টাইফয়েড বা টাইফয়েড জ্বর (Typhoid Fever)

টাইফয়েড বা টাইফয়েড জ্বর (ইংরেজি: Typhoid fever) হল এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগ, যা Salmonella typhi ব্যাক্টেরিয়ার কারণে হয়। লক্ষণ মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে, সচরাচর জীবাণু প্রবেশের ৬-৩০ দিন পর লক্ষণগুলি দেখা যায়। প্রায়ই কয়েকদিনের ব্যবধানে জ্বর এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

টাইফয়েডের কারণ

টাইফয়েডের অন্যতম কারণ হলো দূষিত খাবার গ্রহণ। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এবং পানির মাধ্যমেও এই রোগের জীবাণু ছড়ায়। এ রোগের জটিলতাও নেহাত কম নয়। রক্তক্ষরণ, অগ্নাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ এমনকি কিডনিতেও বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে টাইফয়েড থেকে।

টাইফয়েড রোগের লক্ষণ কি?

  • জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
  • ক্ষুধামন্দা হওয়া সহ কারো কারো কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।
  • গা ম্যাজ ম্যাজ করা সহ রোগীর কফ বা কাশি হতে পারে ।
  • প্রচণ্ড পেটে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
  • দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর পেটে ও পিঠে গোলাপি রঙের দানা দেখা দিতে পারে।
  • কারো কারো জ্বরের সঙ্গে কাশি হয়।
  • হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে।
  • ওষুধ চলা অবস্থায়ও সপ্তাহ খানেক জ্বর থাকতে পারে।

টাইফয়েডের প্রকারভেদ

সালমোনেলা দুটি গ্রুপের অধীনে পড়ে:টাইফয়েডাল সালমোনেলা, যা ব্যাকটেরিয়াল স্ট্রেন। এটি সালমোনেলা টাইফি, প্যারাটাইফি এ, বি এবং সি সহ টাইফয়েড জ্বর বা প্যারাটাইফয়েড জ্বরের জন্ম দেয়।নন-টাইফয়েডাল সালমোনেলা, যার অন্যান্য সমস্ত সালমোনেলা স্ট্রেন রয়েছে।

টাইফয়েড হলে কি কি ক্ষতি হয়?

টাইফয়েড হলে উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, প্রচণ্ড দুর্বলতা, ডায়রিয়া, কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকে র‌্যাশ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হলে পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন হৃদ্‌যন্ত্রে ও মস্তিষ্কে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বা অন্ত্র ছিদ্র।

প্যারাটাইফয়েড জ্বর কি?

প্যারাটাইফয়েড রোগটি অনেকটা টাইফয়েডের মতো হলেও এর আক্রমণ টাইফয়েডের চেয়ে কম জোরালো, আর স্থায়িত্বও কম। উপসর্গ: প্যারাটাইফয়েড হলে প্রথম দিকে হালকা জ্বর, বমি ভাব, অরুচি ও পেটব্যথা থাকে। ধীরে ধীরে জ্বর বাড়তে পারে। প্রথম দিকে কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলেও পরে পাতলা পায়খানা হতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর শরীরের কোন অংশে আক্রমণ করে?

টাইফয়েড একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। এটি শুধুমাত্র একটি অঙ্গকে প্রভাবিত করে না, তবে শরীরের একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে। রক্তের প্রবাহে পৌঁছানোর পরে, ব্যাকটেরিয়া লিভার, প্লীহা এবং পেশী সহ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে আক্রমণ করে। কখনও কখনও, লিভার এবং প্লীহাও ফুলে যায়। ব্যাকটেরিয়া রক্তের মাধ্যমে পিত্তথলি, ফুসফুস এবং কিডনিতেও পৌঁছাতে পারে।

সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ হল জ্বর এবং শরীরে ফুসকুড়ি। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীদের শরীরের তাপমাত্রাও বেশি থাকে। ঘাড় এবং পেটে হালকা লাল দাগও আন্ত্রিক জ্বরের বিকাশ দেখায়।

টাইফয়েড হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজের চিকিত্সক ড. দীনা শারমিন—

রক্ত পরীক্ষা

টাইফয়েড পানিবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায়। তাই টাইফয়েড হয়েছে কি না, তা বুঝতে সবার আগে অসুস্থ ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা

সব সময় পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে। নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। অবশ্যই হাত ভালোভাবে ধুতে হবে। ঘরের জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহূত জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে হবে।

পানি, খাবারে সতর্কতা

পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। খাবার গরম করে খেতে হবে। বাইরের খাবার খেলে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। অপরিষ্কার শাক-সবজি ও কাঁচা-ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

বাসস্থান ও টয়লেটের সুব্যবস্থা

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন টয়লেটে ময়লা বা পানি জমে না থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে খোলামেলা ও পরিষ্কার বাসায় রাখতে হবে।

টাইফয়েড হয়েছে কি না, তা যেমন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে, তেমনি ওষুধ খাওয়ার জন্যও অবশ্যই রোগীকে একজন চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

টাইফয়েডে মৃত্যুর হার কত?

এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি 0.2%। সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের সাথে, টাইফয়েড জ্বর একটি স্বল্পমেয়াদী অসুস্থতা যার জন্য প্রায় 5-6 দিনের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।

কিভাবে টাইফয়েড জ্বর সনাক্তকরণ করা হয়?

পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কেবল চিকিৎসকগণ বলতে পারবেন যে কারও টাইফয়েড জ্বর হয়েছে কিনা। টাইফয়েড দ্রুত সনাক্ত করার জন্য ব্লাড কালচার নামক রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। যদি নমুনায় স্যালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায় তাহলে প্রকার ভেদে টাইফয়েড ও প্যারা- টাইফয়েড পার্থক্য করা হয়। এছাড়া জ্বর হওয়ার ২য় সপ্তাহে “উইডাল টেস্ট” নামে এক ধরনের ননস্পেসিফিক ব্লাড টেস্ট করতে হয় যাতে টাইটার দেখে টাইফয়েড নির্ধারণ করা হয়।

শরীর সুস্থ রাখতে এই সময় বাড়িতে কিছু নিয়ম মেনে চললে শরীর সুস্থ হবে তাড়াতাড়ি।

১) জল খান

টাইফয়েডের মতো রোগ হলে যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণে জল খান। অবশ্য শুধু জল নয়। যে কোনও তরল খাবার খেতে পারেন। ফলের রস, হার্বাল চা-ও থাকতে পারে তালিকায়। টাইফয়েড থেকে ডাইরিয়া হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তা যাতে না হয় তাই তরল খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

২) আদা

শরীরের যে কোনও রকম সমস্যায় আদা সবচেয়ে উপকারী। এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রক্তকে বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিডনি থেকে অযাচিত পদার্থ বের করে দিতেও সাহায্য করে আদা। ফলে শরীর পরিষ্কার হয়। সবচেয়ে উপকারী কাঁচা আদা বা অর্ধেক রান্না করা আদা।

৪) অ্যাপেল সিডার ভিনিগার

এতে প্রচুর অ্যাসিডিক উপাদান থাকে। জ্বর কমাতে সাহায্য করে অ্যাপেল সিডার ভিনিগার। দেহ থেকে উত্তব বের করে এটি। টাইফয়েড মানেই জ্বর একটি বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে বেশি জ্বর হলে অ্যাপেল সিডার ভিনিগার দেওয়া যেতে পারে। ডাইরিয়াকেও আটকায় এই ঘরোয়া টোটকা। দেহের পুষ্টি বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।

৫) ঠান্ডা জল

জ্বর বেশি হলে ঠান্ডা জলে কাপড় ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে রাখতে হবে। সাদা বাংলায় যাকে বলে জলপট্টি দেওয়া। দেহের তাপমাত্রা আরও বেড়ে গেলে অবশ্য এতে আর কাজ হয় না। তখন ঠান্ডা মাথা ধুয়ে দিতে হবে। ঠান্ডা জলে কাপড় ভিজিয়ে সারা গা মুছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে জ্বর খুব তাড়াতাড়ি নেমে যায়।


তথ্যসুত্র:

টাইফয়েড: কীভাবে বুঝবেন, কী করবেন?, Prothomalo.

টাইফয়েড জ্বর শরীরের কোন অংশে আক্রমণ করে?.

জেনে রাখুন কিছু ঘরোয়া টোটকা, Sangbadpratidin.

টাইফয়েডজ্বরেরলক্ষণসমূহ.