নাগরিকের  স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা (Transparency and Accountability in Civil Service)

নাগরিকের  স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা (Transparency and Accountability in Civil Service)

এ কথা অনস্বীকার্য দেশ, সমাজ, সংসারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা-প্রয়োগের প্রধান পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধাচারিতা। ব্যাষ্টি থেকেই সমষ্টি। সঠিক জীবনদৃষ্টি প্রয়োগ করে মেধা ও প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকশিত সমাজে ‘স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়ন’ দ্বারা সৃষ্টির সেবায় সংঘবদ্ধভাবে সম্পাদিত কাজই ‘অশান্তিকে প্রশান্তিতে, রোগকে সুস্থতায়, ব্যর্থতাকে সাফল্যে, অভাবকে প্রাচুর্যে রূপান্তরিত করতে পারে।’

নাগরিক সেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনবে এ আই প্রযুক্তি

দেশের সেবা, পরিবহন, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য ইত্যোমধ্যেই একটি গাইডলাইন ও টাইমফ্রেম প্রস্তুত করা হয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েই এআই প্রয়োগের ঢেউ লেগেছে। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির পাশাপাশি এআই ব্যবহার শুরু হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইন্টারনেট অব থিংকস এর সঙ্গে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, বিগ ডেটা, ব্লক চেইন শব্দগুলো জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। এই টার্মগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি বিপ্লবে অনেক আগেই এআই নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রভাব আমাদের দেশেও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে।

জনগণকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এআই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার যাথার্থতা, গতিময়তা ও দক্ষতা বাড়ায়। অবশ্য এআই ব্যবহারের সফলতা নির্ভর করে ডেটার যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর। এছাড়া নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ, স্কিল রিসোর্স, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, গবেষণা ও উন্নয়ন সুবিধা থাকা দরকার। এ কারণেই সরকার ইতোমধ্যেই ২৮টি হাইটেক পার্ক, ৬৪টি শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দেশের প্রথম বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। আশা করছি, এই উদ্যোগ ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এআই এর মতো কাটিং এজ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দানের সুযোগ তৈরি করবে।

মানবিক সহায়তায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবি নাগরিক সমাজের

মানবিক সহায়তায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাসিইআরএফ তহবিল বিতরণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের উচিত স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নীতি বাস্তবায়ন করা। জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারীর ঘোষণা অনুসারে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করা হয়েছে। আগের মতো এই তহবিলটি শুধু জাতিসংঘের সংস্থা ও রেড ক্রস এবং বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা উচিত নয়। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক ২.৫ মিলিয়ন সংগ্রহ করা হয়েছে, আইএনজিওগুলো কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে তার সামান্য তথ্যই এই পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়েছে।

নাগরিক সম্পৃক্ততা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ায়

স্বচ্ছতা থাকলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। নীতিনির্ধারক, সরকার ও সেবা প্রদানকারীর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নাগরিক সম্পৃক্ততা বিশ্বব্যাংকের কৌশলের অন্যতম উপাদান। বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য, ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে শতভাগ সুবিধাভোগী সেবা পাবেন।প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততার এ ধারণাটি বেশ কার্যকর। এটি আমাদের সামনের দিকে যেতে উৎসাহিত করবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দাতাদের অর্থ পাওয়া যাক আর না যাক, এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, পর্যবেক্ষণ করা এ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো স্থানীয় পর্যায়ে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়ন। ক্ষমতায়ন হলে একদিকে প্রকল্প যেমন টেকসই হবে, অন্যদিকে দক্ষতা বাড়বে।

প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য প্রয়োজন ন্যায়পাল

ন্যায়পাল শব্দটি, পদ ও প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহূত; অর্থাৎ প্রশাসনিক দুর্নীতি তদন্তে সরকারি প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (যেমন বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক প্রবর্তিত যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়। ন্যায়পালের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে বেসামরিক প্রশাসন ও আদালতের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান। তাকে বেআইনি কার্যকলাপ, কর্তব্যে অবহেলা ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করতে হয়।

বিশেষভাবে প্রতারণামূলক অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কার্যকলাপের প্রতি ন্যায়পালকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। যেকোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সংবিধানের বিধি বা দেশের আইন লঙ্ঘন কিংবা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ভঙ্গ করলে ন্যায়পাল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সাধারণভাবে ন্যায়পাল পদের মূল উদ্দেশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের সমতা ও সততা বিধান এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রশাসনের যেকোনো ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ।

পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে ন্যায়পাল নিয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা হয়েছে। ন্যায়পাল ধারণাটি প্রথমবারের মতো সুইডেনে প্রকাশিত হয়, যার আভিধানিক অর্থ হলো মুখপাত্র বা প্রতিনিধি। সহজ ভাষায় বললে বলতে হয়, ন্যায়পাল হলো এমন একজন ব্যক্তি যিনি অন্যের জন্য কথা বলেন ও অন্যের স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। সুইডেনে ১৮০৯ সালে ন্যায়পাল নিয়োগ করা হয়। সুইডিশ ভাষায় Ombudsman বা ন্যায়পাল বলতে এমন একজন সরকারি মুখপাত্র বা প্রতিনিধি কিংবা সরকারি কর্মকর্তাকে বোঝায় যিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেন।

সরকারি আমলা ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী সরকারি এজেন্ট হিসেবে ন্যায়পাল থাকেন স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অভিগম্য। ১৮০৯ সালের পর থেকে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই ন্যায়পাল পদের প্রবর্তন হয়েছে। যুক্তরাজ্যে ন্যায়পালকে বলা হয় ‘পার্লামেন্টারি কমিশনার’। বিশ্বের ১৭০টি দেশে দুশোর অধিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব দেশেই ন্যায়পাল আইনসভা কর্তৃক নিযুক্ত হন। সাধারণত আইনসভায় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে ন্যায়পাল নির্বাচন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই ন্যায়পালকে যথাযথ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুশাসনের প্রধান উপাদান

বৃহত্তর অর্থে নাগরিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্য ভালোভাবে শাসন পরিচালনার নামই সুশাসন। জনগণকে দেয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নকেই সুশাসনের আওতায় ভাবা যায়। তবে একটি দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর এবং সামাজিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সুশাসনের অন্তঃসার হচ্ছে সুষ্ঠু, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি এবং নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি পেশাদারি আমলাতন্ত্র এবং শাসনবিভাগ, যা এর কর্মকান্ডের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক হবে। সুশাসনের জন্য আরও প্রয়োজন হচ্ছে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী একটি শক্তিশালী সুশীলসমাজ। সর্বোপরি, সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যদি সমাজের সব সদস্য আইনের শাসন মেনে চলে।

স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়া বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব:

একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র হতে হলে বাংলাদেশকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে। উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যেতে চাইলে বাংলাদেশকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করবে ভাবা হলেও কার্যত দেখা গেছে- এই আইনের কারণে নাগরিকদের; বিশেষ করে সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব হচ্ছে।‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হলো সুশাসন তথা আইনের শাসনের মূল উপাদান। বাংলাদেশ আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ কম, অপপ্রয়োগ বেশি।’


তথ্যসুত্র

একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র , Mazmin.

শাসন প্রত্যয়টি বিশ্বব্যাপী, Sangbad.

প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, Bonikbarta.

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি , Prthomalo.

মানবিক সহায়তায় স্বচ্ছতা , Kalerkantho.

নাগরিক সেবায় স্বচ্ছতা, Deshrupantor.

Subscribe for Daily Newsletter