারী কক্সবাজার রেল লাইন এক সময়ের স্বপ্ন হলেও এখন আর স্বপ্ন নয়। এটি এখন বাস্তব। ২০২৩ সালের নতুন বছরে রেল আসছে কক্সবাজারে। কক্সবাজার থেকেই রেলে চড়ে মানুষ যাবে দেশের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সহজ হবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আনা নেয়া। আর কক্সবাজারে বাড়বে পর্যটকের স্রোত। পর্যবেক্ষদের মতে কক্সবাজার দোহাজারী রেললাইন চালু হলে পর্যটকদের পাশাপাশি ঘুরে যাবে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকাও।
প্রবাদ আছে, ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই?
সেই ট্রেনের বাড়ি হতে যাচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবরে পর্যটক নিয়ে দরিয়ানগরে ট্রেন আসার প্রত্যয়ে দ্রুত এগুচ্ছে চলমান রেল প্রকল্পের কাজ।কাজ শেষ হলেই ঢাকা থেকে প্রতিদিন ১০ জোড়ার পাশাপশি চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ও লোকাল মিলে আরও বেশকিছু ট্রেন যাবে কক্সবাজার। পর্যটকবাহী এক একটি ট্রেনে থাকবে ৮০০ থেকে ১২০০ যাত্রী।সব মিলিয়ে এ রেলপথে বছরে যাত্রী আসা-যাওয়া করবে প্রায় ২ কোটি। কাক ডাকা ভোরে হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙবে স্থানীয়দের।
কোথাও সমতলের মাঝখানে, কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে আবার কোথাও নদীর ওপর দিয়ে গেছে স্বপ্নের রেললাইন। যেটি দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে যাবেন পর্যটন নগরীতে। আর উপভোগ করবেন নদী, খাল-বিল ও সবুজে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্য।কক্সবাজারের মানুষের এক সময়ের স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। ২০২৪ সালে শেষ করার সিডিউল নিয়ে দ্রুত এগুচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প। তবে নির্মাণ শেষ হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। চলতি বছরেই পর্যটক নিয়ে কক্সবাজার যাবে ট্রেন। ইতিমধ্যে ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
বছরে ২ কোটি যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে নতুন বছর যাত্রা শুরু করছে ঝিনুক আকৃতির বিশ্বমানের রেল স্টেশন। এ আইকনিক স্টেশনে প্রতিদিন রাজধানী থেকে আসবে ১০ জোড়া পর্যটক ট্রেন, এর বাইরে বন্দরনগরী থেকে যাবে আরো বেশ কয়েক জোড়া। যেটি চালু হলে ঢাকা থেকে ৮ ঘন্টা আর চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘন্টায় যাওয়া যাবে সমুদ্র নগরে।রেল কর্তৃপক্ষের ধারণা, ঢাকা থেকে কক্সবাজার টিকিটের দাম পড়বে মানভেদে ৭০০-১৫০০ টাকা, আর চট্টগ্রাম থেকে ২০০-৪০০ টাকা। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ রেলপথে এটিসহ মোট নয়টি স্টেশন তৈরি হবে, যা স্থানীয় অর্থনীতি আর পর্যটনে যোগ করবে নতুন সম্ভাবনা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে এটিসহ মোট নয়টি স্টেশন করা হবে। যার সাথে স্থানীয় অর্থনীতিরও যোগসূত্র তৈরি হবে। স্টেশন ঘিরে হোটেল, মোটেল, পরিবহন খাতে তৈরি হবে নতুন উদ্যেক্তা। সমৃদ্ধ হবে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রকল্পের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আইকনিক রেলস্টেশন। ছয় শতাধিক শ্রমিক ও প্রকৌশলীর শ্রম-ঘাম আর মেধায় চার বছরেই এটি এখন দৃশ্যমান। চারদিকে চলছে গ্লাস ফিটিংস, ছাদের স্টিল ক্যানোফি, আর নানা ধরনের ফিটিংস বসানোর কাজ। ঝকঝকে আধুনিক এই স্টেশন অনেকটা উন্নত বিশ্বের কোনও বিমান বন্দরের মতোই। ভবনের নিচতলায় আছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিং মল রেস্তোরাঁ। তিন তলায় আছে তারকামানের হোটেলে, যেখানে ৩৯টি রুমে থাকার সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। চার তলাতেও রেস্তোরাঁ, শিশুযত্নকেন্দ্রসহ রাখা আছে কর্মকর্তাদের কার্যালয়।
গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদরসহ স্টেশন থাকছে আটটি। এ জন্য সাঙ্গু মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এছাড়াও রেলপথে তৈরি হয়েছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
তথ্যসুত্র
রেলপথের কাজ চলছে, Amader Shomoy.
স্বপ্নের রেল আসবে, Shangbad Sarabela.
সমুদ্রের গর্জন শুনবে ট্রেনযাত্রীরা, Jago News24.
পরিকল্পনায় ভুল, নকশায় ত্রুটি, Kaler Kantho.
বানের পানিতে ভেসে গেছে রেললাইনের পাথর ও মাটি, Prothom Alo.
সমুদ্র নগরী কক্সবাজার শহরে রেল আসছে, Dhaka Mail.
কক্সবাজারে রেল আসছে নতুন বছরে, Daily Inqilab.