বিশ্ব স্কাউট দিবস (World Scout Day)

স্কাউট একটি আন্তর্জাতিক, বিশ্ব ভ্রাতৃত্বমূলক অরাজনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন। বন্ধুত্বের মাধ্যমে সেবা প্রদানের জন্য বহুল জনপ্রিয় সংগঠন এটি। স্কাউটিং আন্দোলনের প্রবক্তা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। তারই হাত ধরে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তাই ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী স্কাউট দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন স্কাউট আজ এই দিবসটি পালন করছে। বর্তমানে বিশ্বের ২১৭টি দেশে তিন কোটি ৮০ লাখ স্কাউট ও গাইড রয়েছে।
স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাডেন পাওয়েল
স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাডেন পাওয়েল কর্মজীবনে সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ১৮৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষুদ্র সীমান্ত শহর ম্যাফ্যেকিংয়ে তিনি ২১৭ দিন বুয়রদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিলেন। এসময় তিনি ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের দলে দলে বিভক্ত করে শত্রুপক্ষের দুর্গে দুর্গে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করেছিলেন এবং তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে সে কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিল। তখন ব্যাডেন পাওয়েল পরিকল্পনা করলেন এইসব ছেলেমেয়েকে সংঘবদ্ধ করতে পারলে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও তারা সফলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকে ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ব্রাউন্সি দ্বীপে ব্যাডেন পাওয়েল মাত্র ২০ জন বালক নিয়ে স্কাউট আন্দোলন শুরু করেন। কালক্রমে তা সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
(ভারতীয় উপমহাদেশে) স্কাউটিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও আমাদের এই অঞ্চলে (ভারতীয় উপমহাদেশে) স্কাউটিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। আর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ইস্ট পাকিস্তান বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালে তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৭৮ সালে আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস। ১৯৯৪ সাল থেকে মেয়েরা এর সদস্য হওয়ার অধিকার লাভ করে।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে
ভারতীয় উপমহাদেশে স্কাউটিংয়ের সূত্রপাত ঘটে ইংরেজ শাসনামলে। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে এর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ‘বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি’ গঠিত হয় এবং ঐ বছরই সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ‘বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি’র পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে ১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ স্কাউট’ নাম ধারণ করে। সংগঠনটিতে নারীদের সদস্য হওয়ার নিয়ম ছিল না। ১৯৯৪ সালে স্কাউট নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব স্কাউট সংস্থা, WOSM (World Organisation of the Scout Movement) কর্তৃক ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আমাদের দেশে এর কার্যক্রম ব্যাপক পরিসরে চলমান। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের স্কুল-কলেজেই স্কাউট রয়েছে। অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালে স্কাউটের সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ দেখিয়ে ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে ২১ লাখ স্কাউট সদস্যের সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।
দেশে ১০লাখ ১৫ হাজার ১১৬ স্কাউট রয়েছেন
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে স্কাউটিংয়ের যাত্রা শুরু ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪৭-এর পর ইস্ট পাকিস্তান বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা। ১৯৭২ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ বয়স্কাউট ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১০লাখ ১৫ হাজার ১১৬ স্কাউট রয়েছেন। কমিউনিটি সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিশুকল্যাণ, নির্মাণ ও সস্তায় বাড়িঘর তৈরিতে স্কাউটরা সহায়তা করে থাকেন। বাংলাদেশ স্কাউটস সূত্র অনুযায়ী, কমিউনিটি সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিশুকল্যাণ, নির্মাণ ও সস্তায় বাড়িঘর তৈরিতে স্কাউটসরা সহায়তা করে থাকেন। এ ছাড়া বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে, অসহায় মানুষের আশ্রয় বা পুনর্বাসনে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেন তারা।অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৭৮ সালে আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস। ১৯৯৪ সাল থেকে মেয়েরা এর সদস্য হওয়ার অধিকার লাভ করে। আত্মনির্ভরশীল সু-নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ কার্যক্রম বিশ্বব্যাপি সমাদৃত।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতি
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতি। সে বছরেরই ৯ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১১১ নং অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতিকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১ জুন বিশ্ব স্কাউট সংস্থা বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতিকে ১০৫তম জাতীয় স্কাউট সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল সভায় বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ স্কাউটস’ করা হয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্কাউটস বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
ব্যাডেন পাওয়েল কাবদের জন্য ‘উলফ কাবস হ্যান্ড বুক’ নামে একটি মূল্যবান বই রচনা করেন
১৯১৬ সালে ১২ বছর পর্যন্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কাউটের নতুন শাখা ‘কাব স্কউট’ তৈরি করলেন। ‘কাব’ শব্দের অর্থ সিংহ শাবক। ব্যাডেন পাওয়েল কাবদের জন্য ‘উলফ কাবস হ্যান্ড বুক’ নামে একটি মূল্যবান বই রচনা করেন। এরপর তরুণদের জন্য গঠন করলেন ‘রোভার স্কাউট’ এবং তরুণীদের জন্য ‘রেঞ্জারিং’। মূলত কাব, স্কউট, রোভার, রেঞ্জার, গাইড একই সংগঠন। শুধু ভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য ভিন্ন নাম। ১৯২০ সালে অলিম্পিয়াতে সারা বিশ্বের স্কাউট ও গাইডদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাবেশ বা জাম্বুরী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বিশ্ব স্কাউটস-এর ৬টি রিজিওন বা অঞ্চল আছে।সেগুলো হলো ১.এশিয়া প্যাসেফিক ফিলিপাইন-ম্যানিলা ২. ইউরোপ অঞ্চল সুইজারল্যান্ড-জেনেভা ৩.আফ্রিকা অঞ্চল কেনিয়া-নাইরোবি ৪. ইন্টার আমেরিকা চিলি-সান্টিয়াগো ৫.আরব অঞ্চল মিশর- কায়রো ৬. ইউরেশিয়া অঞ্চল ইউক্রেন-ইয়ালতাগুজরাফ।
প্রতিভার বিকাশে স্কাউট একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করে আসছে
সাধারণত ৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিশু, কিশোর ও যুবকদের নিয়ে গঠিত হয় এই সংগঠন। যুবসমাজের নৈতিকতার উন্নতি সাধন, দক্ষ জনশক্তি গঠন, নেতৃত্বের যোগ্যতা তৈরি, সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে এটি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে প্রায় সকল দেশেই স্কাউট আন্দোলন চলছে। সারাবিশ্বের স্কাউটরা বিভিন্ন ক্রান্তিকালে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে মানবতার সেবায় নিজেকে সমর্পণ করে চলেছে। বাংলাদেশেও স্কাউট কার্যক্রম দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলছে।
এই দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কাব স্কাউট, স্কাউট ও রোভার স্কাউটরা স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞার যথাযথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হবে
স্কাউটিং বিশ্বের একটি জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী গতিশীল অরাজনৈতিক শিক্ষামূলক, আকর্ষণীয় ও উদ্দীপনামূলক যুব আন্দোলন। শিশু-কিশোর ও যুব বয়সিদের অবসর সময়কে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে বৈচিত্র্যময় কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্কাউটিং এক অনন্য মাধ্যম। স্কাউট আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে একজন শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুব বয়সিরা নিজের ভেতরের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে নিজকে নিয়োজিত করতে পারে। এই দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কাব স্কাউট, স্কাউট ও রোভার স্কাউটরা স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞার যথাযথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের ইতিহাস ও কার্যক্রম সম্পর্কে নিজে জানবে এবং অন্যকে স্কাউট আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্কাউট পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ স্কাউট আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ‘স্কাউট প্রতিজ্ঞা ও আইন’ প্রতিষ্ঠিত। এর মাধ্যমে স্কাউটদের চরিত্র গঠন তথা দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন এবং দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটানো হয়ে থাকে। স্কাউট পদ্ধতির আরেকটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে হাতেকলমে শিক্ষণ। এটি কার্যকর শিক্ষার মৌল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং আধুনিক শিক্ষার ‘কর্নার স্টোন’ হিসেবে স্বীকৃত। স্কাউট পদ্ধতির অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপাদান হচ্ছে টিম সিস্টেম। টিম সিস্টেম নেতৃত্বের বিকাশ, দক্ষতা বৃদ্ধি, দায়িত্ব সচেতনতা, একাত্মবোধ ও শৃঙ্খলাবোধের উন্মেষ, কার্যমূল্যায়ন ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক যোগ্যতা সৃষ্টির বিশেষ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ক্রমবৃদ্ধি স্কাউট পদ্ধতির অন্যতম উপাদান। এ উপাদান প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর ব্যক্তিগত উন্নয়নে তাদের সচেতনভাবে ও সক্রিয়তার সঙ্গে নিয়োজিত করতে সহায়তা করার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে তরুণ-তরুণীকে তার নিজস্ব পথে অগ্রগতিতে সামর্থ্যবান করে তোলা হয়। স্কাউট আন্দোলনের গোড়া থেকেই প্রকৃতি এবং মুক্তাঙ্গনের জীবন স্কাউট কার্যাবলির জন্য একটি আদর্শ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল স্বয়ং প্রকৃতির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং কৌতূহলীর ফলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। বালকদের দেশের উত্তম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে স্কাউটিং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে এবং প্রকৃতির পাঠশালাই এর উপযুক্ত স্থান।
তথ্যসুত্র
রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড বেডেন, Protidinersangbad.
স্কাউটিং আন্দোলনের প্রবক্তা , The Daily Campus.
স্কাউটিং আন্দোলনের শুরু , Ittefaq.
স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত, Jagonews.