সাহিত্য লিখি ও সাহিত্য পড়ি (Write and read literature)
যারা ‘সাহিত্য’ ধারণা নিয়ে দেশেবিদেশের তর্ক কমবেশী অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানেন ‘লিটারেচার’ কথাটা আমরা ব্যবহার করি বটে, কিন্তু তার কোন সারবত্তা নাই। কেন নাই? কারণ লিটারেচার কি তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাবার কোন যুৎসই মানদণ্ড নাই। কি মিল আছে কবিতার সঙ্গে গদ্যের? কিম্বা রম্য রচনার সঙ্গে উপন্যাসের; তারা ছাপাখানায় ছাপা হয় এটা একটা মিল বটে। এর বাইরে ‘লিটারেচার’ কথাটাকে কোন স্থির-নির্দিষ্ট ধারণার ওপর সিধা করে দাঁড় করানো যারপরনাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
সাহিত্য’ কথাটির একটা প্রাচীন মানে আছে আমাদের ভাষায়
সাহিত্য’ কথাটির একটা প্রাচীন মানে আছে আমাদের ভাষায়। এর অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে আমরা প্রায় কিছুই ভাবি নি, বিশ্লেষণ করি নি, কিম্বা সেই ভাবকে আমরা এতোকাল গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলাম না। পাশ্চাত্যের ‘লিটারেচার’ ধারণাকে মোকাবিলার জন্য এখন দিতে চাইছি। এখন দেব। আমরা সেই ভাবের সূত্র ধরে রাখতে চাই, কিম্বা সূত্র মনে রেখে বর্তমানে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করতে চাই। যেহেতু ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’, অতএব সেই চর্চার সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ও বিরাজ করবার বাসনা। অর্থাৎ আমরা যে যার যার পছন্দের বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করলেও সবার সঙ্গে যুক্ত হবার এবং সকলের মধ্যে বিরাজ করবার বাসনার মধ্যেই সাহিত্যের ঘটনা ঘটে। আমরা সাহিত্যকে নতুন করে আবষ্কার করি।
সাহিত্য সমাজ ভাঙতে পারে, চাইলে সমাজকে একত্রে বাঁধতেও পারে
সাহিত্য সমাজ ভাঙতে পারে, চাইলে সমাজকে একত্রে বাঁধতেও পারে। আমাদের অনুমান তাহলে অমূলক নয় যে চিহ্ন বা আরও সুনির্দিষ্ট বা সংকীর্ণ অর্থে অক্ষর নিয়ে কায়কারবারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয়। সাহিত্য যদি সবার সঙ্গে যুক্ত হবার, যুক্ত থাকার এবং সামষ্টিক ভাবে বিরাজ করবার বাসনা হয় তাহলে সেই বাসনা কোন না কোন চিহ্নব্যবস্থা বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যুগপৎ ব্যক্তি এবং সঙ্গে সমাজ হয়ে ওঠে”। সমাজের মধ্যে ব্যক্তি এবং ব্যাক্তির মধ্যে সমাজ – একের মধ্যে অনেক এবং অনেকের মধ্যে ‘এক’-এর মহিমা বিস্ফোরিত করাই সাহিত্যের কাজ।
সাহিত্য ব্যাপারটা শুধু লিখিত ভাষার ব্যাপার না
সাহিত্য ব্যাপারটা শুধু লিখিত ভাষার ব্যাপার না। সেটা আরও বড় জিনিস। সাহিত্য চর্চা শুধু গুটেনবার্গের টেকজনলজি দিয়ে হতে হবে তারও কোন কথা নাই – যে কোন মাধ্যম বা টেকনলজির মধ্য দিয়ে সাহিত্য চর্চা সম্ভব। অর্থাৎ মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য ও চিরায়ত সম্পর্কের একটা অবসান চাইছিলাম আমরা। যেন সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমের ভুমিকা আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
লিটারেচারের ধারণা দানা বেঁধেছে আধুনিকতার মধ্যে
লিটারেচারের ধারণা দানা বেঁধেছে আধুনিকতার মধ্যে। কিন্তুই যে আধুনিকতা আমরা কলোনির দুর্দশা ভোগ করা দেশে চর্চা করি সেটা পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট নয়, বরং ঔপনিবেশিক সম্পর্কের অধীনতা মেনে ‘আধুনিকতা’ নামক একটা ফিনিশড প্রডাক্ট কঞ্জিউওমার হিসাবে ভোগ। আমরা কোকাকোলা খাই, কিন্তু কোকাকোলা কোঠায়, কিভাবে কেমন করে উৎপাদন করা হয় সে সম্পর্কে আমদের কোন হুঁশজ্ঞান নাই। আমরা শুধু খাই বা পান করি। আর পাশ্চাত্য তা বেচাবিক্রি করে। সংক্ষপে কোকাকোলা উপমা দিয়ে বোঝাতে চাইছি। ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য লিটারেচার করে আমরা তাকে অনুবাদ করে সাহিত্য করি। কিন্তু আমাদের ভাষায়, উপলব্ধিতে কিম্বা সাহিত্যের ইতিহাসে ধারণাটির যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আছে আমরা তা খোঁজ করে দেখি নি। তাকে পরখ বা পর্যালোচনা করা তো দূরের কথা। লিটারেচারের ধারণাকে নির্বিচারে গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাকে অনুবাদ সাহিত্য বলে চালিয়ে দিয়েছি। সহিত থেকে সাহিত্য কথাটার মর্ম বোঝার চেষ্টা করি নি। লিটারেচার অর্থেই আমরা সাহিত্য কথাটা এখনও ব্যবহার করি। প্রতিপক্ষ যখন শুধুই সাহিত্য ম্যাগাজিন ছিল তখনও ইংরেজি লিটারেচার কথাটার অনুবাদ আমরা ‘সাহিত্য’ করব কিনা তর্ক উঠেছিল।
লিটারেচার একটি আধুনিক ধারণা
লিটারেচার একটি আধুনিক ধারণা, ফলে এর বিচারও অনেকাংশে আধুনিকতা-বিচারের অন্তর্গত। কিন্তু সেই দিকে এখন এখানে যাচ্ছি না। এটা তো বোঝাই যায় ‘লিটারেচার’ কোন হাওয়াই ধারণা না। তার দেশকালপাত্র আছে। আধু্নিকতার মধ্যেই তার আবির্ভাব ও বিকাশ। আধুনিকতার একটা ভাবগত আছে, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা নিয়ে এখানে কালক্ষেপ করবো না, সেটা এখানে জোর দেব টেকনলজি বা কৃৎকৌশলের ওপর। যাকে আমরা সাধারণত ‘মাধ্যম’ বলে এড়িয়ে যাই, কিম্বা অপরিচ্ছন্ন করে ফেলি। যেমন, শিল্পমাধ্যম। অনুমান হচ্ছে মাধ্যম একান্তই একটি উপায় – শিল্পের চর্চা, মর্ম নির্ণয়ে বা অর্থোৎপাদনে এর কোন ভূমিকা নাই। মার্শাল মাকলুহানের ‘মিডিয়া ইজ দ্য মাসাজ’ – বা মাধ্যমই মর্ম নির্ণয় করে, কথাটা বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে শোনা গিয়েছিল, কিন্তু এর প্রতি খুব একটা মনোযোগ কারো দেখি নি। কিন্তু মাকলুহানও এখন আমার আলোচনার বিষয় নয়।
বলা হয় ট্রাজেডি ও মহাকাব্যের যুগ লিটারেচা্রের যুগ নয়
বলা হয় ট্রাজেডি ও মহাকাব্যের যুগ লিটারেচা্রের যুগ নয় – বিশেষত উপন্যাসের যুগ তো নয়ই। উপন্যাস তখনই সম্ভব যখন ভাষা বলতে আমরা যেভাবে মুখের ভাষা বুঝি সেভাবে আর স্মৃতি, শ্রুতি ও কন্ঠের আদানপ্রদান ও এই তিনের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নাই। মূদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, উপন্যাস মানুষ শোনে না, পড়ে। আর পড়া মানে কান বা কণ্ঠ না, চোখের ভূমিকা প্রধান হয়ে ওঠা। যদি এতোটুকু বুঝতে পারি তাহলে কৃৎকৌশল কিভাবে সাহিত্য চর্চার মধ্যেও বিপ্লব ঘটিয়েছে ( নাকি অন্য কিছু) তার খানিক হদিস আমরা করতে পারব। যদি তাই হয় তাহলে সাহিত্যের বিচার সাহিত্যের নিজের ক্ষেত্র ছাড়া একই সঙ্গে কৃৎকৌশল ও নৃতাত্ত্বিক বিচারেরও অন্তর্গত।
আমরা বাস্তবতা বোঝার জন্য লিখি এবং পড়ি’
আপনার বাস্তবতার একেবারে হৃদয়ে আঘাত করে তখন লেখা, চিন্তা করা ও স্বপ্ন দেখা কঠিন। কিন্তু সাহিত্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বাস্তবতা বোঝার জন্য লিখি ও পড়ি। আমরা একটি বাস্তবতা উদ্ভাবনের জন্য লিখি ও পড়ি।
আমাদের সাহিত্য দলবাজদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে
বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলবে না। আমাদের লেখাপড়া একেবারেই নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্য একদল অশিক্ষিত, গ্রাম্য এবং নিম্ন শ্রেণীর দলবাজদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। আমাদের সাহিত্য এখন তলানিতে! কেউ বলে না সে কথা!
বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্ন কেবল সাহিত্যিক কিংবা পাঠকদের নয়, অধিকাংশ বাংলাভাষীর। কারণ, স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি শ্রেণি, বড় পরিসরে ইংরেজিতেই কথা বলে। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাতে করে দেশীয় সংস্কৃতির সংকট তৈরি হচ্ছে। একজন মানুষ একাধিক ভাষা শিখতে পারে এটা দোষের নয় বরং বিরাট গুণ বলা যেতে পারে, কিন্তু অন্য শিখতে গিয়ে যেন মাতৃভাষার অবজ্ঞা না হয় সেদিকেও খেয়াল করতে হবে। খেয়াল করতে হবে যেমন ব্যক্তিকে সেই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও।
সাহিত্যের কি আকাল !!!
আমাদের সমাজ আজ ভীষন অস্থির । কোথাও স্থিতি নাই । সেখানে কবিতা/গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় কই ?আমরা ছুটছি আর ছুটছি । কিসের পেছনে ছুটছি বা কি জন্য ছুটছি কেউ জানি না । তবু ছুটছি ছুটতে হয় ।আজ যদি কেউ কবিতা লিখে কজনে সেটা পড়ে ? আমার দেখা মতে ২০-৩০ বেশী হলে ৫০ জন । অথচ আমার যতটুক জানা আছে ক্ষুদ্র জ্ঞানের গন্ডিতে তাতে জানি, কবিরা কবিতা লিখেন কিংবা সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেন মানুষের জন্য । মানুষ যেন পড়ে উপকৃত হয় । তাদের মূল উপজীব্য হল মানুষ ।আজ সেই মানুষরাই মুখ ফিরিয়ে নিলে বা আমলে না নিলে তারা কিভাবে অনুপ্রেরনা পাবেন
কিন্তু কেন এমন হয় ?
একজন কবি যতটা আবেগ পুঁজি করে একটা কবিতা লিখেন । তার এক-দশমাংশও কি তিনি অন্য লেখায় দেন ? দেন না ।কিন্তু আমরা সেই অস্থির ছুটন্ত লেখাগুলোই গোগ্রাসে গিলি । যত্নের সাথে যা সৃষ্টি করা হয় তার গুরুত্ব দেয়ার সময় কই ?একজন পিতা কখনো বলেন না, আমার ছেলে সাহিত্যিক হবে বা কবি হবে । কবিতা লেখা মানে সময় অপচয় ।আজ অনেক বাবা সাকিব আল হাসান বানাতে চাইলেও কেউ আল মাহমুদ,হুমায়ুন আহমেদ বানাতে চান না !অথচ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে হুমায়ুন স্যারের মত ভালবাসা আর কার ভাগ্য জুটেছে ? কারো ভাগ্য না ।তবু কেউ হুমায়ুন বানাতে চায় না ।
কি দরকার সময় নষ্ট করে !যাক অনেক কিছুই লিখে ফেললাম । যা আমার জন্য স্পর্ধার পর্যায়ে পড়ে । কিন্তু কি করব যখন দেখি হুমায়ুন আহমেদেরহিমু শরৎচন্দ্রের দেবদাস বিভুতিভূষনের পথের পাচালী'র অপু সমরেষের অনিমেষ হতে চাওয়া মানুষেরা নিজের রক্তকে আপন সন্তানকে সাহিত্যে পড়তে বাঁধা দেন । সাহিত্যেক হতে নিষেধ করেন তখন সত্যিই খারাপ লাগে । আর মানতে পারি না ।কত প্রতিভা যে এই বিধি-নিষেধের বেড়াজালে হারিয়ে গিয়ে কালের গহ্বরে জায়গা করে নিয়েছে তার খবর কে রাখে ?জানি এত কিছু লেখা বৃথা । শুধু শুধু তাত্বিকতা ঝাড়া । তবু অন্তরের রোদন দূরীকরনে এই অরন্য রোদন আর কি !
কবিতার ক্ষেত্রে একটি দর্শন থাকা উচিত। যে দর্শনটির সঙ্গে যেন বিজ্ঞান থাকে। বিজ্ঞান যদি সঙ্গে থাকে, তবে সেই দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে স্থাপন করতে পারে। আর এই দুটির সম্মিলিত রূপই সাহিত্য।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষেও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন—এ রকম কবি সাহিত্যিকরা কিভাবে প্রভাব রেখেছেন?
জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই ভাষাকে আমরা তৈরি করলাম। কবিতায় তার প্রথম রূপরেখাটি আমরা প্রকাশ করতে পারলাম। এই কারণে বলা হয় বাংলায় বাংলা ভাষার যে রূপরেখা হচ্ছে তা ভিন্ন। তা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট বা যা কিছু বলেন এক দম ভিন্ন। যদিও আমরা মূল স্রোতের সঙ্গে আছি। যদিও আমরা প্রমিত বাংলায় আমাদের রচনাগুলো প্রকাশ করে আসছি। তারপর কবিতা এখানে একটি বড় কাজ করে গেল ভিতরে ভিতরে আগুনের সঙ্গে পানির মিলন, হাওয়ার সঙ্গে মাটির মিলন তৈরি করে দিল বাংলাদেশের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে জীবন ও সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে?
মুক্তিযুদ্ধ যদি না হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আমাদের ভিতরে না আসত, তাহলে আমাদের সাহিত্যের ভাষা অন্য রকম হয়ে যেত। সাহিত্যের বিষয়বস্তু অন্য রকম হয়ে যেত।’৭১-এর ভাগটি সাহিত্য চেতনায় আমাদের নতুনভাবে ভাবাল। এগুলো সব আপেক্ষিক কথা। আমরা বলি, আমাদের চেতনাপ্রবাহে নতুন করে যে জীবন এলো, সেটার সূত্রপাত আগেই হয়েছিল। ৬৬ সালে তার একটি শিকড় বড় করে গাঁথা হলো—৬৯-এর আন্দোলন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে। ৬৬-এর ছয় দফা এবং ৬৯-এর আন্দোলনে জনজীবন ততখানি প্রভাবিত না হলেও ৭১-এ এসে আমি চেতনার অংশ হিসেবে শহর ও গ্রামকে একত্রিত করে ফেললাম। শহরবাসী গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং শহরবাসী প্রথমে বুঝতে পারল, এই শহর একটি মেকি শহর। এ শহরের সঙ্গে গ্রাম বিযুক্ত। অথচ আমাদের গ্রামের মানুষ, ভাই-বন্ধুরা প্রমাণ করল এই যুদ্ধ বাঙালির সার্বিক যুদ্ধ।
আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের গুরুত্ব কী?
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করার প্রেক্ষাপটে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা এবং সাহিত্য মেলা করার চিন্তা-ভাবনা সবসময় করি এবং করে আসছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক রূপটি আন্তর্জাতিক রূপে পরিগণিত হয় না। এখানে নানা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলার নামে কিছু কিছু কাজ করে। এখানে বড় কাজটি করে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’
নিজেদের কল্পনা করবার সাহসও সাহিত্য দান করতে পারে।
উনবিংশ শতাব্দির ছাপাখানা, সাহিত্য পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস-কবিতা আমাদের নিজেদের ‘বাঙালি’ কল্পনা করতে শিখিয়েছে। পত্রিকা এই কাণ্ড করতে পারে। শুধু সম্বন্ধ তৈরি নয়, বরং নিজেদের নতুন ভাবে কল্পনা করতে ও ভাবতেও শেখায় সাহিত্য। যদি তাই হয় তবে সেটাই চিরায়ত, শাশ্বত ও একমাত্র ‘কল্পনা’ বা চরম সত্য হয়ে বিরাজ করবে তারও কোন কারণ নাই। সাহিত্য বানাতে যেমন জানে, বদলাতেও পারে, পুরানা কল্পনা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে নিজেদের কল্পনা করবার সাহসও সাহিত্য দান করতে পারে।
আমাদের মন ও কল্পনার রূপান্তর শুধু সাহিত্যের গুণে হয়
তবে আমাদের মন ও কল্পনার রূপান্তর শুধু সাহিত্যের গুণে হয়, এই ভাবনাটা প্রাচীন। সেটা সব সময় ইতিবাচক হয়, সেটাও ঠিক না। তবে বাস্তব বা বৈষয়িক জীবনে জার্মানির জোহান্স গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত ছাপাখানার টেকনলজির আবিষ্কারের পর মানুষের ইতিহাস আর আগের মতো থাকে নি। গুটেনবার্গের টেকনলজি বা ছাপাখানার কৃৎকৌশল কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় চর্চা এবং দৈহিক-মানসিক ভূবন বদলায় সেই দিক নিয়ে আজ অবধি আমরা বিশেষ মনোযোগী হতে পারি নি। অর্থাৎ টেকনলজির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে আমরা বাংলাভাষায় খুব একটা ভেবেছি বলে চোখে পড়ে নি।
সাহিত্য সবসময় নিজ নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উৎপাদন করে
অনেকে বলতে পারেন, সাহিত্য সবসময় নিজ নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উৎপাদন করে; ঠিক, কিন্তু কী ধরণের ব্যক্তি বা সমাজ তৈয়ার করে তার বিচার তো দরকার। তার ক্ষেত্র আলাদা। এমন সমাজও সাহিত্য তৈয়ার করতে পারে যা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক। সবই হতে পারে। সাহিত্যের সঙ্গে নীতিনৈতিকতা, রুচি, নান্দনিকতা, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদির তর্ক আছে। নীতি, আদর্শ, কে কী ধরণের ব্যাক্তিত্ব চাই বা কি ধরণের সমাজ আমরা বাসনা করি সেই সকল ভিন্ন তর্ক। এই ক্ষেত্রে বইপুস্তকের তৈয়ারি নিয়ে যে বিচার, সিনেমা-টেলিভিশান বানানোর বিচারও আলাদা কিছু না। কিম্বা চিত্রকলা বা যাত্রার। এই সকল তর্ক আছে। থাকুক। আমরা আপাতত শুধু এতোটুকুই চাইছি যে বইপুস্তকের সাহিত্যই সাহিত্য – আর ভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা — যেমন, সিনেমা বানানো ভিন্ন একটা ব্যাপার — এই অনুমানের অবসান ঘটুক। সাহিত্যের আলোচনাকে বিশেষ একটি মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত করে বিচারের অভ্যাস যতো তাড়াতাড়ি আমরা ত্যাগ করব, গুটেনবার্গের টেকনলজির বাইরে অন্যান্য মাধ্যমের শক্তি ও সীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণাও আরও পরিচ্ছন্ন হবে
তথ্যসুত্র
বাংলাদেশের সাহিত্যের সম্ভাবনা, Dainik Bangla.
প্রতিপক্ষ ও ‘সাহিত্য’, Protipokkho.
কবিতার ক্ষেত্রে একটি দর্শন থাকা উচিত, Ittefaq.
সাহিত্যের কি আকাল, Somewhereinblog.
সাহিত্য দলবাজদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে, The Daily Star.
যুদ্ধের সময়ে সাহিত্য কেন গুরুত্বপূর্ণ’, Risingbd.