পানি দূষণ (Water Pollution)
২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস
১৯৯৩ সাল থেকে সারাবিশ্বে একযোগে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীব্যাপী পানির প্রয়োজনীয়তা, নিরাপদ পানির সংস্থান ও সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতেই এই দিবসের সূত্রপাত। প্রতিবছরই পানি দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘ভূগর্ভস্থ পানি: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা’।
বাংলাদেশেসহ এশিয়ার নদনদীর পানিগুলো ক্রমান্বয়ে বর্ণ হারাচ্ছে
বাংলাদেশেসহ এশিয়ার নদনদীর পানিগুলো ক্রমান্বয়ে বর্ণ হারাচ্ছে। এর পর সার্কভুক্তদেশগুলোসহ এশিয়ার অনেক দেশ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে অনলাইন সিএনএন-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে শিল্প কারখানার মিশানো পানি সরাসরি নদী খালগুলোতে এসে পড়ে। যে পানিতে থাকে রাসায়নিক পদার্থ এখন শুধু পরিবেশ ক্ষতি হচ্ছে না, একই সঙ্গে পানীয় জলের উৎস দূষিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে দূষণরোধে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। আমাদের যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো, সংরক্ষণও পরিবেশ বিষয়ক আইন আধুনিক করা, দূষণকারীদের জরিমানা করা এবং পানির গুণগতমান পর্যবেক্ষণ করা। এছাড়া নদী রক্ষা কমিশন ইতোমধ্যে দেশের ৪৯ হাজার ১৬২ জন নদী ও খাল দখলের তালিকা ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে। এগুলো এক বছরের মধ্যে উচ্ছেদ করা সম্ভব হলে নদী দূষণ অনেকাংশে কমে যাবে। দখল-দূষণমুক্ত নদনদীর ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে পুনঃদখলও দূষণ। এটিরোধে সরকারকে নদী তীরে ব্যাপকভাবে বনায়ন করতে হবে।
আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে
স্পেস বস্নগ সাইট থেকে জানা যায় ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০% জুড়ে জল দ্বারা আবৃত। গ্রহের মোট জলের মধ্যে ৯৭% সমুদ্র এবং মহাসাগরের এবং মাত্র ৩% স্বাদু জল। এর মধ্যে আবার ২% কঠিন আকারে এবং ১% এরও কম ব্যবহারের জন্য।আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান হয় ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ এই দুই উৎস থেকে। অথচ কল্পনাতীত পানি দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার আজ নেই বললেই চলে। তাই বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক আধার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা অববাহিকার পানি। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের দেশগুলোর পানিসম্পদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।ওই প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে তুলনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে মাটির ওপরের ও নিচের—দুই ধরনের পানিরই অবস্থা খারাপ। মাটির নিচের পানি উত্তোলনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতাও বাংলাদেশে অনেক বেশি।প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্সে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ কিরিবাতি।
পানি খাতের সুরক্ষা ছাড়া এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে এডিবির জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ব্যাং ব্যাং সুসানটোনো বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল পানি নিরাপত্তার দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। পানি খাতের সুরক্ষা ছাড়া এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়োবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে রাসায়নিক পদার্থের দূষণ বাড়ছে। নদীর স্বাস্থ্য দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। নদীর স্বাস্থ্যের অবনতির দিক থেকে শীর্ষে গঙ্গা অববাহিকার দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল।
ভূগর্ভের পানি অতিব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার (কিউবিক কিলোমিটার) পানি উত্তোলন করে। এর ৮৬ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষির সেচকাজে। বাকি ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে ও ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। ভূগর্ভের পানি অতিব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ভূগর্ভের পানি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ভারত। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইরানের অবস্থান। ভূগর্ভ থেকে অতিমাত্রায় পানি উত্তোলনকে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছে এডিবি।
বিভিন্ন এলাকার পানির স্তর বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে
তবে এডিবির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ভূগর্ভ থেকে মোট উত্তোলিত পানির যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিষয়ক পরামর্শক ইফতেখারুল আলম। তিনি এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ প্রায় ১৬ লাখ বিদ্যুচ্চালিত সেচযন্ত্র ও ৩০ হাজার গভীর নলকূপের মাধ্যমে বছরে ৪৮ থেকে ৫২ কিউবিক কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। এই প্রবণতা দেশের বরেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকার পানির স্তর বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের কৃষকেরা ২ কোটি ৩০ লাখ সেচপাম্পের মাধ্যমে তাঁদের সেচের পানি উত্তোলন করেন, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামিয়ে দিয়ে বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকি তো তৈরি করছেই, সেই সঙ্গে এই পানি তুলতে তাঁদের বছরে ৩৭৮ কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে।
মানুষের কর্মকাণ্ড পানিদূষণের প্রধান কারণ
পানির অপর নাম জীবন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি প্রয়োজন, কিন্তু দূষিত পানি জীবননাশের কারণ হতে পারে। সাধারণত পানিতে কোনো বিষাক্ত দ্রব্য অথবা দূষিত বর্জ্য পদার্থ মিশ্রণের ফলে মানব ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে পানিদূষণ বলে। অর্থাৎ পানিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ মিশে পানি দূষিত হয়।মানুষের কর্মকাণ্ড পানিদূষণের প্রধান কারণ। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক, পয়োনিষ্কাশন, কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য এবং গৃহস্থালির বর্জ্যের মাধ্যমে পানি দূষিত হয়। এ ছাড়া নদী বা পুকুরে গরু-ছাগল গোসল করানো, ময়লা আবর্জনা ফেলা এবং কাপড়চোপড় ধোয়ার কারণেও পানি দূষিত হয়।
দূষিত পানি পান করে মানুষ ডায়রিয়া বা কলেরার মতো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়
পানিদূষণের ফলে জলজ প্রাণী মারা যায় এবং জলজ খাদ্যশৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটে। এই দূষণের প্রভাব মানুষের ওপরও পড়ে। দূষিত পানি পান করে মানুষ ডায়রিয়া বা কলেরার মতো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। কৃষিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে পানিদূষণ প্রতিরোধ করা যায়।বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশগত সমীক্ষা নামক সংস্থার মতে, পানি দূষণ হলো অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা, যেটা পরবর্তী দশকগুলোতে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন যেগুলো ৭০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং পৃথিবীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের একটি বড় অংশ শোষণ করে, পানি দূষণ তাদের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা।
সমুদ্রে দূষিত পদার্থের আগমনের একটি সাধারণ পথ হলো নদীর পানি
উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্ত পানি দূষণের পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোও কিন্তু দূষণজনিত সমস্যা নিয়ে লড়াই করে চলেছে। ভূপৃষ্ঠতলীয় পানি দূষণের মধ্যে রয়েছে নদী, হ্রদ এবং সমুদ্রের দূষণ। ভূপৃষ্ঠতলীয় পানি দূষণের একটি বিভাগ হলো সামুদ্রিক দূষণ। সমুদ্রে দূষিত পদার্থের আগমনের একটি সাধারণ পথ হলো নদীর পানি। এর একটি উদাহরণ হলো, নর্দমার পানি এবং কারখানার বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে ফেলা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বিশেষ করে এই ধরনের দূষণ দেখা যায়। প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রের বড় বড় বলয়ের মধ্যে আটকে পড়ে। প্লাস্টিক আবর্জনাগুলো সামুদ্রিক দূষণে সৃষ্ট বিষাক্ত পদার্থগুলোকে শোষণ করে নেয়, যার ফলে সামুদ্রিক জীব এগুলো খেয়ে ফেললে তাদের শরীরেও বিষ প্রবেশ করতে পারে। এসব দীর্ঘজীবী পদার্থগুলো অনেক সময়েই শেষমেশ সামুদ্রিক পাখি এবং প্রাণীদের পেটে চলে যায। এর ফলে তাদের হজমের পথ আটকে যায়। যার ফলে তাদের খিদে কমে যায় অথবা এর থেকে তারা অনাহারেও ভুগতে পারে।
প্রাকৃতিক উপাদানের উচ্চ ঘনত্ব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে
মূল দূষক ছাড়াও, অনেক ধরনের অপ্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন ভূপৃষ্ঠে পানির গ্রোতে পলি ভেসে থাকলে পানিস্তম্ভের মধ্যে দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না এবং এর ফলে জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পানি দূষণকারী নির্দিষ্ট পদার্থগুলো রাসায়নিক, রোগ সংক্রামক জীবাণু এবং ভৌত পরিবর্তন যেমন উচ্চ তাপমাত্রা এবং বিবর্ণতার মতো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাসায়নিক এবং অন্যান্য পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি পদার্থ প্রকৃতিতে তাদের ঘনত্ব দ্বারা বোঝা যায়, তারা পানির স্বাভাবিক উপাদান হলেও কখনো কখনো প্রাকৃতিক উপাদানের উচ্চ ঘনত্ব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া পদার্থের মধ্যে প্রাকৃতিক বস্তু থাকতে পারে, যেমন উদ্ভিদের অংশ, আবার মনুষ্যসৃষ্ট রাসায়নিক পদার্থও থাকতে পারে। অন্যান্য প্রাকৃতিক এবং অ্যানথ্রোপোজেনিক পদার্থ পানিতে টার্বিডিটি সৃষ্টি করতে পারে যা আলো প্রবেশে বাধা দেয়, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং মাছের কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে ফুলকাকে আটকে দেয়।
রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবগুলোকে রোগ সংক্রামক জীবাণু বা প্যাথোজেন বলা হয়
পানির ভৌত রাসায়নিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দায়ী যেসব বিষয় তা হল অম্লত্ব, বৈদ্যুতিক পরিবাহীতা, তাপমাত্রা এবং ইউট্রোফিকেশন। ইউট্রোফিকেশনের মাধ্যমে একটি বাস্তুতন্ত্রে রাসায়নিক উপাদানগুলোকে বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে বাস্তুতন্ত্রটির প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। ইউট্রোফিকেশনের মাত্রার ওপর পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব নির্ভর করে যেমন এর ফলে অ্যানোক্সিয়া হতে পারে এবং পানির মান গুরুতরভাবে হ্রাস পেতে পারে, যার ফলে মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের ক্ষতি হয়। রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবগুলোকে রোগ সংক্রামক জীবাণু বা প্যাথোজেন বলা হয়। এই জীবাণুগুলো মানবদেহে বা প্রাণীদেহে পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি করতে পারে। কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়া পানিবাহিত রোগের প্রকৃত কারণ না হলেও এদেরই পানি দূষণের একটি ব্যাকটেরিয় মানদ- হিসেবে সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়।
এসব অণুগুলো এতই ক্ষুদ্র যে দামি ও উন্নত শোধক কারখানা ছাড়া এদেরকে মুক্ত করা বেশ জটিল
রোগ সংক্রামক জীবাণু সেই নির্দিষ্ট স্থানটির শৌচব্যবস্থা অথবা অপর্যাপ্তরূপে শোধিত নিকাশী পানি থেকে অধিক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো শহরের পুরোনো পরিকাঠামোর নিকাশী ব্যবস্থায় অবাঞ্চিত বহির্গমনের ফলে নর্দমার দূষিত পানি বাইরে চলে আসতে পারে। কিছু শহরে সংযুক্ত নিকাশী ব্যবস্থা আছে যেগুলোর দূষিত পানি ঝড় বৃষ্টির সময় অপরিশোধিত অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। জৈব পানি দূষকের মধ্যে যেগুলো পড়ে তা হলো: ডিটারজেন্টস, রাসায়নিকভাবে জীবাণুমুক্ত পানির মধ্যে থাকা জীবাণুধ্বংসকারী উপজাত পদার্থ যেমন: ক্লোরোফর্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণজাত বর্জ্য, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেনের চাহিদাযুক্ত পদার্থ, চর্বি, গ্রিজ, কীটনাশক এবং ভেষজনাশক, বিভিন্ন ধরনের অর্গ্যানোহ্যালাইডস এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ, পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন, যেমন জ্বালানি এবং পিচ্ছিলকারক তেল, উদ্বায়ী জৈব যৌগ, ক্লোরিনযুক্ত দ্রাবক, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, ট্রাইক্লোরোইথিলিন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি দ্রব্য এবং প্রসাধনী দ্রব্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ, ড্রাগ দূষণ যার মধ্যে রয়েছে ওষুধ এবং তাদের বিপাকজাত দ্রব্য। এসব অণুগুলো এতই ক্ষুদ্র যে দামি ও উন্নত শোধক কারখানা ছাড়া এদেরকে মুক্ত করা বেশ জটিল।
অজৈব পানি দূষণকারী পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে
অজৈব পানি দূষণকারী পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: শিল্পকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের দ্বারা সৃষ্ট অম্লত্ব, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত অ্যামোনিয়া, শিল্পকারখানার উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত রাসায়নিক বর্জ্য, নাইট্রেট এবং ফসফেট জাতীয় উপাদানযুক্ত সার, যা কৃষিজমি থেকে এবং বাণিজ্যিক ও গৃহস্থ ব্যবহারের ফলেও বৃষ্টির পানির সাথে যুক্ত হয়, মোটরগাড়ির ভারি ধাতু, নির্মায়মান অঞ্চল, বৃক্ষচ্ছেদন, জুম চাষ অথবা ভূমি নিষ্কাশন অঞ্চল থেকে প্রবাহিত পানির পলি। পানি দূষণকারী দৃশ্যমান বড় বড় পদার্থ- যেগুলো শহরের ঝোড়ো জলের পরিপ্রেক্ষিতে ভাসমান বলা চলে, এই ধরনের পদার্থগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়: মাটিতে মানুষের দ্বারা পরিত্যক্ত আবর্জনা, ছোট ছোট সর্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের টুকরো এবং পরিত্যক্ত ভাঙা জাহাজ।
পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ
ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুদ বাড়ে। নদনদীতে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর সব নদনদীর ড্রেজিং করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যয়সাপেক্ষ হলেও নদীর পানিকে পরিশোধন করে সুপেয় পানিতে রূপান্তরিত করার পরিমাণ বাড়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি ওয়াসাকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমন হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এসব রক্ষা করতে হবে। গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানায় বেশি বেশি ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
আবাসিক ভবনে পানিসাশ্রয়ী সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে
দেশে ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূমির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়। যত্রতত্র যেখানে-সেখানে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করে এর জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে। সব ওয়াসার লাইনে ডিজিটাল মিটার বসাতে হবে। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত নলকূপেও মিটারিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে কেউ অতিরিক্ত পানি অপচয় করতে না পারে। পানির অপচয় রোধ করতে পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। এজন্য সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আবাসিক ভবনে পানিসাশ্রয়ী সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পানিদূষণের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সরকারি নীতিসহায়তা ও তদারকি আরো জোরদার করা উচিত। এছাড়া সরকারকে ভূগর্ভস্থ পানির মান নিরাপদ রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানিদূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে
সারাবিশ্বে ব্যাপকহারে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে এই পানির মজুত আজ হুমকির মুখে। তাই এই বছরের পানি দিবসের লক্ষ্য হলো ভূগর্ভস্থ পানি সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষকে আরও বেশি সচেতন করা। যাতে বিশুদ্ধ পানির এই উৎস সম্পর্কে মানুষ আরও বেশি সজাগ হয়।বিশেষকরে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, দূষণরোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করা। যাতে করে পৃথিবী আরও বেশিদিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানিদূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মখে পড়বে। তাই আমাদের সবার উচিত এই বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
পানির এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা একটা অনিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে
সারা বছর এ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি অন্ততপক্ষে বিশ্ব পানি দিবসে পানি দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। পানির এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা একটা অনিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে। যত সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দূষণের ভয়াবহতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এ সমস্যাটাকে আমরা কখনো নিজের মনে করছি না। তাই এর দূষেণের মাত্রা কমানোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। পৃথিবীর পানি নিরাপদ রাখার জন্য এককভাবে প্রচেষ্টায় সঠিক ফল না আসাই স্বাভাবিক। তাই এর জন্য বিশ্বব্যাপী একটি সঠিক আইন তৈরি এবং এই আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পানিকে নিরাপদ রেখে একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের উচিত এটিকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা।
সারা বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ লোক মারা যাচ্ছে
সারা বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ লোক মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর তথ্যানুসারে, বিশ্বে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২০ লিটার বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির সংকটে এর পরিমাণ দিন দিন কমছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পানি সংরক্ষণ ও যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলায় মিষ্টি পানির তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে।এ অঞ্চলে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। বলা বাহুল্য বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন,এক সময় দেশের প্রায় ৯৯শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরাপদ পানি সরবরাহের সুবিধা পেলে ও আর্সেনিক ও লবণাক্ততাসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়ায় বর্তমানে তা কমে ৮৮ শতাংশে নেমেছে।
বাংলাদেশে প্রধান প্রধান যে ৫৭টি নদী আছে ৫৪টিই ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর এসব আর্ন্তজাতিক নদীর পানি ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পানি শূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন না মেনে বাংলাদেশকে পানির নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ভারত তাঁর ইচ্ছামত বাঁধ, সংযোগ খাল নির্মাণ করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভাটির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রাপ্য বেশী। ভারত এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না। এ নিয়ে অনেক লেখা লেখি হয়েছে। পাঠক ও জানেন। ভারতের এই বৈরী আচরণের প্রতি আমাদের করণীয় কি এবং কি করছি। এ নিয়ে ও পানি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
তথ্যসুত্র
তবে নদ নদীর দেশ, Dailysangram.
পানির অন্য নাম জীবন , Jaijaidin.
জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক, Prothomalo.
দেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তি , Somoynews.
ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা, Bonikbarta,
পানিবাহিত রোগের প্রকোপে, Alokitobangladesh.
পানির অপর নাম জীবন, Kalerkantho.